বেল্লিক রামায়ণ/বনেদী ও গরবনেদীর উপাখ্যান কথন

অভাগিনী কর্ত্তৃক বনেদী ও গর্‌বনেদীর

উপাখ্যান কথন।

তবে অভাগিনী কহে, শুনহ রাজন।
বনেদী গর্‌বনেদীর ব্যভার কেমন॥
একদেশে ছিল এক প্রবীণ ভূপতি।
আছিল একটীমাত্র তাঁহার সন্ততি॥
মৃত্যুকালে পুত্রে ডাকি কহেন ভূপাল।
“মনে রেখো এই উপদেশ চিরকাল॥

রেখেছি সম্পত্তি যাহা ব’সে ব’সে খেলে।
ফুরাতে না পার সাতপুরুষেতে মিলে॥
অতএব চাকরীর নাহি প্রয়ােজন
কি হেতু করিবে কর্ম্ম রাজার নন্দন॥
তবে যদি অদৃষ্টের দোষে সব যায়।
একান্ত চাকরী হয় করিতে তােমায়॥
বনেদীর স্থানে কর্ম্ম করিবে গ্রহণ।
গর্‌বনেদীর ঘরে না যাবে কখন॥
আধুনিক ধনী যত অতি নীচমনা
তাহার নিকটে কর্ম্ম কভু করিবে না॥
না জানে মানীর মান রাখিবারে তারা।
সদা অহঙ্কারে যেন রহে মাতােয়ারা॥
ধরা যেন সরাখানা করে তারা জ্ঞান।
না চিন্তে পরের সুখ, সদা নিজ ধ্যান॥
চাকরীর কষ্ট সহ্য অনায়াসে হয়।
গর্‌বনেদীর বাক্যে অঙ্গে যে জ্বলয়॥
কেমনে কোমল প্রাণে সে দুঃখ সহিবে।
তাই বলি তার স্থানে কদাপি না যাবে॥
বনেদীর কাছে যাবে, সে রাখিবে মান।
তাহার নিকটে কর্ম্মে নাহি অপমান॥
আপন সমান জ্ঞান সে করে সবায়।
অন্তরেতে ব্যথা সেই না দেয় কাহায়॥

অতি নীচ কর্ম্ম যদি কর তার স্থানে।
সেও ভাল, তাহাতে মঙ্গল পরে আনে॥
কিন্তু মন্ত্রী হইলেও গর্‌বনেদীর।
বিনা দোষে একদিন দিতে হয় শির॥
ইহার সহিত আর একটী অমনি।
শিখাই কাহিনী, মনে রাখিও বাছনি॥
হাজার রূপসী দেখে বিবাহ করিবে।
পরস্ত্রীতে তবু নাহি উপগত হবে॥
তবে যদি একান্ত তা হয় প্রয়ােজন।
বাজারে বেশ্যার কাছে করিও গমন॥
কুলটা গৃহস্থা কন্যা নিকটে না যাবে।
সাক্ষাৎ সাপিনী জ্ঞানে তাহারে ত্যজিবে॥
কেন না, অসাধ্য তার বিশ্বে কিছু নাই।
বিশ্বাসঘাতিনী যেই হয় স্বামী ঠাঁই॥
ধর্ম্মাধর্ম্ম-জ্ঞান তার কিঞ্চিৎ না আছে।
ধর্ম্মটা মুখের কথা সে ভেবে রেখেছে॥
অনায়াসে বুকে ছুরি সে দিবে তােমার।
তখন করিবে ফাঁদে পড়ি হাহাকার॥
কিন্তু বাজারের বেশ্যা, জন্ম বেশ্যা-পেটে।
সে কখন কাহারে না সংহারে কপটে॥
সদা তার মনে এই আছে অনুযােগ।
যেমন করেছি কর্ম্ম করি তেম্নি ভােগ॥

অতএব এ জীবনে যতটুকু পারি।
অবশ্য চালাব সাদা পথে দেহ-তরী॥
সরল ব্যভারে তুষ্ট করিব সবায়।
বিফলে কি হেতু আর জীবন বা যায়॥
প্রমাণ দেখহ তার প্রত্যহ গঙ্গায়।
প্রাতঃস্নান করে যত বনেদী বেশ্যায়॥
অটল বিশ্বাস তাহাদের মনে মনে।
অন্তে গঙ্গাদেবী মােক্ষ দিবে সর্ব্বজনে॥
প্রাতে সন্ধ্যাকালে ধূনা আর গঙ্গাজল।
দ্বারে ঘরে ছিটাইয়ে দেয় অনর্গল॥
শঙ্খধ্বনি করি, ‘হরি’ নাম মুখে গায়।
বলে ‘দীননাথ অন্তে রেখে রাঙ্গা পায়॥’
তা হলে ই বুঝ তাহাদের কিবা ভাব।
কুলটাগণের আর বুঝ কি স্বভাব॥
আকাশে জমিতে হয় বিভিন্নতা যত।
বনেদী বেশ্যায় আর কুলটাতে তত॥
বনেদী মাত্রেই হয় মঙ্গল-আলয়।
গর্‌বনেদীর কাছে সদা রহে ভয়॥
অতএব বনেদীতে সদা রত হবে।
ভুলে গর্‌বনেদীর নিকটে না যাবে॥”
এত বলি সে ভূপতি যায় লােকান্তর।
পুত্র তার মনে মনে চিন্তে অতঃপর॥

কিছু দিন যায়, সেই রাজার নন্দন।
হইল বড়ই কৌতুহলী মনে মন॥
‘কেন হেন কথা পিতা কহিলেন মােরে?
পরীক্ষা করিতে কিন্তু হইবে আমারে॥’
এত ভাবি, একদিন মন্ত্রীরে ডাকিয়া।
কহিলেন, ‘কিছুদিন একাকী থাকিয়া॥—
করহ রাজত্ব তুমি, হে মন্ত্রী প্রধান।
বিশেষ কার্য্যেতে আমি হব আগুয়ান॥
সত্বর ফিরিব ইথে কোন গােল নাই।
চালাও রাজত্ব তুমি রহি এই ঠাঁই॥’
বলিয়ে বাহির হৈয়া তবে শীঘ্র পড়ে।
যেদিকে দুচক্ষু যায় চলেন সত্বরে॥
একদিন দুইদিন হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে।
উপনীত কোন এক বনমাঝে গিয়ে॥
দেখিলেন বন মাঝে একটি মানুষ।
মৃতপ্রায় পড়ে যেন হইয়া বেঁহুস॥
নিকটেতে গিয়া তারে দেখে ভালরূপে।
কহেন, ‘কে তুমি ভাই কই ত স্বরূপে॥’
পথিক কহিল ‘আমি হয়ে পথশ্রান্ত।
তৃষ্ণায় কাতর অতি, করহ জীবন্ত॥
যদ্যপি পানীয় কিছু দয়া করি দাও।
তবে ত আমারে তুমি পরাণে বাঁচাও॥

একবিন্দু জলাভাবে যায় মাের প্রাণ।
কে তুমি হে মহাশয় সাধহ কল্যাণ॥
শুনিয়া রাজার পুত্র দয়ার্দ্র পরাণ।
শশব্যস্তে জল আনয়নে আগুয়ান॥
কিন্তু কিছু দূর গিয়ে রাজার নন্দন।
জলাশয় কোথা নাহি হয় দরশন॥
তবে বহু হরীতকীবৃক্ষ তথা আছে।
রাশি রাশি হরীতকী তলাতে শােভিছে॥
কুড়াইয়ে পাকা হরীতকী এক সেথা।
লইয়া গেলেন সেই পিপাসিত যেথা॥
চারিখণ্ড করি সেই হরীতকীটীরে।
দিলেন মধুরবাক্যে তৃষ্ণার্ত্তের করে॥
বলিলেন ‘এই চারি খণ্ড হরীতকী।
চোষো তুমি ক্রমাগত দুটীগালে রাখি॥
তা হলে যতেক তৃষ্ণা চলি যাবে দূরে।
পানীয় আনিয়ে পরে দিব হে তােমারে॥
অশ্বপৃষ্ঠে যাইলেও এত দূরে জল।
কাটে তার্দ্ধঘণ্টা কাল যাইতে কেবল॥
অতএব এই চারিখানি হরীতকী।
দুগালে রাখিয়ে রস গেল ধীকিধীকি॥
ঘণ্টার মধ্যেতে তার পর আমি এসে।
দিতেছি পানীয় রহ ক্ষণ হেথা বােসে॥’

এই বলি হরীতকী চারিখণ্ড দিয়া।
চলে রাজপুত্র বেগে ঘােড়া ছুটাইয়া॥
যথাকালে জল আনি দিল সে ব্যক্তিরে।
খাইয়ে জীবন যেন পায় সে শরীরে॥
পরে সে কহিল,“ভাই, কেবা তুমি হও।
ইচ্ছা করে তুমি মাের সাথে সাথে রও॥
বন্ধু যদি হও তুমি হয় বড় ভাল।
বুঝি বা মনেতে আর নাহি রয় কাল॥”
কহিলা রাজার পুত্র “আমি অভাজন।
করিতেছি এবে এক কর্ম্ম অন্বেষণ॥
চাকরী না হলে মাের দিন চলা ভার।
কেমনে থাকিব আমি সঙ্গেতে তােমার॥
বড়ঘরে জন্ম মম কিন্তু এক্ষণেতে।
কড়ার সম্বলহীন হয়েছি ক্রমেতে॥
দেখি যদি কোন এক বড়লোক মোরে।
চাকরী প্রদান করে, দয়ার্দ্র অন্তরে॥”
কহিল তাহাতে সেই ব্যক্তি তবে তাঁরে।
“চাকরী বাসনা যদি, দিব চাকরী কোরে॥
মােদের দেশের মান্য রাজা হন যিনি।
তাহার সহিত মাের সৌহার্দ্দ এমনি॥
তাঁহারে কহিব যাহা শুনিবেন তাই
নিশ্চয় চাকরী এক হবে তার ঠাঁই॥

কহিব তোমার কথা খুব ভাল কোরে।
যাহাতে নজর তাঁর পড়ে তোমা ’পরে॥
অতএব এস ভাই সঙ্গেতে আমার।
কি ভাবনা চাকরীর বল না তোমার?
করহ বিশ্বাস মোর কথাতে হে তুমি।
নিশ্চয় তোমার কর্ম্ম কোরে দিব আমি॥”
এত বলি সেইব্যক্তি মুখপানে চায়।
রাজপুত্র বলিলেন, “চল মহাশয়॥
চল তবে কোথা লয়ে যাবে হে আমারে।
ফল কথা কর্ম্ম এক দিও মোরে কোরে॥”
বলিয়ে এরূপ কথা ক্রমে অতঃপর।
ধীরে ধীরে সঙ্গে তার হন অগ্রসর॥
এই ব্যক্তি আপনিই সেই সে ভূপতি।
বড়ই সন্তুষ্ট হইলেন এঁর প্রতি॥
তাই কিছু পুরস্কার করিতে ইহারে।
কৌশলে নিকটে আনে সমাদর কোরে॥
যখন বাড়ীতে এসে হন উপস্থিত।
তখন সে রাজপুত্র দেখিয়া স্তম্ভিত॥
দেখিলেন মস্ত বড় রাজা এই জন।
রাখেন কাছেতে বহু করিয়ে যতন॥
ডাকি যত আপনার জনে তদ্দণ্ডেতে।
কহিলেন ধীরে অতি বিনীতভাবেতে॥

“এই যে দেখিছ ব্যক্তি অতি মহাজন।
নাহিক পৃথিবী মাঝে এমন সুজন॥
বনমাঝে জল বিনা গিয়াছিনু প্রায়।
ইনি যদি দয়া নাহি করিতেন হায়॥
এমন দয়ালু ব্যক্তি পাই কি না পাই।
আমার সমান এঁরে দেখিবে সবাই॥
ছিল অতি বড় লােক জনক ইঁহার।
সময়ে পরিবর্ত্তন হ’ল অবস্থার॥
চিরদিন কাহারও না যায় সমান।
কিবা রাজা কিবা প্রজা কি মূর্খ ধীমান্॥
সবাই অদৃষ্টবশে ওঠে কভু পড়ে।
চিরদিন সমভাব নহে কোন কালে॥
সৎকুলে জন্মফলে সৎ কিন্তু সবে।
অসৎকুলজ শুধু রয় অসৎ স্বভাবে॥
শুধু ধন হলে, মন হয় না ত ভাল।
কাল মন সমভাবে রয়ে যায় কাল॥
ঘরােয়ানা ঘরে জন্ম করিয়ে গ্রহণ।
গরীব হয়েও দেখ, এঁর আচরণ॥
এত বলি সমুদয় বৃত্তান্ত ভূপতি।
একে একে সবাকারে করে অবগতি॥
শুনিয়ে সবাই তুষ্ট উপরে তাঁহার।
বিশেষতঃ রাজ-আজ্ঞা নহে অন্যথার॥

সকলেই মান্য ভক্তি করয়ে তাঁহারে।
অতি সুখে রাজপুত্র কিছুদিন তরে॥
রহিলেন সেই সে রাজার প্রাসাদেতে।
কোন কষ্ট নাহি হয় ক্ষণেক তরেতে॥
কিন্তু বাস্তবিক তাঁর, কিবা মনােভাব।
বাস্তবিক কোন তাঁর নাহি ত অভাব॥
রাজা হেথা ম্যানেজার করিয়া তাঁহারে।
মাস মাস শতমুদ্রা দেন সমাদরে॥
কি হবে সে মাহিয়ানা লইয়া তাঁহার।
রাজপুত্র নিজে, কেবা খায় ধন তাঁর॥
পরীক্ষা করিতে শুধু দুটি বিষয়ের।
স্বীকার করেন মাত্র কষ্ট শরীরের॥

একদিন বৈকালেতে,  বাহিরিয়ে রাজপথে,
ইতস্ততঃ করেন ভ্রমণ।
বেশ্যাপল্লী যে দিকেতে, ধীরে ধীরে সে দিকেতে,
গিয়ে ক্রমে উপস্থিত হন॥
দেখিলেন সারি সারি,  যত সব বিদ্যাধরী,
অবিদ্যা-আলয় আলােকরা।
এলাইয়ে পৃষ্ঠে বেণী,  দাঁড়ায়ে ব্রণবদনী,
হেলে ঢলে হয় যেন সারা॥
আয় আয় চাঁদ আয়,  করিয়ে শিশু ভুলায়,
যেমতি গৃহস্থ-নারীগণে।

তেমতি নয়নাছুরি,  ঘন ইথি উথি ঠারি,
ডাকে যত বখা মূর্খজনে।
কভু দেয় করতালি,  কভু ডাকে আয় বলি,
শীষ দেয় কভু ঘন ঘন।
কভু বা দুর্দ্দিন ভেবে,  কেহ ক্ষণকাল ভাবে,
মৌনভাবে পথ নিরীক্ষণ।
আবার যদ্যপি দেখে,  কেহ তারে চেয়ে দেখে,
স্বর্গ যেন পায় অম্নি হাতে।
ইসারা করিয়ে তায়,  গৃহমাঝে লয়ে যায়,
মাতে কত রঙ্গিল খেলাতে।
কোনও ঘরে তাস চলে,  কেহ কেহ পাশা খেলে,
ছড়া কাটে কেহ—যেন কবি।
স্বর্গীয় পিতার নামে,  কিরে করে মনে মনে,
সভ্যতা দেখাতে কোন বিবি।
হায় রে বিবির পিতা,  হায় রে বাবুর পিতা,
কত পুণ্যে গেছ লােকান্তর।
নরম গরম কত,  পেট ভােরে অবিরত,
খাও হেন তাই অতঃপর॥—
আহা, রঙকরা মুখে,  রঙে গড়া রাঙ্গাচখে,
হােটেলের ভাল ভাল খানা।
যাহা এরা নিজে খায়,  তাই তােমারে পাঠায়,
একটুকু বিলম্ব করে না।

দেখিতে দেখিতে ক্রমে,  আসিলেন হেন স্থানে,
চলে খালি নৃত্য আর গীত।
মদমাতুয়ারা প্রাণে,  মত্ত হরিসংকীর্ত্তনে,
কালীনাম গানেতে মােহিত॥
দেয়ালে দেবতা-ছবি,  দেবগুণ গায় বিবি,
বলি হারি দেবের অদৃষ্ট।
কি সাকার নিরাকার,  সবে মিলে একাকার,
অনাচার চক্ষেতে সুস্পষ্ট॥
সেই স্থান সন্নিকটে,  কিছু দূর হেঁটে হেঁটে,
উপনীত একটি আলয়।
বারাণ্ডাতে এক বিবি,  ঠিক তুলি-আঁকা ছবি,
ভাবিত ভাবেতে বসে রয়॥
কি উদয় হ’ল মনে,  রাজপুত্র সেইক্ষণে,
তাহারেই ডাকিল নামিতে।
পরে নেমে এলে পর,  গেলেন তাহার ঘর,
অতঃপর—কাজ কি নামেতে!—
নানা আমােদের ভোগ,  অথবা সে কর্ম্মভােগ,
করিলেন দুদণ্ড তরেতে॥

এইরূপে সেই দিন আমােদ করিয়ে
যথাকালে পুনর্ব্বার আসেন ফিরিয়ে॥
আবার তাহার পরদিন যথাকালে।
উপস্থিত পুনর্ব্বার হন সেই স্থলে॥

একদিন দুইদিন এমন ক্রমশ।
গিয়ে কিছুদিন তারে দেন দুতিন-শ॥
ক্রমেই জমাট ভাব হ’ল হেনখানা।
একদণ্ড না দেখিলে সে বিবি বাঁচে না॥
সেইকালে রাজপুত্র বলে একদিন।
“তোমার অঙ্গ ত দেখি অলঙ্কারহীন॥
কিছু অলঙ্কার আমি দিব হে তােমায়।
আজি সন্ধ্যাকালে তাহা আনিব হেথায়॥”
বিবি বলে “দয়া যদি এত আপনার।
যা ইচ্ছা দিবেন তাতে কি কথা আমার॥
তবে কথা সাধ্যায়ত্ত হয় ত দিবেন।
নতুবা বিব্রত মিছে কি হেতু হবেন?”
রাজপুত্র বলে, “তাহা যা হয় করিব।
দিতে ইচ্ছা হয়েছে ত অবশ্যই দিব॥”
এরূপ বলিয়া মনসুখে অতঃপর।
রাজবাড়ী অভিমুখে যান বরাবর॥
সম্মুখেই দেখিলেন রাজার নন্দন।
ক্রোড়ে তারে করিলেন করিয়া যতন॥
তার পর নানাবিধ খাবার আনিয়ে।
তাহারে দিলেন পেট ভরে খাওয়ায়ে॥
চারি বৎসরের শিশু ভরিল উদর।
অমনি ঘুমের তরে হইল কাতর॥

কোলে করি দোলা দেন ঘুম পাড়াইতে।
মুহূর্ত্তে বিভাের শিশু হইল ঘুমেতে॥
তার পর শিবালয় আছিল উদ্যানে।
শিশু কোলে উপনীত হন সেই স্থানে॥
অতি অন্ধকার হয় সেই শিবালয়।
বেলাও এদিকে প্রায় অবসন্ন হয়॥
রাশি রাশি বেলপাতা ছিল শিবালয়ে।
রচিলেন শয্যা সেই বেলপাতা দিয়ে॥
শােয়ায়ে দিলেন তারে সেই সে শয্যায়।
মুখ ভিন্ন সর্ব্ব-অঙ্গ ঢাকা দেন তায়॥
যত অলঙ্কার তার অঙ্গেতে আছিল।
একে একে সমুদয় খুলিয়া লইল॥
পরে দ্বার রুদ্ধ করি গিয়ে বেশ্যালয়ে।
বেবাক্‌ দিলেন সেই বেশ্যা-হস্তে গিয়ে॥
বেশ্যা কয়,“কোথা হতে আনিলে এ সব?”
তিনি কন,“এ সকল রাজার বৈভব॥
রাজপুত্রে খুন করি এনেছি গােপনে।
ভয় নাই গলাইয়ে দিব সঙ্গোপনে॥
গলান হইলে কেহ টের নাহি পাবে।”
এত বলি গলাইয়ে দিলেন সে সবে॥
বেশ্যা কহে “চমৎকার তােমার ব্যভার।
আমা লাগি বধ তুমি রাজার কুমার॥

একে ত বধিলে শিশু হয় মহাপাপ।
তাহার উপর প্রভু সাক্ষাতে সে বাপ্॥
তাহার নন্দনে তুমি বধিলে পরাণে।
বল দেখি এ পাপেতে তরিবে কেমনে?
আমি কি তোমার সেই পাপের মোচন।
করিতে পারিব তুমি কর যে এমন?
তীব গর্হিত কার্য্য করিয়াছ তুমি।
যাহা হোক ব’লে আর করিব কি আমি॥”
এত বলি ভাবে সেই বেশ্যা হয়ে মৌন।
রাজপুত্র ফিরিলেন রাজবাড়ী পুন॥
এদিকেতে খোঁজ পড়ে রাজকুমারের।
পরস্পর হয় কথা সেই সম্বন্ধের॥
কহিলেন রাজপুত্র গিয়ে রাজস্থান।
“বধিয়াছি মহারাজ আমি তার প্রাণ॥
অঙ্গে তার অলঙ্কার অনেক আছিল।
তাহা দেখি মনে মোর বড় লোভ হৈল॥
আছে এক বেশ্যা মোর এই সহরেতে।
নিছি এই অলঙ্কার তাহার তরেতে॥
বড় ভালবাসে সেই আমারে রাজন্।
কাজে কাজে করি তার মানসরঞ্জন॥
অবশ্যই অপরাধী হইয়াছি আমি।
এবে শাস্তি যাহা হয় দাও রাজা তুমি॥”

শুনিয়ে অবাক্ রাজা, চিন্তে মনে মন।
“হায় হায়, কি বিচার করিব এখন?
একদিন প্রাণে রক্ষা করেছে আমারে।
এবে ভ্রান্তিক্রমে বধ করিল কুমারে॥”
পরে ধীরে ধীরে এই বলিলেন তায়।
কেমন সে বেশ্যা তব দেখাও আমায়॥
যার তরে বধিলে হে কুমারে আমার।
দেখিব সুন্দরী সেই কেমন প্রকার॥”
এই কথা বলি পরে গাড়ীতে চড়িয়ে।
বরাবর উপনীত সেই বেশ্যালয়ে॥
দেখেই রাজারে সেই বেশ্যার নন্দিনী।
বুঝিল কি হেতু তথা যান নৃপমণি॥
গলে বস্ত্র দিয়া তবে প্রণিপাত করি।
কহিতে লাগিল সেই বেশ্যা ধীরি ধীরি॥—
“মহারাজ, যত দোষী আমি নিজ হতে।
ওই ব্যক্তি নহে লিপ্ত কিঞ্চিৎ দোষেতে॥
আমিই করেছি খুন পুত্রে আপনার।
কি হেতু ধরেন ওরে কি দোষ উহার?”
নৃপতি বলেন,“এ যে নিজে বলে আর।
তুমি পুনঃ এ আবার বল কি প্রকার?
কি কারণ নিজে হত্যা করিয়াছ বলো।
জান না কি হত্যাকারী কত দোষী ওলো?

ফাঁসী যাবে কিম্বা হবে চড়িবারে শূলে।
সহজে কি অব্যাহতি পাবে খুনী হলে?
অতএব হেন কথা নাহি বল আর।
আপনিই দোষ ইনি করেছে স্বীকার॥
এবে শুধু এক কথা সে গহনা এনে।
তােমারেই দেছে কিম্বা দেছে অন্য স্থানে॥”
বেশ্যা কহে “তব পুত্রে করিয়া নিধন।
আপনিই সেই ধন করেছি গ্রহণ॥”
এ দিকেতে রাজপুত্র এইকালে বলে।
“আমিই বধেছি রাজা আপনার ছেলে॥
যে শান্তি দানিতে হয় কর মােরে দান।
বিনা দোষে নাহি বধ অবলার প্রাণ॥
বড়ই দয়ালু হয় এই বারাঙ্গনা।
তাই যে বাঁচাতে মােরে করে এ ছলনা॥”
বাস্তবিক কি ব্যাপার কে প্রকৃত খুনী।
কিছুই বুঝিতে আর না পারে নৃমণি॥
অবশেষে বলিলেন, “যে হও সে হও।
বস্তুত ক্রোধের পাত্র কেহই ত নও॥
স্নেহের ভাজন উভয়েই ত তােমরা।
কাহার উপর ক্রুদ্ধ হইব আমরা॥
একদিন মম প্রাণ রাখিয়াছে এই।
মারিতে ইহারে আর না পারি কাজেই॥

পুনঃ দেখ তুমি হও এর মনােরমা।
কাজেই যে তােমারেও করিলাম ক্ষমা॥
তবে এক কথা দেখ অতঃপর আর।
না করো কদাচ হেন কুৎসিত ব্যভার॥
আবশ্যক ধনরত্ন কিম্বা হে গহনা।
যা হইবে চেয়ে লবে কিবা তায় মানা॥
সেইদণ্ডে পাইবে তা সরকার হতে।
কোন দিকে অকুলান না হবে কিছুতে॥”
পরে রাজপুত্র দিকে চাহিয়া ভূপতি।
কহিলেন ধীরে ধীরে এ কথা সম্প্রতি॥
“চারিখণ্ড হরীতকী দেছিলে যা তুমি।
এই এতদিনে তার কিছু শুধি আমি॥
তােমাপরে ক্রোধোদয় কখন না হবে।
তবে যা বলিনু হেন কভু না করিবে॥
যে অর্থের প্রয়ােজন হইবে যখন।
বলিও আমারে আমি করিব অর্পণ॥”
তখন সে রাজপুত্র বলে হাসি হাসি।
“মহারাজ, বড় মােরে করিয়াছ খুসী॥
বড় খুসী করিয়াছে এই বেশ্যা আর।
এমন সুন্দর নাহি দেখি ত ব্যভার॥
বাঁচাইতে অন্য লােকে নিজ মৃত্যু চায়।
এমন স্বভাব বল কাহার কোথায়?

বনেদী মাত্রেরি বুঝিলাম এই ভাব।
পরদুঃখে বিগলিত সতত স্বভাব॥
বটে এই বারাঙ্গনা কিন্তু বনিয়াদি।
বারাঙ্গনা-গর্ভে জাত সুকোমল হৃদি॥
কুলটা হইলে হেন কভু হইত না।
বেশ্যাগিরি কি লাঞ্ছনা সে যে তা জানে না॥
বেশ্যার গর্ভজা জানে কত এতে সুখ।
জানে তাহাদের বিধি কতটা বিমুখ॥
সুতরাং অনুতপ্ত সদ্য তারা প্রাণে।
বিষম এ ভবার্ণব লঙ্ঘিবে কেমনে॥
আসুন এখানে সাথে ওহে মহীপাল।
দিতেছি তােমার কোলে তােমার ছায়াল॥
মরে নাই মারি নাই, আছয়ে সে প্রাণে।
কোন খেদ নাহি প্রভু তাহার কারণে॥
জানিতে তােমার মন মন সে ইহার।
কেবল কৌশলজাল বিস্তার আমার॥
এত বলি নৃপে লয়ে পুনঃ নিজ সাথে।
চলিলেন বরাবর সেই মন্দিরেতে॥
তখনাে ঘুমায় শিশু দিব্য অঘোরেতে।
তুলিয়া তাহারে দেন রাজার কোলেতে॥
শিশু পেয়ে মহীপাল আনন্দে মগন।
বলিলেন “বল বল তুমি কোন্ জন॥”

রাজপুত্র বলিলেন “জানিবেন পরে।
এবে দিনকত মাত্র ছাড়হ আমারে॥
আছে এক অতিগূঢ় কার্য্য যে আমার।
সাধিয়ে তােমারে দেখা দিব পুনর্ব্বার॥
পরে সেই বেশ্যাকাছে লইতে বিদায়।
আনন্দে করেন তথা গতি পুনরায়॥
বলেন “সন্তুষ্ট বড় আমি তােমাপরে।
নিশ্চয় মনের বাঞ্ছা পূরাব অচিরে॥
সামান্য চাকর আমি নহি লো কাহার।
বিশেষ উদ্দেশ্যে হেন কার্য্য যে আমার॥
যে খুসী করেছ মােরে কি আর কহিব।
নিশ্চয় অভাব তব আমি পূরাইব॥”
বলি তারে এইরূপ তার কাছ হতে।
যাত্রা করি উপনীত অপর স্থানেতে॥
দেখেন পিটিছে ঢোল—এই কথা বলে।
“যিনি নিজ দেহরক্ত প্রতি প্রাতঃকালে॥
পারিবে অর্পিতে এক ছটাক করিয়ে।
পুরস্কার করিবেন বড় খুসী হয়ে॥
যাঁর কার্য্য তিনি হন মস্ত জমিদার।
ভয়ানক ব্যামো এক হয়েছে তাঁহার॥
নর-রক্ত প্রত্যহ ছটাক পরিমিত।
দেহে যদি পুনর্ব্বার হয় প্রবেশিত॥

তা হলে বাঁচেন রোগে তা না হলে নয়।”
রাজপুত্র সেই ঢোল ত্বরায় ধরয়॥
বলেন “ছটাক রক্ত আমি দিব নিতি।
কোথায় সে জমিদার দেখাও সংপ্রতি॥”
তাহারে লইয়া ঢোলওলা তবে যায়।
উপনীত জমিদার আছয়ে যথায়॥
জিজ্ঞাসিল জমিদার, “সত্য কি না বটে।—
পারিবে ছটাক রক্ত দিতে দেহ কেটে॥
বৎসরেক কাল ঢোল পিটাতেছি হেন।
কিন্তু এত দিন নাহি হ’ল ফল কোন॥
কেহ নাহি রাজী হয় এ কর্ম্ম করিতে।
তুমি যে হতেছ রাজী কিসের আশাতে?”
রাজপুত্র কহে “কিছু মম আশা নাই।
স্নেহ কর চিরদিন এইমাত্র চাই॥
ত্রিসংসারে নাহি কেহ আপনার জন।
আপনার ভাবি কেহ করিলে যতন॥
কি ছার সামান্য রক্ত প্রাণ দিতে পারি।
যদি মোরে চিরদিন ভাব আপনারি॥”
কহে জমিদার “ভাল, তাই করা যাবে।
তুমি মম আপনার জন হয়ে রবে॥
যা তোমার আবশ্যক চাহিলেই পাবে।
কি খোরাক কি পোষাক সব দে(ও)য়া যাবে॥

নগদ মাসিকবৃত্তি একশত করি।
করিলাম ধার্য্য আমি তরেতে তােমারি॥”
রাজপুত্র বলিলেন, “যথেষ্ট তাহাই।
এ হতে অধিক আশা কভু করি নাই॥”
এত বলি সেই স্থানে রন অতঃপর।
এই জমিদার হয় আধুনিক নর॥
স্বনামা পুরুষ ধন্য, নহে বনিয়াদি।
দেখি এর কাছে দশা কি ঘটান বিধি॥
প্রতিদিন দেন রক্ত ছটাক ছটাক।
দেখিয়ে যতেক লােক হইল অবাক্॥
একমাস দুইমাস দিলেন এমনি।
আরােগ্য হলেন জমিদার-চূড়ামণি॥
ক্রমেতে এমন হ’ল—নিটোল শরীর।
পূর্ব্বতুল্য স্থূলাকার দৃঢ় ও সুস্থির॥
সকলেই দেখে তাঁয় আনন্দিত অতি।
সকলেই বলে “এই জন মহামতি॥
ইনি না করিলে দয়া—হইত না হেন।
নিশ্চয় দেবতা ইনি হইবেন কোন॥”
জমিদার কিন্তু আর নহেন তেমন।
কৃতজ্ঞতা-পূর্ণচিত্ত পূর্ব্বের মতন॥
আগে আগে লইতেন সদা সমাচার।
সুখে তিনি রন কিবা দুঃখে কাছে তাঁর॥

পাছে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে যান চোলে।
ভয়ে করযোড়ে আছিলেন সদাকালে॥
আর ত নাহি সে ভয়—কেন ভয় তবে?
দিব্য নিজ মনে তাই রহিলেন এবে॥
কেবল না দিলে নয় খোরাক পোষাক।
লোকনিন্দা হবে তাই মনে ভাবে—থাক॥
নতুবা গেলেই এবে বেঁচে যেন যায়।
যায় না তা হলে এই টাকাটা বৃথায়॥
যাই হোক,—রেখেছেন আলয়ে আপন।
খরচের নাহি কমি আছিল যেমন॥
রাজপুত্র এইকালে ফিরি পথে পথে।
গৃহস্থের নারী এক ফেলেন পীরিতে॥
অতীব কামুকা নারী স্বামী নাই দেশে।
সম্প্রতি কার্য্যেতে কোন গেছেন বিদেশে॥
সেই নারী রত হলো রাজপুত্র সনে।
দিব্য দিনকত সুখে কাটায় গোপনে॥
মাসেকের মধ্যেতেই হ’ল গর্ভবতী।
স্বামীর দোহাই দিবে—ভাবে মনে সতী॥
বড় যত্ন রাজপুত্রে সেই নারী করে।
ক্ষণকাল অদর্শনে প্রাণে যেন মরে॥
রাজার পুত্রও যত্ন করে ততোধিক।
মনে প্রাণে মিলামিলি হয়ে গেল ঠিক॥

দুই-তিনমাস গত হলে এরূপেতে।
একদিন সংঘটন শুন আচম্বিতে॥
এই সে নারীর বাড়ী হয় যেই স্থানে।
জমিদারটীর এক বাগান সে স্থানে॥
সেই বাগানের মধ্যে আছে সরােবর।
এই নারী ছাদে বসি করে তা গােচর॥
বহু রাজহাঁস পাতিহাঁস সেথা চরে।
খাইতে একটী হাঁস বাসনা অন্তরে॥
কহিল রূপসী “ওই হাঁসের মধ্যেতে।
পার কি না পার তুমি একটী আনিতে?
খাইতে বাসনা বড় হয়েছে আমার।
অতএব দেহ আনি একটী উহার॥”
ছিল একটী হাঁস বিশেষ চিহ্নিত।
দেখাইয়ে সেইটীরে করিল নিশ্চিত॥
কহে রাজপুত্র, “ভাল, আনিব এখনি।”
এত বলি বাগানেতে গেলেন তখনি॥
ধরিলেন সেই হাঁসে করিয়ে কৌশল।
ছাদ হতে নারী তাহা হেরিল সকল॥
পরে গিয়ে একপাশে সেই উদ্যানেতে।
লুকায়ে বসায়ে তারে একটী ঝােপেতে॥
লুকায়ে বসায়ে এক খােলা ভাঙ্গি তার।
চিৎ কোরে রাখিলেন ঝােপের মাঝার॥

হাসের জাতের এই হয় ত ধরম।
রাখিলে এরূপে তারা বড়ই নরম॥
নড়িতে চড়িতে আর শক্তি নাহি থাকে।
মরার মতন দেহ চিৎ কোরে রাখে॥
রাখিয়ে এরূপে সেই হাঁসেরে সেথায়।
বাজার হইতে এক আনি পুনরায়॥
কেটেকুটে ঠিক কোরে নিয়ে তারে দেয়।
কতই আনন্দে সেই হাতে করি নেয়॥
পরে যথানিয়মেতে করিয়ে রন্ধন।
যথাকালে দুইজনে করয়ে ভােজন॥
এ দিকেতে জমিদার বাড়ী গেলে পরে।
জিজ্ঞাসে হাঁসের কথা সবাই তাঁহারে॥
বলে, এইরূপ হাঁস একটী আছিল।
গিয়েছে পুকুরে কিন্তু আর না ফিরিল॥
না জানি কারণ কিবা ঘটিল তাহার।
জান কি আপনি কিছু তার সমাচার॥”
রাজপুত্র বলিলেন, “খাইয়াছি আমি।
মিথ্যা নাহি কহি কথা কহ গিয়া তুমি॥”
শুনিয়ে সকলে তবে কহে জমিদারে।
জমিদার অগ্নিশর্ম্মা রেগে একেবারে॥
কহিলেন “খাবার কি না জোটে তোমার।
বড়ই রাক্ষসপ্রায় দেখি যে ব্যভার॥

হাঁস ধোরে খাও তুমি এত নীচাশয়।
তােমারে রাখা ত আর উচিত না হয়॥”
রাজপুত্র কহে “আছে একটী রমণী।
উপগত মাের সনে হয় সে কামিনী॥
হইয়াছে গর্ভবতী মাংস খেতে সাধ।
তাহাতেই ঘটে প্রভু যতেক প্রমাদ॥”
কহে জমিদার, “কৈ কোথা সেই নারী
চাহি দেখিবারে তারে কি নাম তাহারি॥”
শুনি রাজপুত্র তার কাছে লয়ে যায়।
কিন্তু সেই নারী আর মানিতে না চায়॥
বলে, “ও মা, কোথা যাবো, কে এ সর্ব্বনেশে?
এত বড় কথা বলে কি সাহসে এসে॥
দেখ গো তােমরা আমি গৃহস্থ-রমণী।
জাতিকুল-খেকো কথা বলে এ যে শুনি॥
তােমরা যদ্যপি নাহি শাস্তি দিবে এরে।
তবে ত মজাবে এই আরো কত ঘরে॥”
কহে জমিদার, “ওরে কে আছিস তােরা।
নাহিক দেখি ত পাজী বিশ্বে হেন ধারা॥
মারিতে মারিতে জুতো পিঠেতে ইহার।
শীঘ্র কোরে দিয়ে আয় সহরের বার॥”
রাজপুত্র হেসে হেসে কহেন তখন।
“ভাল ভাল হাঁস আমি করি প্রত্যর্পণ॥

একটা হাঁসের তরে এতটা লাঞ্ছনা।
রক্তদানে বাঁচাইনু সে কথা ভাব না॥”
এত বলি হাঁস আনি দিল সম্মুখেতে।
দেখিয়ে আশ্চর্য্য অতি হয় সকলেতে॥
তখন সে জমিদার কহে, “এ কি হল?
কেমনেতে হাঁস তবে ফিরে পা(ও)য় গেল॥
না-হক্ করিয়ে ইচ্ছা কেন গালি খাও।
বৃথা এ নারীর নামে কেন দোষ দাও॥”
রাজপুত্র কহে, “ক্রমে জানিবে সকলি।”
দ্রুতগতি তথা হতে যান এত বলি॥
উপস্থিত নিজ দেশে গিয়ে বরাবর।
ক্ষণতরে নাহি আর রন অন্যত্তর॥
নহে যে সে রাজপুত্র হয় এই জন।
অধীনে বহুৎ রাজ্য রহে সর্ব্বক্ষণ॥
যেই রাজা জমিদার সঙ্গে ব্যবহার।
দুইজনেতেই রন অধীনে ইঁহার॥
বসিয়ে আপন তক্তে দুজনে ডাকান।
সহিত কুলটা সেই বেশ্যা উচ্চ-প্রাণ॥
সংবাদ পাইবামাত্র সবে উপস্থিত।
দেখিয়া সম্মুখে পরে হয় চমকিত॥
আনন্দে অধীর সেই নৃপতি এক্ষণে।
বলেন “আপনি বঞ্চিলেন হেন দীনে?”

আলিঙ্গনে তুষিলেন রাজপুত্র তাঁয়।
পরে বহু সমাদর করেন বেশ্যায়॥
কিন্তু সেই জমিদার দেখে ভীত অতি।
যথোচিত ভীত আর সেই সে অসতী॥
কিন্তু তিনি শাস্তি কিছু না করি প্রদান।
কহিলেন এই শুধু, রাখি যোগ্য মান॥
“নিজ নিজ স্বভাবের দেহ পরিচয়।
ইহাতে নাহিক মোর হয় ক্রোধোদয়॥
কেবল পরীক্ষা হেতু চরিত্র সবার।
করিলাম এই কষ্ট আমি যে স্বীকার॥
বনেদী মাত্রেই বুঝিলাম উচ্চ-মন।
অবনেদী হলেই সে ব্যভার এমন॥”
এত বলি ভাগিনী হইল নীরব।
নিস্তব্ধ নিরেট কথা শুনি এই সব॥
বলিলেন “ভাল ভাল, তাই তবে হোক্।
তোমার স্বামীর ধন তারি কাছে রোক॥
এত বলি ডাকাইয়ে বেল্লিক রামেরে।
অভাগিনী সমর্পণ করে তার করে॥
আনন্দে বেল্লিকরাম হইল মগন।
বলে “ধন্য এতদিনে তোমার জীবন॥
রাহুগ্রস্ত শশী পুন পাইলাম করে।
এ হতে সৌভাগ্য আর আছে কিবা নরে॥”

বেল্লিকের রামায়ণ অতি মিষ্টরস।
পাঠমাত্রে মিষ্টতায় ভাসে দুই কস॥
যে শুনে এ রামায়ণ সেই স্বর্গে যায়।
পাঠক মাত্রের সুখ না ধরে ধরায়॥
পিলে রােগী পিলে রােগে পায় অব্যাহতি।
পেলেগ পলায় পল্লী হতে দ্রুতগতি॥
কলেরা বসন্ত আর না ঘেঁষে নিকটে।
বন্ধ্যানারী পুত্রমুখ হেরে আঁখিপটে॥
নির্ধনীর ধন হবে—ঘরে না ধরিবে।
ধর্ম্ম অর্থ কাম মােক্ষ চতুর্ব্বর্গ পাবে॥
না পােড়ে পণ্ডিত যার হইতে বাসনা।
সে যেন রামায়ণ পড়িতে ভুলে না॥
বিনি কণ্ঠে গান গাবে—অতীব রসাল।
বিনা দানে নাম তার হইবে,“দয়াল॥”

সম্পূর্ণ।