বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ।

 ইতিমধ্যে এক ঘটনা ঘটিয়াছে। যখন সীতারাম দেখিল, উদয়াদিত্যকে কারারুদ্ধ করা হইয়াছে, তখন সে আর হাত পা আছড়াইয়া বাঁচে না। প্রথমেই ত সে রুক্মিণীর বাড়ি গেল। তাহাকে যাহা মুখে আসিল তাহাই বলিল। তাহাকে মারিতে যায় আর কি! কহিল, “সর্ব্বনাশী, তাের ঘরে আগুন জ্বালাইয়া দিব, তাের ভিটায় ঘুঘু চরাইব, আর যুবরাজকে খালাস করিব, তবে আমার নাম সীতারাম! আজই আমি রায়গড়ে চলিলাম, রায়গড় হইতে আসি, তারপরে তাের ঐ কালামুখ লইয়া এই শানের উপরে ঘষিব, তোর মুখে চূণ কালি মাখাইয়া সহর হইতে বাহির করিয়া দিব, তবে জলগ্রহণ করিব!”

 রুক্মিণী কিয়ৎক্ষণ অনিমেষ নেত্রে সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া শুনিল, ক্রমে তাহার দাঁতে দাঁতে লাগিল, ঠোঁটে ঠোঁট চাপিল, তাহার হাতের মুষ্টি দৃঢ়বদ্ধ হইল, তাহার ঘন কৃষ্ণ ভ্রূযুগলের উপর মেঘ ঘনাইয়া আসিল,তাহার ঘন-কৃষ্ণ চক্ষু-তারকায় বিদ্যুৎ সঞ্চিত হইতে লাগিল, তাহার সমস্ত শরীর নিস্পন্দ হইয়া গেল; ক্রমে তাহার স্থূল অধরোষ্ঠ কাঁপিতে লাগিল, ঘন ভ্রূ তরঙ্গিত হইল, অন্ধকার চক্ষে বিদ্যুৎ খেলাইতে লাগিল, কেশরাশি ফুলিয়া উঠিল, হাত পা থর থর করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিল। একটা পৈশাচিক অভিশাপ, একটা সর্ব্বাঙ্গস্ফীত কম্পমান হিংসা সীতারামের মাথার উপরে যেন পড়ে পড়ে। সেই মুহূর্ত্তে সীতারাম কুটীর হইতে বাহির হইয়া গেল। ক্রমে যখন রুক্মিণীর মুষ্টি শিথিল হইয়া আসিল, দাঁত খুলিয়া গেল, অধরোষ্ঠ পৃথক হইল, কুঞ্চিত ভ্রূ প্রসারিত হইল, তখন সে বসিয়া পড়িল, কহিল, “বটে! যুবরাজ তোমারই বটে। যুবরাজের বিপদ হইয়াছে বলিয়া তোমার গায়ে বড় লাগিয়াছে—যেন যুবরাজ আমার কেহ নয়। পোড়ারমুখো, এটা জানিস্ না সে যে আমারই যুবরাজ, আমিই তাহার ভাল করিতে পারি আর আমিই তাহার মন্দ করিতে পারি। আমার যুবরাজকে তুই কারামুক্ত করিতে চাহিস্। দেখিব কেমন তাহা পারিস্।”

 সীতারাম সেই দিনই রায়গড়ে চলিয়া গেল।

 বিকালবেলা বসন্তরায় রায়গড়ের প্রাসাদের বারান্দায় বসিয়া রহিয়াছেন। সম্মুখে এক প্রশস্ত মাঠ দেখা যাইতেছে। মাঠের প্রান্তে খালের পরপারে একটি আম্রবনের মধ্যে সূর্য্য অস্ত যাইতেছেন। বসন্তরায়ের হাতে তাঁহার চিরসহচর সে সেতারটি আর নাই। বৃদ্ধ সেই অস্তমান সূর্য্যের দিকে চাহিয়া আপনার মনে গুন্ গুন্ করিয়া গান গাহিতেছেন।

আমিই শুধু রৈনু বাকি।
যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা’ তা, কেবল ফাঁকি।
আমার ব’লে ছিল যারা,
আর ত তারা দেয় না সাড়া,
কোথায় তারা, কোথায় তারা? কেঁদে কেঁদে কারে ডাকি’।
বল্ দেখি মা, শুধাই তােরে,
“আমার” কিছু রাখলি নেরে?
আমি কেবল আমায় নিয়ে কোন্ প্রাণেতে বেঁচে থাকি।

 কে জানে কি ভাবিয়া বৃদ্ধ এই গান গাহিতে ছিলেন। বুঝি তাঁহার মনে হইতেছিল, গান গাহিতেছি, কিন্তু যাহাদের গান শুনাইতাম, তাহারা যে নাই। গান আপনি আসে, কিন্তু গান গাহিয়া যে আর সুখ নাই। এখনাে আনন্দ ভুলি নাই, কিন্তু যখনি আনন্দ জন্মিত, তখনি যাহাদের আলিঙ্গন করিতে সাধ যাইত, তাহারা কোথায়? যে দিন প্রভাতে রায়গড়ে ঐ তাল গাছটার উপরে মেঘ করিত, মনটা আনন্দে নাচিয়া উঠিত, সেই দিনই আমি যাহাদের দেখিতে যশােরে যাত্রা করিতাম, তাহাদের কি আর দেখিতে পাইব না? এখনাে এক একবার মনটা তেমনি আনন্দে নাচিয়া উঠে কিন্তু হা—এইসব বুঝি ভাবিয়া আজ বিকাল বেলায় অস্তমান সূর্য্যের দিকে চাহিয়া বৃদ্ধ বসন্তরায়ের মুখে আপনা আপনি গান উঠিয়াছে—“আমিই শুধু রৈনু বাকি।

 এমন সময়ে খাঁ সাহেব আসিয়া এক মস্ত সেলাম করিল। খাঁ সাহেবকে দেখিয়া বসন্তরায় উৎফুল্ল হইয়া কহিলেন—“খাঁ সাহেব, এস এস!” অধিকতর নিকটে গিয়া ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন, “সাহেব তােমার মুখ অমন মলিন দেখিতেছি কেন? মেজাজ ভাল আছে ত?”

 খাঁ সাহেব—“মেজাজের কথা আর জিজ্ঞাসা করিবেন না, মহারাজ। আপনাকে মলিন দেখিয়া আমাদের মনে আর সুখ নাই! একটি বয়েদ আছে—‘রাত্রি বলে আমি কেহই নই, আমি যাহাকে মাথায় করিয়া রাখিয়াছি সেই চাঁদ, তাহারি সহিত আমি একত্রে হাসি, একত্রে ম্লান হইয়া যাই।’—মহারাজ, আমরাই বা কে, আপনি না হাসিলে আমাদের হাসিবার ক্ষমতা কি? আমাদের আর সুই নাই, জনাব!”

 বসন্তরায় ব্যগ্র হইয়া কহিলেন, “সে কি কথা সাহেব? আমার ত অসুখ কিছুই নাই,—আমি নিজেকে দেখিয়া নিজে হাসি—নিজের আনন্দে নিজে থাকি—আমার অসুখ কি খাঁ সাহেব?”

 খাঁ সাহেব—“মহারাজ এখন আপনার আর তেমন গান বাদ্য শুনা যায় না।”

 বসন্তরায় সহসা ঈষৎ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “আমার গান শুনিবে সাহেব?”

“আমিই শুধু রইনু বাকি।
যা ছিল তা গেল চলে,
রইল যা’ তা কেবল ফাঁকি।”

 খাঁ সাহেব—“আপনি আর সে সেতার বাজান কই? আপনার সে সেতার কোথায়?”

 বসন্তরায় ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন—“সে সেতার কি নাই, তাহা নয়। সেতার আছে, শুধু তাহার তার ছিঁড়িয়া গেছে, তাহাতে আর সুর মেলে না।” বলিয়া আম্রবনের দিকে চাহিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে বসন্তরায় বলিয়া উঠিলেন, খাঁ সাহেব একটা গান গাও না—একটা গান গাও, গাও—“তাজবে তাজ নওবে নও।”

 খাঁ সাহেব গান ধরিলেন:—

“তাজবে তাজ নওবে নও।”

 দেখিতে দেখিতে বসন্তরায় মাতিয়া উঠিলেন—আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না! উঠিয়া দাঁড়াইলেন, একত্রে গাহিতে লাগিলেন, “তাজবে তাজ, নওবে নও।” ঘন ঘন তাল দিতে লাগিলেন, এবং বারবার করিয়া গাইতে লাগিলেন। গাহিতে গাহিতে সূর্য্য অস্ত গেল, অন্ধকার হইয়া আসিল, রাখালেরা বাড়িমুখে আসিতে আসিতে গান ধরিল। এমন সময়ে আসিয়া সীতারাম “মহারাজের জয় হৌক” বলিয়া প্রণাম করিল। বসন্তরায় একেবারে চমকিত হইয়া, তৎক্ষণাৎ গান বন্ধ করিয়া তাড়াতাড়ি তাহার কাছে আসিয়া তাহার গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “আরে সীতারাম যে! ভাল আছিস্ ত? দাদা কেমন আছে? দিদি কোথায়? খবর ভাল ত?”

 খাঁ সাহেব চলিয়া গেল। সীতারাম কহিল, “একে একে নিবেদন করিতেছি মহারাজ।” বলিয়া একে একে যুবরাজের কারারােধের কথা কহিল। সীতারাম আগাগােড়া সত্য কথা বলে নাই। যে কারণে উদয় আদিত্যের কারারোধ ঘটিয়াছিল, সে কারণটা তেমন স্পষ্ট করিয়া বলে নাই।

 বসন্তরায়ের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল, তিনি সীতারামের হাত দৃঢ় করিয়া ধরিলেন। তাঁহার ভ্রূ ঊর্দ্ধে উঠিল, তাঁহার চক্ষু প্রসারিত হইয়া গেল, তাঁহার অধরোষ্ঠ বিভিন্ন হইয়া গেল—নির্ণিমেষ নেত্রে সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “অ্যাঁ?”

 সীতারাম কহিল, “আজ্ঞা হাঁ মহারাজ।” কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া বসন্তরায় কহিলেন “সীতারাম!”

 সীতারাম—“মহারাজ!”

 বসন্তরায়—“তাহা হইলে দাদা এখন কোথায়?”

 সীতারাম—“আজ্ঞা তিনি কারাগারে!”

 বসন্তরায় মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। উদয়াদিত্য কারাগারে, এ কথাটা বুঝি তাঁহার মাথায় ভাল করিয়া বসিতেছে না, কিছুতেই কল্পনা করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। আবার কিছুক্ষণ বাদে সীতারামের হাত ধরিয়া কহিলেন—“সীতারাম!”

 সীতারাম—“আজ্ঞা মহারাজ!”

 বসন্তরায়—“তাহা হইলে দাদা এখন কি করিতেছে?”

 সীতারাম—“কি আর করিবেন! তিনি কারাগারেই আছেন।”

 বসন্তরায়—“তাঁহাকে কি সকলে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে?”

 সীতারাম—“আজ্ঞা হাঁ মহারাজ।”

 বসন্তরায়—“তাহাকে কি কেহ একবার বাহির হইতে দেয় না?”

 সীতারাম—“আজ্ঞা না।”

 বসন্তরায়—“সে একলা কারাগারে বসিয়া আছে?”

 বসন্তরায় একথাগুলি বিশেষ কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেন নাই। আপনা-আপনি বলিতেছিলেন। সীতারাম তাহা বুঝিতে পারে নাই—সে উত্তর করিল—“হাঁ মহারাজ।”,

 বসন্তরায় বলিয়া উঠিলেন—“দাদা, তুই আমার কাছে আয়রে। তােকে কেহ চিনিল না।”