বেতালপঞ্চবিংশতি/উপসংহার
উপসংহার
বেতাল কহিল মহারাজ আমি তোমার অধ্যবসায় সাহস স্ব ও বিরত্ব দর্শনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে তোমাকে কিছু উপদেশ দিতেছি অবধানপূর্ব্বক শ্রবণ কর।
যে যোগী তোমাকে শবানয়নার্থে প্রেরণ করিয়াছে সে কুম্ভকারকুলোদ্ভব। তাহার নাম শান্তশীল। আর এই যে শব দেখিতেছ ইহা ভোগবতীর অধিপতি রাজা চন্দ্রভানুর মৃত দেহ। শান্তশীল আপন যোগসিদ্ধির নিমিত্ত অনেক কৌশলে তাহার প্রাণবধ করিয়া প্রায় কৃতকার্য্য হইয়া আছে। এক্ষণে তোমার প্রাণসংহার করিতে পারিলেই উহার সম্পূর্ণ রূপে প্রয়োজনসিদ্ধি হয়। অতএব আমি তোমাকে সাবধান করিয়া দিতেছি। যোগী পূজা সমাপন করিয়া কহিবেক মহারাজ সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত কর। তদনুসারে তুমি প্রণত হইলে সে তৎক্ষণাৎ খড়্গপ্রহার করিবেক। তুমি প্রণাম না করিয়া কহিবে আমি সমস্ত পৃথিবীর সম্রাট্ কোন কালে কাহাকেও দণ্ডবৎ প্রণাম করি নাই ও কেমন করিয়া দণ্ডবৎ প্রণাম করিতে হয় তাহাও জানি না। আপনি কৃপা করিয়া দেখাইয়া দিলে প্রণাম করিতে পারি। অনন্তর সে যেমন ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিবেক অমনি তুমি খড়্গপ্রহার দ্বারা তাহার শিরশ্ছেদন করিবে এবং চন্দ্রভানু ও শান্তশীল উভয়ের মৃত দেহ তৈলকটাহে নিক্ষেপ করিলে শান্তশীলের সম্পূর্ণ যোগফল পাইয়া নিরুদ্বেগে অখণ্ড সাম্রাজ্য করিতে পারিবেক। সে ব্যক্তি আততায়ী, আততায়ীর প্রাণবধে পাতক নাই।
এই বলিয়া বেতাল সেই মৃত শরীর হইতে বহির্গত হইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিল। রাজা সেই শব লইয়া সন্ন্যাসীর সন্নিধানে উপস্থিত হইলে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া রাজার বহু প্রশংসা করিতে লাগিলেন। অনন্তর জীবন দানপূর্ব্বক সেই মৃত শরীর বলি প্রদান করিলেন এবং পূজার অন্যান্য অঙ্গ সমাপন করিয়া রাজাকে কহিলেন মহারাজ সাষ্টাঙ্গ প্রণাম কর তোমার প্রতাপবৃদ্ধি ও অভীষ্টসিদ্ধি হইবেক। রাজা বেতালবাক্য স্মরণ করিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া অতি বিনয়ে নিবেদন করিলেন মহাশয় আমি উক্ত প্রকার প্রণাম করিতে জানি না। আপনি গুৰু, কৃপা করিয়া দেখাইয়া দেউন। পরে যোগী রাজাকে প্রণাম শিখাইবার নিমিত্ত যেমন ভূতলে দণ্ডবৎ পতিত হইলেন অমনি রাজা বেতালের উপদেশানুসারে খড়্গাঘাত দ্বারা তাহার শিরশ্ছেদন করিলেন।
দেবতারা রাজার সাহসদর্শনে সন্তুষ্ট হইয়া দুন্দুভিধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। দেবরাজ বিমান হইতে অবতরণপূর্ব্বক রাজাকে দর্শন দিয়া কহিলেন মহারাজ আমি তোমার প্রতি প্রীত হইয়াছি বরপ্রার্থনা কর। রাজা অনিমিষসহস্রনয়নেপলক্ষিত কলেবর দর্শনে দেবরাজ নিশ্চয় করিয়া আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিলেন এবং কহিলেন আপনকার প্রসাদে পৃথিবীতে আমার কোন প্রার্থয়িতব্য নাই। এক্ষণে এইমাত্র প্রার্থনা করি যেন আমার এই বৃত্তান্ত সমস্ত সংসারে প্রসিদ্ধ হয়। ইন্দ্র কহিলেন মহারাজ যাবৎ চন্দ্র সূর্য্য পৃথিবী ও আকাশমণ্ডল থাকিবেক তাবৎ কাল পর্য্যন্ত তোমার এই বৃত্তান্ত নিঃসন্দেহ ধরাতলে প্রসিদ্ধ থাকিবেক।
এই রূপে রাজাকে বরপ্রদান করিয়া দেবরাজ দেবলোকে প্রস্থান করিলেন, অনন্তর রাজা মন্ত্র প্রয়োগপূর্ব্বক দুই মৃত দেহ তৈলকটাহে নিক্ষেপ করিবামাত্র দুই বিকটবেশ বীরপুৰুষ উপস্থিত হইল এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল মহারাজ কি আজ্ঞা হয়। রাজা কহিলেন আমি যখন যখন স্মরণ করির তোমরা আমার নিকটে উপস্থিত হইবে। তাহারা যে আজ্ঞা মহারাজ বলিয়া প্রস্থান করিল। রাজা বিক্রমাদিত্যও চরিতার্থ হইয়া হৃষ্ট চিত্তে রাজধানী প্রত্যাগমনপূর্ব্বক পরম সুখে রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।