বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।
উপাখ্যানের আরম্ভভাগে রুক্মিণীর উল্লেখ করা হইয়াছে, বােধ করি পাঠকেরা তাহাকে বিস্মৃত হন নাই। এই মঙ্গলাই সেই রুক্মিণী। সে রায়গড় পরিত্যাগ করিয়া নাম-পরিবর্ত্তন-পূর্ব্বক যশােহরের প্রান্তদেশে বাস করিতেছে। রুক্মিণীর মধ্যে অসাধারণ কিছুই নাই। সাধারণ নীচ প্রকৃতির স্ত্রীলোকের ন্যায় সে ইন্দ্রিয়পরায়ণ, ঈর্ষাপরায়ণ, মনেরাজ্যঅধিকার-লোলুপ। হাসি কান্না তাহার হাতধরা, আবশ্যক হইলে বাহির করে, আবশ্যক হইলে তুলিয়া রাখে। যখন সে রাগে, তখন সে অতি প্রচণ্ড; মনে হয় যেন রাগের পাত্রকে দাঁতে নখে ছিঁড়িয়া ফেলিবে। তখন অধিক কথা কয় না, চোখ দিয়া আগুন বাহির হইতে থাকে, থর্থর্ করিয়া কাঁপে। গলিত লৌহের মত তাহার হৃদয়ের কটাহে রাগ টগ্বগ্ করিতে থাকে। তাহার মনের মধ্যে ঈর্ষা সাপের মত ফোঁস্ ফোঁস্ করে ও ফুলিয়া ফুলিয়া লেজ আছড়াইতে থাকে। এদিকে সে নানাবিধ ব্রত করে, নানাবিধ তান্ত্রিক অনুষ্ঠান করে। যে শ্রেণীর লোকেদের সহিত সে মেশে, তাহাদের মন সে আর্য্যশ্চরূপে বুঝিতে পারে। যুবরাজ যখন সিংহাসনে বসিবেন তখন সে যুবরাজের হৃদয়ের উপর সিংহাসন পাতিয়া তাঁহার হৃদয়রাজ্য ও যশোহর-রাজ্য একত্রে শাসন করিবে, এ আশা শয়নে স্বপ্নে তাহার হৃদয়ে জাগিতেছে। ইহার জন্য সে কি না করিতে পারে! বহুদিন ধরিয়া অনবরত চেষ্টা করিয়া রাজবাটির সমস্ত দাস দাসীর সহিত সে ভাব করিয়া লইয়াছে। রাজবাটির প্রত্যেক ক্ষুদ্র খবরটি পর্য্যন্ত সে রাখে। সুরমার মুখ কবে মলিন হইল তাহাও সে শুনিতে পায়, প্রতাপাদিত্যের সামান্য পীড়া হইলেও তাহার কানে যায়, ভাবে এইবার বুঝি আপদটার মরণ হইবে। প্রতাপাদিত্য ও সুরমার মরণোদ্দেশে সে নানা অনুষ্ঠান করিয়াছে, কিন্তু এখনো ত কিছুই সফল হয় নাই। প্রতিদিন প্রাতে উঠিয়া সে মনে করে আজ হয় ত শুনিতে পাইব, প্রতাপাদিত্য অথবা সুরমা বিছানায় পড়িয়া মরিয়া আছে। প্রতিদিন তাহার অধীরতা বাড়িয়া উঠিতেছে। ভাবিতেছে মন্ত্র তন্ত্র চুলায় যাক্ একবার হাতের কাছে পাই ত মনের সাধ মিটাই। ভাবিতে ভাবিতে এমন অধর দংশন করিতে থাকে যে অধর কাটিয়া রক্ত পড়িবার উপক্রম হয়।
রুক্মিণী দেখিল যে, প্রতিদিন সুরমার প্রতি রাজার ও রাজমহিষীর বিরাগ বাড়িতেছে। অবশেষে এতদূর পর্য্যন্ত হইল যে সুরমাকে রাজবাটি হইতে বিদায় করিয়া দিবার প্রস্তাব হইয়াছে। তাহার আর আনন্দের সীমা নাই। যখন সে দেখিল তবুও সুরমা গেল না, তখন সে বিদায় করিয়া দিবার সহজ উপায় অবলম্বন করিল।
রাজমহিষী যখন শুনিলেন মঙ্গলা নামক একজন বিধবা তন্ত্র মন্ত্র ঔষধ নানাপ্রকার জানে, তখন তিনি ভাবিলেন সুরমাকে রাজবাটি হইতে বিদায় করিবার আগে যুবরাজের মনটা তাহার কাছ হইতে আদায় করিয়া লওয়া ভাল। মাতঙ্গিনীকে মঙ্গলার নিকট হইতে গােপনে ঔষধ আনাইতে পাঠাইলেন।
মঙ্গলা নানাবিধ শিকড় লইয়া সমস্ত রাত ধরিয়া কাটিয়া, ভিজাইয়া, বাঁটিয়া, মিশাইয়া মন্ত্র পড়িয়া বিষ প্রস্তুত করিতে লাগিল।
সেই নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে, নির্জ্জন নগরপ্রান্তে, প্রচ্ছন্ন কুটির মধ্যে হামানদিস্তার শব্দ উঠিতে লাগিল, সেই শব্দই তাহার এক মাত্র সঙ্গী হইল, সেই অবিশ্রাম একঘেয়ে শব্দ তাহার নর্ত্তনশীল উৎসাহের তালে তালে করতালি দিতে লাগিল, তাহার উৎসাহ দ্বিগুণ নাচিতে লাগিল, তাহার চোখে আর ঘুম রহিল না।
ঔষধ প্রস্তুত করিতে পাঁচদিন লাগিল। বিষ প্রস্তুত করিতে পাঁচ দিন লাগিবার আবশ্যক করে না। কিন্তু সুরমা মরিবার সময় যাহাতে যুবরাজের মনে দয়া না হয়, এই উদ্দেশে মন্ত্র পড়িতে ও অনুষ্ঠান করিতে অনেক সময় লাগিল।
প্রতাপাদিত্যের মত লইয়া মহিষী সুরমাকে আরাে কিছু দিন রাজবাটিতে থাকিতে দিলেন। সুরমা চলিয়া যাইবে, বিভা চারিদিকে অকূল পাথার দেখিতেছে। এ কয় দিন সে অনবরত সুরমার কাছে বসিয়া আছে। একটি মলিন ছায়ার মত সে চুপ করিয়া সুরমার সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। এক একটা দিন যায়, সন্ধ্যা আইসে, বিভা ততই যেন ঘনিষ্ঠতর ভাবে সুরমাকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়া রাখিতে চায়। দিনগুলিকে কে যেন তাহার প্রাণপণ আকর্ষণ হইতে টানিয়া ছিঁড়িয়া লইয়া যাইতেছে। বিভার চারিদিকে অন্ধকার! সুরমার চক্ষেও সমস্তই শূন্য। তাহার আর উত্তর দক্ষিণ পূর্ব্ব পশ্চিম নাই, সংসারে দিগ্বিদিক্ সমস্ত মিশাইয়া গেছে। উদয়াদিত্যের পায়ের কাছে পড়িয়া থাকে, কোলের উপর শুইয়া থাকে, তাঁহার মুখের পানে চুপ করিয়া চাহিয়া থাকে, আর কিছু করে না। বিভাকে বলে “বিভা, তাের কাছে আমার সমস্ত রাখিয়া গেলাম” বলিয়া দুই হাতে মুখ আচ্ছাদন করিয়া কাঁদিয়া ফেলে।
অপরাহ্ণ হইয়া আসিয়াছে; কাল প্রত্যুষে সুরমার বিদায়ের দিন। তাহার গার্হস্থ্যের যাহা কিছু সমস্ত একে একে বিভার হাতে সমর্পণ করিল। উদয়াদিত্য প্রশান্ত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবে বসিয়া আছেন। তিনি স্থির করিয়াছেন, হয় সুরমাকে রাজপুরীতে রাখিবেন, নয় তিনিও চলিয়া যাইবেন। যখন সন্ধ্যা হইল, তখন সুরমা আর দাঁড়াইতে পারিল না, তাহার পা কাঁপিতে লাগিল, মাথা ঘুরিতে লাগিল। সে শয়নগৃহে গিয়া শুইয়া পড়িল, কহিল, “বিভা, বিভা, শীঘ্র একবার তাঁহাকে ডাক্ আর বিলম্ব নাই।”
উদয়াদিত্য দ্বারের কাছে আসিতেই সুরমা বলিয়া উঠিল “এস, এস, আমার প্রাণ কেমন করিতেছে!” বলিয়া দুই বাহু বাড়াইয়া দিল। উদয়াদিত্য কাছে আসিতেই তাঁহার পা দুটি জড়াইয়া ধরিল। উদয়াদিত্য বসিলেন, তখন সুরমা বহু কষ্টে নিশ্বাস লইতেছে, তাহার হাত পা শীতল হইয়া আসিয়াছে। উদয়াদিত্য ভীত হইয়া ডাকিলেন, “সুরমা!” সুরমা অতি ধীরে মাথা তুলিয়া উদয়াদিত্যের মুখের পানে চাহিয়া কহিল, “কি নাথ!” উদয়াদিত্য ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, “কি হইয়াছে সুরমা?” সুরমা কহিল, “বােধ করি আমার সময় হইয়া আসিয়াছে,” বলিয়া উদয়াদিত্যের কণ্ঠ আলিঙ্গন করিবার জন্য হাত উঠাইতে চাহিল, হাত উঠিল না! কেবল মুখের দিকে সে চাহিয়া রহিল। উদয়াদিত্য দুই হাতে সুরমার মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “সুরমা, সুরমা, তুমি কোথায় যাইবে সুরমা! আমার আর কে রহিল?” সুরমার দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। সে কেবল বিভার মুখের দিকে চাহিল! বিভা তখন হতচেতন হইয়া বোধশূন্য নয়নে সুরমার দিকে চাহিয়া আছে। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় সুরমা ও উদয়াদিত্য বসিয়া থাকিতেন, সম্মুখে সে বাতায়ন উন্মুক্ত। আকাশের তারা দেখা যাইতেছে, ধীরে ধীরে বাতাস বহিতেছে, চারিদিক স্তব্ধ। ঘরে প্রদীপ জ্বালাইয়া গেল। রাজবাটিতে পূজার শাঁক ঘণ্টা বাজিয়া ক্রমে থামিয়া গেল। সুরমা উদয়াদিত্যকে মৃদুস্বরে কহিল, “একটা কথা কও, আমি চোখে ভাল দেখিতে পাইতেছি না।”
ক্রমে রাজবাটিতে রাষ্ট্র হইল যে, সুরমা নিজ হস্তে বিষ খাইয়া মরিতেছে। রাজমহিষী ছুটিয়া আসিলেন, সকলে ছুটিয়া আসিল! সুরমার মুখ দেখিয়া মহিষী কাঁদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “সুরমা, মা আমার, তুই এইখানেই থাক্, তোকে কোথাও যাইতে হইবে না। তুই আমাদের ঘরের লক্ষ্মী, তোকে কে যাইতে বলে?” সুরমা শাশুড়ীর পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল। মহিষী দ্বিগুণ কাঁদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “মা তুই কি রাগ করিয়া গেলি রে?” তখন সুরমার কণ্ঠরোধ হইয়াছে, কি কথা বলিতে গেল, বাহির হইল না। রাত্রি যখন চারি দণ্ড আছে, তখন চিকিৎসক কহিলেন, “শেষ হইয়া গেছে!” “দাদা, কি হইল গো” বলিয়া বিভা সুরমার বুকের উপরে পড়িয়া সুরমাকে জড়াইয়া ধরিল। প্রভাত হইয়া গেল, উদয়াদিত্য সুরমার মাথা কোলে রাখিয়া বসিয়া রহিলেন!