বীরবাণী (১৯০৫)/‘গাই গীত শুনাতে তোমায়’
‘গাই গীত শুনাতে তোমায়।’
গাই গীত গুনাতে তোমায়,
ভাল মন্দ নাহি গণি,
নাহি গণি লোকনিন্দা যশ কথা।
দাস তোমা দোহাকার,
সশক্তিক নমি তব পদে।
আছ তুমি পিছে দাঁড়াইয়ে,
তাই ফিরে দেখি তব হাসিমুখ।
ফিরে ফিরে গাই, কারে না ডরাই,
জন্মমৃত্যু মোর পদতলে।
দাস তব জনমে জনমে দয়ানিধে;
তব গতি নাহি জানি।
মম গতি—তাহাও না জানি।
কেবা চায় জানিবারে?
ভুক্তি মুক্তি ভক্তি আদি যত,
জপতপ সাধন ভজন,
আজ্ঞা তব দিয়াছি তাড়ায়ে;
আছে মাত্র জানাজানি আশ,
তাও প্রভু কর পার।
চক্ষু দেখে অখিল জগৎ,
না চাহে দেখিতে আপনায়,
কেন বা দেখিবে?
দেখে নিজরূপ দেখিলে পরের মুখ।
তুমি আঁথি মম, তব রূপ সর্ব্বঘটে।
ছেলে খেলা করি তব সনে,
কভু ক্রোধ করি তোমা পরে,
যেতে চাই দূরে পলাইয়ে;
শিয়রে দাঁড়ায়ে তুমি রেতে,
নির্ব্বাক্ আনন, ছল ছল আঁখি,
চাহ মম মুখপানে।
অমনি যে ফিরি, তব পায় ধরি,
কিন্তু ক্ষমা নাহি মাগি।
তুমি নাহি কর রোষ।
পুল্র তব, অন্য কে সহিবে প্রগলভতা?
প্রভু তুমি, প্রাণসখা তুমি মোর।
কতু দেখি আমি তুমি, তুমি আমি।
বাণী তুমি, বীণাপাণি কণ্ঠে মোর,
তরঙ্গে তোমার ভেসে যায় নরনারী।
সিন্ধুরোলে তব হুহুঙ্কার,
চন্দ্র সূর্য্যে তোমার বচন,
মৃদুমন্দ পবন—আলাপ,
এ সকল সত্য কথা।
কিন্তু মানি অতি স্থুল ভাব,
তত্ত্বজ্ঞের এ নহে বারতা।
সূর্য্যচন্দ্র চল গ্রহ তারা,
কোটি কোটি মণ্ডলীনিবাস
ধূমকেতু বিজলি আভাস,
সুবিস্তৃত অনন্ত আকাশ মন দেখে।
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ আদি,
ভঙ্গ যথা তরঙ্গ লীলার
বিদ্যা অবিদ্যার ঘর,
জন্ম জরা জীবন মরণ,
সুখ দুখ দ্বন্দ্ব ভরা
কেন্দ্র যার অহমহমিতি,
ভুজদ্বয়—বাহির অন্তর,
আসমুদ্র আসূর্য্যচন্দ্রমা,
আতারক অনন্ত আকাশ,
মন বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার,
দেব যক্ষ মানব দানব,
পশুপক্ষী কৃমি কীটগণ,
অণুক দ্ব্যণুক জড়জীব,
সেই সমক্ষেত্রে অবস্থিত।
স্থুল অতি এ বাহ্য বিকাশ,
কেশ যথা শিরঃপরে।
মেরুতটে হিমানী পর্ব্বত,
যোজন যোজন সে বিস্তার;
অভ্রভেদী নিরভ্র আকাশে
শত উঠে চূড়া তার।
ঝকমকি জ্বলে হিমশিলা
শত শত বিজলি প্রকাশ।
উত্তর অয়নে বিবস্বান্
একীভূত সহস্র কিরণ
কোটি বজ্র সম করধারা
ঢালে যবে তাহার উপর,
শৃঙ্গে শৃঙ্গে মূচ্ছিত ভাস্কর,
গলে চুড়া শিখর গহ্বর
বিকট নিনাদে খসে পড়ে গিরিবর
স্বপ্নসম জলে জল যায় মিলে।
সর্ব্ব বৃত্তি মনের যখন
একীভূত তোমার কৃপায়,
কোটিসূর্য্য অতীত প্রকাশ,
চিৎসূর্য্য হয় হে বিকাশ,
গলে যায় রবি শশী তারা,
আকাশ পাতাল তলাতল,
এ ব্রহ্মাণ্ড গোস্পদ সমান।
বাহ্যভূমি অতীত গমন,
শান্ত ধাতু, মন আস্ফালন নাহি করে,
শ্লথ হৃদয়ের তন্ত্রী যত,
খুলে যায় সকল বন্ধন,
মায়ামোহ হয় দূর,
বাজে তথা অনাহত ধ্বনি তব বাণী;
শুনি সসন্ত্রমে, দাস তব প্রস্তুত সতত
সাধিতে তোমার কায।
"আমি বর্ত্তমান।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড গ্রাসি যবে
প্রলয়ের কালে
জ্ঞান জ্ঞেয় জ্ঞাতা লয়,
অলক্ষণ অতর্ক্য জগৎ,
নাহি থাকে রবি শশী তারা,
সে মহা নির্ব্বাণ, নাহি ‘কর্ম্ম করণ কারণ,
মহা অন্ধকার ফেরে অন্ধকার বুকে,
আমি বর্ত্তমান।
“আমি বর্ত্তমান।
প্রলয়ের কালে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড গ্রাসি যবে
জ্ঞান জ্ঞেয় জ্ঞাতা লয়,
অলক্ষণ অতর্ক্য জগৎ,
নাহি থাকে রবি শশী তারা,
মহা অন্ধকার ফেরে অন্ধকায় বুকে,
ত্রিশূন্য জগৎ শান্ত সর্ব্বগুণভেদ,
একাকার সূক্ষ্মরূপ শুদ্ধ পরমাণুকায়,
আমি বর্ত্তমান।
“আমি হই বিকাশ আবার।
মম শক্তি প্রথম বিকার
আদি বাণী প্রণব ওঙ্কার
বাজে মহাশূন্য পথে,
অনন্ত আকাশ শোনে মহানাদ ধ্বনি,
ত্যজে নিদ্রা কারণ মণ্ডলী,
পায় নব প্রাণ অনস্ত অনন্ত পরমাণু;
লম্ফঝম্ফ আবর্ত্ত উচ্ছ্বাস
চলে কেন্দ্র প্রতি দূর অতি দূর হতে;
চেতন পবন তোলে ঊর্ম্মিমালা,
মহাভূত সিন্ধু পরে;
পরমাণু আবর্ত্ত বিকাশ
আস্ফালন পতন উচ্ছ্বাস
মহাবেগে ধায় সে তরঙ্গরাজি।
অনন্ত অনন্ত খণ্ড তার
উৎসারিত প্রতিঘাত বলে,
ছোটে শূন্যপথে খগোলমণ্ডলীরূপে।
ধায় গ্রহ তারা,
ফেরে পৃথ্বী মনুষ্য আবাস।
"আমি আদি কবি,
মম শক্তি বিকাশরচনা,
জড়জীব আদি যত।
মম আজ্ঞা বলে
বহে ঝঞ্চা পৃথিবী উপর,
গর্জ্জে মেঘ অশনি নিনাদ;
মৃদুমন্দ মলয় পবন
আসে যায় নিশ্বাস প্রশ্বাসরূপে;
চালে শশী হিম করধারা,
তরুলতা করে আচ্ছাদন ধরা বপু;
তোলে মুখ শিশিরবর্জ্জিত
ফুল্লফুল রবি পানে।”