বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
বিভার ম্লানমুখ দেখিয়া সুরমা আর থাকিতে পারিল না; তাহার গলা ধরিয়া কহিল, “বিভা তুই চুপ করিয়া থাকিস্ কেন? তাের মনে যখন যাহা হয়, বলিস্ না কেন?”
বিভা ধীরে ধীরে কহিল, “আমার আর কি বলিবার আছে?”
সুরমা কহিল, “অনেক দিন তাঁহাকে দেখিস্ নাই, তাের মন কেমন করিবেই ত! তুই তাঁহাকে আসিবার জন্য একখানা চিঠি লেখ্ না। আমি তাের দাদাকে দিয়া পাঠাইবার সুবিধা করিয়া দিব।”
বিভার স্বামী চন্দ্রদ্বীপপতি রামচন্দ্র রায়ের সম্বন্ধে কথা হইতেছে।
বিভা ঘাড় হেঁট করিয়া কহিতে লাগিল,—“এখানে কেহ যদি তাঁহাকে গ্রাহ্য না করে, কেহ যদি তাঁহাকে ডাকিবার আবশ্যক বিবেচনা না করে, তবে এখানে তিনি না আসিলেই ভাল। তিনি যদি আপনি আসেন তবে আমি বারণ করিব। তিনি রাজা, যেখানে তাঁহার আদর নাই, সেখানে তিনি কেন আসিবেন? আমাদের চেয়ে তিনি কিসে ছােট যে, পিতা তাঁহাকে অপমান করিবেন?” বলিতে বলিতে বিভা আর সামলাইতে পারিল না, তাহার মুখখানি লাল হইয়া উঠিল ও সে কাঁদিয়া ফেলিল।
সুরমা বিভার মুখ বুকে রাখিয়া তাহার চোখের জল মুছাইয়া কহিল, “আচ্ছা, বিভা, তুই যদি পুরুষ হইতিস্ ত কি করিতিস্? নিমন্ত্রণ পত্র পাস্ নাই বলিয়া কি শ্বশুর বাড়ি যাইতিস্ না?”
বিভা বলিয়া উঠিল, “না, তাহা পারিতাম না। আমি যদি পুরুষ হইতাম ত এখনি চলিয়া যাইতাম; মান অপমান কিছুই ভাবিতাম না। কিন্তু তাহা বলিয়া তাঁহাকে আদর করিয়া না ডাকিয়া আনিলে তিনি কেন আসিবেন?”
বিভা এত কথা কখন কহে নাই। আজ আবেগের মাথায় অনেক কথা বলিয়াছে। এতক্ষণে একটু লজ্জা করিতে লাগিল। মনে হইল, বড় অধিক কথা বলিয়া ফেলিয়াছি। আবার, যে রকম করিয়া বলিয়াছি, বড় লজ্জা করিতেছে? ক্রমে তাহার মনের উত্তেজনা হ্রাস হইয়া আসিল ও মনের মধ্যে একটা গুরুভার অবসাদ আস্তে আস্তে চাপিয়া পড়িতে লাগিল। বিভা বাহুতে মুখ ঢাকিয়া সুরমার কোলে মাথা দিয়া শুইয়া পড়িল; সুরমা মাথা নত করিয়া কোমল হস্তে তাহার ঘন কেশভার পৃথক্ করিয়া দিতে লাগিল! এমন কতক্ষণ গেল। উভয়ের মুখে একটি কথা নাই। বিভার চোখ দিয়া এক এক বিন্দু করিয়া জল পড়িতেছে ও সুরমা আস্তে আস্তে মুছাইয়া দিতেছে।
অনেকক্ষণ বাদে যখন সন্ধ্যা হইয়া আসিল তখন বিভা ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল ও চোখের জল মুছিয়া ঈষৎ হাসিল! সে হাসির অর্থ— “আজ কি ছেলেমানুষিই করিয়াছি!” ক্রমে মুখ ফিরাইয়া সরিয়া গিয়া পালাইয়া যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিল। সুরমা কিছু না বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া রহিল। পূর্ব্বকার কথা আর কিছু উত্থাপন না করিয়া কহিল, “বিভা শুনিয়াছিস্, দাদামহাশয় আসিয়াছেন?”
বিভা। “দাদামহাশয় আসিয়াছেন?”
সুরমা। “হাঁ।”
বিভা আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিল “কখন্ আসিয়াছেন?”
সুরমা। “প্রায় চার প্রহর বেলার সময়।”
বিভা। “এখনো যে আমাদের দেখিতে আসিলেন না।”
বিভার মনে ঈষৎ অভিমানের উদয় হইল। দাদা মহাশয়ের দখল লইয়া বিভা অতিশয় সতর্ক। এমন কি, এক দিন বসন্তরায় উদয়াদিত্যের সহিত অনেকক্ষণ কথােপকথন করিয়া বিভাকে অন্তঃপুরে তিন দণ্ড অপেক্ষা করাইয়াছিলেন, একবারেই তাহার সহিত দেখা করিতে যান নাই, এই জন্য বিভার এমন কষ্ট হইয়াছিল যে, যদিও সে বিষয়ে সে কিছু বলে নাই বটে তবু প্রসন্ন মুখে দাদামহাশয়ের সঙ্গে কথা কহিতে পারে নাই।
বসন্তরায় ঘরে প্রবেশ করিয়াই হাসিতে হাসিতে গান ধরিলেন;—
“আজ তােমারে দেখ্তে এলেম অনেক দিনের পরে!
ভয় নাইক, সুখে থাক,
অধিক ক্ষণ থাক্ব নাক’
আসিয়াছি দুদণ্ডেরি তরে!
দেখ্ব শুধু মুখ খানি
শুন্ব দুটি মধুর বাণী
আড়াল থেকে হাসি দেখে চলে যাব দেশান্তরে!”
গান শুনিয়া বিভা মুখ নত করিয়া হাসিল। তাহার বড় আহ্লাদ হইয়াছে। অতটা আহ্লাদ পাছে ধরা পড়ে বলিয়া বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে।
সুরমা বিভার মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিল, “দাদা মহাশয়, বিভার হাসি দেখিবার জন্য ত আড়ালে যাইতে হইল না?”
বসন্তরায়। “না। বিভা মনে করিল, নিতান্তই না হাসিলে যদি বুড়া বিদায় না হয়, তবে না হয় একটু হাসি। ও ডাকিনীর মৎলব আমি বেশ বুঝি, আমাকে তাড়াইবার ফন্দি! কিন্তু শীঘ্র তাহা হইতেছে না। আসিলাম যদি ত ভাল করিয়া জ্বালাইয়া যাইব, আবার যত দিন না দেখা হয় মনে থাকিবে!”
সুরমা হাসিয়া কহিল, “দেখ দাদা মহাশয়, বিভা আমার কানে কানে বলিল যে মনে রাখানই যদি অভিপ্রায় হয়, তবে যা’ জ্বালাইয়াছ তাহাই যথেষ্ট হইয়াছে, আর নূতন করিয়া জ্বালাইতে হইবে না।”
কথাটা শুনিয়া বসন্তরায়ের বড়ই আমােদ বােধ হইল। তিনি হাসিতে লাগিলেন।
বিভা অপ্রতিভ হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, আমি কখনাে ও কথা বলি নাই। আমি কোন কথাই কই নাই।”
সুরমা কহিল, “দাদা মহাশয়, তােমার মনস্কামনা ত পূর্ণ হইল! তুমি হাসি দেখিতে চাহিলে তাহা দেখিলে, কথা শুনিতে চাহিয়াছিলে তাহাও শুনাইলাম, তবে এখন দেশান্তরে যাও।”
বসন্তরায়। “না ভাই, তাহা পারিলাম না! আমি গােটা-পােনেরো গান ও এক মাথা পাকা চুল আনিয়াছি, সে গুলি সমস্ত নিকাশ না করিয়া যাইতে পারিতেছি না!”
বিভা আর থাকিতে পারিল না, হাসিয়া উঠিল, কহিল,—“তােমার আধ মাথা বই চুল নাই যে দাদামহাশয়!”
দাদামহাশয়ের অভিসন্ধি সিদ্ধ হইল। অনেক দিনের পর প্রথম আলাপে বিভার মুখ খুলিতে কিছু আয়ােজনের আবশ্যক করে, কিন্তু দাদা মহাশয়ের কাছে বিভার মুখ একবার খুলিলে তাহা বন্ধ করিতে আবার ততােধিক আয়ােজনের আবশ্যক হয়। কিন্তু দাদা মহাশয় ব্যতীত আর কাহারাে কাছে কোন অবস্থাতেই বিভার মুখ খুলে না।
বসন্তরায় টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “সে এক দিন গিয়াছেরে ভাই! যে দিন বসন্তরায়ের মাথায় এক মাথা চুল ছিল, সে দিন কি আর এত রাস্তা হাঁটিয়া তোমাদের খোষামোদ করিতে আসিতাম? একগাছি চুল পাকিলে তোমাদের মত পাঁচটা রূপসী চুল তুলিবার জন্য উমেদার হইত ও মনের আগ্রহে দশটা কাঁচা চুল তুলিয়া ফেলিত!”
বিভা গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা দাদামহাশয়, তোমার যখন একমাথা চুল ছিল, তখন কি তোমাকে এখনকার চেয়ে ভাল দেখিতে ছিল?”
মনে মনে বিভার সে বিষয়ে বিষম সন্দেহ ছিল। দাদা মহাশয়ের টাক্টি, তাঁহার গুম্ফসম্পর্কশূন্য অধরের প্রশস্ত হাসিটি, তাঁহার পাকা আম্রের ন্যায় ভাবটি, সে মনে মনে পরিবর্ত্তন করিতে চেষ্টা করিল, কোন মতেই ভাল ঠেকিল না। সে দেখিল, সে টাক্টি না দিলে তাহার দাদামহাশয়কে কিছুতে মানায় না। আর গোঁফ জুড়িয়া দিলে দাদা মহাশয়ের মুখখানি একেবারে খারাপ দেখিতে হইয়া যায়। এত খারাপ হইয়া যায় যে, সে তাহা কল্পনা করিলে হাসি রাখিতে পারে না। দাদামহাশয়ের অবার গোঁফ! দাদা মহাশয়ের আবার টাক্ নাই!
বসন্তরায় কহিলেন, “সে বিষয়ে অনেক মতভেদ আছে। আমার নাতনীরা আমার টাক্ দেখিয়া মোহিত হয়, তাহারা আমার চুল দেখে নাই। আমার দিদিমারা অপার চুল দেখিয়া মোহিত হইতেন, তাঁহারা আমার টাক্ দেখেন নাই। যাহারা উভয়ই দেখিয়াছে, তাহারা এখনো একটা মত স্থির করিতে পারে নাই।”
বিভা কহিল, “কিন্তু তা বলিয়া দাদা মহাশয় যতটা টাক্ পড়িয়াছে তাহার অধিক পড়িলে আর ভাল দেখাইবে না!”
সুরমা কহিল, “দাদামহাশয় টাকের আলোচনা পরে হইবে। এখন বিভার একটা যাহা হয় উপায় করিয়া দাও!”
বিভা তাড়াতাড়ি বসন্তরায়ের কাছে গিয়া বলিয়া উঠিল, “দাদামহাশয় —আমি তোমার পাকাচুল তুলিয়া দিই।”
সুরমা। “আমি বলি কি”—
বিভা। “শোননা দাদামহাশয়, তোমার—”
সুরমা। “বিভা চুপ কর্। আমি বলি কি, তুমি গিয়ে একবার—”
বিভা। “দাদামহাশয়, তোমার মাথায় পাকাচুল ছাড়া যে আর কিছুই নেই, তুলে দিলে সমস্ত মাথায় টাক্ পড়্বে!”
বসন্তরায়। “আমাকে যদি কথা শুনতে না দিস্ দিদি, আমাকে যদি বিরক্ত করিস্ তবে আমি রাগ হিন্দোল আলাপ করিব।”
বলিয়া তাঁহার ক্ষুদ্রায়তন সেতারটির কান মোচ্ড়াইতে আরম্ভ করিলেন। হিন্দোল রাগের উপর বিভার বিশেষ বিদ্বেষ ছিল।
বিভা বলিল, “কি সর্ব্বনাশ। তবে আমি পালাই বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।”
তখন সুরমা গম্ভীর হইয়া কহিল, “বিভা নীরব হইয়া দিনরাত্রি যে কষ্ট প্রাণের মধ্যে বহন করে তাহা জানিতে পারিলে বোধ করি মহারাজারও মনে দয়া হয়!”
“কেন! কেন! তাহার কি হয়েছে!” বলিয়া নিতান্ত আগ্রহের সহিত বসন্তরায় সুরমার কাছে গিয়া বসিলেন।
সুরমা কহিল, “বৎসরের মধ্যে একটি দিন ঠাকুরজামাইকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইতেও কাহারো মনে পড়ে না?”
বসন্তরায় চিন্তা করিয়া কহিবেন, “ঠিক্ কথাই ত!”
সুরমা কহিল, “স্বামীর প্রতি এ অনাদর কয়জন মেয়ে সহিতে পারে বল ত? বিভা ভাল মানুষ, তাই কাহাকেও কিছু বলে না, আপনার মনে লুকাইয়া কাঁদে।”
বসন্তরায় ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিলেন “আপনার মনে লুকাইয়া কাঁদে?”
সুরমা। “আজ বিকালে আমার কাছে কত কাঁদিতে ছিল।”
বসন্তরায়। “বিভা আজ বিকালে কাঁদিতেছিল?”
সুরমা। “হাঁ!”
বসন্তরায়। “আহা, তাহাকে একবার ডাকিয়া আন, আমি দেখি!”
সুরমা বিভাকে ধরিয়া আনিল। বসন্তরায় তাহার চিবুক ধরিয়া কহিলেন, “তুই কাঁদিস কেন দিদি? যখন তাের যা’ কষ্ট হয় তাের দাদা মহাশয়কে বলিস্ না কেন? তা হ’লে আমি আমার যথাসাধ্য করি? আমি এখনই যাই, প্রতাপকে বলিয়া আসি গে!”
বিভা বলিয়া উঠিল, “দাদামহাশয়, তােমার দুটি পায়ে পড়ি আমার বিষয়ে বাবাকে কিছু বলিও না। দাদামহাশয়, তােমার পায়ে পড়ি যাইও না!”
রলিতে বলিতে বসন্তরায় বাহির হইয়া গেলেন; প্রতাপাদিত্যকে গিয়া বলিলেন, “তােমার জামাতাকে অনেক দিন নিমন্ত্রণ কর নাই ইহাতে তাহার প্রতি নিতান্ত অবহেলা প্রকাশ করা হইতেছে। যশােহর-পতির জামাতাকে যতখানি সমাদর করা উচিত, ততখানি সমাদর যদি তাহাকে না করা হয়, তবে তাহাতে তোমারই অপমান। তাহাতে গৌরবের কথা কিছুই নাই।”
প্রতাপাদিত্য পিতৃব্যের কথায় কিছু মাত্র দ্বিরুক্তি করিলেন না। লােকসহ নিমন্ত্রণ-পত্র চন্দ্রদ্বীপে পাঠাইবার হুকুম হইল।
অন্তঃপুরে বিভা ও সুরমার কাছে আসিয়া বসন্তরায়ের সেতার বাজাইবার ধুম পড়িয়া গেল।
“মলিন মুখে ফুটুক হাসি জুড়াক্ দু নয়ন!”
“মলিন মুখে ফুটুক্ হাসি, জুড়াক দু নয়ন।
মলিন বসন ছাড় সখি, পর আভরণ।”
বিভা সেতারের তারে হাত দিয়া সেতার বন্ধ করিয়া আবার কহিল, “বাবার কাছে আমার কথা বলিয়াছ?”
এমন সময়ে উদয়াদিত্যের কনিষ্ঠ অষ্টমবর্ষীয় সমরাদিত্য ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া বলিয়া উঠিল, “অ্যাঁ, দিদি! দাদামহাশয়ের সহিত গল্প করিতেছ! আমি মাকে বলিয়া দিয়া আসিতেছি।”
“এস, এস, ভাই এস!” বলিয়া বসন্তরায় তাহাকে পাক্ড়া করিলেন।
রাজ-পরিবারের বিশ্বাস এই যে, বসন্তরায় ও সুরমায় মিলিয়া উদয়াদিত্যের সর্ব্বনাশ করিয়াছে। এই নিমিত্ত বসন্তরায় আসিলে সামাল্ সামাল্ পড়িয়া যায়। সমরাদিত্য বসন্তরায়ের হাত ছাড়াইবার জন্য, টানা-হেঁচ্ড়া আরম্ভ করিল। বসন্তরায় তাহাকে সেতার দিয়া, তাহাকে কাঁধে চড়াইয়া, তাহাকে চস্মা পড়াইয়া, দুই দণ্ডের মধ্যে এমনি বশ করিয়া লইলেন যে, সে সমস্ত দিন দাদা মহাশয়ের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ফিরিতে লাগিল ও অনবরত সেতার বাজাইয়া তাঁহার সেতারের পাঁচটা তার ছিড়িয়া দিল ও মেজরাপ কাড়িয়া লইয়া আর দিল না!