বৌদ্ধ-ভারত/ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়

বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়

 শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় “তপোবন” প্রবন্ধে লিখিয়াছেন —“ভারতবর্ষে এই একটি আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখা গেছে, এখানকার সভ্যতার মূল প্রস্রবন সহরে নয়, বনে। ভারতবর্ষের প্রথমতম আশ্চর্য্য বিকাশ যেখানে দেখতে পাই সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষ অত্যন্ত ঘেঁষাঘেঁষি করে একেবারে পিণ্ড পাকিয়ে ওঠেনি। সেখানে গাছপালা নদী-সরোবর মানুষের সঙ্গে মিলে থাকবার যথেষ্ট অবকাশ পেয়েছিল, সেখানে মানুষও ছিল, ফাঁকাও ছিল— ঠেলাঠেলি ছিল না। অথচ এই ফাঁকার ভারতবর্ষের চিত্তকে জড়প্রায় করে দেয়নি বরঞ্চ তার চেতনাকে আরও উজ্জ্বল করে দিয়েছিল।

 “ভারতবর্ষের যে দুই বড় বড় প্রাচীন যুগ চলে গেছে, বৈদিক ও বৌদ্ধযুগ—সেই দুই যুগকে বনই ধাত্রীরূপে ধারণ করেছে। কেবল বৈদিক ঋষিরা নন, ভগবান্ বুদ্ধও কত আম্রবন, কত বেণুবনে তার উপদেশ বর্ষণ করেছেন—রাজপ্রাসাদে তাঁর স্থান কুলায়নি—বনই তাঁকে বুকে করে নিয়েছিল। সেই অরণ্যবাসনিঃসৃত সভ্যতার ধারা সমস্ত ভারতবর্ষকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে এবং আজ পর্য্যন্ত তার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়নি।”

 বস্তুতঃই বৈদিক ও বৌদ্ধযুগে ভারতের তপঃক্ষেত্র হইতে সভ্যতার ধারা উৎসাকারে উৎসারিত হইয়া নিখিল ভারতে পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল। তপোবনবাসী ঋষিদের আশ্রমে বিদ্যার্থী ধনি-দরিদ্র সকলে বিদ্যাশিক্ষার নিমিত্ত গমন করিতেন। ঋষি ছাত্রদিগকে অন্ন ও বিদ্যা উভয়ই দান করিতেন, আশ্রমবাসী শিষ্যগণ ব্রাহ্মমহূর্ত্তে গাত্রোত্থান করিয়া ধেনু চারণ, সমিধ, কুশ ও ফল আহরণ, কৃষিক্ষেত্রে জলসেচন ও বেদ অধ্যয়ন করিত। তখন পুস্তক ছিল না, গুরুর মুখে বেদ শ্রবণ করিয়া শিষ্যগণ উহা শিক্ষা করিত বলিয়া বেদের নাম ছিল শ্রুতি। সেই প্রাচীনকালের শিক্ষার কোন ইতিবৃত্ত নাই, তবে জাবাল, সত্যকাম, বেদ, আরুণি, উপমন্যু ও উতঙ্ক প্রভৃতি বিদ্যার্থীদের গুরুভক্তির আখ্যানমধ্যে তদানীন্তন শিক্ষাপদ্ধতির কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যাইতে পারে।

 পরলোকগত শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় নৈমিষারণ্যকে প্রাচীন ভারতের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন—“স্থিরবাহিনী পুণ্যসলিলা গোমতী কঙ্কনের ন্যায় নৈমিষ কাননকে বেষ্টন করিয়া ধীরে ধীরে প্রবাহিত হইতেছে। সেই পুরাকালে বহু ঋষি এখানে বাস করিতেন। এখানেই বেদের অধিকাংশ আরণ্যক রচিত হয়। দেশ-দেশান্তরের ঋষিগণ নৈমিষারণ্যে আসিয়া শিক্ষা লাভ করিতেন এবং স্বদেশে গিয়া মঠ স্থাপনপূর্ব্বক লব্ধজ্ঞান প্রচার করিতেন। এইরূপে সমগ্র ভারতে বেদবাণী প্রচারিত হইত।”

 অরণ্যের সাধনা ও শিক্ষা এইরূপে জনসমাজের উপর পতিত হইয়া রাজা প্রজা সকলকে কল্যাণবর্ত্মে পরিচালিত করিত। ঋষিদের অধ্যাত্ম প্রভাবে তখন অসীম বলসম্পন্ন ভূপতিগণ কম্পিত হইতেন। বৈদিক যুগের এই শিক্ষাপদ্ধতি বৌদ্ধ যুগেও প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধ যুগে ভারতে যে সভ্যতার ধারা প্রবাহিত হইছিল সাধনানিরত বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের নিভৃতনিবাস হইতেই সেই ধারা উত্থিত হইত। নির্জ্জন গিরিগুহা এবং শান্ত-সুন্দর পল্লী ও নগরোপকণ্ঠবাসী বৌদ্ধসাধুগণের বিহারগুলিই বৌদ্ধযুগের শিক্ষানিকেতন ছিল।

তক্ষশিলা

 তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতীয় বিদ্যামহাপীঠ সমূহের মধ্যে প্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ। ভগবান্ বুদ্ধের প্রাদুর্ভাবকালেই এই বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান ছিল। ঐতিহাসিকগণ যে সময়কে বৌদ্ধযুগ আখ্যা প্রদান করেন, তাহার পূর্ব্ববর্ত্তী কালেই তক্ষশিলায় বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বলিয়া মনে হয়। তক্ষশিলা প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের রাজধানী ছিল। রাওলপিণ্ডি নগরের ২০ মাইল দূরে সরইকালা নামক রেলওয়ে জংশনের অব্যবহিত উত্তর ও উত্তর-পূর্ব্বে ছয় বর্গমাইল স্থান ব্যাপিয়া প্রাচীন তক্ষশিলার ধ্বংসস্তূপ এখনও পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। ষ্ট্রাবো, প্লিনি, আরিয়ন প্রভৃতি প্রসিদ্ধ গ্রীক লেখকগণ তাঁহাদের গ্রন্থে তক্ষশিলার সমৃদ্ধি ও বিদ্যাগৌরবের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। ভুবনবিজয়ী আলেকজাণ্ডারের জন্মের বহু পূর্ব্বেই তক্ষশিলা-বিশ্ববিদ্যালয়ের কীর্ত্তি দিগন্তবিশ্রুত হইয়াছিল। ভারতীয় আর্য্যগণ অতি প্রাচীন কালেই এই স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন। মহাভারতে উক্ত হইয়াছে যে, জন্মেঞ্জয় এখানে সর্পযজ্ঞ করিয়াছিলেন। হয় তো ঐ কিংবদন্তীর মধ্যে তখনকার আর্য্য-অনার্য্য-বিরোধের তত্ত্ব প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। এইরূপ অনুমিত হয় যে, অত্রত্য বিদ্যায়তন বহুশতবর্ষ অক্ষুণ্ণ প্রতাপে বিরাজ করিয়াছিল। যাঁহার কুটনীতি বলে নন্দবংশ ধ্বংস হইয়াছিল, মৌর্য্যভূপতি চন্দ্রগুপ্তের সেই বিশ্বস্ত মন্ত্রী চাণক্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপণ্ডিত ছাত্র ছিলেন। অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ সূত্র রচনা করিয়া যিনি অমরতা লাভ করিয়াছেন সেই পাণিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রসিদ্ধ ছাত্র। গান্ধার রাজ্যের শালাতুর গ্রামে পাণিনির নিবাস ছিল। মগধের অন্তর্গত কুসমপুর গ্রামের বর্ষনামক তদানীন্তন সুপ্রসিদ্ধ এক অধ্যাপকের নিকটও তিনি বহুবৎসর ব্যাকরণ শিক্ষা করিয়াছিলেন।

 গোভরণ (কেহ বলেন ধর্ম্মরক্ষ) ও মাতঙ্গ তক্ষশিলার অপর দুই প্রসিদ্ধ ছাত্র। তাঁহারা খৃষ্টীয় ৬৭ অব্দে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারার্থ চীনদেশে গমন করিয়াছিলেন। তক্ষশিলা-বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দেশদেশান্তরে পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল। গুপ্ত রাজাদিগের শাসনসময়ে চীনদেশ হইতে দলে দলে ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষার্থ আগমন করিত।

 পঞ্চায়ুধ, অসাতমন্ত্র, বরণ, তিলমুষ্টি প্রভৃতি বৌদ্ধ জাতকে স্থানে স্থানে এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে, তক্ষশিলা এককালে নিখিল ভারতের সুপ্রসিদ্ধ বিদ্যাশিক্ষার কেন্দ্র ছিল। এখানে বিবিধ ললিত কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হইত। রিসডেভিডস্ ও জর্জ্জ বুলার এইরূপ প্রতিপন্ন করিয়াছেন যে, জাতকে ভগবান্ বুদ্ধের আবির্ভাব ও উহার পূর্ব্ববর্ত্তী সময়কার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে। সুতরাং এইরূপ বলা যায় যে, খৃষ্টপূর্ব্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে তক্ষশিলা পূর্ণগৌরবে বিদ্যমান ছিল। খৃষ্টপূর্ব্ব চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন মহাবগ্‌গ সঙ্কলিত হইয়াছিল তখনও তক্ষশিলার গৌরব পূর্ব্ববৎ ছিল। খৃষ্টপূর্ব্ব প্রথম শতাব্দীতে এই নগর সাইথিয়ান রাজাদের রাজধানী ছিল।

 রামায়ণ ও মহাভারতে তক্ষশিলার নাম আছে। এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে, মহাবীর রামচন্দ্রের ভ্রাতা ভরতের পুত্ত্র তক্কের নাম হইতে এই নগরের নাম তক্ষশিলা হইয়াছে।

 তক্ষশিলাকে বৌদ্ধগণ “তক্কসির” নামে অভিহত করেন। এইরূপ এক কিংবদন্তী আছে যে, বুদ্ধ কোনো এক জন্মে এইস্থলে আপনার শির দান করিয়া আত্মোৎসর্গ করিয়াছিলেন। পরিব্রাজক ফাহিয়েন এই কিংবদন্তী ব্যতীত তক্ষশিলা সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য অপর কোন কথা তাঁহার বিস্তৃত ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করেন নাই। উয়ান চুয়াঙ্‌এর ভ্রমণ-বিবরণে প্রকাশ যে, তাঁহার ভ্রমণকালে তক্ষশিলায় অনেকগুলি বৌদ্ধ মঠ ছিল কিন্তু, তথায় অতি অল্পসংখ্যক মহাযান সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধ বাস করিতেন।

 মার্‌সল সাহেব তৎপ্রণীত “A Guide to Taxila” গ্রন্থে তক্ষশিলার স্তূপ ও বিহার সমূহের ধ্বংসাবশেষরাজির যে বিবরণ প্রদান করিয়াছেন তাহা পাঠ করিলে মনে হয় যে, তক্ষশিলা শিল্পে, ঐশ্বর্য্যে, ধর্ম্মে ও বিদ্যালোচনায় এককালে নিঃসন্দেহে অতি শ্রেষ্ঠ ছিল। তিনি লিখিয়াছেন,—“তক্ষশিলায় যে সকল ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা দেখিতে হইলে ন্যূনকল্পে দুই দিনের দরকার।”

 মহাবীর আলেক্‌জাণ্ডার যখন দেশজয়ার্থ ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন তখন তিনি তক্ষশিলা অধিকার করেন। সেই সময়ের গ্রীক ঐতিহাসিকগণের বর্ণনাপাঠে জানা যায় যে, তক্ষশিলা সমৃদ্ধ, জনবহুল, সুশাসিত রাজ্য ছিল। তখন ঐ দেশে বহুবিবাহ ও সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল।

 তক্ষশিলা ভারত সীমান্তে অবস্থিত। ঐ নগর বহুশতাব্দী কেবল ভারতের নহে, সমগ্র এশিয়া মহাদেশের জ্ঞান-পিপাসুদের আশ্রয়স্থল ছিল। চীনদেশের সাহিত্যে তক্ষশিলার উল্লেখ আছে। তখনকার এক রাজপুত্ত্র চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষার জন্য তক্ষশিলায় আসিয়াছিলেন। মহাবগ্‌গে বর্ণিত হইয়াছে যে, জীবক তক্ষশিলায় এক দেশপ্রসিদ্ধ আচার্য্যের নিকট চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। তক্ষশিলা আয়ুর্ব্বেদ শিক্ষার পক্ষে অতিশয় অনূকূল ক্ষেত্র ছিল তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। মহাবগ্‌গে এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে, জীবককে তাঁহার অধ্যাপক মহাশয় এই অনুমতি করেন—“যাও, তুমি কোদালি লইয়া তক্ষশিলার সকল দিকে এক যোজন মধ্যে যত গাছ গাছড়া আছে পরীক্ষা কর, যে সকল গাছ গাছরা ঔষধরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে না সেইগুলিই লইয়া আসিও।” জীবক এইরূপ কোন গাছ গাছড়া লইয়া আসিতে পারেন নাই।

 তক্ষশিলার ছাত্রদিগকে বহু বিষয় মুখে মুখে শিক্ষা দেওয়া হইত। পরবর্ত্তী কালে নালন্দা ও অপর বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ছাত্রগণ হস্তলিপি-গ্রন্থ পাঠ করিতে পাইত। যাহাতে ছাত্রগণ শিক্ষণীয় বিষয় মনে রাখিতে পারে তজ্জন্য তাহাদিগকে সূত্রের সাহায্য শিক্ষাদান করা হইত।

 ভারতবর্ষের সকল অঞ্চলের সর্ব্বশ্রেণীর ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা করিতে যাইত। এখানে কোশলরাজ প্রসেনজিতের মত রাজবংশীয় এবং জীবকের মত সাধারণ লোক সমভাবেই স্থান পাইত। ভারতবর্ষের বহুরাজ্যের রাজপুত্ত্রগণ এখানে ধনুর্ব্বিদ্যা শিক্ষা করিতেন। এখানে ধনুর্ব্বেদ, আয়ুর্ব্বেদ, গান্ধর্ব্ববিদ্যা, অর্থশাস্ত্র, ব্যাকরণ, বেদ-বেদান্ত প্রভৃতি বিবিধ শাস্ত্র শিক্ষাদান করা হইত। মহাসুতসোম জাতকে উক্ত হইয়াছে যে, তক্ষশিলায় শত শত রাজকুমার অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করিতেন। এই স্থলে শিক্ষা অতি উত্তম হইত। পূর্ব্বকালে রাজকুমারগণ তাঁহাদের স্ব স্ব নগরেই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করিতে পারিতেন কিন্তু ভূপতিগণ তথাপি রাজকুমারদিগকে বহুদূরবর্ত্তী তক্ষশিলায় পাঠাইতেন; কারণ এখানকার শিক্ষায় তাঁহাদের বৃথা অহঙ্কার চূর্ণ এবং মন উদার হইত। ইহাতে রাজকুমারগণ শীততাপ সহ্য করিতে শিখিতেন এবং সর্ব্বশ্রেণীর লোকের আচারব্যবহারের সহিত পরিচিত হইবার সুযোগ পাইতেন ৷

 এইখানে ছাত্রগণ প্রত্যেক বিষয় বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের নিকট শিক্ষা করিত। ধনী ছাত্রগণ অধ্যাপককে সহস্র স্বর্ণমদ্রা দক্ষিণা দিত। দরিদ্র ছাত্রগণ দিবারাত্র গুরুসেবা করিত।

 মৌর্য্য-ভূপতি চন্দ্রগুপ্ত গ্রীকদিগকে বিতাড়িত করিয়া তক্ষশিলা ও পাঞ্জাবের অপর সকল স্থান স্বরাজ্যভুক্ত করেন। তাঁহার রাজ্য হিন্দুকুশ পর্ব্বত পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। পিতার জীবদ্দশায় অশোক তক্ষশিলার শাসনকর্ত্তা ছিলেন। তাঁহার রাজত্বসময়ে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম্ম প্রচারিত হইয়াছিল। অশোকের পুত্ত্র কুলান এই স্থানে বাস করিতেন। অতঃপর কুষাণকুলোদ্ভব কণিষ্ক এদেশের রাজা হন। তাঁহার শাসনকর্ত্তারা এই দেশ শাসন করিতেন। তাঁহাদের কতগুলি মুদ্রা ও উৎকীর্ণ লিপি পাওয়া গিয়াছে। একখানি উৎকীর্ণ লিপিতে ‘তক্ষশিলা’ নাম অঙ্কিত রহিয়াছে।

 খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে তক্ষশিলা “অমন্দ্র” নামে পরিচিত ছিল। তক্ষশিলার ভূমি অতিশয় উর্ব্বরা। এখানে অনেকগুলি নদী ও নির্ঝর আছে। ফল ও পুষ্প প্রচুর জন্মে। এখানকার দৃশ্য অতি মনোহর। নগরের উত্তর-পশ্চিমাংশে নাগরাজ এলাপত্রের সরোবর। এই সরোবরের দক্ষিণ-পূর্ব্বে অশোকনির্ম্মিত এক গুহা আছে। নগরের উত্তরাংশে অশোকনির্ম্মিত স্তূপ রহিয়াছে। পর্ব্বদিবসে নাগরিকগণ এই স্তূপ পষ্প ও আলোকমালায় সুশোভিত করিত।

 এখানে যে সকল স্তূপ ও বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে তন্মধ্যে ধর্ম্মরাজিক স্তূপ, কুলান স্তূপ, শির্‌কপের মন্দির, জাণ্ডিয়াল মন্দির, লালচক ও বাদলপুরের বৌদ্ধ বিহার এবং মোহরামোরাডু ও জুলিয়নের প্রসিদ্ধ স্তূপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 তক্ষশিলার এই ধ্বংসরাজির বিশালতা এই নগরের গৌরবময়ী পূর্ব্বস্মৃতি দর্শকমাত্রের হৃদয়ে জাগরিত করিয়া দেয়।

নালন্দা

 খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যানুশীলনের ক্ষেত্র ছিল। এইরূপ কথিত আছে যে, মহামতি অশোক মগধের রাজধানী পাটলীপুত্ত্র হইতে ত্রিশ মাইল দূরে ফল্গুনদীর তীরে এক বৌদ্ধবিহার নির্ম্মাণ করেন। নরেন্দ্র অশোকনির্ম্মিত এই বিহার “নরেন্দ্রবিহার” নামে অভিহিত হইত। এই বিহারই পালিভাষায় নালন্দা নামে উক্ত হইত। কেহ কেহ বলেন বিহারের দক্ষিণে আম্রোদ্যানের সরোবরে এক ‘নাগ’ বাস করিত। সেই নাগের নাম হইতে বিহারের নাম নালন্দা হইয়াছে। উত্তরকালে শঙ্কর ও মুদ্‌গলগোমীনামক দুই প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ঐ বিহারকে বর্দ্ধিত করিয়া নবভাবে নির্ম্মিত করিয়াছিলেন। মহাযান বৌদ্ধধর্ম্মের সুপ্রসিদ্ধ অনুরাগী সুপণ্ডিত নাগার্জ্জুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরে কিয়ৎকাল শঙ্করের নিকট শাস্ত্রাভ্যাস করিয়াছিলেন। অতঃপর নাগার্জ্জুন কৃষ্ণানদীর তীরবর্ত্তী সুধন্যকটক নামক স্থলে স্বয়ং এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন। আধুনিক পাটনা জিলায় বরগাঁও গ্রামে নালন্দার ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হইয়া থাকে।

 নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এককালে এইরূপ সুবৃহৎ হইয়া উঠিয়াছিল যে, তথায় দশ সহস্র ভিক্ষু ও ছাত্র বাস করিতেন। অধ্যাপক ও ছাত্রদের প্রত্যেকের বাসের জন্য পৃথক্ পৃথক্ ঘর ছিল। প্রত্যেকটি ঘর দৈর্ঘ্যে ১২ হাত ও প্রস্থে ৮ হাত, ভারতবর্ষের নানা প্রদেশস্থ নৃপতিবর্গের স্বেচ্ছাপ্রদত্ত দানে এই মহাবিদ্যালয়ের ব্যয় নির্ব্বাহ হইত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সহস্র পাঁচশত দশজন অধ্যাপক পঞ্চাশ প্রকার সূত্রে ও শাস্ত্রে, পাঁচশত দ্বিতীয় শ্রেণীর অধ্যাপক ত্রিশ প্রকার সূত্রে ও শাস্ত্রে এবং এক সহস্র তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যাপক বিশ প্রকার সূত্রে ও শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। যিনি এই অধ্যাপকমণ্ডলীর উপর অধ্যক্ষতা করিতেন তাঁহাকে সমস্ত ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধশাস্ত্রে অসামান্য পারদর্শিতা লাভ করিতে হইত, সতরাং অনন্যসুলভ বিদ্যাগৌরবসম্পন্ন না হইয়া কেহ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যক্ষতা লাভ করিতে পারিতেন না। শীলভদ্রনামক বঙ্গদেশীয় এক সুপণ্ডিত ব্যক্তি এক সময়ে এই গৌরবময় আসন অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। তিনি সমতট প্রদেশের এক রাজার পুত্ত্র। সুপ্রসিদ্ধ চীন পরিব্রাজক উয়ান চুয়াঙ্ এই বঙ্গদেশীয় পণ্ডিতের শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়া নালন্দায় বিদ্যাশিক্ষা করিয়াছিলেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিহার প্রদেশে অবস্থিত হইলেও বাঙ্গালীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘নিজস্ব’ বলিয়া মনে করিতেন। এখানে বহু বাঙ্গালী অধ্যাপক ও ছাত্র ছিলেন। তারপর বঙ্গের পালরাজাদিগের শাসনকালে বিহার তাঁহাদের শাসনাধীন ছিল। তখন তাঁহারা নালন্দা মঠের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিতেন।

 উয়ান চুয়াঙ্ ৫ বৎসর নালন্দায় ছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন —“উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত এই বিহার চিত্রে ও ভাস্কর্য্যে পরমরমণীয় শোভনশ্রী ধারণ করিয়াছিল, এখানে আটটি চতুষ্কোণ কক্ষ আছে, এখানকার বিহারসমূহের অভ্রভেদী উচ্চ গম্বুজ ও চূড়া প্রভাতশিশিরে অদৃশ্য হইয়া থাকে। ইহাদের বাতায়ন হইতে বায়ুর গতি ও মেঘের খেলা এবং উচ্চ ছাদ হইতে চন্দ্র ও সূর্য্যগ্রহণ উত্তমরূপে প্রত্যক্ষ করা যায়।”

 অত্রত্য ছায়া-নিবিড় নিকুঞ্জ ও উদ্যানের শোভাদর্শনে পরিব্রাজক মোহিত হইয়াছিলেন। এখানে সরোবরসমূহের স্বচ্ছ-সলিলে নীলকমল প্রস্ফুটিত হইত, রক্তবর্ণ কুসুমে কনকতরু ঝল্‌মল্ করিত, শ্যামল পত্র-শোভিত আম্রবৃক্ষরাজি আনন্দপ্রদ ছায়া বিস্তার করিত।

 পরিব্রাজক বলেন,—“এই সময়ে ভারতবর্ষে সহস্র সহস্র সঙ্ঘারাম ছিল, কিন্তু নালন্দার গৃহরাজি সৌন্দর্য্যে ও ঐশ্বর্য্যে এবং উচ্চতায় অপর সকলকে অতিক্রম করিয়াছিল।”

 প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের এই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ভার বহন করিতেন দেশের নরপতি ও সমৃদ্ধ ব্যক্তিগণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাহারা বিদ্যার্থী হইয়া গমন করিত তাহাদিগকে কোনপ্রকার ব্যয় প্রদান করিতে হইত না। তক্ষশিলা এবং নালন্দার মত বিশ্ববিদ্যালয় সর্ব্বত্র ছিল না কিন্তু দেশের সর্ব্বত্রই ক্ষুদ্রবৃহৎ সঙ্ঘারামে বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এই সকল বিদ্যালয়ে ভারতীয় সর্ব্বপ্রকার দর্শন ও ধর্ম্মশাস্ত্র শিক্ষা প্রদান করা হইত। এখানে শত শত সুপণ্ডিত অধ্যাপক শিক্ষাদানে নিরত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন দর্শন ও ধর্ম্ম শিক্ষা দেওয়া হইত তেমন গণিত ও জ্যোতির্ব্বিদ্যা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। চুয়াঙ নালন্দায় রাজকীয় মানমন্দির ও জলঘড়ি দেখিয়াছেন। তথাকার জলঘড়ি বিশুদ্ধ সময় প্রকাশ করিত।

 চারুকলা ও হস্তশিল্প শিক্ষাদানের নিমিত্ত বিদ্যালয় ছিল। ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ ভাস্কর্য্যে, প্রতিমাচিত্রণে এবং মন্দিরের আলঙ্কারিক চিত্রকার্য্যে সুদক্ষ ছিলেন। চারুকলায় যাঁহারা কুশলী ছিলেন তাঁহারা হস্তশিল্পকে হেয় বলিয়া মনে করিতেন। খৃষ্টীয় পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ বিহারগুলি বিদ্যালোচনার কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল। নালন্দা বিদ্যায়তনের খ্যাতি সমস্ত এশিয়া মহাদেশে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। নালন্দা প্রাচীন ভারতের, কেহ কেহ মনে করেন সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম বিদ্যায়তন ছিল। এখানকার “রত্নোদধি” নামক গ্রন্থালয়ে হীনযান ও মহাযান এই দুই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যাবতীয় গ্রন্থ যত্নপূর্ব্বক সংগৃহীত হইয়াছিল। উক্ত গ্রন্থালয় অতিবৃহৎ ও উচ্চতায় নয় তলা ছিল। ইহা আকারে বুদ্ধগয়া মন্দিরের তুল্য ছিল। তিব্বত দেশে এইরূপ জনশ্রুতি আছে যে, নালন্দামঠের অপ্রাপ্তবয়স্ক সাধুরা তৈথিক সাধুদিগকে অপমানিত করায় তাঁহারা ক্রোধান্ধ হইয়া গ্রন্থালয় দগ্ধ করিয়া ফেলেন। এইরূপ প্রকাশ যে, কতগুলি গ্রন্থ নাকি অলৌকিক উপায়ে অগ্নিদগ্ন হয় নাই। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। চীনপরিব্রাজক উয়ান চুয়াঙ্ তৎপূর্ব্বে সপ্তম শতাব্দীতে যখন ভারতে আগমন করিয়াছিলেন তখন নালন্দা অক্ষুণ্ণ গৌরবে বিরাজিত ছিল।

অজন্তা

 খৃষ্টপূর্ব্ব কোন এক শতাব্দীতে সম্ভবতঃ কতিপয় বৌদ্ধ সাধু অজন্তার পার্ব্বত্য অঞ্চলে কয়েকটি স্বাভাবিক গুহা প্রাপ্ত হইয়া ছিলেন। তত্রত্য নৈসর্গিক শোভা সাধনার অনকূল বলিয়া তাঁহারা তথায় বাস করিয়া নিভৃত সাধনার শান্তি উপভোগ করিতেন। কালক্রমে ইঁহাদের খ্যাতি দেশমধ্যে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। বহু বদান্য ব্যক্তি তখন অজন্তার গুহাখননে আনুকুল্য করিতে লাগিলেন। এইরূপে তথায় অনেকগুলি গুহা খনিত হইল। উত্তরকালে অজন্তা ভারতের অন্যতম বিদ্যাশিক্ষার কেন্দ্র হইয়া উঠিল। অজন্তার অনেকগুলি গুহায় অধ্যাপক ও বিদ্যার্থীরা বাস করিতেন।

সারনাথ

 অতি প্রাচীনকাল হইতেই বারাণসী শিক্ষা ও ধর্ম্মালোচনার প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল। সকল মতাবলম্বী সাধুগণ এখানে স্ব ধর্ম্মমতের প্রাধান্য কীর্ত্তন করিতে আসিতেন। ভারতের হৃদ্‌পিণ্ডতুল্য এই কেন্দ্রভূমিতে যে সত্য জয়যুক্ত হইত তাহা নিখিল ভারতের সর্ব্বত্র অবলীলাক্রমে প্রসারিত হইয়া পড়িত। ভগবান্ বুদ্ধ বোধিলাভ করিয়া এই পণ্যভূমিতেই তাঁহার নবধর্ম্ম প্রচারকল্পে আগমন করিয়াছিলেন। কালক্রমে বারাণসী ও তন্নিকটবর্ত্তী সারনাথ বৌদ্ধধর্ম্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। সারনাথ যে একদিন বৌদ্ধ সাধুদের তপস্যা ও বিদ্যাদানের প্রসিদ্ধ স্থল ছিল তাহাতে আর কোন সন্দেহ করিবার হেতু নাই। ফাহিয়েন যখন এই পুণ্যতীর্থে আগমন করিয়াছিলেন তখন দেড় সহস্র বিদ্যার্থী এখানে ধর্ম্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেন।

বিক্রমশিলা

 নালন্দার অধঃপতনের পর পাল রাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ওদন্তপুরী ও বিক্রমশিলা বিদ্যায়তন জাগিয়া উঠিয়াছিল। নালন্দা, বিক্রমশিলা ওদন্তপরীর পুস্তকালয় হইতেই তিব্বতীয় বৌদ্ধগণ হস্তলিপি গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ঐ সকল হস্তলিপি গ্রন্থ হইতেই আধুনিক সুবিস্তৃত তিব্বতীয় সাহিত্যের উদ্ভব হইয়াছে। ওদন্তপুরীর গ্রন্থালয় আকারে নালন্দার গ্রন্থালয়কেও ছাড়াইয়া উঠিয়াছিল। এখানে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের বহু হস্তলিপি গ্রন্থ ছিল। ১২০২ খৃষ্টাব্দে বক্তিয়ার যখন বিহার জয় করেন তখন তাঁহার সেনাপতি এই গ্রন্থালয়ের ধ্বংস সাধন করেন।

 বৌদ্ধ বিদ্যায়তন বিক্রমশিলা প্রাচীন মগধ রাজ্যে অবস্থিত ছিল। এইরূপে কথিত আছে যে, পালবংশীয় দ্বিতীয় ভূপতি ধর্ম্মপাল ইহার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁহার পিতা গোপাল পালবংশের প্রথম রাজা। গোপাল, ভূপাল ও লোকপাল এই তিন নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। কানিংহাম সাহেব বলেন, ধর্ম্মপাল অষ্টম শতাব্দীর মধ্য বা শেষ ভাগে রাজত্ব করিতেন।

 সপ্তম শতাব্দীতে চীনদেশ হইতে প্রসিদ্ধ পরিব্রাজক উয়ান চুয়াঙ্ ও ই-চিঙ্ ভারতবর্ষে বৌদ্ধতীর্থ দর্শনার্থ আগমন করিয়াছিলেন; তাঁহাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে বিক্রমশিলার উল্লেখ নাই। সম্ভবতঃ অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে এই বিদ্যায়তন স্থাপিত হইয়াছিল।

 বৌদ্ধধর্ম্মেতিহাস গ্রন্থে প্রকাশ, মগধ রাজ্যে গঙ্গাতটবর্ত্তী প্রদেশে এক প্রশস্তাগ্র উচ্চ শৈলের উপর বিক্রমশিলা বিহার অবস্থিত। উক্ত ছয়দ্বারী বিহারের মধ্যবর্ত্তী বিস্তৃত প্রাঙ্গণে আট সহস্র লোকের সম্মিলন হইতে পারিত। বিক্রমশিলা বিহারটি যে, অতি সুশোভন ছিল তদ্‌বিষয়ে সন্দেহ নাই। কারণ তিব্বতবাসীরা এই বিহারকে আদর্শ করিয়া তাহাদের সঙ্ঘারামগুলি নির্ম্মাণ করিয়াছে। বিক্রমশিলা বিদ্যায়তনে যোগশাস্ত্র, মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্ম্মশাস্ত্র, চিকিৎসা এবং বিবিধ বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হইত। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম্ম যখন তান্ত্রিকতায় পরিণত হয় তখন বিক্রমশিলা তন্ত্রশিক্ষার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। নানাদেশ হইতে বিদ্যার্থীরা এই স্থলে আগমন করিয়া বিদ্যালোচনা করিতেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি মহাবিদ্যালয় এবং ১০৮ জন অধ্যাপক ছিলেন। পণ্ডিতেরা এই বিদ্যায়তনে দ্বাররক্ষকের কার্য্য করিতেন। যে বিদ্যার্থী দ্বাররক্ষক পণ্ডিতদিগকে বিচারে সন্তুষ্ট করিতে না পারিতেন তিনি এই বিদ্যায়তনে প্রবেশ করিতে পারিতেন না। অন্যত্র কোন কোন শাস্ত্রালোচনা করিয়া যাঁহারা পাণ্ডিত্য লাভ করিতেন তাঁহারাই এখানে উচ্চতর বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ পাইতেন। উয়ান চুয়াঙ্ বলেন,—এই প্রকারে পরীক্ষা করিয়া ছাত্র গ্রহণের প্রথা নালন্দায়ও প্রচলিত ছিল।

 ধর্ম্মপালের রাজত্বকালে বিক্রমশিলা সঙ্ঘারামের অধিনায়ক ছিলেন শ্রীবুদ্ধ জ্ঞানপদ। নরপতি নরপাল দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানপদকে বিহারের প্রধান পুরোহিত নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তিব্বতরাজ এই পুরোহিত মহাশয়কে ধর্ম্মসংস্কার কার্য্যের উপযুক্ত মনে করিয়া তাঁহাকে তিব্বতে আহ্বান করিয়াছিলেন। ১০২৮ খৃষ্টাব্দে দীপঙ্কর তিব্বত গমন করিয়া সংস্কারকার্য্যে ব্রতী হইয়াছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে যখন বক্তিয়ার বিহার জয় করেন, তখন মুসলমানেরা বিক্রমশিলা ধ্বংস করে। পালবংশীয় শেষ নরপতি ইন্দ্রদ্যুম্নের শাসনকালে এই শোচনীয় কাণ্ড ঘটিয়াছিল। ঐ সময়ে শাক্যশ্রী বিক্রমশিলার প্রধান পুরোহিত ছিলেন। তিনি প্রাণভয়ে প্রথমে উড়িষ্যায়, পরে সেখান হইতে তিব্বতে পলায়ন করেন।

 ভাগলপুর হইতে চব্বিশ মাইল দূরবর্ত্তী পাথরঘাটা নামক স্থানে বিক্রমশিলা সঙ্ঘারাম অবস্থিত ছিল, এইরূপ অনুমিত হইতেছে।