বেল্লিক রামায়ণ/লুকোনো প্রেম

চতুর্থ কাণ্ড।

লুকোনো প্রেম—মনোমোহিনী-হরণ।

যতেক ব্যাপার হেথা করয়ে জামাতা।
শ্বশুর না জানে বিন্দু-বিসর্গ সে কথা॥
উৎসাহে উৎসাহে টাকা প্রতি মাসে মাসে।
করেন প্রেরণ তিনি মনের হরিষে॥
শিখি লেখাপড় পরে সেই সে জামাই।
কন্যারে তাঁহার সুখে রাখিবে সদাই॥
হইবে উকীল এক কিম্বা মুনসেফ্।
ব্যারিষ্টার ম্যাজিষ্টর অভাবে নায়েব॥
যা হোক হবেই এক পদস্থ সুজন।
দশেতে সুখ্যাতি যার করিবে ঘোষণ॥
আশায় আশ্বস্ত হয়ে ঢালে টাকা খালি।
জানে না কিন্তু যে শুধু বাড়ে প্রাণে কালী॥—
করিয়ে যতন নিজ বৈরী করে কোলে।
দুগ্ধ কলা দিয়ে কালসর্পে যেন পালে॥
দিন পেয়ে সেই সর্প দংশিবে যে হায়।
এ ত নাহি ছিল জানা কখন তাহায়॥
তাড়ায়েছে মা ভায়েরে হইতে ভবন।
এত না জেনেছে এত দিন সেইজন॥

নামেতেই বৃহচ্চক্ষু ছিল, সে অজ্ঞান।
কার্য্যক্ষেত্রে অন্য কিছু নাহি ছিল জ্ঞান॥
নহে এ দূষমণে কেন দিয়ে অন্নজল।
পালি ভূতগত কার্য্য করিবে কেবল॥
অতঃপর হয় যাহা শুন বিবরণ।
বেল্লিকের রামায়ণ অপূর্ব্ব কথন॥
বেদবিধি কিছুতে না পাবে এর তত্ত্ব।
অথচ পঠন মাত্র হতে হবে মত্ত॥
একটি লুকোন প্রেমে এই কাণ্ড ভরা
পাঠমাত্রে তুমিও যে প্রেমে হবে মরা॥
সৃষ্টিছাড়া প্রেম ইহা নাহি এর যোড়া।
যথা এ প্রেমের গতি ফেটে যায় পাড়া॥
যথা আর্থকোয়েকেতে চিরাপুঞ্জি হিল।
ফেটে ভূমিসাৎ, নাহি রহে এক তিল॥
দর্ম্মাহাটা সুন্দরী নামেতে এক বিবি।
রূপে ঠিক রঙ দিয়ে আঁকা যেন ছবি॥
দর্ম্মাহাটা রাস্তার ধারেতে তার ঘর।
সদাই দেখিতে পাবে বারান্দা-উপর॥
বসি এক চেয়ারেতে দিব্য সাজগোজে।
সাক্ষাৎ সে পরীজাদী যেন ধরামাঝে॥
আবির্ভূত মর্ত্ত্যধামে তারিতে জগৎ।
অথবা করিতে কোন কার্য্য সে মহৎ॥

আড়ে আড়ে চায় বালা রাস্তার দিকেতে।
মূর্চ্ছা খেয়ে যত লােক পড়ে সে পথেতে॥
বুলি মুখে, ‘কি দেখিনু কি দেখিনু, হায়।
এমন সুন্দর মূর্ত্তি আছিল কোথায়॥
কেমনেতে জাতিকুল থাকয় আমার।
এ যে দেখি ভাবনা সে হইল অপার॥
এমন যে শান্ত ছেলে আমি এ সহরে।
পাগল করিল এ যে মুহূর্ত্তে আমারে॥
না জানি আর সে যত গরীব বেচারা।
কেমনে বাঁচিবে প্রাণে যত গােবেচারা॥
মরিবে হয়ত একেবারে তারা প্রাণে।
কার সাধ্য পায় পার ও কটাক্ষবাণে॥’
এইরূপ সবাকারি আক্ষেপবচন।
যায় পথে, দেখে চেয়ে, বলে আর এমন॥
বলে না কেহই, আমি জ্ঞানে বলে কম।
হায় রে অবোধ বঙ্গজাতির নিয়ম॥
নাহিক কড়ার বল শরীরমধ্যেতে।
অথব বলিছে, বলী সবার চাইতে॥
সবারি মুখেতে বুলি, রমণী জাতিতে।
ভাবে ভাবে বাঁধা আমি নহি ত কিছুতে॥
আপন মুখের বলে সদা বলী সবে।
মনের বলেতে বলী কয় জন ভবে॥

মোদের বেল্লিকরাম এতটা যে বীর।
তারেও এ রমণীতে করিল অধীর॥
প্রত্যহ কলেজে তিনি যে সময়ে যান।
বারান্দায় বোসে বামা দেখিবারে পান॥
বয়েসের মহিমারে দুশত বাহবা।
লেখা-পড়া শিখেও মানুষ হয় হাবা॥
তাড়ায় বেল্লিক তার মাতারে যখন।
তারি কিছুদিন পূর্ব্বে হয় এ ঘটন॥
টাকা হেতু কলহ যে হয় মায়ে পুতে।
তাহার কারণ, দর্ম্মাহাটা সুন্দরীতে॥
এই যে সুন্দরী তার নয়নে পড়িল।
তাতেই অনর্থ যত সংঘটিত হ’ল॥
টাকা বিনে হয় না ত এ সুন্দরী লাভ।
টাকার জন্যে ত তারা করে ভাব-সাব॥
টাকা না পারিলে দিতে দেবে না ত যেতে।
পীড়ন মাতার প্রতি সেই সে জন্যেতে॥
সে পীড়নফলে ঘটেছিল যে সকল।
ইতিপূর্ব্বেতেই বর্ণিয়াছি অবিকল॥
তখন আসিত টাকা মাসে ত্রিশ মোটে।
চলিত সংসার তাহাতেই কষ্টে-সৃষ্টে॥
তাড়াইতে না পারিলে মা ও ভাইগণে।
দর্ম্মাহাটা সুন্দরীরে পায় সে কেমনে॥

ক্রমে তাড়াইয়ে তেঁই একা একেশ্বর।
রাখিলেন বাবুজীটি আলো করি ঘর॥
“বদ্‌লালে ঠিকানা সে কি জানি কি হবে।”—
রহেন সেই সে স্থানে মাত্র এই ভেবে॥
প্রতিমাসে চৌঠা কিম্বা পাঁচুই মধ্যেতে।
যেমন আসিত টাকা, লাগিল আসিতে॥
বহু দূরে হয় বাড়ী শ্বশুরের তাঁর।
আসিতে নারেন তাই গৃহে জামাতার॥
কন্যারেও না পাঠান তাহার নিকটে।
লেখাপড়া শিখিবার বিঘ্ন পাছে ঘটে॥
হায় রে অবোধ অন্ধ বৃহচ্চক্ষু বাবু।
এই বুদ্ধিবলেতেই হলে তুমি বাবু॥
রাখিয়া গৃহেতে ফেলি যুবতী কন্যায়।
আপনি বাড়ালে তুমি আপনার দায়॥
মনে কর এক, কিন্তু ঘটে অন্যরূপ।
জান না তোমরা কলিকালের স্বরূপ॥
এ কি সেই সত্য ত্রেতা অথবা দ্বাপর।
যাহে নিজ হিতাহিত বুঝিবেক নর॥
এক ফোঁটা পুঁটে ছেলে এই কলিকালে।
স্তনদুগ্ধ বাহিরায় গলাটা টিপিলে॥
সেও যায় বেশ্যাবাড়ী, মদভাঙ খায়।
পথে পথে শিষ দিয়ে রসগান গায়॥

মুখেতে আলেয়া জলে নাম বার্ডসাই।
কেহ বা কোকেন খায় নেশার সাফাই॥
হেন কলিকালে কভু কন্যা জামাতায়।
জ্ঞানীতে না রাখিবেক ভিন্ন জায়গায়॥
উভয় দিকেই পারে ঘটিতে অনর্থ।
অতএব দেখা চাই কোনটি যথার্থ॥
কিসে যে বজায় থাকে বৃত্তি সমুদয়।
অন্যায় গমনে নাহি হয় অপচয়॥
অবশ্যই দৃষ্টি চাই সেই সে দিকেতে।
বিপদ নতুবা ঠিক আছেই শেষেতে॥
মাসে মাসে বৃহচ্চক্ষু টাকা যে পাঠায়।
ইচ্ছা এই জামাইটি ভাল শিক্ষা পায়॥
খরচ অভাবে বিদ্যা যদি না শিখিবে।
সে দুঃখ রাখিতে শেষে স্থান নাহি রবে॥
সবাই বলিবে বেটা এমনি কৃপণ।
জামাইটে বয়ে যায় না করে দর্শন॥
থাকিতে ক্ষমতা, বেটা, অবহেলা করি।
করিল জামাই নাশ;—সে লাঞ্ছনা ভারি॥
তাহা ছাড়া কন্যাটীও ভবিষ্যৎ কালে।
উদরান্ন তরে ভাসিবেক অশ্রুজলে॥
শিখে যদি লেখাপড়া উত্তমরূপেতে।
তা হলে পারিবে ঠিক দুমুঠা যােগাতে॥

প্রতি মাসে মুঠ। মুঠা খরচ যে করে।
এই এক আশামাত্র রাখিয়ে অন্তরে॥
তবে কথা, ভাগ্যে যার নাহি সুখ লেখা।
কেমনে সুখের মুখ দেখিবে সে বােকা॥
ঢালিল যে কত টাকা কেবলি সে জলে।
কন্যাটি লাভের মধ্যে ভাসিল অকূলে॥
পঞ্চাশ করিয়া টাকা পাঠান এক্ষণে।
হতেছে দেখিয়ে পাশ উৎসাহিত মনে॥
পাশ মাত্র লাভ কিন্তু সেই পাশেতে যে।
না ভাবেন একবার তাহা হৃদিমাঝে॥
হায় রে কর্ত্তব্য, তার এই কি গেয়ান্।
চক্ষে না দেখেন, শুধু ব্যয় করি যান॥
সাপ ব্যাঙ কি যে হয় তাহা না দেখিব।
কেবল কতকগুলা খরচ করিব॥
তারে কি কখন বলে কর্ত্তব্যপালন।
সে ত মন্দ করা শুধু হয়ে আত্মজন॥
বাপ হও খুড়া হও শ্বশুর কি ভাই।
কেবলি টাকায় কিছু কাজ ত না পাই॥
টাকাখরচের সঙ্গে চাই দেখা শুনা।
নহে সে খরচে মাত্র আনে বিড়ম্বনা॥
বেল্লিকের রামায়ণ যা বলে তা ঠিক।
আজব এ দুনিয়ার সকলি বেল্লিক॥