বেতালপঞ্চবিংশতি/অষ্টম উপাখ্যান
অষ্টম উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ
মিথিলানগরে গুণাধিপ নামে রাজা ছিলেন। দক্ষিণদেশীয় চিরঞ্জীব নামে রজঃপূত তাঁহার গুণগ্রাহকতা ও বদান্যতা কীর্ত্তি শ্রবণ করিয়া তন্নিকটে কর্ম্মের প্রার্থনায় উপস্থিত হইল। কিন্তু তাহার দুরদৃষ্টক্রমে রাজা তৎকালে সর্ব্ব ক্ষণ অন্তঃপুরবাসী হইয়া মহিলাগণসহবাসে কালযাপন করিতেন বহু কালেও এক বার রাজসভায় উপস্থিত হইতেন না। সংবৎসর ব্যতীত হইল তথাপি চিরঞ্জীব রাজসাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারিল না এবং ব্যয়োপযুক্ত যৎকিঞ্চিৎ যাহা সমভিব্যাহারে আনিয়াছিল তাহাও ক্রমে ক্রমে ক্ষয়প্রাপ্ত হইল।
এই রূপে নিঃসম্বল হইয়া চিরঞ্জীব মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল আমি প্রায় এক বৎসর হইল আশারাক্ষসীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া শ্ববৃত্তিসেবাপ্রত্যাশায় দূর দেশ হইতে আসিয়া রাজ্যতন্ত্রপরাঙ্মুখ স্ত্রীপরতন্ত্র রাজার আশ্রয় লইয়াছি। অভীষ্টসিদ্ধির কথা দূরে থাকুক এ পর্য্যন্ত তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতেও পারিলাম না। দেবতা কত দিনে আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া রাজাকে অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইবার সুমতি প্রদান করিবেন তাহাও বুঝিতে পারিতেছি না। আর এ ব্যক্তিকে অমাত্যায়াত্ত দেখিতেছি স্বয়ং রাজকার্য্যে মনোযোগে করে না। কিন্তু রাজা স্বায়ত্ত না হইলেও তাঁহার নিকট মাদৃশ জনের অনায়াসে প্রার্থনাসিদ্ধির সম্ভাবনা নাই। আর অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেই যে আমি এতাদৃশ ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করিয়া কৃতকার্য্য হইতে পারিব ইহারই বা নিশ্চয় কি। বিশেষতঃ এক্ষণে আমি নিঃসম্বল হইলাম। ভিক্ষা দ্বারা পরান্নসংগ্রহ ব্যতিরেকে এ স্থলে অবস্থিতি করিবারও উপায় নাই। কিন্তু পরান্নসেবা মৃত্যুযন্ত্রণা অপেক্ষাও সমধিক ক্লেশদায়িনী। অতএব অনিশ্চিত শ্ববৃত্তিলাভপ্রত্যাশায় আর এক শ্ববৃত্তি অবলম্বন করা অতি নির্ঘৃণ ও কাপুরুষের কর্ম্ম। ফলতঃ আশার দাসত্ব স্বীকার করিলেই এই সমস্ত দুঃসহ ক্লেশ ভোগ করিতে হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি আশাকে দাসী করিয়া সকল ক্লেশের মস্তকে পদার্পণ করিয়াছে তাহারই জীবন সার্থক এবং যদি সংসারে কেহ সুখী থাকে তবে সে ব্যক্তিই যথার্থ সুখী। অতএব অদ্যই আমি সংসারাশ্রমে জলাঞ্জলি দিয়া অরণ্যে গিয়া জগদীশ্বরের আরাধনায় প্রবৃত্ত হইব। এই নিশ্চয় করিয়া চিরঞ্জীব মিথিলা পরিত্যাগপূর্ব্বক অরণ্য প্রবেশ করিল।
কিয়ৎ দিন পরে রাজা গুণাধিপ অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া পুনর্বার রাজকার্য্যে নিবিষ্টমনা হইলেন এবং কতিপয় দিবসের পর কিয়দংশ সৈন্য সামন্ত সমভিব্যাহারে করিয়া মৃগয়ায় গমন করিলেন। ইতস্ততঃ নানা বনে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে তিনি এক মৃগের অনুসরণক্রমে অশ্বারোহণে একাকী অরণ্যের নিবিড়তর প্রদেশে প্রবিষ্ট হইলেন। তৎকালে সকলভুবনপ্রকাশক ভগবান্ কমলিনীনায়ক অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলে চারি দিক্ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইতে লাগিল এবং সে মৃগও দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইল।
তখন রাজা যৎপরোনাস্তি ভীত ও ক্ষুৎপিপাসায় পীড়িত হইয়া অত্যন্ত বিষণ্ণ ও চিন্তাকুল হইলেন। কিন্তু ভয়ক্ষোভ অপেক্ষা বুভুক্ষা ও পিপাসার পীড়া ক্রমে ক্রমে অধিক প্রবল হইয়া উঠিল। তিনি একান্ত অধৈর্য্য হইয়া ইতস্ততঃ জলান্বেষণ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে সেই নিবিড় অরণ্যমধ্যে অসম্ভাবিত কুটীর দর্শন করিয়া হৃষ্টমনা হইলেন। রজঃপূত চিরঞ্জীব বিষয়বিরক্ত হইয়া ঐ কুটীর নির্মাণ করিয়া তপস্যা করিতেছিলেন। রাজা তথায় উপস্থিত ও কুটীরদ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কাতরতা প্রদর্শনপূর্ব্বক জলদান দ্বারা প্রাণদান প্রার্থনা করিলেন। চিরঞ্জীব আতিথেয়তা প্রদর্শনপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ তপোবনসুলভ সুস্বাদ ফল ও সুশীতল জল প্রদান করিল।
রাজা ফল ও জল পাইয়া একপ্রকার ক্ষুধানিবৃত্তি ও পিপসাশান্তি করিলেন এবং সাতিশয় পরিতৃপ্ত হইয়া আপনাকে পুনর্জীবিত বোধ করিতে লাগিলেন। পরে মহোপকারক চিরঞ্জীবের ভাবদর্শনে প্রকৃতঋষিবোধ না হওয়াতে বিনয়পূর্ব্বক কহিলেন মহাশয় আপনি আমার যে মহোপকার করিলেন তাহাতে আমি আপনকার চিরক্রীত রহিলাম। এক্ষণে এক অনুচিত প্রার্থনা দ্বারা ধৃষ্টতাপ্রকাশে প্রবৃত্ত হইতেছি অনুগ্রহপূর্ব্বক অপরাধ মার্জ্জনা করিবেন। আমি ক্রিয়া দ্বারা আপনাকে বিশুদ্ধ তপস্বী দেখিতেছি কিন্তু আকার ইঙ্গিত দর্শনে কোন ক্রমেই প্রকৃত তপস্বী বলিয়া বোধ হয় না। এই বিষয়ে আমার গুরুতর সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। আপনি প্রাণসংশয়সময়ে জলদান দ্বারা আমাকে জীবনদান করিয়াছেন এক্ষণে কৃপাপ্রকাশপূর্ব্বক সংশয়াপনোদন দ্বারা চরিতার্থ করুন।
চিরঞ্জীব রাজার অনুরোধলঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া আত্মপরিচয় প্রদানপূর্ব্বক কহিল আমি লোকমুখে মিথিলাধিপতি রাজা গুণাধিপের আশ্রিতপ্রতিপালনকীর্ত্তি শ্রবণ করিয়া কর্ম্মপ্রার্থনায় তাঁহার নিকট গিয়াছিলাম। কিন্তু আমার ভাগ্যদোষে রাজা বিষয়সম্ভোগে আসক্ত হইয়া সংবৎসরমধ্যেও অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন না। তৎপরে আমি নানা কারণে বিরক্ত হইয়া অরণ্যবাস আশ্রয় করিয়াছি। কিন্তু জাতিস্বভাসিদ্ধ রজোগুণের অতিরেকপ্রযুক্ত আমার অন্তঃকরণ সাত্ত্বিক কার্য্যে অনুরক্ত হইতেছে না এখনও রাজসপ্রকৃতিসুলভ বিষয়ানুরাগে বিচলিত হইতেছে। অতএব তোমার এই সংশয় নিতান্ত অমূলক নহে তুমি উত্তম অনুভব-করিয়াছ। রাজা শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত লজ্জিত হইলেন।
পর দিন প্রভাত হইবামাত্র রাজা গুণাধিপ আত্মপরিচয় প্রদানপূর্ব্বক চিরঞ্জীবকে রাজধানীতে লইয়া গেলেন এবং সাতিশয় অনুগ্রহভাজন ও প্রিয়পাত্র করিয়া আপন নিকটে রাখিলেন। তদবধি রাজা তাহার প্রতি সর্ব্বদাই সদয় ছিলেন সে ব্যক্তিও প্রাণান্তপর্য্যন্ত স্বীকার করিয়া তদীয় নিদেশ সম্পাদন করিত।
এক দিবস রাজা কোন অনুল্লঙ্ঘনীয় প্রয়োজনানুরোধে চিরঞ্জীবকে দেশান্তরে প্রেরণ করিয়াছিলেন। সে রাজকার্য্য সম্পাদন করিয়া পরিশেষে অর্ণবতীরে উপস্থিত হইয়া এক অপূর্ব্ব দেবালর দর্শন করিল এবং তন্মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক দর্শনাদি করিয়া নির্গত হইবামাত্র এক পরম সুন্দরী স্ত্রীকে সহসা উপস্থিত দেখিয়া তাহার লোকাতিগ সৌন্দর্য্যে মোহিত হইয়া একতান মনে অবলোকন করিতে লাগিল। সেই রমণী তাহার এইরূপ ভাব দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল হে পুরুষবর তুমি কি নিমিত্তে এ স্থানে আসিয়াছ এবং কি নিমিত্তেই বা চিত্রার্পিতের ন্যায় দণ্ডায়মান আছ। চিরঞ্জীব কহিল পর্য্যটনস্পৃহায় আসিয়াছিলাম কিন্তু তোমার অলৌকিক রূপ লাবণ্য দর্শনে মোহিত হইয়াছি। স্ত্রী কহিল তুমি এই সরোবরে অবগাহন কর, তাহা হইলে আমি তোমার আজ্ঞাকারিণী হইব।
চিরঞ্জীব শ্রবণমাত্র অতিমাত্র হৃষ্ট হইয়া সরোবরে অবগাহন করিল কিন্তু জলমধ্য হইতে মন্তক উত্তোলন করিয়া দেখিল আপন আলয়ে উপস্থিত হইয়াছে। তখন যৎপরোনান্তি বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া আর্দ্রবস্ত্রপরিত্যাগ ও বস্ত্রান্তরপরিধান করিল এবং অবিলম্বে নরপতিগোচরে উপস্থিত হইয়া পূর্ব্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদিল। এই অদ্ভুত ব্যাপার কর্ণগোচর করিয়া রাজা অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন এবং কহিলেন আমাকে ত্বরায় সেই স্থানে লইয়া চল। অনন্তর উভয়ে সমুচিত যানারোহণপূর্ব্বক সমুদ্রতীরে উপস্থিত হইয়া সেই দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন এবং যথোচিত ভক্তিযোগ সহকারে পূজাপ্রণামাদি সমাধান করিয়া নির্গত হইলেন।
এই অবসরে সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী রমণী রাজার সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল এবং তদীয় সৌন্দর্য্য দর্শনে মোহিত হইয়া কহিল মহারাজ আমার প্রতি যে আজ্ঞা করিবেন তাহাতেই সম্মত হইব। রাজা কহিলেন যদি তুমি আমার বচনানুসারে কার্য্য করিতে চাহ আমার প্রিয়পাত্র চিরঞ্জীবের সহধর্ম্মিণী হও। সে কহিল আমি তোমার রূপ ও গুণের বশীভূত হইয়াছি ইহার স্ত্রী কি প্রকারে হইব। রাজা কহিলেন তুমি এইমাত্র অঙ্গীকার করিয়াছ আমার বচনীনুসারে কর্ম্ম করিবে। সজ্জনেরা প্রাণপর্য্যন্তও পণ করিয়া প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করেন। অতএব আপন বাক্য রক্ষা কর চিরঞ্জীবের সহধর্ম্মিণী হও। পরিশেষে সেই স্ত্রী সম্মত হইলে রাজা গান্ধর্ব্ব বিধান দ্বারা উভয়কে পরস্পর সহচর করিয়া দিয়া আপন সমভিব্যহারে নগরে আনয়ন করিলেন এবং তাহাদের জীবিকানির্বাহার্থে এক নিষ্কর ভূম্যধিকার নির্দ্ধারিত করিয়া দিলেন।
বেতাল জিজ্ঞাসিল মহারাজ রাজা ও চিরঞ্জীবের মধ্যে কোন্ ব্যক্তির অধিক উপকারিতা প্রকাশ হইল। রাজা কহিলেন চিরঞ্জনীবের। বেতাল কহিল কি প্রকারে। বিক্রমাদিত্য কহিলেন রাজা পরিশেশে চিরঞ্জীবের নানা মহোপকার করিলেন যথার্থ বটে, কিন্তু চিরঞ্জীব মৃগয়াদিবসে ফল জল ও আশ্রয় দান দ্বারা রাজার যে উপকার করিয়াছিল তাহার সহিত উহার তুলনা হইতে পারে না।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।