বৌদ্ধ-ভারত/পঞ্চম অধ্যায়
পঞ্চম অধ্যায়
বৌদ্ধ ধর্মের অভ্যুদয় ও বিস্তার
ভগবান্ বদ্ধ কাশীর নিকটবর্ত্তী মৃগদাব নামক স্থানে পঞ্চশিষ্য সমীপে তাঁহার সদ্দ্ধর্ম প্রথমতঃ প্রচার করিয়াছিলেন। অতঃপর কাশীধামে এই ধর্ম্ম প্রচারিত হয়। এই নগরের যশ নামক এক বণিক তনয় বুদ্ধের মুখে নবধর্ম্মের অমৃতময়ী বাণী শ্রবণ করিয়া উক্ত ধর্ম্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা কাশীর প্রসিদ্ধ ধনী ছিলেন। যশের মাতাপিতাও বুদ্ধের শিষ্য হইয়াছিলেন।
এইরূপে নূতন ধর্ম্ম ধীরে ধীরে যখন লোকমধ্যে প্রচারিত হইতেছিল তখনই প্রচারের সুবিধার নিমিত্ত বুদ্ধশিষ্যদের সঙ্ঘবদ্ধ হইবার প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছিল। ভগবান্ বুদ্ধ শিষ্যদিগকে বলিয়াছিলেন—“তোমরা দলবদ্ধ হইয়া সত্যপথে অগ্রসর হইতে থাক, একাকী সত্য-পথে চলিতে চলিতে কেহ কেহ হয়ত দুর্ব্বলতার বশবর্ত্তী হইয়া বিপথগামী হইতে পারে। তোমরা পুণ্যে প্রেমে ও সত্যানুরাগে এক হইয়া বহুজনের হিত কামনায়, এই আদিকল্যাণ, অন্তকল্যাণ, মধ্য-কল্যাণ সদ্ধর্ম্মের কাহিনী প্রচার কর। পৃথিবীতে ধর্ম্মরাজ্য স্থাপিত হউক। তোমরা লোকের কাছে ঘোষণা কর, তাহাদের জীবন পবিত্র। এই ধর্ম্মবাণী নিঃসন্দেহ তাহাদের চিত্তস্পর্শ করিবে।”
এই সময়ে উরবিল্বে কাশ্যপ নামক এক প্রসিদ্ধ অগ্নিউপাসক ছিলেন। তিনি ও তাঁহার দুইভ্রাতা তাহাদের সহস্র শিষ্যসহ বুদ্ধের শিষ্য হওয়ায় নবধর্ম্মের প্রতি লোকের শ্রদ্ধা বর্দ্ধিত হইতে লাগিল।
এই সময়ে বিম্বিসার মগধের রাজা ছিলেন। বুদ্ধ শিষ্যগণসহ মগধের রাজধানী রাজগৃহে ধর্ম্ম প্রচারার্থ গমন করেন। মগধরাজ নবধর্ম্মে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া তাঁহার বেণুবন নামক প্রমোদ উদ্যান বুদ্ধকে দান করিয়াছিলেন। এই সময়ে সুপ্রসিদ্ধ সারিপুত্র ও
বুদ্ধ উপদেষ্টা
মৌদ্গল্যায়ন বুদ্ধের শিষ্য হইয়াছিলেন। এইরূপে মগধ রাজ্যে নতন ধর্ম্ম ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। বিম্বিসার অঙ্গদেশ জয় করিয়াছিলেন, সুতরাং অঙ্গদেশ তখন মগধরাজ্যভুক্ত ছিল।
নবধর্ম প্রচার যাত্রায় বাহির হইয়া ভগবান্ বুদ্ধ কপিলবাস্তু নগরে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার বৃদ্ধ পিতা তখন জীবিত ছিলেন। এই নগরের বহুলোক নবধর্ম্ম গ্রহণ করিলেন। এই সময়ে তাঁহার পিতৃব্যপুত্ত্র আনন্দ নবধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া তাঁহার উপস্থায়ক হইলেন। আনন্দ মনোপ্রাণে ভগবান্ বুদ্ধের সেবা করিতেন, তিনি তাঁহার দক্ষিণ বাহুবৎ সর্ব্বদা সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেন। আনন্দ তাঁহার আজ্ঞাপালনের নিমিত্ত সর্ব্বদা এমনভাবে সতর্ক থাকিতেন যে, তাঁহাকে কদাচ দ্বিতীয় আহ্বান করিবার প্রয়োজন হইত না।
আনন্দের অনুরোধে বুদ্ধ নারীদিগকে সন্ন্যাস-দানে সম্মত হইয়াছিলেন। বিমাতা মহাপ্রজাবতী গৌতমী সর্ব্বপ্রথমে ভিক্ষুণী হইলেন। বুদ্ধের পত্নী যশোধরাও বৌদ্ধধর্ম্মে দীক্ষা পাইয়াছিলেন। পুত্ত্র রাহলও নবধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন।
ধর্ম্মচক্র প্রবর্ত্তনের পরে ভগবান্ বুদ্ধ প্রায় ৪৫ বৎসর জীবিত ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি বৈশালী ও উহার নিকটবর্ত্তীস্থানে ধর্ম্ম প্রচার করেন। এই সময়ে তাঁহার স্বাস্থ্য ভগ্নপ্রায় হইয়াছিল। পাবার চুন্দ নামক এক অনুরাগী শিষ্যের আম্রকাননে বাস করিয়া তিনি কিছু দিন ধর্ম্ম প্রচার করিতেছিলেন। চুন্দ একদিন তাঁহাকে ভোজন করাইয়াছিলেন। উহার পরে তাঁহার রক্তামাশয় রোগ জন্মে। অসুস্থ দেহেই তিনি কুশী নগরে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে একস্থলে তিনি ক্লান্ত হইয়া পড়েন। আনন্দ তাঁহাকে শীতল নির্ম্মল জল পান করাইয়া সুস্থ করেন। অতঃপর তিনি শিষ্যগণসহ হিরণ্যবতী নদীর তীরবর্ত্তী কুশী নগরের উপকণ্ঠে মল্লদের শালবনে গমন করেন। এই উদ্যানেই তিনি পরিনির্ব্বাণ লাভ করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি আনন্দকে বলিয়াছিলেন,—“হে আনন্দ, আমার মৃত্যুর পরে আমার প্রবর্ত্তিত ধর্ম্মই তোমাদের চালক হইবে।”
বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপুরুষ বুদ্ধ পরিনির্ব্বাণ লাভ করেন। তাঁহার অস্থি প্রভৃতি দেহ-ধাতু গ্রহণের জন্য আট রাজ্য হইতে প্রতিনিধিগণ কুশীনগরে আগমন করিয়াছিলেন। দেহধাতুর বিভাগ লইয়া ইহাদের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। দ্রোণ নামক এক ব্রাহ্মণ অস্থি ভাগ করিয়াছিলেন। তিনি সকলের অনুমতিক্রমে যে পাত্রে অস্থি রক্ষিত হইয়াছিল তাহা গ্রহণ করেন। অস্থিবিভাগ শেষ হইবার পরে মৌর্য্যগণ কুশী নগরে আগমন করেন, তাঁহারা দেহধাতু না পাইয়া চিতার অঙ্গার লইয়া যান। এই সকলের দ্বারা উত্তরকালে আটটি শরীরস্তূপ, একটি কুম্ভস্তূপ এবং একটি অঙ্গারস্তূপ নির্ম্মিত হইয়াছিল।
বৌদ্ধধর্ম্মের প্রাদুর্ভাবকালে ভারতবর্ষে অঙ্গ, মগধ, কাশী, কোশল, ভজ্জি, মল্ল, চেদি, বংশ, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, সুরসেন, অশ্বক. অবন্তী, গান্ধার, কাম্বোজ এই ষোলটি বৃহৎ রাজ্য ছিল। বৃদ্ধের জীবদ্দশায়ই এই সকলের অধিকাংশ রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হইতেছিল। বৌদ্ধশাস্ত্র পাঠে ইহা জ্ঞাত হওয়া যায় যে, ভগবান্ বুদ্ধ স্বয়ং, তাঁহার ধর্ম্ম অঙ্গ, মগধ, কাশী, কোশল, ভজ্জি ও মল্ল দেশে প্রচার করিয়াছিলেন!
বুদ্ধের পরিনির্ব্বাণলাভের পরে একবিংশতি দিবসে তাঁহার দেহধাতু বিভক্ত হয়। ঐ দিবস মহাকাশ্যপ ভিক্ষু সংঘে প্রস্তাব করেন— “পঞ্চশত ভিক্ষু রাজগৃহে বর্ষাবাস গ্রহণপূর্ব্বক ধর্ম্ম ও বিনয় সমবেতভাবে আবৃত্তি করুন।” এই প্রস্তাব যথারীতি প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত হইল।[১]
বেরভার পর্ব্বতের পার্শ্বে সপ্তপর্ণী গৃহাদ্বারে মগধরাজ অজাতশত্রু এক পরম রমণীয় সভামণ্ডপ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। এই মণ্ডপের ভিত্তিস্তম্ভ ও সোপান সুবিভক্ত করা হইয়াছিল। নানা প্রকার লতা ও মাল্যদ্বারা মণ্ডপ সুচিত্রিত করা হইয়াছিল।
শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে এই মহাসঙ্গীতির অধিবেশন আরম্ভ হয়। আনন্দপ্রমুখ পাঁচশত ভিক্ষু উপবিষ্ট হইলে সঙ্ঘস্থবির মহাকাশ্যপ ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন— “বন্ধগণ ধর্ম্ম ও বিনয় ইহার মধ্যে কোন্টী আমরা প্রথমে আবৃত্তি করিব?”
ভিক্ষুগণ উত্তর করিলেন—“মাননীয় মহাকাশ্যপ, বিনয় বুদ্ধশাসনের আয়ু, বিনয় থাকিলে বুদ্ধশাসন থাকিবে, অতএব প্রথমে আমরা বিনয়েরই আবৃত্তি করি।”
সঙ্ঘস্থবির জিজ্ঞাসা করিলেন—“কে অগ্রবর্ত্তী হইবেন?”
আয়ুষ্মান্ উপালি।
কেন আনন্দ কি সমর্থ নহেন্? তিনি যে সমর্থ নহেন তাহা নহে, কিন্তু ভগবান্ জীবিত অবস্থাতেই বলিয়া গিয়াছেন যে বিনয়ধর (বিনয়জ্ঞ) সমূহের মধ্যে স্থবির উপালিই শ্রেষ্ঠ। অতএব তাঁহাকেই জিজ্ঞাসা করিয়া আমরা বিনয় আবৃত্তি করিব।
অনন্তর মহাকাশ্যপ উপালিকে প্রশ্ন করিলেন—“বন্ধু উপালি, ভগবান্ প্রথম পারজিক (বিনয় পিটকের অন্তর্গত প্রাতিমোক্ষের প্রথম নিয়ম) কোথায় বিধান করিয়াছিলেন?”
তিনি বলিলেন—বৈশালীতে।
মহাকাশ্যপ বলিলেন——কাহাকে লক্ষ্য করিয়া?
তিনি উত্তর করিলেন——কলন্দকপুত্ত্র সুদত্তকে। এইরূপে মহাকাশ্যপ এক একটি নিয়ম সম্বন্ধে যাহা কিছু জ্ঞাতব্য থাকিতে পারে তাহা প্রশ্ন করিতে লাগিলেন আর উপালি তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করিতে লাগিলেন। এই প্রণালীতে ক্রমশঃ সমগ্র মহাবিভঙ্গ, ভিক্খুনীবিভঙ্গ, খন্ধক (মহাবগ্গ ও চুল্লবগ্গ) ও পরিবার উল্লেখ করিয়া তাহার নাম ‘বিনয় পিটক’ করা হইল।
অনন্তর মহাকাশ্যপ ভিক্ষুগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“কাহাকে অগ্রবর্ত্তী করিয়া ধর্ম্ম আবৃত্তি করিতে পারা যায়?” ভিক্ষগণ স্থবির আনন্দের নাম করিলেন।
মহাস্থবির মহাকাশ্যপ প্রশ্ন করিলেন—“ভগবান্, ব্রহ্মজালসুত্ত কোথায় কাহাকে কি জন্য কি প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন?” আনন্দ তাহার যথাযথ উত্তর দিলেন। এইরূপে অন্যান্য সূত্র সম্বন্ধেও প্রশ্নোত্তর হইল এবং নিকায়সমূহ (দীঘ, মজ্ঝিম, সংযুক্ত, অঙ্গুত্তর ও খুদ্দক) সংগৃহীত হইল। ইহারই নাম ‘সূত্র পিটক’।
তারপরে পূর্ব্ব প্রকারেই স্থবির অনুরুদ্ধকে ধর্ম্মাসনে স্থাপন করিয়া ভিক্ষুগণ ধর্ম্মসঙ্গণি, বিভঙ্গ, কথাবথ্থু, পুগ্গল, পঞ্ঞত্তি যমক ও পট্ঠান আবৃত্তি করিয়া অভিধর্ম্ম পিটক সংগ্রহ করিলেন।
মহাপরুষ বুদ্ধের পরিনির্ব্বাণ লাভের পরে তাঁহার প্রচারিত বিনয় ও সূত্রই বৌদ্ধগণের শাস্তা হইল। এই ধর্ম্ম ধীরে ধীরে প্রচারিত হইতে লাগিল। ইহার শতবর্ষ পরে বৈশালীর ভিক্ষুগণ দশটি নূতন অধিকার পাইবার জন্য আন্দোলন আরম্ভ করেন। ভিক্ষুরা স্বর্ণ ও রৌপ্য দান গ্রহণ করিতে পারিবেন, ইহা ঐ দশাধিকারের অন্যতম। এই বিষয় লইয়া বৈশালীর ভিক্ষুরা একমত হইতে পারেন নাই। ভিক্ষু কাকন্দকের পত্র যশ ইহার প্রতিবাদ করিলেন। এই বিষয়ের মীমাংসার নিমিত্ত তিনি বৈশালীতে এক মহাসমিতির আহ্বান করেন। তিনি পশ্চিম ভারত, অবন্তী এবং দক্ষিণ ভারতের ভিক্ষুগণ সমীপে দূত পাঠাইয়া জানাইলেন—“মাননীয় ভিক্ষুগণ, আপনারা এই বিষয়ের আইনতঃ মীমাংসা করিবার জন্য এখানে আগমন করুন। নচেৎ যাহা ধর্ম্ম নহে তাহাই প্রচারিত হইবে, ধর্ম্মই অবজ্ঞাত হইবে। যাহা বিনয় নহে তাহাই প্রচারিত হইবে, বিনয় অবজ্ঞাত হইবে।”
বৈশালীর ভিক্ষুগণ যশের এই আন্দোলন জানিতে পারিয়া তাঁহারাও পূর্ব্বদেশীয় সমস্ত ভিক্ষুকে স্বদলে আনিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এইরূপে বৌদ্ধদের মধ্যে দুইটি দল স্থাপিত হইল।
বৈশালী নগরে যখন ভিক্ষুমণ্ডলী মহাসভায় সমবেত হইলেন তখন প্রসিদ্ধ স্থবির রেবত তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,—“মাননীয় সঙ্ঘ আমার কথা শ্রবণ করুন,—কয়টি নিয়মের বৈধতা সঙ্ঘের আলোচ্য, এযাবৎ যত বক্তৃতা শুনিলাম তাহাতে বক্তারা আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে কোন কথা বলেন নাই, কেবল অবান্তর বাক্যই বলিয়াছেন, কতিপয় মধ্যস্থের উপর বিচার ভার অর্পণ করিয়া সঙ্ঘ এই বিষয়ের মীমাংসা করুন।”
উভয় পক্ষের চারিজন করিয়া আটজন মধ্যস্থের উপর বিচারকার্য্য অর্পিত হইল। মধ্যস্থগণ সকলে একমত হইয়া বৈশালীর ভিক্ষুগণকে দোষী সাব্যস্ত করিলেন।
খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৩৭৭ অব্দে বৈশালীতে এই মহাসমিতির অধিবেশন হইয়াছিল। এই সভায় সাত শত প্রসিদ্ধ ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন। বৈশালীর ভিক্ষুদের দাবী অসঙ্গত প্রতিপন্ন হইল, কিন্তু উভয়পক্ষ মধ্যস্থদের মীমাংসা গ্রহণ করিলেন না। এই সময় হইতে নেপাল, তিব্বত, চীন প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধগণ ‘মহাসাঙ্ঘিক’ এবং সিংহল, ব্রহ্ম ও শ্যাম প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধগণ ‘থেরবাদী’ আখ্যা প্রাপ্ত হইলেন। পরে মহাসাঙ্ঘিকেরা “মহাযান” এবং থেরবাদীরা ‘হীনযান’ নামে পরিচিত হন।
বৌদ্ধধর্ম্মে জাতিভেদ ছিল না. এই ধর্ম্ম ব্রাহ্মণকে উচ্চবর্ণের নিমিত্ত বংশ গৌরব দান করিত না। এইজন্য মগধের অনার্য্যগণই প্রথমতঃ দলে দলে দলে এই ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিল। যে সকল দেশের অধিবাসীদের অধিকাংশই আর্য্য সেই সকল দেশে প্রথমে বৌদ্ধধর্ম্ম তেমন অনায়াসে প্রাধান্য লাভ করিতে পারে নাই।
কোন ধর্ম্ম যতই উচ্চ হউক না কেন, কতগুলি অনুকূল বাহ্য কারণ না ঘটিলে ঐ ধর্ম্ম লোকমধ্যে ব্যাপ্তি লাভ করিতে পারে না। বুদ্ধের জীবিত কালে মগধরাজ বিম্বিসার ও অজাতশত্রু নূতন ধর্ম্মে অনুরাগী হইয়াছিলেন কিন্তু তাঁহারা তেমন শক্তিমান্ ছিলেন না, আপনাদের নাতিবৃহৎ রাজ্যের বাহিরে তাঁহাদের কোনো প্রভুত্ব ছিল না। খৃষ্টপূর্ব্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মগধ রাজ্য যখন ভারতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হইল তখন রাজশক্তির পৃষ্ঠ পোষণে বৌদ্ধধর্ম্ম ভারতের ধর্ম্মে পরিণত হইয়াছিল।
মহারাজ অশোকের পিতামহ মগধরাজ্য চন্দ্রগুপ্ত গ্রীকদের অধীনতাপাশ হইতে ভারতবর্ষকে মুক্ত করিয়া কীর্ত্তিমান হইয়াছিলেন। নর্ম্মদা নদী হইতে আরম্ভ করিয়া হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্ব্বত পর্য্যন্ত সমগ্র উত্তর ভারত তাঁহার শাসনাধীন হইয়াছিল। গ্রীকবীর সেলুকস্ তাঁহার সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া তাঁহাকে গ্রীক শাসনাধীন পঞ্জাব ও কাবুল প্রদান করেন। বিজয়ী ভারতীয় বীরের সহিত তিনি স্বীয় দুহিতাকে বিবাহ দিয়া তাঁহার সহিত মৈত্রী স্থাপন করিয়াছিলেন। সেই প্রাচীনকালে হিন্দু ও গ্রীক উভয় জাতিই সুসভ্য ছিলেন, সুতরাং এই দুই জাতির মিত্রতা উভয় জাতির পক্ষেই কল্যাণকর হইয়াছিল। গ্রীকেরা ভারতীয়দের নানাবিদ্যা এবং হিন্দুরা গ্রীকদের জ্যোতিষ ও গণিত প্রভৃতি শিক্ষা করিবার সুযোগ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। গ্রীকদূত মেগাস্থিনিস্ চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলীপুত্র নগরে বাস করিতেন। তাঁহার ভারত-বিবরণে সেই সময়ের বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। ভারতবর্ষ তখন ১১৮টি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাদিগকে পরাস্ত করিয়া ভারতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ভূপতি হইয়াছিলেন।
অশোকের এই পরাক্রমশালী পিতামহ কিংবা তাঁহার পিতা বিন্দুসার বৌদ্ধ ছিলেন না। অশোক যখন এই সুবিস্তৃত রাজ্যের অধিকারী হইয়া বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করেন, তখন এই ধর্ম্ম নিখিল ভারতে এবং ভারতের বাহিরে কোনো কোনো রাজ্যে প্রচারিত হইবার সুবর্ণ সুযোগ প্রাপ্ত হয়।
বৌদ্ধ ধর্ম্মের মাহাত্ম্য বর্দ্ধনের জন্য বৌদ্ধ যাজকগণ সম্রাট্ অশোকের সম্বন্ধে যে সকল গল্পের সৃষ্টি করিয়াছেন সেই সকল পাঠ করিলে মনে হয়, বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণের পূর্ব্বে তিনি নৃশংস ও পাপাচারী ছিলেন, বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া তিনি পুণ্যময় জীবন লাভ করেন। বৌদ্ধধর্ম্ম মহামতি অশোককে নবজীবন দান করিয়াছিল ইহা সত্য, কিন্তু তিনি উক্ত ধর্ম্মগ্রহণের পূর্ব্বে নিষ্ঠুর ও অধার্ম্মিক ছিলেন তাহা মনে করিবার পক্ষে কোন যুক্তিযুক্ত কারণ দেখা যায় না। বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রচার-ইতিহাসের শিরোভাগে মহামতি অশোকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। ভগবান্ বুদ্ধের মৈত্রীমূলক ধর্ম্ম যাঁহাদের প্রচেষ্টায় পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ধর্ম্মে পরিণত হইয়াছে অশোক তাঁহাদের মধ্যে প্রধান;
অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম্ম গ্রহণের ইতিহাস তাঁহারই অনুশাসনলিপি পাঠে অবগত হওয়া যায়। তিনি তাঁহার রাজত্বের অষ্টবর্ষে কলিঙ্গ জয় করেন। ঐ যুদ্ধে বহু ব্যক্তির জীবননাশ এবং বহু ব্যাক্তি বন্দী হইয়াছিল। হিংসামূলক এই যুদ্ধ তাঁহাকে ব্যথিত করিয়াছিল। তাঁহার শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে—“এই রাজ্যের ব্রাহ্মণ ও সাধুরা মাতাপিতা ও গুরুজনকে ভক্তি করে, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও দাসদাসীর প্রতি ইহারা সদ্ব্যবহার করে। এইরূপ চরিত্রবান, ব্যক্তিগণ যে দেশে বাস করে সেই দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছে।” যাহারা নিরপরাধ, শিষ্ট ও সচ্চরিত্র তাহাদিগকে হত্যা ও বন্দী করিয়া অশোক স্বভাবতঃই অনুতপ্ত হইয়াছিলেন। এই জন্যই তিনি অহিংসমূলক বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার আড়াই বৎসর পরে তিনি ধর্ম্মযাজকরূপে বৌদ্ধ সঙ্ঘে প্রবেশ করিয়া সর্ব্বপ্রযত্নে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারে নিরত হইলেন।
দীপবংস ও মহাবংসে উক্ত হইয়াছে যে, মহারাজ অশোক কাশ্মীর, গান্ধার, মহিসা (বর্ত্তমান মহীশূর), বনবাস (সম্ভবতঃ রাজ পুতনা), অপরন্তুক (পশ্চিম পঞ্জাব), মহারাষ্ট্র, যোনলোক (বাক্ট্রিয়া ও গ্রীকরাজ্য সমূহ), হিমবত (মধ্য হিমালয়), সুবর্ণ—ভূমি (থাটন অর্থাৎ নিম্ন ব্রহ্মদেশ), এবং লঙ্কাদ্বীপে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারার্থ প্রচারক পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহার অনুশাসন লিপি পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, চোলা (মান্দ্রাজ), পাণ্ড্য (মাদুরা), সত্যপুরা (সাতপুরা পর্ব্বতশ্রেণী), কেরল (ত্রিবাঙ্কুর), সিংহল, সিরিয়ার গ্রীকরাজ এণ্টিয়োকাসের রাজ্যে তাঁহার অভিপ্রায় অনুসারে বৌদ্ধধর্ম্ম গৃহীত হইয়াছিল। অপর এক অনুশাসন লিপিতে প্রকাশ যে, তাঁহার দূতগণ সিরিয়া, মিশর, এপিরস্, মেসিডন্ এবং সিরিনের গ্রীকরাজাদের সমীপে গমন করিয়াছিল।
সম্রাট্ অশোক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হইয়া বৌদ্ধধর্ম্ম পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত করিবার জন্য সর্ব্বস্ব সমর্পণ করিয়াছিলেন। বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারের জন্য তিনি তাঁহার পুত্র মহেন্দ্র ও দুহিতা সঙ্ঘমিত্রাকে সিংহলে পাঠাইয়াছিলেন। সিংহলরাজ তিস্স এই ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। সিংহলরাজকুমারী অনুলা সঙ্ঘমিত্রার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুণী হইয়াছিলেন।
রাজর্ষি অশোক এমন ধর্ম্মানুরাগী ছিলেন যে, ধর্ম্ম তাঁহার নিকট পুত্ত্র, কলত্র ও বিত্ত হইতেও প্রিয়তর ছিল। দেশের সর্ব্বত্র লোকের মনে বৌদ্ধধর্ম্মের মহত্ত্ব ও সুনীতি মুদ্রিত করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে তিনি কত স্তূপ, কত মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়া ছিলেন তাহার যথার্থ সংখ্যা এখনও নির্ণীত হয় নাই। গিরিগাত্রে এবং ক্ষুদ্র বৃহৎ শিলাস্তম্ভে বৌদ্ধধর্ম্মের সুনীতি ও সদুপদেশ উৎকীর্ণ করাইয়া লোককল্যাণ সাধনে তিনি যেমন আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা দেখাইয়াছেন এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর দেখা যায় না।
তাঁহার শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি দ্বারা তিনি লোকসাধারণকে এই অনুরোধ জানাইয়াছেন—(১) কেহ প্রাণী হত্যা করিও না (২) প্রধান প্রধান নগরে আড়ম্বরপূর্ণ ভোজ প্রদান করিও না (৩) মাতাপিতার বশ্যতা স্বীকার কল্যাণপ্রদ (৪) বন্ধু ও স্বজনবর্গ, আত্মীয়কুটম্ব, ব্রাহ্মণ ও ভিক্ষুদের প্রতি বদান্য হওয়া বিধেয়। (৫) মিতব্যয়ী ও বিবাদে নিবৃত্ত হওয়া অতি উত্তম। (৬) আত্মসংযম, চিত্তশুদ্ধি, কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বস্ততা এই কয়টিগুণ অতি উৎকৃষ্ট, দরিদ্রেরাও এই সকলগুণ প্রদর্শন করিতে পারে। (৭) লোকে আরোগ্যলাভ, বিবাহ, সন্তানলাভ, প্রভৃতি উপলক্ষ্যে আপন সৌভাগ্যে আনন্দ প্রকাশের জন্য উৎসব করিয়া থাকে। এই সকল উৎসব বিকৃত ও অকিঞ্চিৎকর। ধর্ম্মবিষয়ক উৎসবই বস্তুতঃ সৌভাগ্যজ্ঞাপক। ধর্ম্মোৎসবের মূলকথা দাসদাসী ও ভৃত্যবর্গের প্রতি যথাবিহিত ব্যবহার, গুরুজনের প্রতি সসম্মান ব্যবহার প্রাণীদের প্রতি অহিংসা, ব্রাহ্মণ ও ভিক্ষুদের প্রতি বদান্যতা। চির-কল্যাণ যাহার কাম্য তাহাকে এইরূপ উৎসবই করিতে হইবে। (৮) তোমার সহিত যাহার ধর্ম্মমত এক নহে এমন গৃহী অথবা সন্ন্যাসী যে-কোনো ব্যক্তির ধর্ম্মমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিও। আপনার ধর্ম্মমতকে শ্রেষ্ঠত্বদান করিবার জন্য অন্যের ধর্ম্মের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ অসঙ্গত। বাক্যে সংযত হওয়া বিধেয়। (৯) ধর্ম্ম কল্যাণপ্রদ, কিন্তু, ধর্ম্ম কাহাকে বলে? লালসার নিবৃত্তি, অপরের কল্যাণ-সাধন, করুণা, বদান্যতা, সত্যানুরাগ এবং পবিত্রতাই ধর্ম্ম বলিয়া উক্ত হইতে পারে। লোকে স্বকৃত উৎকৃষ্ট কার্য্যের গর্ব্ব করিয়া থাকে কিন্তু, স্বকৃত দুষ্কার্য্যের প্রতি অন্ধ। আত্ম-কল্যাণসাধনের জন্য আত্মপরীক্ষা প্রয়োজনীয়।
রাজনৈতিক কার্য্য পরিচালনার জন্য মৌর্য্যভূপতিদের শাসনকালে প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তাদের অধীনে ‘রাজুক’, প্রাদেশিক’, মহাপাত্র’, ‘যুক্ত’, ‘উপযুক্ত’, ‘লেখক’, ‘উপাধিধারী’, এই সকল রাজ কর্ম্মচারী ছিলেন। মৌর্য্যভূপতিদের রাজ্য সুশাসিত, সুগঠিত ছিল এবং মৌর্য্য রাজাদের শাসনকালের বিবরণ যথাবিধি লিপিবদ্ধ করিবার ব্যবস্থা ছিল। মহামতি অশোক তাঁহার রাজত্বের চতুদ্দর্শ বর্ষ হইতে “ধর্ম্মমহাপাত্র”, ‘ধর্ম্মযুক্ত’, উপাধিধারী একদল কর্ম্মচারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সাম্রাজ্যের জনমণ্ডলী ধর্ম্মবিধি প্রতিপালন করে কিনা ধর্ম্মবিভাগীয় ঐ সকল কর্ম্মচারী তাহাই পরিদর্শন করিতেন। দক্ষিণ ভারতের চোলা, পাণ্ড্য প্রভৃতি কয়টি ক্ষুদ্র রাজ্য ব্যতীত সমগ্র ভারতবর্ষ এমনকি আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান, দক্ষিণ হিন্দুকুশ প্রভৃতি রাজ্য সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তিনি তাঁহার এই সুবিস্তৃত রাজ্যের সর্ব্বত্র যেরূপ অসংখ্য স্তূপ, স্তম্ভ ও বিহার স্থাপন করিয়াছিলেন তাহাতে ইহা সুনিশ্চিত যে, অশোকের ধর্ম্মরাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করিত। অশোক-প্রেরিত-ধর্ম্মপ্রচারকগণ এশিয়া ইয়ুরোপ এবং আফ্রিকা এই তিন মহাদেশে গমন করিয়াছিলেন। অশোকের ধর্ম্মপ্রচারের ইতিবৃত্ত পরম বিস্মরকর। বৌদ্ধধর্ম্মের মহোচ্চ আদর্শের প্রতি প্রবিচলিত অনুরাগ হেতু তাঁহার অন্তরে ধর্ম্মপ্রচারের আকাঙ্ক্ষারূপ যে বহ্নি প্রজ্জ্বলিত হইয়াছিল তাহা ধারণার অতীত।
সম্রাট্ অশোক রুগ্ন নরনারীর ও জীবজন্তর জন্য দাতব্য-চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া অসামান্য জীবপ্রীতির পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে জীবসেবার এই আদর্শ তিনিই সর্ব্ব প্রথমে প্রদর্শন করেন। অশোকের মত প্রসিদ্ধ ভূপতি পৃথিবীর ইতিবৃত্তেই বিরল। তাঁহার পণ্যেময় নাম অদ্যাপি যত লোকের মুখে কীর্ত্তিত হইয়া থাকে, সারল্মেন বা সিজারকেও তত অধিক লোকে স্মরণ করে না। ইয়ুরোপের বল্গা নদী হইতে এশিয়ার পূর্ব্বপ্রান্তস্থিত জাপান এবং সাইবিরিয়া হইতে সিংহল পর্য্যন্ত দেশে দেশে সংখ্যাতীত নরনারী ধর্ম্মপ্রাণ অশোকের নাম এখনও শ্রদ্ধাপূর্ব্বক স্মরণ করিয়া থাকে। অশোকাবদান, দীপবংস, মহাবংস এবং প্রসিদ্ধ বৌদ্ধশাস্ত্রীয় ভাষ্যকার বুদ্ধঘোষপ্রণীত বিনয়ভাষ্যে সম্রাট্ অশোকের গৌরবময় জীবনের কীর্ত্তি কাহিনী বিবৃত রহিয়াছে।
সম্রাট্ অশোকের রাজত্বকালে বৌদ্ধশাস্ত্র আলোচনার নিমিত্ত এক সহস্র বৌদ্ধভিক্ষু পাটলীপুত্র নগরে এক মহাসভায় মিলিত হইয়াছিলেন। মাননীয় ভিক্ষু তিস্স এই সভার সভাপতি ছিলেন। তিনি বিস্তৃতভাবে বৌদ্ধশাস্ত্র আলোচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার উপদেশে ধর্ম্মশাস্ত্রবিষয়ক বহু সংশয় ছিন্ন হইয়াছিল। ঐ সভায় তিস্স যে উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন তাহা কথাবত্থু নামে খ্যাত। উহা অভিধর্ম্মের সপ্তম খণ্ডরূপে গণ্য হইয়া থাকে।
বুদ্ধঘোষকে বৌদ্ধশাস্ত্রের শঙ্করাচার্য্য বলা যাইতে পারে। তাঁহার নিবাস মগধে। তিনি সিংহলে গমন করিয়া বৌদ্ধশাস্ত্রীয় ভাষ্য রচনা করিয়া অমরকীর্ত্তি অর্জ্জন করিয়াছেন। তিনি খৃষ্টীয় ৪৫০ অব্দে সিংহল হইতে ব্রহ্মদেশে গমন করিয়া তথায় বৌদ্ধ ধর্ম্ম প্রচার করেন। ৬৩৮ অব্দে শ্যামরাজ্যে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হয়। এখান হইতে সুমাত্রায় বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হইয়াছিল। এই সমস্ত রাজ্যে হীনযান বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচলিত আছে।
খৃষ্টপূর্ব্ব প্রথম শতাব্দীতে উত্তরপশ্চিম ভারতে মহাযান বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচলিত হইয়াছিল। খৃষ্টপূর্ব্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে কাশ্মীর রাজ পুষ্যমিত্র বৌদ্ধদিগকে নির্য্যাতন করিয়া কু-কীর্ত্তি অর্জ্জন করেন।
তাঁহার পুত্ত্র অগ্নিমিত্রের সহিত গ্রীকদিগের যুদ্ধে হইয়াছিল। গ্রীক সেনাপতি রাজা মিণ্ডার এই যুদ্ধে বিজয়ী হইয়াছিলেন। ইনি মহাস্থবির নাগসেনের সহিত বৌদ্ধধর্ম্মতত্ত্ব সম্বন্ধে যে আলোচনা করিয়াছিলেন উহা “মিলিন্দপঞ্হো” নামক সুপ্রসিদ্ধ বৌদ্ধগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। মহাযান বৌদ্ধদের এই ধর্ম্মগ্রন্থ হীনযান সম্প্রদায়ে বৌদ্ধগণও পরম শ্রদ্ধাসহকারে অধ্যয়ন করিয়া থাকেন।
খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কুষণ বংশীয় নরপতি কণিষ্ক কাশ্মীর জয় করেন। বিন্ধ্যগিরি হইতে আরম্ভ করিয়া সমগ্র উত্তর ভারত, কাশ্মীর, ইয়রখণ্ড, খাস্গর, খোকন প্রভৃতি রাজ্য এই প্রবল প্রতাপান্বিত ভূপতির করতলগত হইয়াছিল। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরে মৌর্য্যবংশের গৌরবরবি অস্তমিত হইয়াছিল। তাঁহার পরে কণিষ্কের তুল্য শক্তিশালী রাজা ভারতবর্ষে আর রাজত্ব করে নাই। সম্রাট্ কণিষ্কও বৌদ্ধধর্ম্মে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। স্তূপ ও বিহার নির্ম্মাণ এবং প্রচারক প্রেরণ করিয়া তিনি এই ধর্ম্মের বহুল প্রচারে বিশেষ আগ্রহ প্রদর্শন করিয়াছেন। কণিষ্কের রাজত্বকালে চীনে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার হইতে আরম্ভ হইয়াছিল।
পার্শ্বব নামক এক স্থবিরের নিকট কণিষ্ক অবসর সময়ে বৌদ্ধধর্ম্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেন। নানাদলের নানাপ্রকার শাস্ত্রব্যাখ্যা শুনিয়া অনেক সময়ে সম্রাট্ হতবুদ্ধি হইতেন। সম্রাট স্থবিরকে জানাইলেন যে, ধর্ম্মশাস্ত্রের যথার্থ তাৎপর্য্য ব্যাখ্যাত হওয়া উচিত। সম্রাটের এই অভিপ্রায় অননুসারে বৌদ্ধধর্ম্মশাস্ত্র আলোচনার নিমিত্ত এক মহাসভা আহূত হয়। স্থবির বসুমিত্র এই সভার সভাপতি এবং বুদ্ধচরিত-প্রণেতা অশ্বঘোষ সহকারী সভাপতি বৃত হইয়াছিলেন। অনেকদিন এই মহাসভার অধিবেশন হইয়াছিল। প্রথমতঃ কাশ্মীরের কুন্দল বনবিহার, পরে জালন্ধরের কুবল সঙ্ঘারামে মহা-সভার অধিবেশন হইয়াছিল। এই সভায় মূল বৌদ্ধশাস্ত্র অবলম্বনে উপদেশ, বিভাস, অভিধর্ম্মবিভাস নামক তিনখানি ভাষ্যগ্রন্থ সংস্কৃতে সঙ্কলিত হয়। এই গ্রন্থত্রয়ই মহাযান সম্প্রদায়ের বৌদ্ধদের শাস্ত্রগ্রন্থ হইয়া গিয়াছে।
এই সময় হইতে বৌদ্ধধর্ম্মের উভয় শাখার মধ্যে ব্যবধান বর্দ্ধিত হইল। উভয়ের ধর্ম্মশাস্ত্র মূলতঃ এক হইলেও বস্তুত পৃথক হইল। উভয় সম্প্রদায়ের বুদ্ধও নামে এক হইলেও যথার্থতঃ এক নহেন। হীনযানীয় বুদ্ধ মহাপুরুষ, নরসিংহ কিন্তু মহাযানীর বুদ্ধ দেবতা, শ্রদ্ধাশীল ভক্তদের হৃদয় হইতে তাঁহার উদ্ভব হইয়াছে। মহাযান বৌদ্ধধর্ম্ম বৌদ্ধধর্ম্মের আদিম মূর্ত্তি রক্ষা করিতে পারেন নাই বলিয়া ক্ষোভের কোনো কারণ নাই। বীজ হইতে বনস্পতির উদ্ভব, বনস্পতির সহিত বীজের আকৃতিগত সাদৃশ্য না থাকিলেও উহা বীজেরই সার্থক পরিণতি।
খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনের এক সম্রাট্ বৌদ্ধগ্রন্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন; তখন হইতেই চীনে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হইয়া থাকিবে। খৃষ্টের প্রথম শতকে কুশান নরপতি কণিষ্কের শাসনকালে ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ চীনে এই ধর্ম্ম প্রচার করেন। সেই সময়ে চীনে হ্যানবংশীয় সম্রাট্ মিংতি রাজত্ব করিতেছিলেন। পিকিঙ্ নগর হইতে পাঁচশত মাইল দক্ষিণপূর্ব্বে তাঁহার রাজধানী অবস্থিত ছিল। তাঁহার রাজধানী হেনান নগরেই সর্ব্বপ্রথমে বৌদ্ধকেন্দ্র স্থাপিত হইয়াছিল। হেনান নগর হেনানপ্রদেশের রাজধানী। এখন এই প্রদেশের লোক সংখ্যা প্রায় ২ কোটি।
সম্রাট্, মিংতি পেশোয়ারে সম্রাট কনিষ্কের রাজসভায় সাই-ইন (Tsai yin) নামক এক দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। মাতঙ্গ ও ধর্ম্মরক্ষ নামক দুই জন বৌদ্ধসাধু ইহার সহিত চীন দেশে গমন করেন। ইহাদের সঙ্গে বহু সংখ্যক বৌদ্ধগ্রহ প্রেরিত হইয়াছিল। ঐ শ্বেত অশ্বের পৃষ্ঠে ঐ গ্রন্থরাজি বাহিত হইয়াছিল। ঐ শ্বেত অশ্বের মৃত্যু হইলে হেনান নগরে যে স্থানে উহাকে সমাধিস্থ করা হয় সেই স্থানে এক প্যাগোডা (মন্দির) নির্ম্মিত হইয়াছে। উহার নাম পাই-মা-জু বা শ্বেতাশ্ব মন্দির।
এই সময় হইতে চীনে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হইতে থাকে। তখন হইতে খৃষ্টের ত্রয়োদশ শতক পর্য্যন্ত হেনানে সকল সময়ে ভারতীয় ধর্ম্ম, সাহিত্য, দর্শন ও শিল্প আদৃত হইতেছিল।
খ্রীষ্টের তৃতীয় শতকে উ-তি চীন সম্রাট ছিলেন। তাঁহার শাসন সময়ে বোধি-ধর্ম্ম নামক এক ভারতীয় ভিক্ষু হেনানে গমন করিয়া ধ্যান-তত্ত্ব প্রচার করেন। হেনানের নিকটবর্ত্তী সুংশান পাহাড়ে অনেকগুলি বৌদ্ধমন্দির আছে। তথাকার শাওলিংজু নামক মন্দিরে ভিক্ষু বোধিধর্ম্ম নয় বৎসরকাল ধ্যানে মগ্ন ছিলেন।
খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চীনদেশে বৌদ্ধধর্ম্মানুরাগী সম্রাট্ তাই-সুঙ্ রাজত্ব করিতেন। তিনি হেনান নগরে এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় নানাশাস্ত্র বিশেষভাবে আলোচিত হইত। ঐ বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপকগণ ভারতের ধর্ম্ম ও ভারতের সভ্যতা সমগ্র চীনে এবং কোরিয়া ও জাপানে প্রচারিত করেন। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে চীনের সহিত ভারতের আদান-প্রদানের যোগ বিশেষভাবে ছিল। সম্রাট্ তাইসুঙের শাসনকালে চীনাভিক্ষু উয়ান-চুয়াঙ্ ভারত-ভ্রমণে আগমন করেন। তিনি বহুবৎসর ভারতবর্ষে ছিলেন। তাঁহার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত ভারত-ইতিহাসের মূল্যবান্ তথ্যে পূর্ণ। উয়ান-চুয়াঙ্ হেনানে প্রত্যাবৃত্ত হইবার পরে ই-চিঙ্ ভারত-ভ্রমণে বাহির হন। বুদ্ধের জন্মভূমি ভারতবর্ষকে তখন বৌদ্ধধর্ম্মানুরাগী চীনারা স্বর্গভূমি বলিয়া মনে করিতেন। ই-চিঙ্ এই স্বর্গে ২৫ বৎসর বাস করিয়া স্বদেশে গমন করেন। এই সময় হইতে প্রায় ছয়শত বৎসর কাল চীনা নরনারীর সমগ্র জীবনে ভারতীয় ধর্ম্ম ও সভ্যতা অসামান্য প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।
জাপানের ঠিক কোন্ সময়ে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হয় তাহা অসংশয়ে বলা যায় না। মোটামুটি ইহা বলা যায় যে, খৃষ্টের ষষ্ঠ শতকে জাপানে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হইয়াছিল। ঐ সময় হইতে আজ পর্য্যন্ত জাপানে সংস্কৃত নানাশাস্ত্র আলোচিত হইতেছে। জাপানে এখনও বৌদ্ধদের পরিচালিত সাতটি কলেজে সংস্কৃত সাহিত্য-বিজ্ঞানের অধ্যাপনা হইয়া থাকে। খৃষ্টের সপ্তম শতকে বিখ্যাত চীনা ভারতভ্রমণকারী উয়ান-চুয়াঙ্ ও তাঁহার কতিপয় পণ্ডিতশিষ্য চীনের “বৌদ্ধ অনুবাদ-প্রতিষ্ঠানে” অধ্যাপকতা করিতেন। কয়েকজন জাপানী পুরোহিত ইহাদের নিকট সংস্কৃত শাস্ত্রাভ্যাস করিতেন। ৭৩৫ অব্দে বোধিসেন অপর এক ভারতীয় বৌদ্ধভিক্ষুসহ জাপানে গমন করেন। এই সময় হইতে জাপানে বৌদ্ধধর্ম্ম ও সংস্কৃত শাস্ত্র বিশেষভাবে আলোচিত হইতেছিল
চীন হইতে জাপানে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হইয়াছিল। সেখানে কালক্রমে ঐ ধর্ম্ম বহু শাখায় বিভক্ত হইয়া পড়ে। জাপানের বৌদ্ধ সম্প্রদায় সমূহের মধ্যে “দাই-নিচি” সম্প্রদায় বিশেষ বিখ্যাত। জাপানের পুরাণে সূর্যদেবতার নাম ‘দাই-নিচি। ‘দাই’ অর্থ মহৎ আর ‘নিচি’ অর্থ সূর্য। প্রথমে এই সম্প্রদায়ের উপাস্য বুদ্ধের নাম ছিল “শ্রীমহাবৈরোচন তথাগত।” অতঃপর এই নাম পরিবর্ত্তিত হইয়া “বিরশানো নিয়োরাই” হয়। নিয়োরাই অর্থ উপশম। জাপানীরা তথাগতের বদলে ইহা ব্যবহার করিতে লাগিল। পরে এই আধা সংস্কৃত আধা জাপানী নাম পুরোপরি জাপানী হইয়া —“দাইনিচি নিয়োরাই” নাম পরিগ্রহ করিল।
কেহ কেহ মনে করেন দাইনিচি নিয়োরাই স্বয়ং শাক্যমুনি। আবার কেহ মনে করেন দাইনিচি নিয়োরাই আসল বুদ্ধ—বুদ্ধের নিয়ম মূর্ত্তি। তিনি সমস্ত ভূতের হেতু ও কর্ত্তা এবং শাক্যমুনি তাঁহার অবতার— গুণময় ব্যক্তি মাত্র।
জাপানী তাইজো-কাই বুদ্ধের পদ্মাসনের পাপড়িতে “অ” এবং কঙ্কোকাই বুদ্ধের পন্মের পাপড়িতে “বং” লেখা থাকে। এই দুইটি অক্ষরের রূপ অবিকল সংস্কৃত ও বাঙ্গালা অক্ষরের ন্যায়। কোন সুদূর অতীত কাল হইতে আজ পর্য্যন্ত অক্ষর জাপানে পূজিত ও রক্ষিত হইয়া আসিতেছে তাহা ভাবিলেও বাঙ্গালীর গর্ব্ব ও আনন্দ হইবার কথা।
রেইসেন (Raisen) নামক এক সংস্কৃতজ্ঞ জাপানী পণ্ডিত ৮০৪ অব্দে চীন যাত্রা করেন এবং কালক্রমে তথাকার “বৌদ্ধ-অনুবাদ প্রতিষ্ঠানের” অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। প্রাজ্ঞ নামক জনৈক ভারতীয় ভিক্ষুর সহিত একযোগে তিনি একটি বৌদ্ধ সূত্রের অনুবাদ সম্পূর্ণ করেন। এই গ্রন্থের জাপানী নাম “শিঞ্চি কো আঙ্গো।” ইহা এখনও জাপানী বৌদ্ধদের অন্যতম প্রামাণ্য গ্রহ। জাপান সেই পুরাকালেই ভারতের ধর্ম্ম ও ভারতের সভ্যতা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই প্রাচীনকালে জাপানীসম্রাট্ সাগার পত্র কুমার তাকাওকা জাপান হইতে ভারতবর্ষ যাত্রা করিয়াছিলেন। পথিমধ্যে কোচিন-চীনের অন্তর্গত লাওস নামক স্থানে রোগাক্রান্ত হইয়া তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
খৃষ্টীয় ৩৭২ অব্দে চীন হইতে বৌদ্ধধর্ম্ম কোরিয়ায় প্রচারিত হয়। চীন হইতে খৃষ্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম্ম কোচীন,ফরমোজা, মোঙ্গলিয়া এবং অপর নানারাজ্যে প্রচারিত হইয়াছিল।
বৌদ্ধ ধর্ম্মের অভ্যুত্থানের পরে অল্পকাল মধ্যেই ঐ ধর্ম্ম নেপালে প্রচারিত হইয়া থাকিবে। কিন্তু খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পূর্ব্বে এই ধর্ম্ম তথাকার রাজকীয় ধর্ম্মে পরিণত হয় নাই। ৬৩২ খৃষ্টাব্দে তিব্বতের প্রথম বৌদ্ধরাজ বৌদ্ধধর্ম্মশাস্ত্রীয় গ্রন্থসংগ্রহার্থ নেপালে লোক পাঠাইয়াছিলেন।
বৌদ্ধধর্ম খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে এশিয়া মহাদেশের সকল রাজ্যে এবং আফ্রিকা ও ইয়ুরোপের কোনো কোনো দেশে প্রচারিত হইয়াছিল। এই ধর্ম্ম নানাদেশে নানাজাতির মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়াছে। চীন ও জাপানে বৌদ্ধধর্ম্ম এখনও রাষ্ট্রীয় ধর্ম্মরূপে রহিয়াছে। কিন্তু একই দেশে নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ধর্ম্ম নানা আকারে দৃষ্ট হইয়া থাকে।
বৌদ্ধধর্ম্মের উদারনীতি ও মৈত্রী একসময়ে যে আলোকছটার বিকাশ করিয়াছিল, সেই আলোকে সমস্ত এশিয়া মহাদেশ আলোকিত হইয়াছিল। এই ধর্ম্ম যে, এশিয়া মহাদেশে সভ্যতার বিকাশে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল তাহাতে অনুমাত্র সন্দেহ নাই।
খৃষ্ঠান ধর্ম্মযাজকগণ ইহা স্বীকার করিতে কুণ্ঠাবোধ করিয়া থাকেন যে, বৌদ্ধধর্মম খৃষ্টধর্ম্মের উপর নানাপ্রকারে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। বুদ্ধের জীবনের অনেক ঘটনার সহিত যীশুর জীবনের ঘটনার ঐক্য দৃষ্ট হয়। বুদ্ধের বহু সংখ্যক হিতোপাখ্যান ও উপদেশ যীউশর হিতোপাখ্যান ও উপদেশের সহিত অভিন্ন। কোনো কোনো খৃষ্টান ধর্ম্মযাজক এইরূপ মন্তব্য করিয়াছেন যে, বৌদ্ধধর্ম খৃষ্টধর্ম হইতে ঐ সকল গ্রহণ করিয়াছেন। অথচ ইহা ঐতিহাসিক সত্য যে যীশুর জন্মের প্রায় তিনশত বৎসর পূর্ব্বে মিশর ও সিরিয়া প্রভৃতি দেশে সম্রাট অশোক ধর্ম্মপ্রচারক প্রেরণ করিয়াছিলেন। উক্ত ধর্ম্মপ্রচারকগণ ঐ সকল দেশে বসতিস্থাপন করায় শক্তিশালী বৌদ্ধ সম্প্রদায় গঠিত হইয়াছিল। আলেকজাণ্ড্রিয়ার “থেরাপিউটস্” (Theraputs) এবং প্যালেস্তাইনে “এসেনেস” (Essenes) নামে দুইটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধসম্প্রদায় সাগ্রহে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারে নিযুক্ত ছিল।
সিলিং (Schelling) ও সোপেনহারের (Schopenharuer) তুল্য দার্শনিকগণ স্বীকার করিয়াছেন যে, ভারতীয় ধর্ম্মপ্রচারকগণের দ্বারাই পূর্ব্বোক্ত দুই সম্প্রদায় গঠিত হইয়াছিল। ঐতিহাসিক প্লিনির রচনা মধ্যে এই মন্তব্য দৃষ্ট হয় যে, যীশু যখন প্যালেস্তাইনে ধর্ম্মপ্রচারে নিযুক্ত ছিলেন তখন এসেনেস বৌদ্ধ সম্প্রদায় তথায় সগৌরবে বিরাজ করিতেছিল। ঐ সকল বৌদ্ধ সাধু ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুর তুল্য চিরকৌমার্য্য অবলম্বন পূর্ব্বক মঠে বাস করিতেন। ইহাদের প্রভাব ইহুদী সমাজে নিঃসন্দেহ পতিত হইয়াছিল। বৌদ্ধদের সুনীতি, সদাচার, মৈত্রী প্রভৃতি সমস্তই যিশু পরিজ্ঞাত ছিলেন, সতরাং তিনি ঐ সমস্ত গ্রহণ করিবেন ইহার মধ্যে বিস্ময় বা অগৌরবের কিছুই থাকিতে পারে না। বৌদ্ধ ও খৃষ্টধর্ম্মের অত্যুজ্জ্বল সাদৃশ্যগুলি যাঁহারা আকস্মিক বলিয়া মনে করেন তাঁহাদের ঐতিহাসিক অজ্ঞতা অশ্রদ্ধেয়।
- ↑ প্রথম বৌদ্ধমহাসঙ্গীতির বিবরণটী সংহৃদ্বর শ্রীযুক্ত বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের এক রচনা হইতে সঙ্কলিত হইল।