বেওয়ারিশ লাস/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
সেই ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া আমরা যখন আড়গড়ার ভিতর প্রবেশ করিলাম, সেই সময় দেখিতে পাইলাম যে, আড়গড়া হইতে একটী লোক বাহির হইয়া আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়াই সেই ব্যক্তি কহিল, মহাশয়! “আপনি যাহার অনুসন্ধান করিতেছেন, সে ওই বাহির হইয়া আমাদের দিকে আসিতেছে, দেখুন।”
এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে ডাকিলাম। সে নিকটে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?” উত্তরে সে কহিল, “আমার নাম সুবেদার।”
আমি। হকদার তোমার কে হয়?
সুবেদার। সে আমার ভাই।
আমি। সে এখন কোথায়?
সুবেদার। দেশে যাইব বলিয়া আজ দুই দিবস হইল, সে এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে।
আমি। দেশে যাইবার সময় সে মূল্যবান্ দ্রব্যাদি কিছু লইয়া গিয়াছে কি?
সুবেদার। সবিশেষ মূল্যবান্ দ্রব্য কিছুই লইয়া যায় নাই; কিন্তু এত দিবস পর্য্যন্ত এই স্থানে চাকরি করিয়া যাহা কিছু নগদ অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিল, কেবল তাহাই লইয়া গিয়াছে।
আমি। কত টাকা লইয়া গিয়াছে, বলিতে পার?
সুবেদার। সে যে কত টাকা লইয়া গিয়াছে, তাহা ঠিক আমি বলিতে পারি না; কিন্তু আমার বোধ হয়, এক শত টাকার কম হইবে না।
আমি। তোমার ভাই দেশে চলিয়া গিয়াছে, ইহা তুমি ঠিক বলিতে পার কি?
সুবেদার। না, আমি তাহা ঠিক বলিতে পারি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, দেশে যাইব বলিয়া টাকাকড়ি, পরিধেয় বস্ত্রাদি লইয়া যখন এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে, তখন তাহার দেশে যাওয়াই সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।
আমি। আমার বোধ হইতেছে, তোমার ভাই দেশে যায় নাই। এই কলিকাতার ভিতর কোন একটী মোকদ্দমায় জড়ীভূত হইয়া পড়িয়াছে। আমি যাহার কথা বলিতেছি, সে যে তোমার ভাই, এ কথা আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি না। কিন্তু আমার যতদুর বিশ্বাস, তাহাতে সেই ব্যক্তি তোমার ভাই হওয়াই সম্পূর্ণ সম্ভব।
সুবেদার। কি মোকদ্দমায় আমার ভাই জড়ীভূত হইয়াছে, এবং কোথায় ও কিরূপ মোকদ্দমায় পড়িয়াছে, অনুগ্রহ করিয়া তাহা যদি আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে আমি বড়ই উপকৃত হইব।
আমি। আমার বলিয়া দিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না। তুমি আমার সহিত আইস, যে স্থানে তোমার ভাই আছে, আমি এখনই সেই স্থানে লইয়া গিয়া তোমার ভাইয়ের সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিব।
আমার প্রস্তাবে সুবেদার সম্মত হইল, কিন্তু কহিল, “আপনি একটু অপেক্ষা করুন। এই স্থানে আমার একজন আত্মীয় আছেন, তাঁহাকে ডাকিয়া আনিয়া আমরা উভয়ে এখনই আপনার সহিত গমন করিতেছি।”
এই বলিয়া সুবেদার সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমরা সেই স্থানে তাহার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। অতি অল্প সময় মধ্যেই অপর আর ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া সুবেদার আমাদিগের নিকটে আসিয়া কহিল, “চলুন মহাশয়! কোথায় যাইতে হইবে?”
সুবেদার ও তাহার আত্মীয়কে সঙ্গে লইয়া যে স্থানে সেই মৃতদেহ ছিল, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং সেই মৃতদেহটী সুবেদারকে দেখাইয়া দিয়া কহিলাম, “দেখ দেখি, এই মৃতদেহ কাহার, তাহা তুমি চিনিতে পার কি?”
সুবেদার অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সেই মৃতদেহটী স্থির নেত্রে দর্শন করিয়া কহিল, “ইহা আমার ভ্রাতা হকদারের মৃতদেহ বলিয়া বোধ হইতেছে। ইহাকে এইরূপে কে হত্যা করিল মহাশয়?”
আমি। যে ব্যক্তি যেরূপে ইহাকে হত্যা করিয়াছে, ও যেরূপ অবস্থায় এই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা তুমি এখনই জানিতে পারিবে; কিন্তু তুমি অগ্রে উত্তমরূপে দেখ, ইহা তোমার ভ্রাতার মৃতদেহ কি না?
সুবেদার। আমি বেশ করিয়া দেখিয়াছি, ইহা যে আমার ভাই হকদারের মৃতদেহ, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই।
আমি। মনুষ্য মরিয়া যাওয়ার পর, তাহার আকৃতি প্রায় বিকৃত হইয়া পড়ে। সুতরাং মৃতদেহ দেখিয়া উহা যে কাহার মৃতদেহ তাহা ঠিক নির্ণয় করা সময় সময় সবিশেষ কঠিন হইয়া উঠে। আর ইহাও প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় যে, কোন কোন মৃতদেহ যাহার বলিয়া প্রথমে নির্দ্ধারিত হয়, পরিশেষে তাহাকে জীবিতাবস্থাতেও পাওয়া গিয়া থাকে। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি, এই মৃতদেহ সম্বন্ধে যদি তোমার মনে কোনরূপ সন্দেহ থাকে, তাহা হইলে এই সময় আমাকে পরিষ্কার করিয়া বল। ইহা প্রকৃতই যদি তোমার ভ্রাতার মৃতদেহ হয়, তাহা হইলে যাহার দ্বারা এই ঘটনা ঘটিয়াছে, অনুসন্ধান করিয়া আমরা তাহা বাহির করিতে সবিশেষরূপে চেষ্টা করিব। আর এই মৃতদেহ তোমার ভ্রাতার কি না, এ সম্বন্ধে যদি কোনরূপ সন্দেহ হয়, তাহাও এখনই আমাকে বলিতে পার, তাহা হইলে আমরা তাহার অপর উপায় দেখি।
সুবেদার। আমি বেশ করিয়া দেখিয়াছি, এবং আমার বেশ প্রতীতি হইতেছে, ইহা আমার ভ্রাতা হকদারের দেহই হইবে। ইহার নিকট টাকাকড়ি কিছু পাওয়া গিয়াছে মহাশয়?
আমি। না, ইহার নিকট একটী পয়সাও পাওয়া যায় নাই।
সুবেদার। তাহা হইলে টাকার লোভেই কেহ ইহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে।
আমি। যদি এই মৃতদেহ তোমার ভ্রাতার হয়, তাহা হইলে অর্থই যে এই ঘটনার মূল, তদ্বিষয়ে আমার কিছু মাত্র সন্দেহ নাই।
সুবেদার। ইহা নিশ্চয়ই আমার ভ্রাতার মৃতদেহ।
সুবেদারের কথায় অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই। কারণ, সে যদি তাহার ভ্রাতার মৃতদেহ চিনিতে না পারিবে, তাহা হইলে আর কে চিনিতে পারিবে? যাহা হউক, সুবেদারের কথা যদি প্রকৃত হয়, সেই মৃতদেহ যদি তাহার ভ্রাতা হকদারের হয়, তাহা হইলে কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ হইবে না। কারণ, অনুমান হইতেছে যে, অর্থের নিমিত্ত এই ঘটনা ঘটিয়া থাকিবে; এরূপ হইলে, এই এইরূপ কার্য্যে পরিপক্ক কোন লোকের দ্বারা নিশ্চয়ই এই কার্য্য হইয়াছে। সেইরূপ লোকের দ্বারা এই কার্য্য হইলে দেখা যায় যে, সে লোক প্রায়ই সহজে ধৃত হয় না। তথাপি এ বিষয়ে আমাদিগকে বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিতে হইবে।
সেই সময় আমার মনে হইল, সুবেদারের সমভিব্যাহারে, তাহার আত্মীয় যে ব্যক্তি আগমন করিয়াছে, সেই ব্যক্তিও যে হকদারকে উত্তমরূপে চিনিতে পারিবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহাকেও সেই মৃতদেহ দেখান সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সুবেদারের আত্মীয়কেও সেই মৃতদেহ দেখাইলাম, সে কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, “না মহাশয়! ইহা কাহার মৃতদেহ, তাহা আমি চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।”
আমি। তুমি সুবেদারের ভাই হকদারকে চেন?
আত্মীয়। খুব চিনি।
আমি। এই যে মৃতদেহ দেখিতেছ, তাহা হকদারের মৃতদেহ কি না?
আত্মীয়। ইহা দেখিতে অনেকটা হকদারের দেহের মত বটে; কিন্তু আমার বোধ হয় এই মৃতদেহ হকদারের মৃতদেহ নহে।
আমি। সুবেদার বলিতেছে, ইহা তাহার ভাই হকদারের মৃতদেহ।
আত্মীয়। আমার বোধ হয়, সুবেদার ঠিক চিনিতে পারিতেছে না। ইহার আকৃতির সহিত হকদারের আকৃতির অনেকটা সৌসাদৃশ্য থাকিলেও, ইহার অপেক্ষা হকদার একটু মোটা ও একটু লম্বা।
আমি। হকদার এখন কোথায়?
আত্মীয়। সে দেশে গিয়াছে।
আমি। দেশে যাইতে তাহাকে কে দেখিয়াছে?
আত্মীয়। কেহ দেখিয়াছে কি না, জানি না; কিন্তু যাইবার সময় আমি দেখি নাই।
আমি। রেলে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত কেহ তাহার সঙ্গে গমন করে নাই?
আত্মীয়। কেহ গমন করিয়াছিল কি না, জানি না; কিন্তু তাহার সঙ্গে আমানতের গমন করিবার কথা ছিল।
আমি। আমানত কে?
আত্মীয়। যে গ্রামে হকদারের বাড়ী, আমানতের বাড়ীও সেই গ্রামে।
আমি। এখানে আমানত কোথায় থাকিত?
আত্মীয়। বালিগঞ্জে।
আমি। বালিগঞ্জের কোথায়?
আত্মীয়। বালিগঞ্জে একটী আড়গড়া আছে, সে সেই স্থানেই থাকিত।
আমি। সে কাহার আড়গড়া?
আত্মীয়। সাহেবের আড়গড়া। সাহেবের নাম জানি না।
আমি। সেই স্থানে সে কি কার্য্য করিত?
আত্মীয়। সহিসের কার্য্য করিত।
আমি। তুমি সেই আড়গড়া আমাকে দেখাইয়া দিতে পারিবে কি?
আত্মীয়। কেন পারিব না? আমার সহিত আসুন, আমি তাহাকে এখনই দেখাইয়া দিব।
সুবেদার কর্ত্তৃক মৃতদেহ সেনাক্ত হইয়াছে, অর্থের লোভে তাহার ভাই হকদারকে মারিয়া ফেলিয়া বাক্সের ভিতর পূরিয়া ফেলিয়া দিয়াছে, এই কথা বিদ্যুৎবেগে সহরের সর্ব্বস্থানে প্রচারিত হইয়া পড়িল। যে সকল কর্ম্মচারী, কাহার মৃতদেহ, এই সংবাদ পাইবার প্রত্যাশায় স্থানে স্থানে গমন করিয়াছিলেন, এবং যে সকল কর্ম্মচারী অপর কার্য্যে নানাস্থানে চলিয়া গিয়াছিলেন, এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তাঁহারা সকলে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইতে লাগিলেন।
যাহা হউক, অনন্তর একখানি দ্রুতগামী গাড়ি লইয়া আমি, সুবেদার ও তাহার আত্মীয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া বালিগঞ্জে গমন করিলাম।
কথিত আড়গড়ার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, আমাদিগকে সেই স্থানে রাখিয়া সেই আত্মীয় আমানতের সংবাদ আনিবার নিমিত্ত আড়গড়ার ভিতর গমন করিল, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া কহিল, “আমানত ও হকদার কেহই এ পর্য্যন্ত দেশে যায় নাই, আজ সন্ধ্যার সময় যাইবে।”
আমি। হকদার দেশে যায় নাই; কিন্তু সে এখন কোথায়, তাহ আমানত কিছু বলিতে পারিল?
আত্মীয়। আমানত আর আমাকে কি বলিবে? হকদার যে স্থানে আছে, তাহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি।
আমি। সে এখন কোথায়?
আত্মীয়। সে এখন আমানতের বাসায় বসিয়া রহিয়াছে।
আমি। তুমি নিজ চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছ?
আত্মীয়। হাঁ মহাশয়! আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিতেছি। বিশ্বাস না করেন, বলুন, আমি তাহাকে ডাকিয়া আপনার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিতেছি।
আমি। সে-ই ভাল, তাহাকে একবার ডাকিয়া আমার সম্মুখে আনয়ন কর।
আমার কথা শুনিয়া সেই আত্মীয় পুনরায় সেই আড়গড়ার ভিতর প্রবেশ করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হকদারকে আনিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল। তাহাকে দেখিয়া সুবেদার কহিল, “হাঁ মহাশয়! এ-ই আমার ভাই। এখন দেখিতেছি, সেই মৃতদেহ দেখিয়া আমি ঠিক চিনিতে পারি নাই।”
হকদারকে সঙ্গে লইয়া আমি প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। হকদারকে জীবিত দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন।