বেতালপঞ্চবিংশতি/ষষ্ঠ উপাখ্যান
ষষ্ঠ উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ
ধর্ম্মপুর নামে অতি প্রসিদ্ধ নগর আছে। তথায় ধর্ম্মশীল নামে অতি সুশীল রাজা ছিলেন। তাঁহার মন্ত্রীর নাম অন্ধক। মন্ত্রী এক দিবস রাজাকে পরামর্শ দিলেন মহারাজ নব মন্দির নির্মাণপূর্ব্বক তন্মধ্যে কাত্যায়নীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়া প্রতিদিন যথাবিধানে পূজা করিতে আরম্ভ করুন শাস্ত্রে ইহার বিশেষ ফলশ্রুতি আছে। রাজা মন্ত্রীর পরামর্শে পরম পরিতুষ্ট হইলেন এবং নূতন মন্দির নির্মাণ করাইয়া তন্মধ্যে ভগবতী কাত্যায়নীর কাঞ্চনময়ী প্রতিমূর্ত্তি সংস্থাপনপূর্ব্বক প্রত্যহ মহাসমারোহে পূজা করিতে লাগিলেন, বিনা পূজায় প্রাণান্তেও জলগ্রহণ করিতেন না।
রাজা এই রূপে দেবতারাধনে যত্নবান্ ও গো ব্রাহ্মণে ভক্তিমান্ ছিলেন তথাপি সংসারাশ্রমসারভূত তনয়ের মুখচন্দ্রনিরীক্ষণে অধিকারী হইলেন না। সর্ব্বদাই মনে মনে চিন্তা করেন শাস্ত্রে ও লোকাচারে প্রসিদ্ধ আছে অপুত্ত্র ব্যক্তির সংসারাশ্রম ধনজনপরিপূর্ণ হইলেও শূন্যপ্রায় এবং পরকালেও সদ্গতি লাভ হয় না। অতএব কি কর্ত্তব্য।
এক দিবস মন্ত্রিপ্রবর অন্ধকের পরামর্শানুসারে কাত্যায়নীর মন্দিরে প্রবেশপূর্ব্বক সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব করিতে লাগিলেন দেবি তুমি ত্রিলোকজননী। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর প্রভৃতি দেবগণ অষ্ট প্রহর তোমার আরাধনা করেন। তুমি কালে কালে ত্রিভুবনের মহানর্থহেতু উৎপাতধূমকেতুপ্রায় মহিষাসুর রক্তবীজ প্রভৃতি দুর্বৃত্ত দৈত্যদানবগণের প্রাণসংহার করিয়া ভূমির ভার হরিয়াছ। আর যখন যে স্থানে তোমার ভক্তেরা বিপদ্গ্রস্ত হইয়াছে তুমি তৎক্ষণাৎ তথায় উপস্থিত হইয়া তাহাদের পরিত্রাণ করিয়াছ। তুমি শরণাগত ভক্তগণের মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ করিয়া থাক এই নিমিত্ত আমি তোমার শরণাপন্ন হইয়াছি আমার মনস্কামনা পরিপূর্ণ কর। এইরূপস্তবাবসানে পুনর্বার সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন।
অনন্তর আকাশবাণী হইল রাজন্ আমি তোমার প্রতি অতিশয় প্রসন্ন হইয়াছি অভিপ্রেত বর প্রার্থনা কর। রাজা শুনিয়া কৃতার্থম্মন্য হইয়া আনন্দগদ্গদ স্বরে কহিলেন জননি যদি প্রসন্ন হইয়া থাক কৃপা করিয়া এই বর দাও যেন আমি অবিলম্বে পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করি। দেবী কহিলেন বৎস অবিলম্বে তোমার পুত্ত্র জন্মিবেক এবং ঐ পুত্ত্র সুশীল শান্তস্বভাব ও সর্ব্ব বিষয়ে পারদর্শী হইবেক।
কিয়ৎ দিন অতীত হইলে রাজার এক পুত্ত্র জন্মিল। রাজা মহাসমারোহে সপরিবারে দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইয়া স্বহস্তে দেবীর পূজাকার্য্য নির্বাহ করিলেন এবং সমাগত দীন দরিদ্র অনাথ প্রভৃতিকে প্রার্থনাধিকধনদান দ্বারা পরিতুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন।
এক দিবস দীনদাস নামে তন্তুবায় কোন কার্য্য উপলক্ষে নিজ বন্ধুর সহিত রাজধানীতে গমন করিতেছিল। দৈবযোগে তাহার সজাতীয়া সেই নগরবাসিনী এক পরম সুন্দরী কন্যা নয়নগোচর হওয়াতে তদীয় অসামান্য রূপ লাবণ্য দর্শনে মোহিত হইল। অনন্তর সে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে তন্তুবায় মনে মনে চিন্তা করিল আমাদের মহারাজ পুত্ত্রবিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়াও ভগবতী কাত্যায়নীর প্রসাদে বৃদ্ধ বয়সে পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়াছেন। দেবীর কৃপাদৃষ্টি হইলে আমারও এই স্ত্রীরত্ন লাভ সম্পন্ন হইতে পারে।
এই চিন্তা করিয়া দেবীর মন্দিরে প্রবেশপূর্ব্বক দৃঢ়তর ভক্তিযোগ সহকারে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে মানসিক করিল ভগবতি যদি এই কামিনীর সহিত আমার বিবাহ হয় আমি স্বহস্তে আপন মস্তক ছেদন করিয়া তোমার পূজা দিব। এইরূপ মানস করিয়া প্রণামপূর্ব্বক আপন বন্ধুর সহিত নির্দিষ্ট স্থানে প্রস্থান করিল। পরে নিজালয়ে প্রত্যাগমনানন্তর সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী রমণীর দুঃসহ বিরহানলে দগ্ধহৃদয় হইয়া আহারবিহারাদি সমস্ত বিষয়ে অনুরাগশূন্য হইল এবং অষ্ট প্রহর অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া কেবল সেই কামিনীর বিভ্রমবিলাসাদি ধ্যান করিতে লাগিল।
তাহার সহচর স্বীয় প্রিয় বয়স্যের এবংবিধ অপ্রতিবিধেয় স্মরদশাপ্রাদুর্ভাব দেখিয়া অত্যন্ত বিষণ্ণমনা হইল এবং অশেষপ্রকার চিন্তা করিয়াও কোন উপায় নির্দ্ধারণে অসমর্থ হইয়া পরিশেষে তাহার পিতার নিকট সবিশেষ সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। তাহার পিতা সমস্ত শ্রবণ ও স্বচক্ষে সমুদায় দর্শন করিয়া বিবেচনা করিল ইহার যেরূপ দশা দেখিতেছি বোধ করি সেই কন্যার সহিত বিবাহ না হইলে প্রাণত্যাগ করিতে পারে। অতএব এ বিষয়ে উপেক্ষা করা বিধেয় নহে বরং যাহাতে ত্বরায় ইহার অভীষ্টসিদ্ধি হয় তদ্বিষয়ে যত্নবান্ হওয়া কর্ত্তব্য।
এই নিশ্চয় করিয়া দীনদাসের পিতা পুত্ত্রের মিত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া সেই কন্যার পিত্রালয়ে উপস্থিত হইল এবং যথোচিত শিষ্টাচার ও মিষ্টালাপের পর গৃহস্বামীকে কহিল আমি তোমার নিকট কিছু প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি, যদি তুমি দিতে অসম্মত না হও ব্যক্ত করি। সে কহিল যদি সাধ্যাতীত না হয় অবশ্য দিব তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এইরূপ বচনবদ্ধ করিয়া দীনদাসের পিতা গৃহস্বামীর নিকট আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবামাত্র সে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্দ্ধারিত করিয়া কন্যাদান করিল। তন্তুবায়তনয় অভিলষিতদারসমাগম দ্বারা কৃতার্থম্মন্য হইয়া পরম সুখে কালহরণ করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে দীনদাসের শ্বশুরালয়ে কর্ম্মবিশেষ উপস্থিত হওয়াতে সে নিমন্ত্রিত হইয়া পূর্ব্ব বন্ধুকে সমভিব্যাহারে করিয়া স্ত্রীসহিত শ্বশুরালয়ে প্রস্থান করিল। সেই নগর নিকটবর্ত্তী হইলে দেবীর মন্দিরসন্দর্শনে পূর্ব্বকৃত মানসিক স্মরণ হওয়াতে দীনদাস মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল আমি অত্যন্ত অসত্যবাদী পামর। দেবীর নিকট মানসিক করিয়া বিস্মৃত হইয়া রহিয়াছি। জন্মজন্মান্তরেও আমি এই গুরুতর অপরাধ হইতে নিষ্কৃতি পাইব না। যাহা হউক এক্ষণে ক্ষণমাত্রও বিলম্ব না করিয়া দেবীর ধার পরিশোধ করা উচিত।
তৎপরে স্বীয় সহচরকে কহিল মিত্র তুমি ক্ষণ কাল অপেক্ষা কর আমি ত্বরায় দেবীদর্শন করিয়া প্রত্যাগমন করিতেছি। এই বলিয়া তথায় উপস্থিত ও সন্নিহিত সরোবরে স্নাত হইয়া প্রথমতঃ যথাবিধি পূজা করিল অনন্তর ভগবতি কাত্যায়নি বহু কাল হইল আমি তোমার নিকট মানসিক করিয়াছিলাম অদ্য তাহার পরিশোধ করিতেছি। এই বলিয়া মন্দিরস্থিত খড়্গ লইয়া স্কন্ধদেশে আঘাত করিবামাত্র মস্তক দেই হইতে পৃথগ্ভূত হইয়া ভূতলে পতিত হইল।
পরে দীনদাসের আসিতে অনেক বিলম্ব দেখিয়া তাহার বন্ধু তাহার স্ত্রীকে কহিল তুমি এই খানে থাক আমি বন্ধুকে ডাকিয়া আনি। এই বলিয়া তথায় গমন করিয়া মন্দিরমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক দেখিল দীনদাসের মস্তক ও দেহ পৃথক্ পৃথক্ পতিত আছে। তদ্দর্শনে হতবুদ্ধি হইয়া সে মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল সংসার অতি বিরুদ্ধ স্থান। কোন ব্যক্তিই বোধ করিবেক না এ স্বয়ং প্রাণত্যাগ করিয়াছে। সকলেই কহিবেক আমি এই স্ত্রীর সৌন্দর্য্যে মোহিত হইয়া আপন অসদভিপ্রায় সাধনের নিমিত্ত বন্ধুর প্রাণনাশ করিয়াছি। অকারণে এরূপ বিরূপ লোকারপবাদগ্রস্ত হওয়া অপেক্ষা প্রাণত্যাগ করাই বিধেয়। এই ভাবিয়া সে ব্যক্তিও তৎক্ষণাৎ সেই খড়্গ দ্বারা আপন মস্তকচ্ছেদন করিল।
তন্তুবায়তনয়া বহু ক্ষণ একাকিনী দণ্ডায়মান থাকিয়া তাহাদের অন্বেষণার্থে দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইল এবং উভয়কেই মৃত পতিত দেখিয়া বিবেচনা করিল দৈবদুর্বিপাকে আমার যে দুরবস্থা ঘটিল তাহাতে বোধ করি পূর্ব্ব জন্মে কত পাতক করিয়াছিলাম। বিশেষতঃ বাল্যাবধি বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ করিয়া অসার দেহভার বহন করা বিড়ম্বনামাত্র। আর লোকেও বিশেষ না জানিয়া কহিবেক এই স্ত্রী দুশ্চরিত্রা আপন অভীষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত স্বামীর ও স্বামীর বন্ধুর প্রাণনাশ করিয়াছে। অতএব সর্ব্ব প্রকারেই আমার প্রাণত্যাগ করা উপযুক্ত।
এই বলিয়া সেই শোণিতলিপ্ত খড়্গ লইয়া আপন শিরশ্ছেদন করিতে উদ্যত হইবামাত্র দেবী তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হইয়া তাহার হস্ত ধারণ করিলেন এবং কহিলেন বৎসে আমি তোমার সাহস ও সদ্বিবেচনা দর্শনে প্রসন্ন হইয়াছি বরপ্রার্থনা কর। তন্তুবায়দুহিতা কহিল জননি যদি প্রসন্ন হইয়া থাক এই উভয়ের প্রাণদান কর। দেবী তথাস্তু বলিয়া উভয়ের কলেবরের সহিত শিরঃসংযোগ করিতে আদেশ দিয়া অন্তর্হিতা হইলেন। তন্তুবায়কন্যা কাত্যায়নীর বচনশ্রবণে আহ্লাদে অন্ধপ্রায়া হইয়া একের মস্তক অন্যের শরীরে যোজিত করিয়া দিল। উভয়েই তৎক্ষণাৎ প্রাণদান পাইয়া গাত্রোত্থান করিল। এই রূপে উপাখ্যান সম্পূর্ণ করিয়া বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ শাস্ত্রের বিধি অনুসারে এক্ষণে কোন্ ব্যক্তি ঐ কন্যার স্বামী হইতে পারে। রাজা কহিলেন শুন বেতাল যেমন নদীর মধ্যে গঙ্গা উত্তম পর্ব্বতের মধ্যে সুমেরু বৃক্ষের মধ্যে কল্পতরু সেইরূপ সমুদায় অঙ্গের মধ্যে মস্তক উত্তম এই নিমিত্তে শাস্ত্রকারেরা ইহার নাম উত্তমাঙ্গ রাখিয়াছেন। অতএব পূর্ব্বস্বামীর উত্তমাঙ্গোপলক্ষিতকলেবরবিশিষ্ট ব্যক্তিই তাহার স্বামী হইবেক।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।