বৈকুণ্ঠের খাতা/তৃতীয় দৃশ্য
তৃতীয় দৃশ্য।
কেদার।
কেদার। শ্যালীর বিবাহত নির্ব্বিঘ্নে হয়ে গেছে। কিন্তু বৈকুণ্ঠ থাক তে এখানে বাস করে সুখ হচ্চে না। উপদ্রবত করা যাচ্ছে কিন্তু বুড়ো নড়ে না!
বৈকুণ্ঠের প্রবেশ।
বৈকুণ্ঠ। এই যে কেদার বাবু, আপনাকে শুকনো দেখাচ্চে যে? অসুখ করেনিত?
কেদার। ওর নাম কি— ডাক্তারে সকল রকম মানসিক পরিশ্রন নিষেধ করেছে—
বৈকুণ্ঠ। আহা, কি দুঃখের বিষয়! আপনি এখানেই কিছু দিন বিশ্রাম করুন!
কেদার। সেই রকমইত স্থির করেছি!
বৈকুণ্ঠ। তা দেখুন্—বেণী বাবুকে—
কেদার। বেণী বাবু নয়, বিপিন বাবুর কথা বল্চেন বোধ হয়—
বৈকুণ্ঠ। হাঁ হাঁ, বিপিন বাবুই বটে—ঐ যে তিনি ছোট বৌমার কে হন্—
কেদার। খুড়ো হন্—
বৈকুণ্ঠ। খুড়োই হবেন। তা তাঁকে আমার এই ঘরে থাক্তে দিয়েছেন—সেকি তাঁর—
কেদার। না, ওর নাম কি, তাঁর কোন অসুবিধে হয় নি—তিনি বেশ আছেন—
বৈকুণ্ঠ। জানেন্ ত কেদার বাবু, আমি এই ঘরেই লিখে থাকি—
কেদার। তা বেশ ত, আপনি লিখ্বেন— ওর নাম কি—আপনি লিখ্বেন—তাতে বিপিন বাবুর কোন আপত্তি নেই।
বৈকুণ্ঠ। না, আপত্তি কেন করবেন, লোকটি বেশ— কিন্তু তাঁর একটি অভ্যাস আছে, তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রায় সর্ব্বদাই গুন্ গুন্ করে গান করেন—তাতে লেখবার সময়—
কেদার। কি বলে— সে জন্যে ভাবনা কি! আপনি তাঁকে ডেকেই বলুন না—
বৈকুণ্ঠ। না না না না! সে থাক্! তিনি ভদ্রলোক—
কেদার। ওর নাম কি, আমিই তাঁকে ডেকে খুব করে ভর্ৎসনা করে দিচ্চি—
বৈকুণ্ঠ। না না কেদার বাবু, সে করবেন না— লেখার সময় গান ত আমার ভালই লাগে। কিন্তু আমি ভাবছিলুম হয় ত আর কোনো ঘরে বেণী বাবু একলা থাক্লে বেশ মন খুলে গাইতে পারেন।
কেদার। ওর নাম কি—ঠিক উল্টো! বিপিন বাবুর একটি লোক সর্ব্বদাই চাই—
বৈকুণ্ঠ। তা দেখেছি—বড় মিশুক্—হয় গান, নয় গল্প, করচেন্ই—তা আমি তাঁর কথা মন দিয়ে শুনে থাকি!— কিন্তু দেখ কেদার বাবু— কিছু মনে কোরো না ভাই—একটা বড় গুরুতর বেদনা পেয়েছি, সে কথা তোমাকে না বলে থাক্তে পাচ্চিনে। ভাই আমার সেই স্বরসূত্রসার পুঁথিখানি কে নিয়েছে!
কেদার। কোথায় ছিল বলুন্ দেখি!
বৈকুণ্ঠ। সে ত আপনি জানেন। এই ঘরে ঐ শেল্ফের উপর ছিল। আজকাল এঘরে সর্ব্বদা লোক আনাগোনা করচেন আমি কাউকে কিছুই বল্তে পারচিনে——কিন্তু শেল্ফের ঐ জায়গাটা শূন্য দেখচি আর মনে হচ্চে আমার বুকের ক’খানা পাঁজর খালি হয়ে গেছে!
কেদার। তবে আপনাকে—ওর নাম কি—খুলে বলি— অবিনাশ আপনার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যায়!
বৈকুণ্ঠ। অবু! সেত এ সব বই পড়ে না!
কেদার। পড়েনা—ওর নাম কি—বিক্রি করে!
বৈকুণ্ঠ। বিক্রি করে!
কেদার। নতুন প্রণয়—নতুন সখ্—ওর নাম কি—খরচ বেশি। আমি তাকে বলি, অবু—কি বলে ভাল—মাইনের টাকা থেকে কিছু কিছু কেটে নিয়ে দাদাকে দিলেই হয়। অবু বলে লজ্জা করে।
বৈকুণ্ঠ। ছেলেমানুষ! প্রণয়ের খাতিরও এড়াতে পারে না, আবার দাদার সম্মানটিও রাখ্তে হবে!
কেদার। ওর নাম কি—আমি আপনার বইখানি উদ্ধার করে আন্ব—
বৈকুণ্ঠ। তা যত টাকা লাগে! আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাক্ব।
কেদার। (স্বগত) বাজারে ত তার চার পয়সা দামও হল না— এ আরও হল ভাল— ধর্ম্ম ও রইল, কিছু পাওয়া ও গেল।
অবিনাশের প্রবেশ।
অবিনাশ। দাদা!
বৈকুণ্ঠ। কি ভাই অবু!
অবিনাশ। আমার কিছু টাকার দরকার হয়েছে—
বৈকুণ্ঠ। তাতে লজ্জা কি অবু! আমি বল্চি কি এখন থেকে তোমার টাকা তুমিই রাখ না ভাই—আমি বুড়ো হয়ে গেলুম— হারিয়ে ফেলি কি ভুলেই যাই—আমার কি মনের ঠিক আছে!
অবিনাশ। এ আবার কি নতুন কথা হল দাদা।
বৈকুণ্ঠ। নতুন কথা নয় ভাই—তুমি বিয়ে থাওয়া করে সংসারী হয়েছ— আমি ত সন্যাসী মানুষ—
অবিনাশ। তুমিই ত দাদা, আমার বিয়ে দিয়ে দিলে তাতেই যদি পর হয়ে থাকি, তবে থাক্— টাকা কড়ির কথা আর আমি বল্ব না! (প্রস্থান)
বৈকুণ্ঠ। আহা অবু রাগ কোরো না— শোনো আমার কথাটা আহা শুনে যাও!—
(“ভাব্তে পারিনে পরের ভাবনা” গাহিতে
গাহিতে বিপিনের প্রবেশ।)
বৈকুণ্ঠ। এই যে বেণী বাবু—
বিপিন। আমার নাম বিপিন বিহারী।
বৈকুণ্ঠ। হাঁহাঁ, বিপিন বাবু। আপনার বিছানায় ঐ যে বইগুলি রেখেচেন, ও গুলি পড়চেন বুঝি?
বিপিন। নাঃ পড়িনে, বাজাই।
বৈকুণ্ঠ। বাজান্? তা আপনাকে যদি বাঁয়া তব্লা, কি মৃদঙ্গ—
বিপিন। সে ত আমার আসে না— আমি বই বাজাই।
দেখুন্ বৈকুণ্ঠ বাবু, আপনাকে রোজ বল্ব মনে করি ভুলে যাই— আপনার এই ডেক্সো আর ঐ গোটাকতক শেল্ফ এখান থেকে সরাতে হচ্চে— আমার বন্ধুরা সর্ব্বদাই আসচে তাদের বসাবার জায়গা পাচ্চিনে—
বৈকুণ্ঠ। আর ত ঘর দেখিনে— দক্ষিণের ঘরে কেদার বাবু আছেন—ডাক্তার তাঁকে বিশ্রাম করতে বলেচে— পূবের ঘরটায় কে কে আছেন আমি ঠিক চিনিনে— তা বেণী বাবু—
বিপিন। বিপিন বাবু।
বৈকুণ্ঠ। হাঁহাঁ বিপিন বাবু— তা যদি ওগুলো এই এক পাশে সরিয়ে রাখি তাহলে কি কিছু অসুবিধে হয়?
বিপিন। অসুবিধা আর কি, থাকবার কষ্ট হয়। আমি আবার বেশ একটু ফাঁকা না হয়ে থাক্তে পারিনে। “ভাব্তে পারিনে পরের ভাবনা লো সই!—
ঈশানের প্রবেশ।
বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, এ ঘরে বেণী বাবুর—
বিপিন। বিপিন বাবুর—
বৈকুণ্ঠ। হাঁ, বিপিন বাবুর থাকার কিছু কষ্ট হচ্ছে।
ঈশান। কষ্ট হয়ে থাকে ত আর আবশ্যক কি, ওঁর বাপের ঘর দুয়োর কিছু নেই, না কি!
বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, চুপ্ কর!
বিপিন। কি রাস্কেল, তুই এত বড় কথা বলিস!
ঈশান। দেখ, গালমন্দ দিয়ো না বল্চি—
বৈকুণ্ঠ। আঃ ঈশেন থাম—
বিপিন। আমি তোদের এ ঘরে পায়ের ধুলো মুছতে চাইনে। আমি এখনি চল্লুম।
বৈকুণ্ঠ। যাবেন না বেণী বাবু। আমি গলবস্ত্র হয়ে বল্চি মাপ কর্বেন— (বৈকুণ্ঠকে ঠেলিয়া বিপিনের প্রস্থান) ঈশেন তুই কি করলি বল্ দেখি—তুই আর আমাকে বাড়িতে টিঁক্তে দিলিনে দেখ্চি।
ঈশান। আমিই দিলুম না বটে!
বৈকুণ্ঠ। দেখ্ ঈশেন, অনেক কাল থেকে আছিস তোর কথাবার্ত্তাগুলো আমাদের অভ্যাস হয়ে এসেছে, এরা নতুন মানুষ এরা সইতে পারবে কেন? তুই একটু ঠাণ্ডা হয়ে কথা কইতে পারিস্নে?
ঈশান। আমি ঠাণ্ডা হয়ে থাকি কি করে। এদের রকম দেখে আমার সর্ব্বশরীর জ্বল্তে থাকে!
বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, ওরা আমাদের নতুন কুটুম্ব— ওরা কিছুতে ক্ষুণ্ণ হলে অবিনাশের গায়ে লাগ্বে— সে আমাকেও কিছু বল্তে পারবে না—অথচ তার হল—
ঈশান। সে ত সব বুঝেছি। সেই জন্যেই ত ছোট বয়সে ছোট বাবুকে বিয়ে দেবার জন্যে কতবার বলেছি— সময়কালে বিয়ে হলে এতটা বাড়াবাড়ি হয় না।
বৈকুণ্ঠ। যা আর বকিস্নে ঈশেন—এখন যা— আমি সকল কথা একবার ভেবে দেখি!
ঈশান। ভেবে দেখো! এখন যে কথাটা বল্তে এসেছিলুম বলে নিই। আমাদের ছোট মার খুড়ি না পিসি, না কে এক বুড়ি এসে দিদি ঠাকরুণকে যে দুঃখ দিচ্চে সে ত আমার আর সহ্য হয় না!
বৈকুণ্ঠ। আমার নীরুমাকে! সে ত কারো কিছুতে থাকে না!
ঈশান। তাঁকে ত দিনরাত্তির দাসীর মত খাটিয়ে মারচে— তার পরে আবার মাগী তোমার নামে খোঁটা দিয়ে তাঁকে বলে কি না যে, তুমি তোমার ছোট ভাইয়ের টাকায় গায়ে ফুঁ দিয়ে বড়মানুষী করে বেড়াচ্চ। মাগীর যদি দাঁত থাক্ত ত নোড়া দিয়ে ভেঙ্গে দিতুন না!
বৈকুণ্ঠ। তা নীরু কি বলে?
ঈশান। তিনি ত তাঁর বাপেরই মেয়ে—মুখখানি যেন ফুলের মত শুকিয়ে যায়—একটি কথা বলে না—
বৈকুণ্ঠ। (কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া) একটা কথা আছে, যে সয় তারই জয়—
ঈশান। সে কথাটা আমি ভাল বুঝিনে! আমি একবার ছোট বাবুকে—
বৈকুণ্ঠ। খবরদার ঈশেন আমার মাথার দিব্যি দিয়ে বল্চি—অবিনাশকে কোন কথা বল্তে পারবিনে।
ঈশান। তবে চুপ করে বসে থাক্ব?
বৈকুণ্ঠ। না, আমি একটা উপায় ঠাউরেছি! এখানে জায়গাতেও আর কুলচ্চেনা—এঁদের সকলেরই অসুবিধে হচ্চে দেখতে পাচ্চি—তা ছাড়া অবিনাশের এখন ঘরসংসার হল—তার টাকা কড়ির দরকার, তার উপরে ভার চাপাতে আমার আর ইচ্ছে নেই—আমি এখান থেকে যেতে চাই—
ঈশান। সে ত মন্দ কথা নয়— কিন্তু—
বৈকুণ্ঠ। ওর আর কিন্তু টিন্তু নেই ঈশেন। সময় উপস্থিত হলেই প্রস্তুত হতে হয়।
ঈশান। তোমার লেখা পড়ার কি হবে?
বৈকুণ্ঠ। (হাসিয়া) আমার লেখা! সে আবার একটা জিনিষ! সবাই হাসে আমি কি তা জানিনে ঈশেন? ওসব রইল পড়ে। সংসারে লেখায় কারো কোন দরকার নেই!
ঈশান। ছোট বাবুকে ত বলে কয়ে যেতে হবে?
বৈকুণ্ঠ। তা হলে সে কিছুতেই যেতে দেবে না। সে ত আর আমাকে যাও বল্তে পারবে না ঈশেন! গোপনেই যেতে হবে— তার পরে তাকে লিখে জানাব। যাই আমার নীরুকে একবার দেখে আসিগে!
তিনকড়ি ও কেদারের প্রবেশ।
তিনকড়ি। দাদা, তুইত আমাকে ফাঁকি দিয়ে হাঁসপাতালে পাঠালি—সেখান থেকেও আমি ফাঁকি দিয়ে ফিরেছি—কিছুতেই মলেম না!
কেদার। তাইতরে দিব্যি টিঁকে আছিস্ যে!
তিনকড়ি। ভাগ্যে দাদা একদিনও দেখ্তে যাও নি—
কেদার। কেনরে!
তিনকড়ি। যম বেটা ঠাউরালে এ ছোঁড়ার দুনিয়ায় কেউ নেই—নেহাৎ তাচ্ছিল্য করে নিলে না। ভাই তোকে বল্ব কি, এই তিনকড়ের ভিতরে কতটা পদার্থ আছে সেইটে দেখবার জন্যে মেডিকাল কালেজের ছোকরাগুলো সব ছুরি উঁচিয়ে বসে ছিল—দেখে আমার অহঙ্কার হত! যাই হোক্ দাদা তুমি ত এখানে দিব্যি জমিয়ে বসেচ।
কেদার। যা, যা, মেলা বকিস্নে। এখন এ আমার আত্মীয় বাড়ি তা জানিস্?
তিনকড়ি। সমস্তই জানি— আমার অগোচর কিছুই নেই। কিন্তু বুড়ো বৈকুণ্ঠকে দেখ্চিনে যে! তাকে বুঝি ঠেলে দিয়েছিস্? ঐটে তোর দোষ! কাজ ফুরলেই—
কেদার। তিনকড়ে! ফের! কানমলা খাবি!
তিনকড়ি। তা দে মলে। কিন্তু সত্যি কথা বল্তে হয়, বৈকুণ্ঠকে যদি তুই ফাঁকি দিস্ তা হলে অধর্ম্ম হবে— আমার সঙ্গে যা করিস্ সে আলাদা—
কেদার। ইস্ এত ধর্ম্ম শিখে এলি কোথা!
তিনকড়ি। তা যা বলিস্ ভাই— যদিচ তুমি আমি এত দিন টিঁকে আছি তবু ধর্ম্ম বলে একটা কিছু আছে। দেখ কেদার দা, আমি যখন হাঁসপাতালে পড়েছিলুম, বুড়োর কথা আমার সর্ব্বদা মনে হত— পড়ে পড়ে ভাবতুম, তিনকড়ি নেই এখন কেদারদার হাত থেকে বুড়োকে কে ঠেকাবে! বড় দুঃখ হত।
কেদার। দেখ্ তিনকড়ে তুই যদি এখানে আমাকে জ্বালাতে আসিস্ তা হলে—
তিনকড়ি। মিথ্যে ভয় করচ দাদা! আমাকে আর হাঁসপাতালে পাঠাতে হবে না। এখানে তুমি একলাই রাজত্ব করবে। আমি দুদিনের বেশি কোথাও টিঁকতে পারিনে, এ জায়গাও আমার সহ্য হবে না।
কেদার। তাহলে আর আমাকে দগ্ধাস্ কেন— না হয় দুটো দিন আগেই গেলি।
তিনকড়ি। বৈকুণ্ঠের খাতাখানা না চুকিয়ে যেতে পারচিনে—তুমি তাকে ফাঁকি দেবে জানি। অদৃষ্টে যা থাকে ওটা এই অভাগাকেই শুন্তে হবে।
কেদার। এ ছোঁড়াটাকে মেরে ধরে গাল দিয়ে কিছুতেই তাড়াবার যো নেই।—তিনকড়ে তোর ক্ষিধে পেয়েছে?
তিনকড়ি। কেন আর মনে করিয়ে দাও ভাই?
কেদার। চল্ তোকে কিছু পয়সা দিই গে—বাজার থেকে জলখাবার কিনে এনে খাবি।
তিনকড়ি। এ কি হল! তোমারও ধর্ম্মজ্ঞান! হঠাৎ ভালমন্দ একটা কিছু হবেনাত! (উভয়ের প্রস্থান)
ঈশান ও বৈকুণ্ঠের প্রবেশ।
বৈকুণ্ঠ। ভেবেছিলুম, খাতাপত্রগুলো আর সঙ্গে নেব না—শুনে মা নীরু কাঁদ্তে লাগ্লে— ভাব্লে বুড়ো বয়সের খেলাগুলো বাবা কোথায় ফেলে যাচ্চে। এগুলো নে ঈশেন!—ঈশেন।
ঈশান। কি বাবু!
বৈকুণ্ঠ। ছোটর উপর বড়র যে রকম স্নেহ, বড়র উপর ছোটর সে রকম হয় না—না ঈশেন!
ঈশান। তাইত দেখ্তে পাই।
বৈকুণ্ঠ। আমি চলে গেলে অবু বোধ হয় বিশেষ কষ্ট পাবে না!
ঈশান। না পাবারই সম্ভব। বিশেষ—
বৈকুণ্ঠ। হাঁ, বিশেষ তার নতুন সংসার হয়েছে—আর ত আত্মীয় স্বজনের অভাব নেই—কি বলিস্ ঈশেন—
ঈশান। আমিও তাই বল্ছিলুম।
বৈকুণ্ঠ। বোধ হয় নীরুমার জন্যে তার মনটা—নীরুকে অবু বড় ভালবাসে; না ঈশেন!
ঈশান। আগে ত তাই বোধ হত, কিন্তু—
বৈকুণ্ঠ। অবিনাশ কি এ সব জানে?
ঈশান। তা কি আর জানেন না? তিনি যদি এর মধ্যে না থাক তেন, তা হলে কি আর বুড়িটা সাহস কর ত—
বৈকুণ্ঠ। দেখ্ ঈশেন, তোর কথাগুলো বড় অসহ্য! তুই একটা মিষ্টি কথা বানিয়েও বলতে পারিস নে? এতটুকু বেলা থেকে আমি তাকে মানুষ করলুম,—একদিনের জন্যেও চোখের আড়াল করি নি,—আমি চলে গেলে তার কষ্ট হবে না—এমন কথা তুই মুখে আনিস্ হারামজাদা বেটা! সে জেনে শুনে আমার নীরুকে কষ্ট দিয়েছে! লক্ষ্মীছাড়া পাজি, তার কথা শুনলে বুক ফেটে যায়!
(“ভাব্তে পারিনে পরের ভাবনা” গাহিতে
গাহিতে বিপিনের প্রবেশ।)
বিপিন। ভেবেছিলুম ফিরে ডাকবে। ডাকে না যে! এই যে বুড়ো এইখেনেই আছে। বৈকুণ্ঠ বাবু আমার জিনিষপত্র নিতে এলুম। আমার ঐ হুঁকোটা, আর ঐ ক্যাম্বিসের ব্যাগটা। ঈশেন শীগ্গির মুটে ডাক।
বৈকুণ্ঠ। সে কি কথা—আপনি এখানেই থাকুন! আমি করযোড় করে বল্চি আমাকে মাপ করুন্ বেণী বাবু।
বিপিন। বিপিন বাবু।
বৈকুণ্ঠ। হাঁ, হাঁ, বিপিন বাবু! আপনি থাকুন্— আমরা এখনি ঘর খালি করে দিচ্চি।
বিপিন। এ বইগুলো কি হবে?
বৈকুণ্ঠ। সমস্তই সরাচ্চি। (শেল্ফ হইতে বই ভূমিতে নাবাইতে প্রবৃত্ত)
ঈশান। এ বই গুলিকে বাবু যেন বিধবার পুত্রসন্তানের মত দেখ্ত—ধূলো নিজের হাতে ঝাড়ত— আজ ধূলোয় ফেলে দিচ্চে! (চক্ষু মোচন)
বিপিন। কেদারের ঘরে আফিমের কৌটা ফেলে এসেছি—নিয়ে আসিগে! ভাব্তে পারিনে পরের ভাবনা লো সই!”
তিনকড়ির প্রবেশ।
তিন। এই যে পেয়েছি, বৈকুণ্ঠ বাবু! ভাল ত?
বৈকুণ্ঠ। কি বাবা, তুমি ভাল আছ? অনেক দিন দেখিনি।
তিনকড়ি। ভয় কি বৈকুণ্ঠ বাবু, আবার অনেক দিন দেখ্তে পারেন। ধরা দিয়েছি; এখন আপনার খাতাপত্র বের করুন্!
বৈকুণ্ঠ। সে সব আর নেই তিনকড়ি— তুমি এখন নিশ্চিন্তমনে এখানে থাকতে পারবে।
তিনকড়ি। তা হলে আর লিখ্বেন না?
বৈকুণ্ঠ। না, সে সব খেয়াল ছেড়ে দিয়েছি।
তিনকড়ি। ছেড়ে দিয়েছেন সত্যি বল্চেন?
বৈকুণ্ঠ। হাঁ ছেড়ে দিয়েছি।
তিনকড়ি। আঃ বাঁচ্লেম! তা হলে ছুটি— আমি যেতে পারি?
বৈকুণ্ঠ। কোথায় যাবে বাপু?
তিনকড়ি। অলক্ষ্মী যেখানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান্! ভেবেছিলুম মেয়াদ ফুরোয়নি—খাতা এখনো অনেকখানি বাকি আছে—শুনে যেতে হবে।— তা হলে প্রণাম হই।
বৈকুণ্ঠ। এস বাবা, ঈশ্বর তোমার ভাল করুন!
তিনকড়ি। উঁহুঁ! একটা কি গোল হয়েছে ঠিক বুঝ্তে পারচিনে! ভাই ঈশেন, এতদিন পরে দেখা, তুমিও ত আমাকে মার মার শব্দে খেদিয়ে এলে না— তোমার জন্যে ভাবনা হচ্চে!
অবিনাশের প্রবেশ।
অবিনাশ। দাদা, কোথা থেকে তুমি যত সব লোক জুটিয়েছ—বাড়ির মধ্যে বাইরে কোথাও ত আর টিঁকতে দিলে না!
বৈকুণ্ঠ। তারা কি আমার লোক অবু? তোমারই ত সব—
অবিনাশ। আমার কে! আমি তাদের চিনিনে! কেদারের সব আত্মীয়— তুমিই ত তাদের স্থান দিয়েছ! সেই জন্যেই ত আমি তাদের কিছু বল্তে পারিনে। তা, তুমি যদি পার ত তাদের সাম্লাও দাদা— আমি বাড়ি ছেড়ে চল্লুম।
বৈকুণ্ঠ। আমিই ত যাব মনে করছিলুম—
তিনকড়ি। তার চেয়ে তাঁরা গেলেই ত ভাল হয়। আপনারা দুজনেই গেলে তাঁদের আদর অভ্যর্থনা করবে কে?
অবিনাশ। বাড়ির মধ্যে একটা কে বুড়ি এসেছে, সে ত ঝগড়া করে একটাও দাসী টিঁক্তে দিলে না—তাও সয়েছিলুম—কিন্তু আজ আমি স্বচক্ষে দেখ্লুম, সে নীরুর গায়ে হাত তুল্লে— আর সহ্য হল না—তাকে এইমাত্র গঙ্গা পার করে দিয়ে আসচি!
ঈশান। বেঁচে থাক ছোট বাবু— বেঁচে থাক!
বৈকুণ্ঠ। অবিনাশ, তিনি ছোট বৌমার আত্মীয়া হন্—তাঁকে—
তিনকড়ি। কেউ না, কেউ না, ও বুড়ি কেদারদার পিসি। ওকে বিবাহ করে কেদারের পিসে আর বাঁচতে পারলে না— বিধবা হয়ে ভাইয়ের বাড়ি আস্তে ভাইও মরে’ বাঁচ্ল, এখন কেদারদা নিজের প্রাণ রক্ষে করতে ওকে তোমাদের এখানে চালান করেছে!
অবিনাশ। দাদা, তোমার এ বইগুলো মাটিতে নাবাচ্চ কেন? তোমার ডেক্সো গেল কোথায়?
ঈশান। এ ঘরে যে বাবুটি থাকেন বই থাক্লে তাঁর থাক্বার অসুবিধে হয়, বড় বাবুকে তিনি লুটিস্ দিয়েছেন—
অবিনাশ। কি! দাদাকে ঘর ছেড়ে যেতে হবে!
বিপিনের প্রবেশ।
বিপিন। “ভাব্তে পারিনে পরের ভাবনা”—
অবিনাশ। (তাড়া করিয়া গিয়া) বেরও, বেরও, বেরও বল্চি, বেরও এখান থেকে— বেরও এখনি—
বৈকুণ্ঠ। আহা, থাম অবু থাম, থাম, কি কর—বেণী বাবুকে—
বিপিন। বিপিন বাবুকে—
বৈকুণ্ঠ। হাঁ, বিপিন বাবুকে অপমান কোর না—
তিনকড়ি। কেদারদাকে ডেকে আন্তে হচ্চে— এ তামাসা দেখা উচিত। (প্রস্থান)
(ঈশান বিপিনকে বলপূর্ব্বক বাহির করিল)
বিপিন। ঈশেন একটা মুটে ডাক— আমার হুঁকো আর ক্যাম্বিশের ব্যাগটা— (প্রস্থান)
বৈকুণ্ঠ। ঈশেন, হারামজাদা কোথাকার—ভদ্রলোককে তুই— তোকে আর—
ঈশান। আজ আমাকে গাল দাও, ধরে মার, আমি কিছু বল্ব না—প্রাণ বড় খুসি হয়েছে।
কেদারকে লইয়া তিনকড়ির প্রবেশ।
কেদার। ওর নাম কি, অবিনাশ ডাক্চ?
অবিনাশ। হাঁ—তোমার চুলো প্রস্তুত হয়েছে, এখন ঘর থেকে নাব্তে হবে!
কেদার। তোমার ঠাট্টাটা অবিনাশ অন্য লোকের ঠাট্টার চেয়ে— ওর নাম কি— কিছু কড়া হয়!
বৈকুণ্ঠ। আহা, অবিনাশ, তুমি থাম!—কেদার বাবু, অবিনাশের উদ্ধত বয়েস— আপনার আত্মীয়দের সঙ্গে ওঁর ঠিক্—
অবিনাশ। বন্ছিল না! তাই তিনি তাঁদের হাত ধরে সদর দরজার বার করে দিয়ে এসেছেন—
তিনকড়ি। এতক্ষণে আবার তাঁরা খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকেচেন—সাবধান থাক্বেন—
অবিনাশ। এখন তোমাকেও তাঁদের পথে—
তিনকড়ি। ওকে দোস্রা পথ দেখাবেন, সব কটিকে একত্রে মিল্তে দেবেন না—
কেদার। অবু— ওর নাম কি— তা হলে আমার সম্বন্ধে করতলের পরিবর্ত্তে পদতলেই স্থির হল—
অবিনাশ। হাঁ—যার যেখানে স্থান—
কেদার। ঈশেন, তা হলে একটা ভাল দেখে সেকেণ্ডক্লাস্ গাড়ি ডেকে দাওত!
তিনকড়ি। ভেবেছিলুম এবার বুঝি একলা বেরতে হবে— শেষ, দাদাও জুট্ল। বরাবর দেখে আস্চি কেদারদা, শেষকালটা তুমি ধরা পড়ই, আমি সর্ব্বাগ্রেই সেটা সেরে রাখি—আমার আর ভাবনা থাকে না!
কেদার। তিনকড়ে! ফের!—
বৈকুণ্ঠ। কেদার বাবু, এখনি যাচ্ছেন কেন? আসুন্, কিঞ্চিৎ জলযোগ করে নিন্—
তিন। তা বেশ ত, আমাদের তাড়া নেই!
বৈকুণ্ঠ। ঈশেন!