বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
রামমােহন মাল যখন অন্তঃপুরে আসিয়া বিভাকে প্রণাম করিয়া কহিল, “মা তােমায় একবার দেখিতে এলাম” তখন বিভার মনে বড় আহ্লাদ হইল। রামমােহনকে সে বড় ভালবাসিত। কুটুম্বিতার নানাবিধ কার্য্যভার বহন করিয়া রামমােহন প্রায় মাঝে মাঝে চন্দ্রদ্বীপ হইতে যশােহরে আসিত। কোন আবশ্যক না থাকিলেও অবসর পাইলে সে এক একবার বিভাকে দেখিতে আসিত। রামমােহনকে বিভা কিছুমাত্র লজ্জা করিত না। বৃদ্ধ, বলিষ্ঠ, দীর্ঘ, রামমােহন যখন “মা” বলিয়া আসিয়া দাঁড়াইত তখন তাহার মধ্যে এমন একটা বিশুদ্ধ, সরল, অলঙ্কারশূন্য স্নেহের ভাব থাকিত, যে বিভা তাহার কাছে আপনাকে নিতান্ত বালিকা মনে করিত। বিভা তাহাকে কহিল “মােহন, তুই এতদিন আসিস্ নাই কেন?”
রামমােহন কহিল, “তা মা, ‘কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখন নয়,’ তুমি কোন্ আমাকে মনে করিলে? আমি মনে মনে কহিলাম, মা না ডাকিলে আমি যাব না; দেখি, কত দিনে তাঁর মনে পড়ে! তা’ কৈ, একবারাে ত মনে পড়িল না!”
বিভা ভারি মুষ্কিলে পড়িল। সে কেন ডাকে নাই, তাহা ভাল করিয়া বলিতে পারিল না। তাহা ছাড়া, ডাকে নাই বলিয়া যে মনে করে নাই, এই কথাটার মধ্যে এক জায়গায় কোথায় যুক্তির দোষ আছে বলিয়া মনে হইতেছে, অথচ ভাল করিয়া বুঝাইয়া বলিতে পারিতেছে না।
বিভার মুষ্কিল দেখিয়া রামমােহন হাসিয়া কহিল, “না মা অবসর পাই নাই বলিয়া আসিতে পারি নাই।”
বিভা কহিল, “মােহন তুই বােস; তােদের দেশের গল্প আমায় বল্।”
রামমােহন বসিল। চন্দ্রদ্বীপের বর্ণনা করিতে লাগিল। বিভা গালে হাত দিয়া এক মনে শুনিতে লাগিল। চন্দ্রদ্বীপের বর্ণনা শুনিতে শুনিতে তাহার হৃদয়টুকুর মধ্যে কত কি কল্পনা জাগিয়া উঠিয়াছিল, সে দিন সে আসমানের উপর কত ঘর বাড়িই বাঁধিয়াছিল, তাহার আর ঠিকানা নাই। যখন রামমােহন গল্প করিল, গত বর্ষার বন্যায় তাহার ঘড় বাড়ি সমস্ত ভাসিয়া গিয়াছিল; সন্ধ্যার প্রাক্কালে সে একাকী তাহার বৃদ্ধা মাতাকে পিঠে করিয়া সাঁতার দিয়া মন্দিরের চূড়ায় উঠিয়াছিল, ও দুই জনে মিলিয়া সমস্ত রাত্রি সেইখানে যাপন করিয়াছিল;—তখন বিভার ক্ষুদ্র বুকটির মধ্যে কি হৃৎকম্পই উপস্থিত হইয়াছিল।
গল্প ফুরাইলে পর রামমােহন কহিল “মা, তোমার জন্য চারগাছি শাঁখা আনিয়াছি, তােমাকে ঐ হাতে পরিতে হইবে, আমি দেখিব।”
বিভা তাহার চারগাছি সােনার চুড়ি খুলিয়া শাঁখা পরিল, ও হাসিতে হাসিতে মায়ের কাছে গিয়া কহিল,—“মা, মােহন তােমার চুড়ি খুলিয়া আমাকে চারগাছি শাঁখা পরাইয়া দিয়াছে।”
মহিষী কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট না হইয়া হাসিয়া কহিলেন, “তা,’ বেশ ত সাজিয়াছে, বেশ ত মানাইয়াছে।”
রামমােহন অত্যন্ত উৎসাহিত ও গর্ব্বিত হইয়া উঠিল। মহিষী তাহাকে ডাকাইয়া লইয়া গেলেন, নিজে উপস্থিত থাকিয়া তাহাকে আহার করাইলেন। সে তৃপ্তিপূর্ব্বক ভােজন করিলে পর তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন,—“মােহন, এই বারে তাের সেই আগমনীর গানটি গা।” রামমােহন বিভার দিকে চাহিয়া গাহিল;—
“সারা বরষ দেখিনে মা, মা তুই আমার কেমন ধারা,
নয়ন-তারা হারিয়ে আমার অন্ধ হ’ল নয়ন-তারা!
এলি কি পাষাণী ওরে,
দেখ্ব তােরে আঁখি ভােরে,
কিছুতেই থামেনা যে মা, পােড়া এ নয়নের ধারা!”
রামমােহনের চোখে জল আসিল, মহিষীও বিভার মুখের দিকে চাহিয়া, চোখের জল মুছিলেন। আগমনীর গানে তাঁহার বিজয়ার কথা মনে পড়িল।
ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। পুরমহিলাদের জনতা বাড়িতে লাগিল। প্রতিবেশিনীরা জামাই দেখিবার জন্য ও সম্পর্ক অনুসারে জামাইকে উপহাস করিবার জন্য অন্তঃপুরে সমাগত হইল। আনন্দ, লজ্জা, আশঙ্কা, একটা অনিশ্চিত, অনির্দ্দেশ্য না জানি-কি-হইবে ভাবে বিভার হৃদয় তোলপাড় করিতেছে, তাহার মুখ কান লাল হইয়া উঠিয়াছে, তাহার হাত পা শীতল হইয়া গিয়াছে। ইহা কষ্ট কি সুখ কে জানে!
জামাই অন্তঃপুরে আসিয়াছেন। হুল-বিশিষ্ট সৌন্দর্য্যের ঝাঁকের ন্যায় রমণীগণ চারিদিক্ হইতে তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াছে। চারিদিকে হাসির কোলাহল উঠিল। চারিদিক্ হইতে কোকিল-কণ্ঠের তীব্র উপহাস মৃণাল-বাহুর কঠোর তাড়ন, চম্পক-অঙ্গুলির চন্দ্র-নখরের তীক্ষ্ণ পীড়ন চলিতে লাগিল। রামচন্দ্র রায় যখন নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, তখন একজন প্রৌঢ়া রমণী আসিয়া তাঁহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া বসিল। সে কঠোর কণ্ঠে এমনি কাটা কাটা কথা কহিতে লাগিল ও ক্রমেই তাহার মুখ দিয়া এমনি সকল রুচির বিকার বাহির হইতে লাগিল যে পুর-রমণীদের মুখ এক প্রকার বন্ধ হইয়া আসিল। তাহার মুখের কাছে থাকদিদিও চুপ করিয়া গেলেন। বিমলাদিদি ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। কেবল ভূতাের মা তাহাকে খুব এক কথা শুনাইয়াছিল। যখন উল্লিখিত ভূতাের মার মুখ খুব চলিতেছিল, তখন সেই প্রৌঢ়া তাহাকে বলিয়াছিল, “মাগো মা, তােমার মুখ নয়ত, এক গাছা ঝাঁটা!” ভূতাের মা তৎক্ষণাৎ কহিল, “আর মাগি, তাের মুখটা আঁস্তাকুড়, এত ঝাঁটাইলাম তবুও সাফ হইল না!” বলিয়া গস্ গস্ করিয়া চলিয়া গেল। একে একে ঘর খালি হইল, রামচন্দ্র রায় বিরাম পাইলেন!
তখন সেই প্রৌঢ়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া মহিষীর কক্ষে উপস্থিত হইল। সেখানে মহিষী দাসদাসীদিগকে খাওয়াইতেছিলেন। রামমােহনও এক পার্শ্বে বসিয়া খাইতেছিল। সেই প্রৌঢ়া, মহিষীর কাছে আসিয়া তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিল,—“এই যে নিকষা জননী!” শুনিবামাত্র রামমােহন চমকিয়া উঠিল, প্রৌঢ়ার মুখের দিকে চাহিল। তৎক্ষণাৎ আহার পরিত্যাগ করিয়া শার্দ্দুলের ন্যায় লম্ফ দিয়া তাহার দুই হস্ত বজ্রমুষ্টিতে ধরিয়া বজ্রস্বরে বলিয়া উঠিল, “আমি যে ঠাকুর তোমায় চিনি!” বলিয়া তাহার মস্তকের বস্ত্র উন্মোচন করিয়া ফেলিল। আর কেহ নহে, রমাই ঠাকুর! রামমােহন ক্রোধে কাঁপিতে লাগিল, গাত্র হইতে চাদর খুলিয়া ফেলিল; দুই হস্তে অবলীলাক্রমে রমাইকে আকাশে তুলিল, কহিল “আজ আমার হাতে তাের মরণ আছে!” বলিয়া তাহাকে দুই এক পাক আকাশে ঘুরাইল। মহিষী ছুটিয়া আসিয়া কহিলেন, “রামমােহন তুই করিস্ কি?” রমাই কাতর স্বরে কহিল, “দোহাই বাবা, ব্রহ্মহত্যা করিস্ না!” চারিদিক হইতে বিষম একটা গােলযােগ উঠিল। তখন রামমােহন রমাইকে ভূমিতে নামাইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে কহিল, “হতভাগা, তাের কি আর মরিবার জায়গা ছিল না?”
রমাই কহিল, “মহারাজ আমাকে আদেশ করিয়াছেন।” রামমােহন বলিয়া উঠিল, “কি বলিলি, নিমকহারাম? ফের অমন কথা বলিবি ত, এই সানের পাথরে তাের মুখ ঘষিয়া দিব!” বলিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিল।
রমাই আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল। তখন রামমােহন খর্ব্বকায় রমাইকে চাদর দিয়া বাঁধিয় বস্তার মতন করিয়া ঝুলাইয়া অন্তঃপুর হইতে বাহির, হইয়া গেল।
দেখিতে দেখিতে কথাটা অনেকটা রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছে। রাত্রি তখন দুই প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে। রাজার শ্যালক আসিয়া সেই রাত্রে প্রতাপাদিত্যকে সংবাদ দিলেন যে, জামাতা রমাই ভাঁড়কে রমণীবেশে অন্তঃপুরে লইয়া গেছেন! সেখানে সে পুর-রমণীদের সহিত, এমন কি, মহিষীর সহিত বিদ্রূপ করিয়াছে।
তখন প্রতাপাদিত্যের মুর্ত্তি অতিশয় ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল। রােষে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ আলােড়িত হইয়া উঠিল। স্ফীতজটা সিংহের ন্যায় শয্যা হইতে উঠিয়া বসিলেন। কহিলেন, “লছমন্ সর্দ্দারকে ডাক।” লছমন্ সর্দারকে কহিলেন—“আজ রাত্রে আমি রামচন্দ্র রায়ের ছিন্ন মুণ্ড দেখিতে চাই!” সে তৎক্ষণাৎ সেলাম করিয়া কহিল, “যাে হুকুম মহারাজ!” তৎক্ষণাৎ তাঁহার শ্যালক তাঁহার পদতলে পড়িল, কহিল— “মহারাজ, মার্জ্জনা করুন, বিভার কথা একবার মনে করুন। অমন কাজ করিবেন না!” প্রতাপাদিত্য পুনরায় দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “আজ রাত্রের মধ্যেই আমি রামচন্দ্র রায়ের মুণ্ড চাই!” তাঁহার শ্যালক তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “মহারাজ, আজ তাঁহারা অন্তঃপুরে শয়ন করিয়াছেন, মার্জ্জনা করুন, মহারাজ মার্জ্জনা করুন!” তখন প্রতাপাদিত্য কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া কহিলেন—“লছমন্ শুন, কাল প্রভাতে যখন রামচন্দ্র রায় অন্তঃপুর হইতে বাহির হইবে, তখন তাহাকে বধ করিবে, তােমার উপর আদেশ রহিল।” শ্যালক দেখিলেন তিনি যত দূর মনে করিয়াছিলেন, তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক হইয়া গিয়াছে। তিনি সেই রাত্রে চুপি চুপি আসিয়া বিভার শয়নকক্ষের দ্বারে আঘাত করিলেন।
তখন দূর হইতে দুই প্রহরের নহবৎ বাজিতেছে। নিঃস্তব্ধ রাত্রে সেই নহবতের শব্দ, জ্যোৎস্নার সহিত, দক্ষিণা-বাতাসের সহিত মিশিয়া ঘুমন্ত প্রাণের মধ্যে স্বপ্নসৃষ্টি করিতেছে। বিভার শয়নকক্ষের মুক্ত বাতায়ন ভেদ করিয়া জ্যোৎস্নার আলাে বিছানায় আসিয়া পড়িয়াছে, রামচন্দ্র রায় নিদ্রায় মগ্ন। বিভা উঠিয়া বসিয়া চুপ করিয়া গালে হাত দিয়া ভাবিতেছে। জ্যোৎস্নার দিকে চাহিয়া তাহার চোখ দিয়া দুই এক বিন্দু অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছিল। বুঝি যেমনটি কল্পনা করিয়াছিল ঠিক তেমনটি হয় নাই। তাহার প্রাণের মধ্যে কাঁদিতেছিল। এতদিন যাহার জন্য অপেক্ষা করিয়াছিল, সে দিন ত আজ আসিয়াছে।
রামচন্দ্র রায় শয্যায় শয়ন করিয়া অবধি বিভার সহিত একটি কথা কন নাই। প্রতাপাদিত্য, তাঁহাকে অপমান করিয়াছে—তিনি প্রতাপ-আদিত্যকে অপমান করিবেন কি করিয়া? না, বিভাকে অগ্রাহ্য করিয়া। তিনি জানাইতে চান, “তুমি ত যশােহরের প্রতাপাদিত্যের মেয়ে, চন্দ্রদ্বীপাধিপতি রাজা রামচন্দ্র রায়ের পাশে কি তােমাকে সাজে?” এই স্থির করিয়া সেই যে পাশ ফিরিয়া শুইয়াছেন আর পাশ্বপরিবর্ত্তন করেন নাই। যত মান অভিমান সমস্তই বিভার প্রতি। বিভা জাগিয়া বসিয়া ভাবিতেছে। একবার জ্যোৎস্নার দিকে চাহিতেছে, একবার স্বামীর মুখের দিকে চাহিতেছে। তাহার বুক কাঁপিয়া কাঁপিয়া এক একবার দীর্ঘনিশ্বাস উঠিতেছে—প্রাণের মধ্যে বড় ব্যথা বাজিয়াছে। সহসা একবার রামচন্দ্রের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সহসা দেখিলেন বিভা চুপ করিয়া বসিয়া কাঁদিতেছে। সেই নিদ্রোত্থিত অবস্থার প্রথম মুহূর্ত্তে যখন অপমানের স্মৃতি জাগিয়া উঠে নাই, গভীর নিদ্রার পরে মনের সুস্থ ভাব ফিরিয়া আসিয়াছে, রোষের ভাব চলিয়া গিয়াছে, তখন সহসা বিভার সেই অশ্রুপ্লাবিত করুণ কচি মুখখানি দেখিয়া সহসা তাঁহার মনে করুণা জাগিয়া উঠিল। বিভার হাত ধরিয়া কহিলেন, “বিভা, কাঁদিতেছ!” বিভা আকুল হইয়া উঠিল। বিভা কথা কহিতে পারিল না, বিভা চোখে দেখিতে পাইল না, বিভা শুইয়া পড়িল। তখন রামচন্দ্র রায় উঠিয়া বসিয়া ধীরে ধীরে বিভার মাথাটি লইয়া কোলের উপরে রাখিলেন, তাহার অশ্রুজল মুছাইয়া দিলেন। এমন সময়ে দ্বারে কে আঘাত করিল। রামচন্দ্র বলিয়া উঠিলেন “কেও?” বাহির হইতে উত্তর আসিল, “অবিলম্বে দ্বার খােল!”