বৌদ্ধ-ভারত/প্রথম অধ্যায়

প্রথম অধ্যায়

বুদ্ধ ও বৌদ্ধশাস্ত্র

'

 খৃষ্টপূর্ব্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের চিন্তারাজ্যে এক তুমল বিপ্লব ঘটিয়াছিল। বহু শতাব্দী ধরিয়া এদেশের হিন্দু আর্য্যগণ যে ক্রিয়াকর্ম্ম, আচারঅনুষ্ঠান নির্ব্বিচারে মানিয়া আসিতেছিলেন, কালক্রমে সেই সকল অনুষ্ঠান এমন প্রাণহীন ও নীরস হইয়া পড়িয়াছিল যে, সেগ‍ুলি আর কাহারও চিত্তে ধর্ম্মবোধের সঞ্চার করিত না। অত্যাশ্চর্য্য নৈসর্গিক শোভায় বিহ্বল হইয়া ঋগ্বেদের ঋষিগণ স্বাভাবিক ভক্তির উচ্ছ্বসে সরল বন্দনামন্ত্রে ইন্দ্র, বরণ, ঊষা প্রভৃতি যে দেবতাগণের আরাধনা করিয়াছেন, তখনও সেই দেবতাগণের নাম উচ্চারিত হইত বটে, কিন্তু, সেই নাম তখন কাহারও হৃদয়যন্ত্রে ভক্তিতারে ঝঙ্কার দিত না। এই সকল ঋষির বংশধরগণই বাহির হইতে চাপ পাইয়া নানা প্রয়োজনের তাগিদে আপনাদের কর্ম্ম বিভাগ করিয়া নানা বর্ণের সৃষ্টি করিয়া ফেলিলেন। কালে কালে সেই ভাগবিভাগ জাতিভেদের সৃষ্টি করিল। ঋষিদের বংশধরগণের এক দল হইলেন ব্রাহ্মণ; ক্লিয়াকর্ম্ম যাগযজ্ঞ ধ্যানধারণাই তাঁহাদের ব্যবসায় হইল। ইহাতে কোনও সফল ফলে নাই এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু, কালক্রমে এই প্রথায় লোকের মনে এই বোধ জন্মিল যে, যাজক পুরোহিতই তাহাদের প্রতিনিধি হইয়া ভগবানকে ডাকিবেন, ব্যক্তিগত ক্লেশ স্বীকার করিয়া তাহাদের ধ্যানধারণার কোনও প্রয়োজন নাই। বেদের ঋষি যে ভাবের প্রেরণায় মন্ত্রার্থ প্রত্যক্ষ করিয়া ভগবানের বন্দনা গান গাহিয়াছেন, সে ভাব সর্ব্বতোভাবে অন্তর্হিত হইল। মন্ত্রের আবৃত্তি, আয়োজনের অনাবশ্যক আড়ম্বর, ক‍্রিয়ার বাহল্য এবং অনুষ্ঠানের প্রকরণ ভাবের অভাব প্রকাশ করিতে লাগিল। ভাবের বিলোপের অনুপাতে কর্ম্মকাণ্ড বাড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্ত‍ু মানুষের হৃদয় তাহা মানিতে চাহিবে কেন? মাননুষের চিত্ত আপনাআপনি বিদ্রোহী হইয়া উঠিল; প্রতিক্রিয়া সুর‍ু হইল। সত্য বটে, উপনিষদের ঋষিগণ বিশ্বব্যাপী দেবতার মহিমা ঘোষণা করিয়াছেন এবং নানা দর্শনশাস্ত্রে পণ্ডিতেরা দুর্ব্বোধ্য বাদানবাদের দ্বারা নানা ধর্ম্মতত্বের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। কিন্তু, সেই উচ্চ ধর্ম্ম, সেই উচ্চ তত্ত্ব মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়াছিল। সাধারণ লোক তাহার খোঁজ রাখিত না, অথবা উহা ধারণা করা তাহাদের সাধ্যের অতীত ছিল। ফলে যে সকল ক্রিয়া কর্ম্মের উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় ও অর্থ তাহারা কিছুমাত্র বুঝিত না সেই সমস্তই তাহারা আচরণ করিত। কিন্তু বুদ্ধি দিয়া মানুষ যাহা করে না, সে তাহাতে সুখ পায় না এবং তাহার মন সেই অনাবশ্যক বোঝা ছুঁড়িয়া ফেলিবার জন্যই বিদ্রোহী হইয়া উঠে।

 সেই সুদূর অতীতকালে ভারতবর্ষে মানবচিত্ত একদা এমনই বিদ্রোহী হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। সাধকশ্রেষ্ঠ গৌতম বুদ্ধ এই বিদ্রোহীদের অন্যতম। লোকে তাঁহাকে বেদবিরোধী বলিয়া নাস্তিক আখ্যা দিল, তিনি সেই নিন্দার মুকুট পরিয়াই বিদ্রোহের পতাকা দৃঢ় হস্তে ধারণ করিলেন। তিনি উচ্চ তত্ত্ব ছাড়িয়া সোজা কথায় সত্য প্রচার করিয়া লোকের মন জয় করিয়া লইলেন। ছোটবড় সকলকে স্নেহকণ্ঠে নিজের কাছে ডাকিয়া ধর্ম্মের উদার ক্ষেত্র দেখাইয়াছিলেন। তিনি তত্ত্বও বলেন নাই, শাস্ত্রও বলেন নাই; বলিয়াছেন তাঁহার অন্তরের উপলব্ধ সহজ সত্য। তাহা অনাবৃত, অবিকৃত সত্য বলিয়াই সর্ব্বজনের গ্রহণযোগ্য। এই জন্য তাঁহার ধর্ম্ম কতিপয় পণ্ডিতের ধর্ম্ম হইল না; সকল দেশের, সকল মানবের ধর্ম্ম হইল। ভারতবর্ষের চিত্ত বহুকাল পরে একটি অমৃত উৎসের রস পাইয়া সজীব হইয়া উঠিল।

 এই প্রাণের ক্রিয়া সকল দিক দিয়া প্রকাশ পাইয়াছিল। একমাত্র ধর্ম্ম নহে— শিল্পে, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, স্থাপত্যে, সকল দিকেই দেশ উন্নত হইয়াছিল। গৌতমবুদ্ধ ইচ্ছাপর্ব্বক স্বয়ং একটি নূতন ধর্মস্থাপনের চেষ্টা পাইয়াছিলেন, এমন কথা যদি কেহ মনে করেন তিনি নিঃসন্দেহ ভুল করিবেন। তাঁহার অপূর্ব্ব জীবনের ইতিবৃত্ত পাঠ করিলে জানা যায় যে, তিনি এদেশের সকল শাস্ত্র, পঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করিয়াছেন, গ‍ুর‍ূদের শরণাপন্ন হইয়া নানা সাধনার সহিত পরিচিত হইয়াছেন, শ্রেয়ের সন্ধানে দেশে দেশে, বনে, পর্ব্বতে ঘরিয়া বেড়াইয়াছেন। তাঁহার পূর্ব্বে আরও অনেকে এইরূপ পরিব্রাজকরূপে ধর্ম্মসাধনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। হিন্দুশাস্ত্রকারগণ বুদ্ধের মতানুবর্ত্তীদের “শাক্য পুত্রীয় শ্রমণ” নাম দিয়া শাস্ত্রমধ্যে এক পার্শ্বে একট, ঠাঁই দিয়াছেন। ইহা হইতেই এ কথা বোঝা যায় যে, হিন্দু শাস্ত্রকারগণের মতেও গৌতমবুদ্ধ এমন কিছু অন্যায় করেন নাই যে, তাঁহাকে একান্ত উপেক্ষেনীয় বলিয়া তাঁহারা ত্যাগ করিতে পারেন। হয়তো শাস্ত্রকারগণের মতে বুদ্ধ নূতন কিছু করেন নাই। এক হিসাবে এ কথা মানিয়া লওয়া যায়। যেহেতু সহজ সত্য চিরকালই এক, কিন্ত‍‍ু সেই সহজ সত্যই মানুষ বারংবার ভুলিয়া যায়। বুদ্ধ সেই বিস্মৃত সত্য সরল হৃদয়স্পর্শী কথায় বলিয়াছেন। পুঞ্জীভূত ক্লিয়াকর্ম্মের আবর্জ্জনা উড়াইয়া দিয়া লোককে সত্যের উজ্জ্বল মূর্ত্তি দেখাইয়া দিয়াছেন। তিনি সমাজে, শাস্ত্রে, আচারে, অনুষ্ঠানে কোথাও সত্যের দেখা না পাইয়া পাগল হইয়া সত্যরত্ন উদ্ধারের জন্য সখভোগ, রাজৈশ্বর্য্য ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং সত্যধন লাভ করিয়াই বদ্ধ হইয়াছিলেন।

 অনুগামী শিষ্যদের কাছে তিনি তাঁহার সত্যসাধনার এই কাহিনী বিবৃত করিয়াছেন। লোকের প্রতি অননুকম্পা করিয়া, বহুজনের হিতকামনায় তিনি তাঁহার উপলব্ধ সত্য সোজা কথায় সর্ব্বজন সমক্ষে ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তাঁহার উপদেশ লোক সাধারণকে চক্ষুষ্মান, করিল, অমৃত দুন্দুভি শ্রবণ করাইল। যাহা কোনকালে শুনে নাই লোক সাধারণ এমন মধুর ধর্ম্মবাণী শনিয়া নূতন প্রাণ লাভ করিল। তাঁহার সেই সত্যবাণী মন্ত্র হইয়াছে, তাঁহার সেই কাহিনীই উত্তরকালে শাস্ত্র হইয়াছে।

 প্রাচীন শাস্ত্রকার গৌতম বুদ্ধের জন্য যত ক্ষুদ্র আসনটিই রাখুন না কেন, পৃথিবীর ইতিহাসের ক্ষেত্রে তিনি এমন বৃহৎ স্থান জুড়িয়া রহিয়াছেন যে, সমস্ত পৃথিবী তাঁহাকে প্রীতিপূর্ব্বক আপনার বলিয়া চিনিয়া জানিয়া লইয়াছে। পুরাণে তিনি অবতার বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। এমন অবতার হইয়া তাঁহার গৌরব একটুও বাড়িয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। অবতার বলিয়া অনেকেই তাঁহাকে অন্তরে স্থান দিতে কুণ্ঠা বোধ করিয়া থাকেন। কিন্তু, মহাপুরুষ বলিয়া সকলেই তাঁহাকে হৃদয় আসনে বসাইয়া ভক্তিপূর্ণ অর্ঘ্যদান করিবেন।

 বুদ্ধকে ঘরের কোণে ছোট একটি আসন দিয়া হিন্দুরা তাঁহার ধর্ম্ম ও শাস্ত্র এই দেশ হইতে এমন নিঃশেষে বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছিলেন যে, এই ধর্ম্ম একরূপ এদেশ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছিল।

 কিন্তু, সজীব পাদপ যে দিকে আলোক পায় সেই দিকেই ঝুঁকিয়া পড়ে। জন্মভূমিতে ঠাঁই না পাইয়া এই ধর্ম্ম বিদেশকেই আশ্রয় করিল এবং তথায় বলিষ্ঠ, স্বাধীন, প্রাণবান নরনারীর শ্রদ্ধার আলোকে অপূর্ব্ব বিকাশ লাভ করিল। বুদ্ধের ধর্ম্ম যদি অগভীর হইত, তাঁহার সাধনাতর, যদি ভারতবর্ষের মর্ম্মস্থানে শিকড় প্রবেশ করাইতে না পারিত, তাহা হইলে যখন এদেশ বিদ্রোহী হইয়া এই তরুর শাখা পল্লব কাটিয়া ফেলিয়াছিল, তখন মূলটিও উপাড়িয়া ফেলিত সন্দেহ নাই। এই অসাধ্য সাধনের চেষ্টা হয় নাই এমন নহে কিন্তু, মন্দির ভাঙ্গিয়া শাস্ত্র পোড়াইয়া ত এই চেষ্টা সফল হইতে পারে না; এই পত্রপল্লবশাখাহীন তরুর মূলটা এদেশের মাটিতে রহিয়াই গিয়াছে।

 গৌতম বুদ্ধই সর্ব্বপ্রথমে বৈদিক ক্রিয়াকর্ম্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন, একথা সত্য নহে। তাঁহার প্রাদুর্ভাবের বহু পূর্ব্ব হইতেই বিরুদ্ধতা দেখা গিয়াছে। নিগ্রন্থ, আজীবক প্রভৃতি সম্প্রদায়গলিও বৈদিক ক্রিয়াকর্ম্মের কোনো প্রয়োজনীয়তাই স্বীকার করে না।

 এই বেদবিরোধী ক্ষুদ্র বৃহৎ দলগুলির প্রভাব সমস্ত দেশের উপর পরিব্যাপ্ত হইতে পারে নাই, তথাপি দেশের স্থানে স্থানে লোকের চিত্ত বিদ্রোহের তরঙ্গ তুলিয়াছিল। ঐ সকল ক্ষুদ্র দলের নায়কগণ সকলের গ্রহণযোগ্য কোন উন্মুক্ত সার্ব্বভৌম রাস্তা নির্দ্দেশ করিয়া দিতে পারেন নাই। দুই একজন নায়ক একদল লোকের চিত্ত জয় করিয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিতে পারিয়াছিলেন, এইমাত্র। গৌতম বুদ্ধের অত্যুজ্জল প্রতিভার আলোক মানবের গম্ভব্য পথ প্রকাশিত করিয়া দিয়াছে। তাঁহার, সাধু চরিত্র এমন মাধুর্য্যে মণ্ডিত ছিল যে, তাঁহাকে সকলেই আপনার বলিয়া গ্রহণ করিল, তাঁহার উদারতা এমন বিশ্বব্যাপিনী ছিল যে কোনো লোকই তাঁহাকে আপনার বলিতে সঙ্কোচ বোধ করিল না। তাঁহার বাণী এমন ঋজু ও মর্ম্মস্পর্শী ছিল যে, তীক্ষ্ণ তীরের ফলার ন্যায় উহা যে কোনো শ্রোতারই হৃদয়ে বিদ্ধ হইয়া থাকিত। এখন প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পরেও এই মহাপুরুষের নিষ্কলঙ্ক শুদ্ধ চরিত্রের পবিত্র-সৌরভ এবং নীতি ও ধর্ম্মের বাণী অসংখ্য নরনারীর চিত্তহরণ করিতেছে। তাঁহারই অপূর্ব্ব মৈত্রীমূলক ধর্ম্ম ভারতবর্ষের নানাপ্রদেশের নানা ভাষাভাষীদিগকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করিয়াছিল। উদ্ভবকাল হইতে প্রায় পনর শত বৎসর এই সদ্‌ধর্ম কখনো উজ্জ্বল প্রভায়, কখনো মৃদুমন্দ ভাতিতে ভারতবাসীর চিত্তে আলোক দান করিয়াছে। তাহারপর সহসা রূপকথার রাজকুমারীর প্রাণের মত কে যেন কেমন করিয়া সোনা রূপার কাঠি ফিরাইয়া বৌদ্ধধর্ম্ম, বৌদ্ধবিহার এবং বৌদ্ধশাস্ত্র অল্পকাল মধ্যে সমস্তই প্রাণহীন করিয়া দিল। গভীর অন্ধকারে সমস্তই ঢাকা পড়িয়া গেল।

 পতন দশায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার সহিত আঁটিয়া উঠিতে না পারিয়া বৌদ্ধধর্ম্মের পৈতৃক ভিটায় স্থান হইল না। স্বগৃহের পরিত্যক্ত অনাদৃত যুবকের ন্যায় বৌদ্ধধর্ম্মকে বিদেশেই ঘর বাঁধিতে হইয়াছে। সেইখানে এই ধর্ম্ম সবিক্রমে সগৌরবে আপন মহিমায় অচলপ্রতিষ্ঠ হইয়া রহিয়াছে। কিন্তু, ভারতবর্ষ এই ধর্ম্মের গৌরব বিস্মৃত হইল।

 যাঁহারা এই মৈত্রীমূলক সদ্‌ধর্ম্মের বর্ত্তমান অভ্যুত্থানের সংবাদ রাখেন তাঁহারা জানেন যে, ধৈর্য্যশীল প্রতীচ্য পণ্ডিতগণ ভারতবর্ষের ভিতর হইতে এই ধর্ম্মের কোনো গ্রন্থ উদ্ধার করিতে পারেন নাই; ভারতপ্রান্তবর্ত্তী নেপাল এবং ভারতের বাহিরে তিব্বত, সিংহল, ব্রহ্মদেশ, চীন ও জাপান হইতে বৌদ্ধশাস্ত্র সংগৃহীত হইয়াছে। নেপাল, তিব্বত, চীন ও জাপানে মহাযান বৌদ্ধধর্ম্ম এবং সিংহল ও ব্রহ্মদেশে হীনযান বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচলিত। একই ধর্ম্ম, একই শাস্ত্র দুই সম্প্রদায়ে দুইরূপে অভিব্যক্ত হইয়াছে। হীনযান ধর্ম্মগ্রন্থে বৌদ্ধধর্ম্মের আদিম অবিকৃত চেহারাটি দেখা যাইতে পারে। এই ধর্ম্মশাস্ত্র “ত্রিপিটক” নামে খ্যাত। আমরা সিংহল হইতে এই “ত্রিপিটক” পাইয়াছি। বর্ত্তমানে সিংহলে যে ত্রিপিটক প্রচলিত আছে তাহার পাঠ তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতির নির্দ্ধারিত পাঠের সহিত অভিন্ন হইবে বলিয়া মনে হয়। কারণ যখন অশোকপুত্র মহেন্দ্র একদল বৌদ্ধ সাধুসহ পিতার আদেশে সিংহলে ধর্ম্ম প্রচারার্থে গিয়াছিলেন, সেই সময়ে সিংহল রাজ তিস্‌স বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিয়া সিংহলে এই ধর্ম্ম স্থাপন করেন। যে সকল বৌদ্ধসাধু মহেন্দ্রের অনুগমন করিয়াছিলেন তাঁহারা কেহ কেহ হয়ত তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতিতে যোগদান করিয়া থাকিবেন। ইহার দেড়শত বৎসর পরেই পালি পিটকগুলি হস্তাক্ষরে গ্রন্থাকারে লিখিত হয়। বৌদ্ধধর্ম্মের অভ্যুত্থানের সময়েই এই ধর্ম্ম সিংহলে প্রচারিত হইয়াছিল এবং তখন সাধুদের স্মৃতিতেই এই ধর্ম্ম যথাযথ ভাবে মুদ্রিত ছিল, সুতরাং সিংহলী ত্রিপিটককে অসঙ্কোচে পণ্ডিতেরা প্রামাণ্য বলিয়া মানিয়া লইয়াছেন। এই ত্রিপিটকেই বৃদ্ধের বাণী অবিকৃত আকারে লিপিবদ্ধ আছে বলিয়া মনে হয়। বুদ্ধের পরিনির্ব্বাণলাভের দুই এক শত বৎসর মধ্যে ত্রিপিটক গ্রথিত হইয়াছিল। ইহার মধ্যে তাঁহার জীবন ও বাণী যে ভাবে পাওয়া যায়, তাহা বিশেষ অতিরঞ্জিত মনে করিবার কারণ নাই। অশেষ শাস্ত্রাধ্যাপক হইয়াও বুদ্ধ দেশপ্রচলিত ভাষাতেই ছোটবড়, পণ্ডিতমূর্খ সকলের নিকট তাঁহার ধর্ম্মকাহিনী বিবৃত করিতেন, সতরাং প্রাকৃত পালিভাষায় লিখিত ত্রিপিটকে বুদ্ধের উক্তি যথাযথ ভাবেই লিখিত হইয়া থাকিবে, ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ করিবার হেতু নাই।

 বুদ্ধের জীবিতকালের ও তাঁহার আবির্ভাবের অব্যবহিত পরবর্ত্তী বহুশত বৎসরের ইতিহাসের বিস্তর উপকরণ এই ত্রিপিটকে পাওয়া যায় বলিয়া ত্রিপিটকের একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্য আছে। যাঁহারা বুদ্ধের ও বৌদ্ধধর্ম্মের আদিম অবিকৃত মর্ত্তি দেখিয়াই তৃপ্ত হইয়া থাকেন, তাঁহারা কেহ কেহ মহাযান বৌদ্ধধর্ম্মকে হীনযান বৌদ্ধধর্ম্ম অপেক্ষা হীন বলিতে চাহেন। তাঁহাদের সহিত সকলে একমত হইতে পারিবেন এমন আশা করা যায় না।

 মহাযান বৌদ্ধশাস্ত্রে বৌদ্ধধর্ম্মের একটি আশ্চর্য্য পরিণতি দেখা যায়। মহাযান বৌদ্ধেরা বুদ্ধের মুখের কথাগুলি যথাযথ আকারে রক্ষা করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করেন নাই কিন্তু, তাঁহাদের সাধকগণ সাধনার অমৃতরস সেচনে সেই মূলবীজগলিকে পত্রিত, পুষ্পিত বৃক্ষে পরিণত করিয়াছেন। সেই পরিণতির ইতিবৃত্তের মধ্যে সামাজিক রাষ্ট্রীয় ইতিবৃত্তের উপকরণ না থাকিতে পারে, কিন্তু, তন্মধ্যে সাধনার ক্রমবিকাশ উজ্জ্বল আকারে প্রস্ফূর্ত্ত হইয়াছে। ললিত বিস্তরে বুদ্ধের সাধনার ইতিবৃত্ত যেমন সুপরিস্ফুট হইয়াছে, তেমন সুস্পষ্ট বর্ণনা অন্যত্র দেখা যায় না।

 মহাযান সম্প্রদায় আদিম বুদ্ধবাণীকে মূলধন করিয়া নানাদিক দিয়া খাটাইয়া, বাড়াইয়া প্রাণেরই পরিচয় দিতেছেন। ইহাতে হয় তো স্থানে স্থানে লোকসান হইয়া থাকিবে, কিন্তু, সে ক্ষতি এড়াইবার উপায় নাই। কারণ ঘরের পুঁজি লইয়া ব্যবসায়ে নামিলে লাভ লোকসানের ঝুঁকি থাকিবেই। সুতরাং মহাযানদের শাস্ত্রে অতিরঞ্জন দেখিয়া বিস্মিত হইলে চলিবে না। তাহাদিগের সমাজে, সাধনায় ও শাস্ত্রে মৃত্যুর দুর্ল্লক্ষণ নাই, নানাদিকে জীবনের আবেগই দৃষ্ট হইয়া থাকে; প্রাণের আনন্দলীলা নিরন্তর হিল্লোলিত হইতেছে। বৌদ্ধধর্ম্মের ব্যাপ্তি ও পরিণতির ইতিবৃত্ত অতীব কৌতূহলাবহ।

 কেবল মাত্র ধর্ম্মসাধনার দিক হইতে নহে, ঐতিহাসিকতার দিক হইতেও বৌদ্ধশাস্ত্রের আলোচনার প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। এই শাস্ত্রের মধ্যে প্রাচীন ভারতের সভ্যতার উজ্জ্বল চিত্র দৃষ্ট হয়। সেই প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের বাহ্য আকার, রাষ্ট্রীয় বিভাগ, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা কিরূপ ছিল বৌদ্ধশাস্ত্রে নানাস্থানে তাহার সুস্পষ্ট বর্ণনা রহিয়াছে। বৌদ্ধশাস্ত্রের আকর হইতে প্রতিদিন পণ্ডিতেরা নিত্য নূতন রত্ন আহরণ করিতেছেন।

 বৌদ্ধশাস্ত্র বা ত্রিপিটক মোটামটি তিনভাগে বিভক্ত। বিনয়, সূত্র, অভিধর্ম্ম। বিনয় পিটকে সঙ্ঘের ইতিবৃত্ত বিস্তারিত আলোচিত হইয়াছে। বিনয়ের পাঁচ ভাগ আছে; পারাজিক, পাচিত্তীয়, মহাবগ্‌গ, চুল্লবগ্‌গ, পরিবার।

 বৌদ্ধসঙ্ঘ প্রাচীন ভারতের সর্ব্বপেক্ষা শক্তিশালী জনসঙ্ঘ। বিনয়পিটকে এই সঙ্ঘের অভ্যুত্থান ও নানা পরিবর্ত্তনের ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়। পাতিমোক্‌খ সুত্তবিভঙ্গের অন্তর্গত। এই গ্রন্থখানিকে প্রাচীনতম বৌদ্ধগ্রন্থ বলা হয়। পাতিমোক্‌খ গ্রন্থে প্রায়শ্চিত্তের বিধানগুলি সূত্রাকারে গ্রথিত আছে। সূত্রবিভঙ্গে নানা অপরাধ ও তাহার প্রায়শ্চিত্ত বিধান বিস্তারিত আলোচিত হইয়াছে।

 প্রত্যেক পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথিতে বৌদ্ধদের সম্মিলনীতে সূত্রবিভঙ্গ পঠিত হইত। বৌদ্ধ সাধুদের এই পাক্ষিক সভাগুলির একটি বিশেষত্ব এই ছিল যে, সমবেত ভিক্ষুসঙ্ঘের সম্মুখে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীগণ তাঁহাদের কৃত ক্ষুদ্র বৃহৎ পাপগুলি অকপটে স্বীকার করিতেন এবং পাপগুলির নিমিত্ত কোনো-না-কোনো প্রায়শ্চিত্ত গ্রহণ করিতেন। এই সভার প্রয়োজনের নিমিত্ত পাতিমোক্‌খের প্রায়শ্চিত্তবিধি সূত্রাকারে বিরচিত হইয়াছিল। গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং এই সূত্রগুলির আবৃত্তি করিয়াছেন বলিয়া উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু, এই উক্তির সমর্থনের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। পালি বৌদ্ধশাস্ত্র এক মাত্র ভাবে নহে, ভাষায়ও ভগবান্ বুদ্ধের বলিয়া স্বীকৃত হইতে পারে। কারণ ভগবান্ বুদ্ধ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া যখন তাঁহার সুচিন্তিত ধর্ম্মমত জনসমাজে প্রচারের জন্য বাহির হইলেন তখন তাঁহার বয়স পঁয়ত্রিশ বৎসর মাত্র। তাঁহার পরে তিনি পঁয়তাল্লিশ বৎসরেরও বেশী কাল জীবিত ছিলেন। এই দীর্ঘকালে তাঁহার মুখের বাণী শিষ্যগণ যথাযথ কণ্ঠস্থ করিয়া থাকিবেন হইাতে সন্দেহ করিবার হেতু নাই। এইজন্যই সূত্রপিটকে কোথায়ও ছাঁটা-কাটা ধর্ম্মমত লিপিবদ্ধ হয় নাই। কোন সময়ে, কোথায়, কি কারণে, কাহার নিকট বুদ্ধ তাঁহার ধর্ম্মবাণী ব্যাখ্যা করিয়াছেন প্রত্যেক সূত্রেরই ভূমিকাভাগে তাহার উল্লেখ দেখা যায়। সূত্রপিটকের প্রায় সকল সূত্রেরই বক্তা স্বয়ং ভগবান্ বুদ্ধ। কদাচিৎ তাঁহার প্রধান শিষ্যদের দুই এক জনের নাম দেখা যায়।

 বৌদ্ধধর্ম্মশাস্ত্রের এই ঐতিহাসিক যাথাতথ্য সকল দেশের সূধীবর্গকে এই শাস্ত্রালোচনায় আকর্ষণ করিতেছে, সেই আলোচনার ফলে ভারতের সভ্যতা ও ভারতের মহাপুরুষ বুদ্ধ পৃথিবীতে এমন অপূর্ব্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করিতেছেন। পালি বৌদ্ধশাস্ত্রেও অল্পাধিক অতিরঞ্জন ও বাহ‍ুল্য স্থান পাইয়াছে সন্দেহ নাই। কারণ এই গ্রন্থগুলি সহিষ্ণু বৌদ্ধদের স্মৃতি হইতে সংগৃহীত হইয়া নানা কাল ও সমাজ অতিক্রম করিয়া বর্ত্তমান যুগে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। এই শাস্ত্রের বাক্যবিন্যাসে ও রচনাভঙ্গীতে সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের বিচিত্র ধর্ম্মমতের প্রভাব দৃষ্ট হইয়া থাকে সন্দেহ নাই। তথাপি এই শাস্ত্রের নিজস্ব মহিমাময়রূপ ঢাকা পড়িয়া যায় নাই। যুক্তি ও বিজ্ঞানবাদীদিগের জ্ঞানদৃষ্টি উক্তর‍ূপ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছে ও তাঁহারা এই ধর্ম্মের ও শাস্ত্রের আদর না করিয়া পারিবেন না।