বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/দ্বিতীয় প্রবাহ
দ্বিতীয় প্রবাহ
মহারাজের সহিত মহিষীর পরামর্শ হইল। এজিদও কথার সূত্র পাইয়া তাহাতে নানা প্রকার শাখাপ্রশাখা বাহির করিয়া বিশেষ সতর্কতার সহিত আবদুল জব্বারের নিকট ‘কাসেদ’ প্রেরণ করিলেন।
পাঠক! কাসেদ যদিও বার্ত্তাবহ, কিন্তু বঙ্গদেশীয় ডাকহরকরা, কি পত্রবাহক মনে করিবেন না। রাজপুত্র-বাহক, অথচ সভা ও বিচক্ষণ—মহামতি মুসলমান লেখকগণ ইহাকেই ‘কাসেদ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। কাসেদের পরিচ্ছদ সভ্যতাবর্জ্জিত নহে। সুধীর, সুগম্ভীর, সত্যবাদী, মিষ্টভাষী, সুশ্রী না হইলে কেহ কাসেদ-পদে বরিত হইতে পারে না। তবে দূতে ও ‘কাসেদে’ অতি সামান্য প্রভেদ মাত্র, ‘কাসেদ’ দূতের সমতুল্য মাননীয় নহে। বিশেষভাবে মনোনীত করিয়াই আবদুল জব্বারের নিকট কাসেদ প্রেরিত হইয়াছিল। আবদুল জব্বার ভদ্রবংশসম্ভূত, অবস্থাও মন্দ নহে, স্বচ্ছন্দে ভদ্রতা রক্ষা করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিতে পারিতেন; তজ্জন্য পরের দ্বারস্থ হইতে হইত না। কিন্তু তাঁহার ধনলিপ্সা অত্যন্ত প্রবল ছিল। কিসে দশ টাকা উপার্জ্জন করিবেন, কি উপায়ে নিজ অবস্থার উন্নতি করিবেন, কি কৌশলে ঐশ্বর্য্যশালী হইয়া অপেক্ষাকৃত অধিকতর সুখস্বাচ্ছন্দ্যে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিবেন, এই চিন্তাই সর্ব্বদা তাঁহার মনে জাগরূক ছিল। তাঁহার একমাত্র স্ত্রী জয়নাব স্বামীর অবস্থাতেই পরিতৃপ্তা ছিলেন, কোন বিষয়েই তাঁহার উচ্চ আশা ছিল না। যে অবস্থাতেই হউক, সতীত্বধর্ম্ম পালন করিয়া সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করাই তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল। ধর্ম্ম-চিন্তাতেও তিনি উদাসীন ছিলেন না। আবদুল জব্বার সুশ্রী পুরুষ না হইলেও তাঁহার প্রতি তিনি ভক্তিমতী ছিলেন। স্বামীপদ-সেবা করাই স্বর্গলাভের সুপ্রশস্ত পথ, তাহা তাঁহার হৃদয়ে সর্ব্বদা জাগরূক ছিল। লৌকিক সুখে তিনি সুখী হইতে ইচ্ছা করিতেন না, ভালও বাসিতেন না; ভ্রমেও ধর্ম্মপথ হইতে এক পদ বিচলিত হইতেন না। আবদুল জব্বার নিজ অদৃষ্টকে ধিক্কার দিয়া সময়ে সময়ে এজিদের ঐশর্য্য ও এজিদের রূপলাবণ্যের ব্যাখ্যা করিতেন। তাহাতে সতী-সাধ্বী জনাব মনে মনে নিতান্ত ক্ষুন্ন হইতেন। নিতান্ত অসহ্য হইলে বলিতেন,—“ঈশ্বর যে অবস্থায় যাহাকে রাখিয়াছেন তাহাতেই পরিতৃপ্ত হইয়া কায়মনে তাহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা কর্ত্তব্য। পরের ধন, পরের রূপ দেখিয়া নিজ অদৃষ্টকে ধিক্কার দেওয়া বুদ্ধিমানের কর্ত্তব্য নহে। দেখুন, জগতে কত লোক যে, আপনার অপেক্ষা দুঃখী ও পর-প্রত্যাশী আছে, তাহা গণনা করা যায় না। ঈশ্বরের বিবেচনা অসীম। মানুষের সাধ্য কি যে, তাঁহার বিবেচনায় দোষার্পণ করিতে পারে? তবে অজ্ঞ মনুষ্যগণ না বুঝিয়া অনেক বিষয়ে তাঁহার কৃতকার্য্যের প্রতি দোষারোপ করে। কিন্তু তিনি এমনি মহান, এমনি বিবেচক, যাহার যাহা সম্ভবে, যে যাহা রক্ষা করিতে পারিবে, তিনি তাহাকে তাহাই দিয়াছেন। তাঁহার বিবেচনায় তিনি কাহাকেও কোন বিষয়ে বঞ্চিত করেন না। কৃতজ্ঞতার সহিত তাঁহার গুণানুবাদ করাই আমাদের সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।”
স্ত্রীর কথায় আবদুর জব্বার কোন উত্তর করিতেন না, কিন্তু কথাগুলি বড় ভাল বোধ হইত না। তাঁহার মত এই যে, ধনসম্পত্তিশালী না হইলে জগতে সুখী হওয়া যাইতে পারে না; সুতরাং তিনি সর্ব্বদাই অর্থচিন্তায় ব্যস্ত থাকিতেন, ব্যবসায়-বাণিজ্যে যখন যাহা সুবিধা মনে করিতেন তখন তাহাই অবলম্বন করিতেন। নিকটস্থ বাজারে অন্যান্য ব্যবসায়িগণের নিকট প্রায় সর্ব্বদা উপস্থিত থাকিয়া তিনি অর্থোপার্জ্জনের পথ অনুসন্ধান করিতেন, কেবল আহারের সময় বাটী আসিতেন; আহার করিয়া পুনরায় কার্য্যস্থানে গমন করিতেন। আজ জয়নাব স্বামীর আহারীয় আয়োজনে ব্যস্ত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র রন্ধন-কার্য্য সমাধা করিলেন এবং স্বামীর সম্মুখে ভোজ্য বস্তু প্রদান করিয়া স্বহস্তে ব্যজন করিতে লাগিলেন। স্বামী যাহাতে সুখে আহার করিতে পারেন, সে পক্ষে সেই সাধ্বী সতী পরম যত্নবতী। একে উত্তপ্ত প্রদেশ, তাহাতে জ্বলন্ত অনলের উত্তাপ, এই উভয় তাপে জয়নাবের মুখখানি রক্তবর্ণ ধারণ করিয়াছে, ললাটে ও নাসিকার অগ্রভাগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তার ন্যায় ঘর্ম্মবিন্দু শোভা পাইতেছে। গণ্ডদেশ বহিয়া বুকের বসন পর্য্যন্ত ভিজিয়া গিয়াছে। পৃষ্ঠবসনের ত কথাই নাই, এত ভিজিয়াছে যে, সে সিক্তবাস ভেদ করিয়া পৃষ্ঠদেশের সুদৃশ্য কান্তি ফুটিয়া বাহির হইয়াছে। পরিহিত বস্ত্রের স্থানে স্থানে কালির চিহ্ন। এই সকল দেখিয়া আবদুল জব্বার বলিলেন, “তুমি যে বল, ঈশ্বর যে অবস্থায় রাখেন, সেই অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হয়; কিন্তু তোমার এ অবস্থা দেখিয়া আমি কি প্রকারে সন্তুষ্ট থাকিতে পারি, বল দেখি? আমি যদি ধনবান হইতাম, আমার যদি কিছু অর্থের সংস্থান থাকিত, তাহা হইলে তোমার এত কষ্ট কখনই হইত না। স্থানবিশেষে, পাত্রবিশেষে ঈশ্বরের বিবেচনা নাই, এইটিই বড় দুঃখের বিষয়। তোমার এই শরীর কি আগুনের উত্তাপ সহনের যোগ্য? এই শরীরে কি এত পরিশ্রম সহ্য হয়? দেখ দেখি, এই দর্পণখানিতে মুখখানি একবার দেখ দেখি, কিরূপ দেখাইতেছে।”
আবদুল জব্বার এই কথা বলিয়া বাম হস্তে একখানি দর্পণ লইয়া স্ত্রীর মুখের কাছে ধরিলেন। জয়নাব তৎপ্রতি লক্ষ্য না করিয়া দর্পণখানি গ্রহণ পূর্ব্বক উপবেশন-স্থানের এক পার্শ্বে রাখিয়া দিলেন। গম্ভীর বদনে বলিলেন, “স্ত্রীলোকের কার্য্য কি?”
আবদুল জব্বার বলিলেন, “তাহা আমি জানি। আমার অবস্থা ভাল হইলে আমি অসংখ্য দাসদাসী রাখিয়া দিতাম; তাহার সকল কার্য্য করিত। তোমাকে এত পরিশ্রম, এত কষ্ট কখনই সহ্য করিতে হইত না।”
জয়নাব বলিলেন, “আপনি যাহাই বলুন, আমি তাহাতে সুখী হইতাম না। আপনি বোধ হয় স্থির করিয়াছেন যে, যাহাদের অনেক দাস-দাসী আছে, মণিমুক্তার অলঙ্কার আছে, বহুমূল্য বস্ত্রাদি আছে, তাহারাই জগতে সুখী—তাহা মনে করিবেন না; মনের সুখই যথার্থ সুখ।”
আবদুল জব্বার বলিলেন, “ও কোন কথাই নহে। টাকা থাকিলে সুখের অভাব কি? আমি যদি এজিদের ন্যায় ঐশ্বর্য্যশালী হইতাম, তোমাকে কত সুখে রাখিতাম, তাহা আমি জানি আর আমার মনই জানে। ঈশ্বর টাকা দেন নাই, কি করিব, মনের সাধ মনেই রহিয়া গেল।”
গম্ভীর বদনে জয়নাব কহিলেন, “ও কথা বলিবেন না। শাহজাদা এজিদের ন্যায় আপনি ক্ষমতাবান বা ধনবান হইলে আমার ন্যায় কুশ্রী স্ত্রীর প্রতি আপনার ভালবাসা জন্মিত না। আপনারই নয়ন আমাকে দেখিয়া ঘৃণা করিত। ঈশ্বরের সৃষ্টি অতি বিচিত্র। কাহাকেও তিনি সীমাবিশিষ্ট করিয়া রূপবতী করেন নাই। উচ্চাসনে বসিলে আপনার মন সেইরূপ উচ্চরূপেই মোহিত হইত। অবস্থার পরিবর্ত্তনে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়।”
“অবস্থার পরিবর্ত্তন হইলেই কি প্রণয়, মায়া, মমতা, ভদ্রতা ও সুহৃদ ভাবের পরিবর্ত্তন হয়?”
“হীন অবস্থার পরিবর্ত্তনে অবশ্য কিছু পরিবর্ত্তন হয়,—কিছু কেন? প্রায়ই পরিবর্ত্তন হইয়া থাকে। চারিদিকে চাহিলেই অনেক দেখিতে পাইবেন। যাহারা ধনপিপাসু, অর্থকেই যাহারা ইহকাল-পরকালের সুখসাধন মনে করে, অর্থলোভে অতি জঘন্য কার্য্য করিতে তাহারা একটুও চিন্তা করে না, অতি আদরের ও যত্নের ভালবাসা জিনিসটিও অর্থলোভে বিসর্জ্জন দিতে কিছুমাত্র অপেক্ষা করে না।
কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়া আবদুল জব্বার কহিলেন, “এ কথাটা এক প্রকার আমাতেই বর্ত্তিল। তুমি যাহাই বল, জগতের সমুদয় অর্থ, সমুদয় ঐশ্বর্য্য একত্র করিয়া আমার সম্মুখে রাখিলেও আমি আমার ভালবাসাকে পরিত্যাগ করিতে পারিব না। সকলেরই মুল্য আছে, ভালবাসার মূল্য নাই। যখন মূল্য নাই, তখন আর তাহার সঙ্গে অন্য বস্তুর তুলনা কি, কথাই বা কি?”
আবদুল জব্বারের আহার শেষ হইল। রীতিমত হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া বাবসায়ের হিসাবপত্রাদি লইতে তিনি ব্যতিব্যস্ত হইলেন ও যেখানে বাহা রাখিয়াছেন, একে একে সংগ্রহ করিলেন। ব্যবসায়ের সাহায্যকারী অথচ নিকট আত্মীয় ওস্মানের নাম করিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “এখনও আসিল না। আজ অনেক অসুবিধা হইবে। আর কতক্ষণ বিলম্ব করিব?”—এই কথা বলিয়াই বাটী হইতে যাত্রা করিবেন, এমন সময়ে ওস্মান অতি ব্যস্তভাবে আসিয়া বলিলেন, “আবদুল জব্বার! দামেস্ক হইতে একজন কাসেদ আসিয়াছে—অত্যন্ত ব্যস্ত, অতিশয় পরিশ্রান্ত, অতিশয় ক্লান্ত। সেই লোক তােমাকেই অম্বেষণ করিতেছে, তােমার বাসস্থানের অনুসন্ধান না পাইয়া অনেক ঘুরিয়াছে। শুনিলাম, তাহার নিকট দামেস্কাধিপতির আদেশপত্র আছে।”
ওস্মানের মুখে এই কথা শুনিয়া আবদুল জব্বার শশব্যস্তে বাটীর বাহিরে আসিলেন। কাসেদ ঈশ্বরের গুণানুবাদ করিয়া দামেস্কাধিপতির বন্দনার পর অতি বিনীতভাবে আবদুল জব্বারের হস্তে শাহী-নামা প্রদান করিলেন।
আবদুল জব্বার শত শত বার সেই শাহী-নামা চুম্বন ও মন্তকোপরি ধারণ করিয়া কাসেদের যথাযোগ্য অভ্যর্থনা করিলেন। অনন্তর তিনি শাহীনামহস্তেই অন্তঃপুর-মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন; তথায় উপস্থিত হইয়া বিশেষ ভক্তিসহকারে শাহী-নামাখানি পাঠ করিলেন। তাহাতে লিখিত আছে,
“সম্ভ্রান্ত আবদুল জব্বার!
তােমাকে জানান যাইতেছে যে, দামেস্কাধিপতি তােমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে তোমাকে স্মরণ করিয়াছেন। অবিলম্বে রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া রাজপ্রসাদলাভে সৌভাগ্য জ্ঞান কর।
আবদুল জব্বার এতৎ পাঠে মহাসৌভাগ্য জ্ঞান করিয়া জয়নাবকে কহিলেন, “আমি এখনই দামেস্কযাত্রা করিব। আমি এমন কি পুণ্য কার্য্য করিয়াছি যে, স্বয়ং বাদশাহ্ আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন! ঈশ্বর জানেন, ভবিষ্যতে কি আছে!”
আবদুল জব্বারের এই সংবাদ শ্রবণে প্রতিবেশীরা সকলেই অশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। আবদুল জব্বারের মহাসৌভাগ্য! সকলেই শাহী-নামা মহামান্য মস্তকোপরি রাখিয়া দামেস্ক-সিংহাসনের গৌরবরক্ষা করিলেন। সকলেই একবাক্যে আবদুল জব্বারের গুণানুবাদ করিয়া কহিলেন, “আবদুল জব্বারের কপাল ফিরিল”; সমবয়সীরা বলিতে লাগিল, “ভাই, তুমি ত ভাগ্যগুণে বাদশাহের নিকট পরিচিত হইলে, সম্মানের সহিত রাজদরবারেও আহূত হইলে; আমাদের কথা মনে রাখিও।”
আবদুল জব্বার ব্যতিব্যস্ত হইয়া রাজধানী গমনে উদ্যোগী হইলেন। আত্মীয়স্বজন এবং সাধারণ প্রতিবেশিগণের নিকট ও জয়নাবের সমক্ষে তিনি বিনম্রভাবে বিদায় গ্রহণ করিলেন। শাহী দরবারে গমনোপযোগী যে সকল বসন তাঁহার ছিল, তৎসমস্ত সংগ্রহ করিয়া বাহক-বাহন-সমভিব্যাহারে দামেস্কনগরাভিমুখে গমনার্থ তিনি প্রস্তুত হইলেন। প্রতিবেশিবর্গ সহাস্যবদনে তাঁহার প্রশংসাগান কীর্ত্তন করিতে করিতে স্ব-স্ব আবাসে চলিয়া গেলেন। জয়নাবের চক্ষু দুইটি বাষ্পসলিলে পরিপূর্ণ হইল। মনের উল্লাসে আবদুল জব্বার তৎকালে এতদূর বিহ্বল হইলেন যে, যাত্রাকালে প্রিয়তমা জয়নাবকে একটি মনের কথাও বলিয়া যাইতে মনে হইল না; সামান্যতঃ বিদায় গ্রহণ করিয়াই ত্বরিত গতিতে রাজদর্শনে যাত্রা করিলেন। পদমর্য্যাদার এমনই কুহক!