বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/ষোড়শ পরিচ্ছেদ
ষোড়শ পরিচ্ছেদ।
যখন গোপনে বৃত্তি পাঠানোর কথা প্রতাপাদিত্যের কানে গেল, তখন তিনি কথা না কহিয়া অন্তঃপুরে আদেশ পাঠাইয়া দিলেন সুরমাকে পিত্রালয়ে যাইতে হইবে। উদয়াদিত্য বক্ষে দৃঢ় বল বাঁধিলেন। বিভা কাঁদিয়া সুরমার গলা জড়াইয়া কহিল, “তুমি যদি যাও, তবে এ শ্মশানপুরীতে আমি কি করিব?” সুরমা বিভার চিবুক ধরিয়া, বিভার মুখ চুম্বন করিয়া কহিল, “আমি কেন যাইব বিভা, আমার সর্বস্ব এখানে রহিয়াছে।” সুরমা যখন প্রতাপাদিত্যের আদেশ শুনিল, তখন কহিল, “আমি পিত্রালয়ে যাইবার কোন কারণ দেখিতেছি না। সেখান হইতে আমাকে লইতে লোক আসে নাই, আমার স্বামীরও এবিষয়ে মত নাই। অতএব বিনা কারণে সহসা পিত্রালয়ে যাইবার আমি কোন আবশ্যক দেখিতেছি না।” শুনিয়া প্রতাপাদিত্য জ্বলিয়া গেলেন। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলেন, কোন উপায় নাই। সুরমাকে কিছু বলপূর্ব্বক বাড়ি হইতে বাহির করা যায় না, অন্তঃপুরে শারীরিক বল খাটে না। প্রতাপাদিত্য মেয়েদের বিষয়ে নিতান্ত আনাড়ি ছিলেন, বলের প্রতি বল প্রয়োগ করিতে তিনি জানিতেন, কিন্তু এই অবলাদের সম্বন্ধে কিরূপ চাল চালিতে হয়, তাহা তাঁহার মাথায় আসিত না। তিনি বড় বড় কাছি টানিয়া ছিঁড়িতে পারেন, কিন্তু তাঁহার মোটা মোটা অঙ্গুলি দিয়া ক্ষীণ সূত্রের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গ্রন্থি মোচন করিতে পারেন না। এই মেয়েগুলা তাঁহার মতে, নিতান্ত দুর্জ্ঞেয় ও জানিবার অনুপযুক্ত সামগ্রী। ইহাদের সম্বন্ধে যখনি কোন গোল বাধে, তিনি তাড়াতাড়ি মহিষীর প্রতি ভার দেন। ইহাদের বিষয়ে ভাবিতে বসিতে তাঁহার অবসরও নাই, ইচ্ছাও নাই এবং যোগ্যতাও নাই। ইহা তাঁহার নিতান্ত অনুপযুক্ত কাজ। এবারেও প্রতাপাদিত্য মহিষীকে ডাকিয়া কহিলেন, “সুরমাকে বাপের বাড়ি পাঠাও!” মহিষী কহিলেন, “তাহা হইলে বাবা উদয়ের কি হইবে?” প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “উদয় ত আর ছেলেলানুষ নয়, আমি রাজকার্য্যের অনুরোধে সুরমাকে রাজপুরী হইতে দূরে পাঠাইতে চাই, এই আমার আদেশ।”
মহিষী উদয়াদিত্যকে ডাকাইয়া কহিলেন, “বাবা উদয়, সুরমাকে বাপের বাড়ি পাঠান যাক্!” উদয়াদিত্য কহিলেন, “কেন মা, সুরমা কি অপরাধ করিয়াছে?”
মহিষী কহিলেন, “কি জানি বাছা, আমরা মেয়ে মানুষ, কিছু বুঝি না, বউমাকে বাপের বাড়ি পাঠাইয়া মহারাজার রাজকার্য্যে যে কি সুযোগ হইবে, তা মহারাজই জানেন।”
উদয়াদিত্য কহিলেন, “মা, আমাকে কষ্ট দিয়া আমাকে দুঃখী করিয়া রাজকার্য্যের কি উন্নতি হইল? যতদূর কষ্ট সহিবার তাহা ত সহিয়াছি, কোন্ সুখ আমার অবশিষ্ট আছে? সুরমা যে বড় সুখে আছে তাহা নয়। দুই সন্ধ্যা সে ভর্ৎসনা সহিয়াছে, দূর-ছাই সে অঙ্গ-আভরণ করিয়াছে, অবশেষে কি রাজবাড়িতে তাহার জন্য একটুকু স্থানও কুলাইল না! তোমাদের সঙ্গে কি তাহার কোন সম্পর্ক নাই মা? সে কি ভিখারী অতিথি, যে যথন খুসী রাখিবে, যখন খুসী তাড়াইবে? তাহা হইলে মা, আমার জন্যও রাজবাড়িতে স্থান নাই, আমাকেও বিদায় করিয়া দাও।”
মহিষী কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন, কহিলেন “কি জানি বাবা। মহারাজা কখন কি যে করেন, কিছু বুঝিতে পারি না। কিন্তু, তাও বলি বাছা, আমাদের বৌমাও বড় ভাল মেয়ে নয়। ও রাজবাড়িতে প্রবেশ করিয়া অবধি এখানে আর শান্তি নাই। হাড় জ্বালাতন হইয়া গেল। তা,’ ও দিনকতক বাপের বাড়িতেই যাক্ না কেন, দেখা যাক্, কি বল বাছা! ও দিনকতক এখান হইতে গেলেই দেখিতে পাইবে, বাড়ির শ্রী ফেরে কি না!”
উদয়াদিত্য এ কথার আর কোন উত্তর করিলেন না, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন, তাহার পরে উঠিয়া চলিয়া গেলেন।
মহিষী কাঁদিয়া প্রতাপাদিত্যের কাছে গিয়া পড়িলেন, কহিলেন “মহারাজ, রক্ষা কর! সুরমাকে পাঠাইলে উদয় বাঁচিবে না। বাছার কোন দোষ নাই, ঐ সুরমা, ঐ ডাইনীটা তাহাকে কি মন্ত্র করিয়াছে।” বলিয়া মহিষী কাঁদিয়া আকুল হইলেন।
প্রতাপাদিত্য বিষম রুষ্ট হইয়া কহিলেন, “সুরমা যদি না যায় ত আমি উদয়াদিত্যকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিব!”
মহিষী মহারাজার কাছ হইতে আসিয়া সুরমার কাছে গিয়া কহিলেন, “পােড়ামুখি, আমার বাছাকে তুই কি করিলি? আমার বাছাকে আমাকে ফিরাইয়া দে! আসিয়া অবধি তুই তাহার কি সর্ব্বনাশ না করিলি? অবশেষে—সে রাজার ছেলে—তা’র হাতে বেড়ী না দিয়া কি তুই ক্ষান্ত হইবি না?”
সুরমা শিহরিয়া উঠিয়া কহিল, “আমার জন্য তাঁর হাতে বেড়ী পড়িবে? সে কি কথা মা! আমি এখন চলিলাম!”
সুরমা বিভার কাছে গিয়া সমস্ত কহিল; বিভার গলা ধরিয়া কহিল, “বিভা, এই যে চলিলাম, আর বােধ করি আমাকে এখানে ফিরিয়া আসিতে দিবে না।” বিভা কাঁদিয়া সুরমাকে জড়াইয়া ধরিল। সুরমা সেইখানে বসিয়া পড়িল। অনন্ত ভবিষ্যতের অনন্ত প্রান্ত হইতে একটা কথা আসিয়া তাহার প্রাণে বাজিতে লাগিল, “আর হইবে না!” আর আসিতে পাইব না, আর হইবে না, আর কিছু রহিবে না! এমন একটা মহাশূন্য ভবিষ্যৎ তাহার সমুখে প্রসারিত হইল, —যে ভবিষ্যতে সে মুখ নাই, সে হাসি নাই, সে আদর নাই, চোখে চোখে বুকে বুকে প্রাণে প্রাণে মিলন নাই, সুখ দুঃখের বিনিময় নাই, বুক ফাটিয়া গেলেও এক মুহূর্ত্তের জন্যও এক বিন্দু প্রেম নাই, স্নেহ নাই, কিছু নাই, কি ভয়ানক ভবিষ্যৎ! সুরমার বুক ফাটিতে লাগিল, মাথা ঘুরিতে লাগিল, চোখের জল শুকাইয়া গেল! উদয়াদিত্য আসিবামাত্র সুরমা তাঁহার পা দুটি জড়াইয়া বুকে চাপিয়া বুক ফাটিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সুরমা এমন করিয়া কখন কাঁদে নাই। তাহার বলিষ্ঠ হৃদয় আজ শতধা হইয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য সুরমার মাথা কোলে তুলিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে সুরমা?” সুরমা উদয়াদিত্যের মুখের দিকে চাহিয়া আর কি কথা কহিতে পারে? মুখের দিকে চায় আর কাঁদিয়া ওঠে। বলিল, “ঐ মুখ আমি দেখিতে পাইব না? সন্ধ্যা হইবে, তুমি বাতায়নে আসিয়া বসিবে, আমি পাশে নাই? ঘরে দীপ জ্বালাইয়া দিবে, তুমি ঐ দ্বারের নিকট আসিয়া দাঁড়াইবে, আর আমি হাসিতে হাসিতে তােমার হাত ধরিয়া আনিব না? তুমি যখন এখানে, আমি তখন কোথায়?” সুরমা যে বলিল “কোথায়” তাহাতে কতখানি নিরাশা, তাহতে কত দূর দূরান্তরের বিচ্ছেদের ভাব! যখন কেবল মাত্র চোখে চোখেই মিলন হইতে পারে তখন মধ্যে কত দূর! যখন তাহাও হইতে পারে না, তখন আর কত দূর! যখন বার্ত্তা লইতে বিলম্ব হয়, তখন আরাে কতদূর! যখন প্রাণান্তিক ইচ্ছা হইলেও এক মুহূর্ত্তের জন্যও দেখা হইবে না, তখন—তখন ঐ পা দুখানি ধরিয়া এমনি করিয়া বুকে চাপিয়া এই মুহূর্ত্তেই মরিয়া যাওয়াতেই সুখ।