বেতালপঞ্চবিংশতি/একবিংশ উপাখ্যান
একবিংশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ
জয়স্থল নগরে বিষ্ণুস্বামী নামে ধর্ম্মাত্মা ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার চারি পুত্ত্র ছিল। এক জন দ্যূতাসক্ত দ্বিতীয় লম্পট তৃতীয় নির্লজ্জ চতুর্থ নাস্তিক। ব্রাহ্মণ পুত্ত্রদিগের অসদ্ব্যবহার ও কদাচার দর্শনে অতিশয় বিরক্ত হইয়া এক দিবস চারি জনকে একত্র করিয়া এইরূপ ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন যে ব্যক্তি দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত হয় কমলা ভ্রান্তিক্রমেও তাহার প্রতি দৃষ্টিপতি করেন না। ধর্ম্মশাস্ত্রে লিখিত আছে নাসাকর্ণচ্ছেদনপূর্ব্বক গর্দ্দভে আরোহণ করাইয়া দ্যূতকারীকে দেশ হইতে বহিস্কৃত করিবেক। দৃতাসক্ত ব্যক্তি হিতাহিতবিবেচনা ও ধর্ম্মাধর্ম্মজ্ঞান শূন্য হয়। ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির দ্যূতাসক্ত হইয়া সমস্ত সাম্রাজ্য ও আপন ভার্য্যা পর্য্যন্ত হারাইয়া পরিশেষে বনবাসদুঃখে কালযাপন করিয়াছিলেন। আর যে ব্যক্তি লম্পট হয় সে সুখভ্রমে দুঃখার্ণবে প্রবেশ করে। লম্পটেরা বারাঙ্গনানুরাগে সর্ব্বস্বান্ত করিয়া পরিশেষে চৌর্য্যবৃত্তি অবলম্বন করে। ফলতঃ লম্পট ব্যক্তির সত্ত্ব শীল আচার বিচার নিয়ম ধর্ম্ম সমস্তই নষ্ট হয়। আর যে ব্যক্তি নির্লজ্জ তাহাকে ভর্ৎসনা করা বা উপদেশ দেওয়া বৃথা। তাহার লোকনিন্দার ভয় থাকে না এবং গর্হিত কর্ম্ম করিয়াও ঘৃণাবোধ হয় না। ফলতঃ এবংবিধ ব্যক্তির যত ত্বরায় মৃত্যু হয় ততই মঙ্গল। আর যে ব্যক্তি পরকালের ভয় না করে দেবতা ও গুৰুজনে শ্রদ্ধাবান্ না হয় এবং সনাতন বেদাদি শাস্ত্রে আস্থাশূন্য হয় সে অতি পাষণ্ড তাহার সহিত বাক্যালাপ করিলেও অধর্ম্ম আছে। লোকে পুত্ত্রের মঙ্গলপ্রার্থনায় জপ তপ দান ধ্যান ব্রত উপবাসাদি করে কিন্তু আমি কায়মনোবাক্যে তোমাদের মৃত্যু প্রার্থনা করিতেছি।
পিতার এইপ্রকার তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া চারি জনেরই অন্তঃকরণে অত্যন্ত ঘৃণা জন্মিল। তখন তাহারা পরস্পর কহিতে লাগিল বাল্যকালে বিদ্যাভ্যাসে ঔদাস্য করিয়াছিলাম তাহাতেই আমাদের এই দুরবস্থা ঘটিয়াছে এক্ষণে বিদেশে গিয়া বিদ্যাভ্যাস কর। উচিত। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া চারি জনে নানা দেশে ভ্রমণপূর্ব্বক অল্পকালমধ্যে সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী হইল। প্রত্যাগমনসময়ে তাহারা পথিমধ্যে দর্শন করিল এক চর্ম্মকার মৃত ব্যাঘ্রের মাংস ও চর্ম্ম লইয়া প্রস্থান করিল কেবল অস্থি সকল স্থানে স্থানে পতিত রহিল।
তাহাদের এক ব্যক্তি অস্থিসঙ্ঘটনী বিদ্যা শিক্ষা করিয়া ছিল সে মন্ত্রপ্রভাবে সমস্ত অস্থি একস্থানস্থ করিয়া ব্যাঘ্রের কঙ্কাল সঙ্কলন করিল। দ্বিতীয় মাংসসঞ্জননী বিদ্যা দ্বারা সমুদায় দেহে মাংস জন্মাইয়া দিল। তৃতীয় চর্ম্মযোজনী বিদ্যা জানিত সে তৎপ্রভাবে ব্যাঘ্রের সর্ব্ব শরীর চর্ম্ম দ্বারা আচ্ছাদিত করিল। চতুর্থ মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা দ্বারা ব্যাঘ্রের প্রাণদান করিল। ব্যাঘ্র হিংস্র জন্তু তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান করিয়া তাহাদের চারি জনেরই প্রাণসংহার করিল।
ইহা কহিয়া বেতাল জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ এই চারি জনের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি অধিক নির্বোধ। রাজা কহিলেন যে ব্যক্তি জীবনদান করিল যেই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক নির্বোধ।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।