বেতালপঞ্চবিংশতি/সপ্তম উপাখ্যান
সপ্তম উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ শ্রবণ কর।
চম্পা নগরে চন্দ্রাপীড় নামে নরপতি ছিলেন। তাঁহার সুলোচনা নামে ভার্য্যা ও ত্রিভুবনসুন্দরী নামে অতি সুন্দরী কন্যা ছিল। কন্যা কালক্রমে বিবাহযোগ্যা হইলে রাজা উপযুক্ত পাত্রের নিমিত্ত অত্যন্ত চিন্তিত হইলেন। নানাদেশীয় রাজারা ক্রমে ক্রমে অবগত হইলেন রাজা চন্দ্রাপীড়ের এক পরমসুন্দরী কন্যা আছে তাহার রূপলাবণ্যের মাধুরী দর্শনে মুনিজনেরও মন মোহিত হয়। তাঁহারা সকলেই বিবাহপ্রার্থনায় নিপুণতর চিত্রকর দ্বারা স্ব স্ব প্রতিমূর্ত্তি চিত্রিত করাইয়া চন্দ্রাপীড়ের নিকট পাঠাইতে লাগিলেন। রাজা মনোনীত করিবার নিমিত্ত সেই সকল চিত্র কন্যার নিকট প্রেরণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু কাহারও ছবি তাহার মনোনীত হইল না। তখন রাজা কন্যাকে স্বয়ংবরের আদেশ করিলেন। সে তাহাতে অসম্মতা হইয়া কহিল তাত স্বয়ংবর বৃথা আড়ম্বরমাত্র তাহাতে আমার প্রয়োজন নাই। যে ব্যক্তি বিদ্যা বুদ্ধি বিক্রম এই তিনে অসাধারণ হইবেক আমি তাহাকেই পতিত্বে বরণ করিব।
কিয়ৎ দিন পরে দেশান্তর হইতে চারি বর উপস্থিত হইল। রাজি তাহাদিগকে আপন আপন গুণের পরিচয় দিতে কহিলেন॥ তন্মধ্যে এক ব্যক্তি কহিল মহারাজ আমি বাল্যাবধি বহু যত্নে ও বহু পরিশ্রমে নানা বিদ্যায় কৃতকার্য্য হইয়াছি। আর আমার এক অসাধারণ গুণ এই যে প্রতিদিন একখণ্ড বহুমূল্য বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া পাঁচ রত্ন মুল্যে বিক্রয় করি। তাহার মধ্যে এক রত্ন সর্ব্বাগ্রে ব্রাহ্মণহস্তে সমর্পণ করি। দ্বিতীয় দেবসাৎ করিয়া তৃতীয় আপন অঙ্গে ধারণ করি। চতুর্থ ভাবী ভার্য্যায় নিমিত্ত স্থাপন করিয়া পঞ্চম দ্বারা নিত্য ব্যয় নির্বাহ করি॥ এই ওণ আমা ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তির নাই। আর আমার রূপের পরিচয় দিবার আবশ্যকতা কি মহারাজ প্রত্যক্ষ নিরীক্ষণ করিতেছেন। দ্বিতীয় কহিল আমি জলচর স্থলচর সমস্ত পশু পক্ষীর ভাষা জানি। আমার সমান বলবান্ ত্রিভুবনে আর কোন ব্যক্তি নাই। আর আমার রূপ আপনকার সম্মুখেই উপস্থিত রহিয়াছে। তৃতীয় কহিল আমি শাস্ত্রে অদ্বিতীয় আমার সৌন্দর্য্য সাক্ষাৎ দেখিতেছেন। আপন মুখে বর্ণন করিয়া নির্লজ্জ হইবার প্রয়োজন কি। চতুর্থ কহিল আমি শস্ত্রবিদ্যায় অদ্বিতীয়, শব্দবেধী শর নিক্ষেপ করিতে পারি। আর আমার রূপলাবণ্যের বিষয় জগন্মণ্ডলে প্রসিদ্ধ আছে এবং আপনিও স্বচক্ষে দেখিতেছেন।
এই রূপে ক্রমে ক্রমে চারি জনের বিদ্যা ও রূপ গুণের পরিচয় লইয়া রাজা মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন। চারি জনকেই বিদ্যা ও রূপ গুণে অসাধারণ দেখিতেছি কাহাকে কন্যাদান করি। অনন্তর আপন কন্যার নিকটে গিয়া চারি জনের গুণব্যাখ্যা করিয়া কহিলেন বৎসে এই চারি বর উপস্থিত তুমি কাহাকে মনোনীত কর। শুনিয়া ত্রিভুবনসুন্দরী লজ্জায় অধোমুখী ও নিরুত্তরা হইয়া রহিল।
ইহা কহিয়া বেতাল জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ কোন্ ব্যক্তি যুক্তিমার্গানুসারে ত্রিভুবনসুন্দরীর পতি হইতে পারে। রাজা কহিলেন যে ব্যক্তি বস্ত্র নির্মাণ করিয়া বিক্রয় করে সে জাতিতে শূদ্র। যে ব্যক্তি পশু পক্ষীর ভাষা শিক্ষা করিয়াছে সে বৈশ্য। যিনি সমস্ত শাস্ত্রে পারদর্শী হইয়াছেন তিনি ব্রাহ্মণ জাতি। কিন্তু শস্ত্রবেদী ব্যক্তি কন্যার সজাতীয় সেই শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে এই কন্যার পরিণেতা হইতে পারে।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।