বেল্লিক রামায়ণ/বেল্লিকের অবতার গ্রহণ
প্রথম কাণ্ড।
বেল্লিকের অবতার গ্রহণ।
আজব শহর এই কলিকাতাধামে।
কায়স্থ-সন্তান এক ছিল ‘অভা’ নামে॥
শুনা যায় বসু-বংশ-অবতংস সেই।
রূপে গুণে অভা সম আর বুঝি নেই॥
যেমন টিকল নাক টিয়াপাখী তুল।
মিশ্মিশে রঙটুকু ঠিক যেন ঝুল॥
ভাঁটার মতন চক্ষু কিবা নীল তারা
ষষ্ঠীর বাহন লজ্জা পেয়ে হয় সারা॥
তাহা ছাড়া বিশেষত্ব আরাে যে দেখিবে।
এমন সুদৃষ্টি আর পাবে কি না পাবে॥
পাছে দৃষ্টিক্ষেপ মাত্রে সবে, দৃষ্টি পড়ে।
শঙ্কায় রহে সে তাই কুলুঙ্গীতে চোড়ে॥
গভীর গহ্বরযুক্ত সে আঁখি-কুলুঙ্গী।
জ্ঞান হয় বহু তপস্যার ফলে সঙ্গী॥
ছিপ্ছিপে তনুখানি কিবে ঢেঙ্গা হয়।
মনুমেণ্টের সে যেন তেউড় নিশ্চয়॥
কাঠের সিঁড়ি বা মই হ’লে আবশ্যক।
না হয় করিতে ব্যয় পয়সা নাহক্॥
দয়া করি দেহখানি তুলিলেই ব্যস্।
অমনি সমাধা কার্য্য হয় যে নির্যাস্॥
দুটি জোড়া গোঁফ, যেন বিড়ালের ল্যাজ্।
পান খেয়ে দাঁত রাঙ্গা যেন ছােট প্যাঁজ্॥
গন্ধেও পিঁয়াজ্ চন্দ্র সদা বিদ্যমান।
রসনা রসিলে তাহে কত খুসী প্রাণ॥
শত-ফাটা কাঁসী যেন হয় নিনাদিত।
যদি দয়াবশে তায় বাহিরায় গীত॥
মাণিকপীরের গান করয়ে যাহারা।
তাদের হাতের ঠিক চামরের পারা॥
দাড়ীগুলি বাবুজীর কিবা হেলে দোলে।
তালে তালে করে নৃত্য কথনের কালে॥
চলনে ফেরণে বাবু সদা খ্যাতি পায়।
যে দেখেছে সে সজেছে কি সংশয় তায়॥
এই সে বাবুর নাম বলিয়াছি, ‘অভা’।
বহুৎ আদরের নাম দেয় তার বাবা॥
বাপের একৈক পুত্র এই অভারাম।
রাখে সে বহুৎ মতে বাপের সুনাম॥
যদি বল কেমনে সে রাখে তাহা শুনি।
শুন তবে অতঃপর কহি সে কাহিনী॥
যখন ইহার বাপ্ যায় লোকান্তরে।
রেখে যায় বহু টাকা এ অভার তরে॥
বয়স তখন মাত্র বিশ কি বাইশ।
বাপের মরণে হায় কতই হরিষ॥
জুটিল ইয়ার্-বন্ধু যত জুটিবার।
নিত্য আসি করে সব বৈঠক গুল্জার॥
ভাঙ্গিলে কাঁঠাল যথা মাছির আম্দানী।
ইয়ারের দলবৃদ্ধি নিত্যই তেমনি॥
এ বলে ‘একটি ফোঁটা মােরে দয়া কর।’
ও বলে ‘আমারে দয়া কর বন্ধুবর!’
‘দাও দাও’ বােল খালি সকলেরি মুখে।
সাবাড়িল সব রস চুমুকে চুমুকে॥
দয়ার সাগর ‘অভা’ পড়ে পা(ও)য়া ধনে।
না জানে রাখিতে হয় কত সে যতনে॥
যে যা চায় তাই তারে দেয় অকাতরে।
নাহি বলে ‘নারি দিতে’ কখন ত কারে॥
তখন তাহার আর অভা নাম নাই।
‘অভয়চরণ বাবু’ কহে যে সবাই॥
প্রথম যেদিন বাপ মরিল তাহার।
সেই দিন হতে নাম ফিরিল ‘অভার’॥
বলে অভা মারে তার, “শােন মা জননি!
অভা নামে আর নাহি ডাকিও এমনি॥
দেখ আমি, কত বড় হইতে চলিনু।
তাহা ছাড়া বাবা মাের ছাড়িলেন তনু॥
উত্তরাধিকারী এবে হই আমি তাঁর।
রাখিতে হইবে এবে নাম ত তাঁহার॥
অতএব বলি তাই, ছাড়ি ‘অভা’ নাম।
অভয়চরণ বল, পূরে মনস্কাম॥”
পুত্রের সুখেই সুখ হয় ত মাতার।
পুত্রের রাখিতে মন হ’ল মন তার॥
অভয়চরণ বলি ডাকে অতঃপরে।
ভুলেও না ‘অভা’ আর বলেন তাহারে॥
অভয়চরণ নাম সেই হতে হ’ল।
বাবু কথাটীও ক্রমে তাহে যােগ দিল॥
যতেক বন্ধুতে তায় ‘বাবু বাবু’ করি।
‘অভয়চরণ বাবু’, করিল জাহিরি॥
রূপচাঁদ হতে না কি কিছু বড় নাই।
আছয়ে যতেক চাঁদ ইহ বিশ্বে ভাই॥
সবার মােহিনী হতে এ মােহিনী বেশী।
কে না জানে এর বলে কুরূপা রূপসী॥
খঞ্জের চরণ মেলে এই রূপচাঁদে।
অন্ধের নয়ন হয় এ চাঁদ থাকিলে॥
কোন্ ইষ্টসিদ্ধি করে গগনের চাঁদ।
কেবল গণি ত তারে রূপেরি সে ফাঁদ॥
ব্রজে কালাচাঁদ ছিল নদীয়ায় গােরা।
তাহাতে অধিক রূপচাঁদে চাঁদী যারা॥
রূপিয়ার সেরা বিশ্বে কিছু নাহি ঠিক্।
রূপিয়াবিহীন জনে ধিক্ ধিক্ ধিক্!
রূপিয়ারি বশে অভা অভয়চরণ।
রূপীর খাতিরে দশে করয়ে গণন॥
কে চিনিত বল তারে, কেবা সেই হয়।
কার মাথাব্যথা এত তত্ত্ব তার লয়॥
দেখিল দশেতে যেই আছে তার টাকা।
অমনি ঘেঁষিল কাছে মিটাইতে ধোঁকা॥
নেউয়া কাঁঠাল দিব্য পাকা যেন হায়।
দৃষ্টিমাত্রে সুখী সবে কাছে ঘেঁষে যায়॥
ভ্যান্ ভ্যান্—নিত্য রব, অর্থ—দাও দাও।
কেবলি লোলুপ আঁখি খুঁজে সদা দাঁও॥
এক এক ফোঁটা করি কিন্তু ক্রমে ক্রমে।
সমুদয় রস(ই) তারা নিল চুমে চুমে॥
হেন এক ফোঁটা আর নাহি রহে তায়।
একটী পিপীড়া মাত্র হয় সুখী যায়॥
তখন মাছির দল ক্রমে ফাঁক হ’ল।
কি দশা যে কাঁঠালের কেহ না দেখিল॥
হইয়ে ভুঁতুড়ি-সার তখন কাঁঠাল।
কাঁদিয়ে ভিজায় মাটী নিন্দয়ে কপাল॥
হেন ভাবে কিছুদিন কাটিয়ে ত চলে।
অন্ন বিনে ছন্ন ছাড়া ভাবে ভাল মলে॥
কিন্তু সে মরণ যদি অদৃষ্টে না রয়।
সহজে কাহার বল মরণই বা হয়?
বার বার তিনবার আত্মঘাতী হতে।
লাগায় গলেতে ফাঁসী দায়ে মুক্তি পেতে॥
কিন্তু কপালেতে কিছু আছে না কি আরো।
খুলিল আপনা হতে সে ফাঁসের গেরো॥
ছিঁড়ে পড়ে গলরজ্জু, দেখ কি ব্যাপার।
ঐশ্বরাদি কার্য্যে বল আছে হাত কার?
কাজেই মরিতে আর প্রবৃত্তি না হয়।
ধৈর্য্য ধরি কিছুকাল পুনশ্চ বাঁচয়॥
পতিপ্রাণা পত্নী তার আছিল একটী।
মেগে পেতে দিনান্তেতে আনিত সে দুটী॥
তাতেই অতীব ক্লেশে দিনপাত হয়।
তখন সে নারী তার গর্ভবতী রয়॥
গর্ভিণী দেখেই তারে বাবু কাঁপে ভয়ে।
মানুষ করিব শিশু কিবা খাওয়াইয়ে॥
নিজেদের ভাত নাই শিশু কি বা খাবে।
শরীর আরো যে শীর্ণ তাই ভেবে ভেবে॥
এক দুই করি ক্রমে দিন কেটে গেল।
দশ মাস দশ দিন উত্তীর্ণ হইল॥
ভূমিষ্ঠ হইল শিশু দিক্ আলো করি।
নাম সে ‘বেল্লিকরাম’ হয় ত ইহারি॥
জন্মকালে যে ঘটন লিখেছি তা আগে।
চিরকাল স্মৃতিপথে রহিবেক জেগে॥
এমন আশ্চর্য্য আর কে দেখেছে কোথা।
বােম্বাই আঁবের চাক্লা যেন রে এ কথা॥
ইচ্ছা নাহি হয় ছাড়ি কহি অবিরল।
এই সে শিশুর হতে পিতৃ-মুখােজ্জ্বল॥
ভাবে ‘অভা’—থুড়ি!—বাবু অভয়চরণ।
দুঃখের কাণ্ডারী হবে এ পুত্র-রতন॥
দয়া করি মুখ হরি চান্ এতদিনে।
তাই সে দিলেন তিনি এ পুত্র-রতনে॥
নিরখিয়ে চাঁদমুখ জুড়ায় হৃদয়।
যে সে চাঁদ নয় এ ত চাঁদ সুধাময়॥
কিন্তু পাঠকের দল বুঝ তােমরাই।
কিবা চমৎকার রূপ এচাঁদ রে ভাই॥
মূর্চ্ছা বুঝি যাই দেখে না পারি থাকিতে।
সার্থক সে এতদিনে জন্ম এ মহীতে॥
নমস্কার কোটি কোটি শ্রীচরণে এঁর।
অতঃপর বাল্যলীলা কহি বেল্লিকের॥