বৌদ্ধ-ভারত/চতুর্থ অধ্যায়
চতুর্থ অধ্যায়
বৌদ্ধ সংঘ ও জনসাধারণ
বিনয়পিটকের পাতিমোক্খভাগে বৌদ্ধভিক্ষুদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিপাল্য নিয়মবলী লিপিবদ্ধ আছে। সেইগুলি পাঠ করিয়া পাঠক ভাবিতে পারেন, এত বাধা বাঁধন কেন এত গুলি ছোটবড় বিধিনিষেধের সৃষ্টি করিয়া ভগবান্ বুদ্ধ হয়তো ভিক্ষুদের স্বাধীনতার উপর অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ করিয়া থাকিবেন ৷
এই বিধিনিষেধগুলির পশ্চাতে বুদ্ধের ধর্ম্মে ও সংঘে স্বাধীনতার যে অপূর্ব্ব বিকাশ ঘটিয়াছিল তাহাই আমাদের আলোচ্য ও বিবেচ্য। বুদ্ধ যে নির্ব্বাণ বা মুক্তির ধর্ম্ম প্রচার করিলেন, সেই ধর্ম্মে সিদ্ধিলাভের জন্য তিনি মানুষকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়াছেন। অন্য কাহারো মুখাপেক্ষী না হইয়া মানুষ আপনি ভিতর হইতে ধার্ম্মিক হইয়া উঠিবে, সে আপনি আপনার অবলম্বন হইবে ইহাই তাঁহার উপদেশ। দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি মুক্তির পত্রিকা অথবা স্বর্গের চাবি হাতে করিয়া আসিয়া ধর্ম্মার্থীকে শাসাইবেন এমন বিড়ম্বনা বৌদ্ধধর্ম্মে নাই। মানষকে তিনি যে ধর্ম্মের উদারক্ষেত্রে আহ্বান করিয়াছেন, সেখানে তাহার মনুষ্যত্বের সর্ব্বাঙ্গ বিকাশে কোন বাধাই ঘটিতে পারে না।
বৃদ্ধের এই পবিত্র ধর্ম্মের রসধারাসিক্ত উর্ব্বরক্ষেত্রে সংঘের উদ্ভব হইয়াছিল। সংঘ তাঁহারই সষ্টি, তথাপি তিনি কখনো আপনাকে সংঘের নেতা বা চালক বলিয়া প্রকাশ করেন নাই। অন্তিম জীবনে বৈশালীর বিহারে তিনি উপস্থায়ক আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছিলেন—"আনন্দ, সংঘ আমার কাছে কি প্রত্যাশা করিয়া থাকেন? আমি অকপটে সকলের কাছে আমার উপলব্ধ সত্য ব্যাখ্যা করিয়াছি, কোনো কথাই তো গোপন করি নাই। আমি কখনো এ কথা মনে করি না যে, আমি সংঘের চালক অথবা সংঘ আমার অধীন। যদি কেহ এমন মনে করেন, তিনি নেতার আসন গ্রহণ করিয়া সংঘকে দৃঢ়রূপে বাঁধিবার নিয়ম প্রণালী প্রণয়ন করুন। সংঘ রক্ষার জন্য আমি কোনো বাঁধা নিয়ম প্রণালী রাখিয়া যাইতে ইচ্ছা করি না।”
মহাপুরুষ বুদ্ধের এই উক্তি অতি সুস্পষ্ট। সংঘের স্বাভাবিক বৃদ্ধির পথে অন্তরায় হইয়া তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে কখনো আপনার অধীন করিতে চাহেন নাই। তাঁহার প্রেম ও সাধনায় সংঘ সৃষ্ট হইলেও তিনি অন্ধ স্নেহেব বশবর্ত্তী হইয়া শিশুটিকে একান্তভাবে আপনি কোলে আঁক্ড়াইয়া ধরিলেন না; পরন্তু তাঁহাকে মুক্তির অবারিত প্রান্তরে ছাড়িয়া দিলেন। সেখানে শ্রদ্ধাশীল শ্রাবক ও ভিক্ষুদের স্নেহরস পান করিয়া শিশু আনন্দে বাড়িতেছিল। এইরূপ স্বাধীনভাবে বাড়িতে পাইয়াছিল বলিয়াই এক সময়ে সংঘ ভারতব্যাপী সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠান হইয়া উঠিয়াছিল। এই সৃষ্টিব্যাপারে বুদ্ধের কৃতিত্ব ও মহিমা তো আছেই; ভিক্ষুদের ও লোক সাধারণের সহানুভূতি ও সংস্রব সুস্পষ্ট দেখা যাইয়া থাকে।
বৌদ্ধ বিহারে যে সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়াছিল সেই সভ্যতা বৌদ্ধসাধুদিগের ও তদানীন্তন জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বৃহৎ বনষ্পতির ন্যায় সংঘ অতি ক্ষীণ প্রারম্ভ হইতে ধীরে ধীরে মহৎ পরিণামের দিকে অগ্রসর হইতেছিল। সংঘের নিয়মাবলী প্রয়োজনের তাগিদে এইরূপ হইয়া উঠিয়াছে। ইহা ব্যক্তি বিশেষের সৃষ্টি নহে, অথবা কোনো স্থানে নির্দ্ধারিত হয় নাই। নিয়মগুলি সমাজের ও সংঘের মধ্যে আলোচিত হইয়া সাধারণ ভাবে গৃহীত হইত। লোকের দাবী, সুখ-সুবিধা প্রয়োজনাদির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া নিয়ম প্রণীত ও প্রবর্ত্তিত হইয়াছে।
মহাবগ্গে “সাদ্ধিবিহারিকের” কর্ত্তব্য বিস্তারিত বর্ণিত আছে। নবীন ভিক্ষু অপর কোনো প্রবীণ ভিক্ষুকে উপাধ্যায় বরণ করিয়া তাঁহারই উপদেশানুসারে জীবন যাপন করিবেন, এইরূপ নিয়ম আছে। উক্ত নবীন ভিক্ষু স্থবিরের সহিত একই বিহারে বাস করেন বলিয়া তাঁহাকে সার্দ্ধবিহারী বা ‘সাদ্ধিবিহারিক’ বলা হয়। এইরূপ উপাধ্যায়-বরণ-প্রথা প্রথমে ছিল না। দেখা গিয়াছিল, নবীন ভিক্ষুরা জনপদে যাইবার সময়ে যথোচিত বহির্ব্বাস পরিধান করেন না, উচ্ছিষ্ট পাত্রে অন্যের উচ্ছিষ্ট দ্রব্য গ্রহণ করিয়া আহার করেন, ভোজন সময়ে ভোজনগৃহে —“ভাত চাই, ঝোল চাই” বলিয়া চীৎকার করেন।
তাহাদের এই অশিষ্ট ব্যবহারে জনপদবাসীরা উত্যক্ত হইত। এইরূপ ব্যবহারের কথা পরস্পর বলাবলি করিত এবং লোকে ক্রুদ্ধ হইয়া বলিত, “এ কেমন ব্যাপার, শাক্যপুত্রীয় শ্রমণেরা এমন অভদ্র বেশে লোকালয়ে ভিক্ষায় আসিয়া থাকেন? তাঁহারা ভোজন সময়ে ভোজনালয়ে এমন কোলাহল করেন কেমন করিয়া?”
জনপদবাসীদের এই সকল কথা মিতাচার, বিনীত ও বুদ্ধিমান্ ভিক্ষুদের কানে গেল। তাঁহাদের মধ্যেও এই সকল কথার আলোচনা হইল। তাঁহারা এই অভিযোগের কথা ভগবান্ বুদ্ধকে নিবেদন করিলেন। তিনি অর্ব্বাচীন ভিক্ষুদিগকে তিরস্কার করিয়া কহিলেন—“তোমাদের এমন ব্যবহার করা একান্ত অসঙ্গত, এরূপ করিলে লোকে এই ধর্ম্মে আশ্রয় গ্রহণ করিতে চাহিবে না। পরন্তু যাহারা এই ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে তাহারাও শ্রদ্ধা হারাইয়া এই ধর্ম্মের আশ্রয় হইতে সরিয়া পড়িবে। এই উপলক্ষে তিনি ভিক্ষুদিগকে একটি ধর্ম্মোপদেশ দিয়া বুঝাইয়া দিলেন যে, নির্ব্বাণের শান্তি, সংযমের দ্বারাই লভ্য, শিষ্টতার দ্বারাই লভ্য এবং বীর্য্যের দ্বারাই লভ্য।
এই দিন স্থির হইল অপ্রাপ্ত-বয়স্ক ভিক্ষু কোন প্রবীণ ভিুক্ষকে উপাধ্যায় বরণ করিয়া শ্রেয়োলাভের সাধনা করিবেন। শ্রদ্ধায় ও নিষ্ঠায় এক হইয়া নবীন ও প্রবীণ ভিক্ষু পিতাপুত্রের ন্যায় পরস্পরের সহায় হইবেন ও শ্রদ্ধাপ্রীতিতে তাঁহাদের সম্বন্ধ মধুর হইয়া উঠিবে।
এইরূপে যে সার্দ্ধবিহারীর জন্য উপাধ্যায় গ্রহণের বিধি প্রবর্ত্তিত হইল, এই বিধি ভগবান্ বুদ্ধ করিয়াছেন তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু এই বিধি কি সঙ্ঘের শান্তশিষ্ট ভিক্ষুরা প্রার্থনা করেন নাই। জনপদবাসীদের অভিযোগের মধ্যেও কি এমনই একটী অভিলাষ ব্যক্ত ছিল না।
এমন করিয়া বৌদ্ধবিধিগুলির আলোচনা করিলে দেখা যায় যে, এই শাস্ত্রে বিধি-নিষেধের যে বিস্তৃত তালিকা আছে ভগবান্ বুদ্ধ তাহা প্রভুর ন্যায় সঙ্ঘের মাথায় বোঝার মত চাপাইয়া দেন নাই। বিধিগুলির প্রবর্ত্তনের ইতিহাসের মধ্যে দেশের লোকের ও সংঘের সাধদের অভিপ্রায় সস্পষ্ট অভিব্যক্ত আছে।