বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/তৃতীয় প্রবাহ

তৃতীয় প্রবাহ

 এজিদের শিরায় শিরায়, শোণিতবিন্দুর প্রতি পরমাণু-অংশে, প্রতি শ্বাসপ্রশ্বাসে, শয়নে, স্বপ্নে, জয়নাব-লাভের চিন্তা অন্তরে অবিরতভাবে রহিয়াছে। কিন্তু সে চিন্তার উপরেও আর একটি চিন্তা মস্তিষ্কমধ্যে ঘুরিতেছে। এক সময়ে এক মনে দুই প্রকারের চিন্তা অসম্ভব। কিন্তু মূলকার্য্যের কৃতকার্য্যতা-লাভের আশায় অন্য একটি চিন্তা বা কল্পনাকে আশ্রয় করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ না হওয়া যায়, এরূপ নহে। প্রথম চিন্তায় কৃতকার্য্য হইবার আশাতেই বাহ্যিক চিন্তাই প্রবল হইয়া উঠে। চিন্তার আধার মস্তক, কিন্তু ভালবাসার চিন্তাটুকু মস্তকে উদিত হইয়াই একেবারে হৃদয়ের অন্তঃস্থান অধিকার করিয়া বসে। তাহা যখনই মনে উদিত হয়, অন্তরে ব্যথা লাগে, হৃৎপিণ্ডে আঘাত করে, হৃদয়তন্ত্রী বেহাগ রাগে বাজিয়া উঠে। এজিদ আপাততঃ বাহ্য চিন্তাতেই মহাব্যস্ত। কারণ, এই চিন্তার মধ্যে আশা, ভরসা, নিরাশা সকলই রহিয়াছে। কাজেই পূর্ব্বভাবের কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন বোধ হইতেছে। এজিদের নয়নে, ললাটে ও মুখশ্রীতে যেন ভিন্ন ভাব অঙ্কিত। দেখিলেই বোধ হয়, যেন কোন দগ্ধীভূত বিকৃত ধাতুর উপরে কিঞ্চিৎ রজতের পাকা গিল্টি হইয়াছে। হঠাৎ দেখিলেই চাকচিক্যবিশিষ্ট রজতপাত্র বলিয়াই ভ্রম জন্মে, কিন্তু মনোনিবেশ করিয়া লক্ষ্য করিলে, সমাবৃত বিকৃত ধাতুর পরমাণু অংশ নয়নগোচর হইয়া চাক্‌চিক্যবিশিষ্ট উজ্জ্বলভাব যেন বহু দূরে সরিয়া যায়। পুরবাসিগণ এবং অমাত্যগণ সকলেই রাজপুত্রের তাদৃশ বাহিক প্রসন্নভাব দর্শন করিয়া মহা আনন্দিত হইলেন।

 মারওয়ান যদিও প্রধান মন্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু এজিদের বুদ্ধি, বল, সহায়, সাহস ইত্যাদি যত কিছু,সকলই মারওয়ান। প্রধান মন্ত্রী হামান কেবল রাজকার্য্য ব্যতীত সাংসারিক অন্য কোন কার্য্যে মারওয়ানের মতে বাধা দিতে পারিতেন না, কারণ তিনি এজিদের প্রিয়পাত্র। সকল সময়েই সকল বিষয়েই মারওয়ানের সহিত এজিদের পরামর্শ হইত। সে পরামর্শের সময় অসময় ছিল না। কি পরামর্শ, তাহা তাঁহারাই জানিতেন।

 মারওয়ান বলিলেন, “রাজকুমার! মহারাজ বর্ত্তমান না থাকিলে আপনাকে কখনই এত কষ্ট পাইতে হইত না।”

 এজিদ বলিলেন, “পুত্রের স্বাধীনতা কোথায়? কি করি, পিতা বর্ত্তমানে পিতার অমতে কোন কার্য্যে অগ্রসর হওয়া পুত্রের পক্ষে অনুচিত। আমি হাসান-হোসেনের ভক্ত নহি, শাহজাদা বলিয়া মান্য করি না; নতশিরে তাহদের নামে দণ্ডবৎ করি না; সেইজন্য পিতা মহাবিরক্ত। আবার অন্যায় বিচারে একজনের প্রাণ বধ করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করিতে সাহস হয় না, ইচ্ছাও করে না। লোকাপবাদ—তাহার পর পরলোকের দণ্ড! আর কেন? মহারাজ যে একটু ইঙ্গিত করিয়াছেন, তাহাতেই ত মনস্কামনা সিদ্ধি—আর কি চাই? ধর্ম্মবিরুদ্ধ না হইলে কোন কার্য্যে তিনি বাধা দিবেন না; ইহাই যথেষ্ট। যে মন্ত্রণা করিয়া কার্য্য আরম্ভ করা হইয়াছে, যদি কৃতকার্য্য হইতে পারি, তবে আর অন্য পথে যাইবার আবশ্যক কি? একটা গুরুতর পাপভার মাথায় বহন করিবারই বা প্রয়োজন কি? নরহত্যা মহাপাপ।”

 হঠাৎ সাদিয়ানা বাদ্য বাজিয়া উঠিল। এজিদ কহিলেন, “অসময়ে আনন্দবাদ্য কি জন্য? বুঝি আবদুল জব্বার আসিয়া থাকিবে।” উভয়ে একটু ত্রস্তভাবে দরবার অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। রাজকর্ম্মচারিগণের প্রতি যে যে প্রকার আদেশ দেওয়া হইয়াছিল, তৎসমস্তই প্রতিপালিত হইয়াছে। কোন বিষয়ে বিশৃঙ্খলা হয় নাই। দরবার পর্য্যন্ত গমনপথে শ্রেণীবদ্ধ সৈন্যগণ এখনও পর্য্যন্ত যথাস্থানে দণ্ডায়মান। তদ্দর্শনে তাঁহারা আরও অধিকতর উৎসাহে দ্রুতগতিতে গমন করিতে লাগিলেন। পথে কাসেদের সহিত দেখা হইল। কাসেদ সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিয়া নিবেদন করিলেন, “রাজাদেশ প্রতিপালিত হইয়াছে। আবদুল জব্বার সমাদরে গৃহীত হইয়াছেন। মহারাজ আম-দরবার বরখাস্ত করিয়া আবদুল জব্বারের সহিত খোশমহলে বার দিয়াছেন।” এই কথা বলিয়া কাসেদ পুনরায় অভিবাদন পূর্ব্বক যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন।

 এজিদ মারওয়ানের সহিত আনন্দ-মন্দিরে উপস্থিত হইয়া মহারাজাকে অভিবাদন করিলেন এবং রাজাজ্ঞা প্রাপ্তিক্রমে নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপবেশন করিয়া আবদুল জব্বারের সহিত মহারাজের কথোপকথন শুনিবার অপেক্ষায় উৎসুক রহিলেন।

 আবদুল জব্বার বিশেষ সতর্কতার সহিত জাতীয় সভ্যতা রক্ষা করিয়া করজোড়ে মহারাজ সমীপে বসিয়া আছেন। পুত্রের পরামর্শমত এজিদের জননী স্বামীর নিকট যাহা বলিয়াছিলেন, যে প্রকার কথার প্রস্তাব করিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন, মাবিয়া অবিকল সেইরূপ বলিতে লাগিলেন,—“আবদুল জব্বার। আমার ইচ্ছা, তোমাকে আমি সর্ব্বদা আমার নিকটে রাখি। কোন প্রকার রাজকার্য্যে নিযুক্ত রাখিতে ইচ্ছা করি না। কারণ, তাহাতে সময়ে সময়ে নানা প্রকার চিন্তায় চিন্তিত হইতে হইবে, মন্ত্রিদলের আজ্ঞানুবর্ত্তী হইতে হইবে। অথচ রাজনীতি অনুসারে কোন প্রকার পদমর্য্যাদা রক্ষা করা তোমার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিবে। কাজেই সকলের নিকট হাস্যাস্পদ হওয়ারই সম্ভাবনা। আমার ইচ্ছা যে, তোমাকে নিশ্চিতভাবে রাজপরিবারের মধ্যে রাখিয়া দিই।”

 করজোড়ে আবদুল জব্বার বলিলেন, “আমি দাসানুদাস, আজ্ঞাবহ ভৃত্য; যাহা আদেশ করিবেন, শিরোধার্য্য করিয়া প্রতিপালন করি। আমার নিতান্ত সৌভাগ্য যে, আমি আমার আশার অতিরিক্ত আদৃত হইয়া রাজসমীপে উপবেশনের স্থান পাইয়াছি।”

 মাবিয়া বলিলেন, “আবদুল জব্বার। আমার মনোগত অভিপ্রায় প্রধান উজীর মারওয়ানের মুখে শ্রবণ করিয়া তোমার প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন কর। আমার উপাসনার সময় অতীতপ্রায়, আমি আজিকার মত বিদায় লইলাম।”

 এই বলিয়াই মাবিয়া খোশমহল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। মন্ত্রী মারওয়ান বাদশাহের প্রতিনিধিস্বরূপ বলিতে লাগিলেন, “মাননীয় আবদুল জব্বার সাহেব! আমাদের ইচ্ছা যে, রাজসংসার হইতে আপনার নিত্য-নিয়মিত রাজোচিত ব্যয়োপযোগী সম্পত্তি প্রদানপূর্ব্বক অদ্বিতীয় রূপযৌবনসম্পন্ন, বহুগুণবতী, নিষ্কলঙ্কচন্দ্রাননা, মহামাননীয়া রাজকুমারী সালেহার সহিত শাস্ত্রসঙ্গত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করিয়া এই দামেস্ক নগরে আপনাকে স্থায়ী করি। ইহাতে আপনার মত কি?”

 কর্ণে এই কথা প্রবেশ করিবামাত্র আবদুল জব্বার মনের আনন্দে বিভ্রান্ত হইয়া কিছুই উত্তর করিতে পারিলেন না। এজিদের ভগ্নী সালেহার পাণিগ্রহণ করিবেন, স্বাধীনভাবে ব্যয়বিধানের জন্য সম্পত্তি প্রাপ্ত হইবেন, ইহা অপেক্ষা সুখের বিষয় আর কি আছে? জীবনে যাহা তিনি আশা করেন নাই, স্বপ্ন যে অমূলক চিন্তা, সে স্বপ্নেও কোন দিন যাহা উপদেশ পান নাই, অভাবনীয়রূপে আজ তাহাই তঁহার ভাগ্যে ঘটিল! ঈশ্বর সকলই করিতে পারেন। মন্ত্রিমুখে এই বাক্য শ্রবণ করিয়া আবদুল জব্বার যেন ক্ষণকালের জন্য আত্মহারা হইলেন; তখনই সম্মতিসূচক অভিপ্রায় জানাইতেন, কিন্তু হর্ষবিহ্বলতা আশু তাঁহার বাক্‌শক্তি হরণ করিল। ক্ষণকাল পরে বলিলেন, “মন্ত্রিবর। আমার পরম সৌভাগ্য। রাজাদেশ শিরোধার্য্য।”

 মারওয়ান বলিলেন, “আপনার অঙ্গীকারে আমরাও পরমানন্দ লাভ করিলাম। সমস্তই প্রস্তুত, এখনই এই সভায় এই শুভলগ্নে শুভকার্য্য সুসম্পন্ন হউক।”

 পূর্ব্ব হইতেই এজিদ সমস্ত প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছেন। মারওয়ানকে ইঙ্গিত করিবামাত্র পুরোহিত, অমাত্যবর্গ, পরিজনবর্গ সকলেই একসঙ্গে উপস্থিত হইলেন। মঙ্গলবাদ্য বাজিতে লাগিল। পুরোহিতের আদেশমত এজিদ পাত্রীপক্ষের প্রতিনিধি সাব্যস্ত হইলেন; মারওয়ান এবং আবদুর রহমান সাক্ষী হইলেন।

 এই স্থানে হিন্দু পাঠকগণের নিকট কিছু বলিবার আছে। আমাদের বিবাহ-প্রথা একটু সংক্ষেপে বুঝাইয়া না দিলে, এ উপস্থিত বিবাহ-বিষয় বুঝিতে একটু আয়াস আবশ্যক হইবে। আমাদের বিবাহ না হওয়া পর্য্যন্ত পাত্রপক্ষীয় কোন পুরুষ কি স্ত্রীর পাত্রীকে দেখিবার প্রথা নাই।

 পাত্র পূর্ণবয়স্ক হইলে পুরোহিতের উপদেশক্রমে, যে দেশে হউক-না, কয়েকটি কথা আরবীয় ভাষায় উচ্চারণ করিতে হয়। পাত্রীপক্ষীয় অভিভাবকগণের মনোনীত প্রতিনিধিকে পাত্রের সেই কথাগুলির প্রত্যুত্তরস্বরূপ কয়েকটি কথা বলিতে হয়। বিবাহের মূল কথাই এই—প্রস্তাব আর স্বীকার (ইজাব-কবুল)। পাত্রী যে বিবাহে সম্মত হইয়াছেন, তাহার প্রমাণস্বরূপ দুইটি সাক্ষীর প্রয়োজন। তদ্ভিন্ন আমাদের বিবাহে অন্য কোন প্রকার ধর্মার্চ্চনা, কি মন্ত্রপাঠ, কি অন্য কোন প্রকারের ক্রিয়া কিছুই নাই। তবে লৌকিক প্রথানুসারে ধর্ম্মভাবে শিথিলপ্রযত্ন ব্যক্তিগণ, কি কেহ, আমোদর অঙ্গ মনে করিয়া যে কিছু অনুষ্ঠান করেন, তাহা শাস্ত্রসম্মত নহে। তাহা না করিলেও বিবাহ-বন্ধনের সুদৃঢ় গ্রন্থি শিথিল হয় না। নিয়ম-লঙ্ঘন-দোষে কোন প্রকার অমঙ্গল ভয়েও কোন পক্ষকে ভয়াতুর হইতে হয় না।

 প্রস্তাব বাহুল্যভয়ে এতদ্বিষয়ের আর অধিক আড়ম্বর নিষ্প্রয়োজন বোধ করি। তবে একটি স্থূল কথা ‘দেনমোহর’। অধুনা যে প্রকার লক্ষ লক্ষ টাকার দেনমোহর-প্রথা ভারতে মুসলমান-সমাজে প্রচলিত হইয়াছে, যে প্রথানুসারে স্বামীর যথাসর্ব্বস্ব কন্যার কোষগত করিয়া স্বামীকে পথের ভিখারী করা হইতেছে, তাহা বড় ভয়ঙ্কর। বৃটিশ-বিধিও যদি এই ধর্ম্মসংক্রান্ত এবং শাস্ত্রসঙ্গত ব্যাপারে কেবলমাত্র স্বীকার-উক্তির জন্যই যথার্থ টাকার দায়িত্ব স্বীকারের অপরাধে স্বামীকে দায়ী করিয়া তাহার পৈত্রিক সম্পত্তি, আবাসভূমি বিক্রয়, পরিশেষে দেহ পর্য্যন্ত বন্দিশ্রেণীর সহিত কারাগারে আবদ্ধ করিয়া যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে থাকেন; তবে তাহা নিতান্ত আক্ষেপের বিষয়। আমাদেরও দোষ না আছে, এরূপ নহে। আপন আপন দুহিতার ভবিষ্যৎ হিত কামনায় আমরা ক্রমে “মোহরানার” সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি করিতেছি! যাঁহারা ঐহিক, পারত্রিক উভয় রাজ্যের রাজা, সেই প্রভু মোহাম্মদের পরিবারগণের মোহরানার সংখ্যা এত অল্প ছিল যে, পাঠকগণ শুনিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন। প্রভু মোহাম্মদের কন্যা, হাসান-হোসেনের জননী বিবি ফাতেমার দেনমোহর আধুনিক পরিমাণ মুদ্রার হিসাব-অনুসারে চারি টাকা চারি আনার বেশী ছিল না।

 পাত্রীর সম্মতিসূচক স্বীকারবাক্য স্বকর্ণে শ্রবণ করিবার জন্য প্রতিনিধি মহাশয় সাক্ষীসহ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহারা সভায় প্রত্যাগত হইয়া জাতীয় রীত্যনুসারে সভাস্থ সভ্যগণকে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলেন, “বিবি সালেহা এ বিষয়ে অসম্মত নহেন, কিন্তু তাঁহার একটি কথা আছে। সে কথা এই যে, তিনি লোক-পরম্পরায় শুনিয়াছেন, এই মাননীয় সন্ত্রান্ত আবদুল জব্বার সাহেবের জয়নাব নামে একটি স্ত্রী আছেন, ধর্ম্মানুসারে জয়নাবকে পরিত্যাগ না করিলে তিনি এ বিবাহে সম্মতি দান করিতে পারেন না।” আরও তিনি বলিলেন, “জয়নাবের যত দেনমোহরের জন্য আবদুল জব্বার দায়ী, তাহার পরিমাণ তিনি জানিতে চাহেন ও জয়নাবের ভরণ-পোষণের জন্য অতিরিক্ত আরও সহস্র মুদ্রা প্রদানেও তিনি প্রস্তুত আছেন।” এই প্রস্তাবে হয়ত অনেকেরই মস্তক ঘুরিয়া যাইত, চিন্তাশক্তির পরীক্ষা হইত, আন্তরিক ভাবেরও পরীক্ষা হইত, কিন্তু আবদুল জব্বারের বিবেচনাশক্তি এতদূর প্রবল যে, তিনি অগ্রপশ্চাৎ ভাবিবার জন্য তাঁহার চিন্তাশক্তিকে ক্ষণকালের নিমিত্ত বিচলিত করিলেন না। যেমনি প্রশ্ন তেমনি উত্তর।

 আবদুল জব্বার বলিলেন, “আমি সম্মত আছি। মুখের কথা কেন, তালাকনামা (স্ত্রী-পরিত্যাগ-পত্র) এখনই লিখিয়া দিতেছি।”

 লেখনী ও কাগজ সকলই প্রস্তুত ছিল। আবদুল জব্বার প্রথমে পরমেশ্বরের নাম, পরে প্রভু মোহাম্মদের নাম লিখিয়া পতিপরায়ণা নিরপরাধিনী সতীসাধ্বী সহধর্ম্মিণী জয়নাবকে তালাক দিলেন। সভাস্থ অনেক মহোদয় সাক্ষিশ্রেণীতে স্ব-স্ব নাম স্বাক্ষর করিলেন। প্রতিনিধির হস্ত দিয়া সেই তালাকনামাখানি সালেহার নিকট প্রেরিত হইল। প্রতিনিধি পুনরায় সাক্ষীসহ অন্তঃপুরে গমন করিলেন। সভাস্থ সকলেই প্রফুল্লচিত্তে সুস্থির হইয়া বসিলেন; নূতন রাগে, নূতন তালে আনন্দবাদ্য বাজিতে লাগিল। বিবাহসভা সম্পূর্ণরূপেই আনন্দময়ী। আবদুল জব্বারের ভবনে জয়নাবের হৃদয়তন্ত্রী ছিড়িয়া গেল। জলপূর্ণ আঁখি দুইটি বোধ হয় জলভারে ডুবিল। আবদুল জব্বারের প্রত্যুত্তর অবধি তালাকনামা লিখিয়া প্রতিনিধির হস্তে অর্পণ করা পর্য্যন্ত জয়নাবের মুখশ্রীর ও তাঁহার অজ্ঞাত বিপদ সময়ে চিত্তচাঞ্চল্যের প্রকৃত ছবি প্রকৃতরূপে বিচিত্র করিয়া পাঠকগণকে দেখাইতে পারিলাম না। কারণ, তাহা কল্পনাশক্তির অতীত—মসী-লেখনীর শক্তিবহির্ভূত।

 প্রতিনিধি ফিরিয়া আসিলেন, পূর্ব্ব রীত্যনুসারে সভাস্থ সকলকেই পুনরভিবাদন করিয়া বলিলেন,—

 “এ সভায় রাজমন্ত্রী, রাজসভাসদ, রাজপারিষদ, রাজাত্মীয়, রাজহিতৈষী, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং বহুদর্শী ব্যক্তিগণ সকলেই উপস্থিত আছেন। সালেহা বিবি যাহা বলিলেন, ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া আমি তাহা অবিকল বলিতেছি, আপনারা মনযোগপূর্ব্বক শ্রবণ করুন।—

 “যে ব্যক্তি ধনলোভে, কি রাজ্যলোভে, কি মানসম্রম-বৃদ্ধির আশায় নিরপরাধিনী সহধর্ম্মিণীকে পরিত্যাগ করিতে পারে, বহুকালের প্রণয় ও ভালবাসা যে ব্যক্তি এক মুহূর্ত্তে ভুলিতে পারে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ দাম্পত্য-প্রণয়ের বন্ধন অকাতরে ছিন্ন করিতে পারে, তাহাকে বিশ্বাস কি? তাহার কথায় আস্থা কি? তাহার মায়ায় আশা কি? এমন বিশ্বাসঘাতক স্ত্রী-বিনাশক অর্থলোভী নরপিশাচের পাণিগ্রহণ করিতে সালেহা বিবি সম্মত নহেন।”

 সভাস্থ সকলেই রাজকুমারীর বুদ্ধি ও বিবেচনার প্রশংসা করিতে লাগিলেন। আবদুল জব্বারের মস্তকে যেন সহস্র অশনির সহিত আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাঁহার আকাশকুসুমের আমূল চিন্তাবৃক্ষটি এককালে নির্ম্মূল হইয়া গেল। প্রতিনিধির বাক্য-বজ্রাঘাতে সুখ-স্বপ্ন-তরু দগ্ধীভূত হইল। পরিচারকগণ রাজকুমারীর অঙ্গীকৃত অর্থ আবদুল জব্বারের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল। আবদুল জব্বার তাহা গ্রহণ করিলেন না। কাহাকেও কিছু না বলিয়া সভাভঙ্গের গোলযোগে রাজভবন হইতে বহির্গত হইয়া রাজদত্ত পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিলেন এবং ফকিরের বেশ ধারণ করিয়া বনে বনে নগরে নগরে বেড়াইতে লাগিলেন; গৃহে প্রতিগমন করিলেন না।

 কথা গোপন থাকিবার নহে। আবদুল জব্বারের সঙ্গীরা ফিরিয়া যাইবার পূর্ব্বেই তাঁহার আবাসপল্লীতে উক্ত ঘটনা রাষ্ট্র হইয়াছিল। মূল কথাগুলি নানা অলঙ্কারে বর্দ্ধিত কলেবর হইয়া বাতাসের অগ্রে অগ্রে ছুটিয়া জয়নাবকে এবং প্রতিবেশিগণকে মহা দুঃখিত করিয়াছিল। তখন পর্য্যন্তও নিশ্চিত সংবাদ কেহ পান নাই। অনেকেই বিশ্বাস করেন নাই। সেই অনেকের মধ্যে জয়নাব একজন। আবদুল জব্বারের সঙ্গিগণ বাটীতে ফিরিয়া আসিলে জয়নাবের সন্দেহ দূর হইল। তাহার আশাতরী বিষাদ-সিন্ধুতে ডুবিয়া গেল। জয়নাব কাহাকেও কিছু বলিলেন না; কেবল তাঁহার পিতাকে সংবাদ দিয়া অতি মলিনবেশে দুঃখিত হৃদয়ে পিত্রালয়ে গমন করিলেন।