বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ।
বসন্তরায় তাহার পর দিনই যশোহরে যাত্রা করিলেন, কাহারাে নিষেধ মানিলেন না। যশােহরে পৌঁছিয়াই একেবারে রাজবাটির অন্তঃপুরে গেলেন। বিভা সহসা তাহার দাদা মহাশয়কে দেখিয়া যেন কি হইয়া গেল। কিছুক্ষণ, কি যে করিবে কিছু যেন ভাবিয়া পাইল না। কেবল, চোখে বিস্ময়, অধরে আনন্দ, মুখে কথা নাই, শরীর নিস্পন্দ—খানিকটা দাঁড়াইয়া রহিল—তাহার পর তাঁহার পায়ের কাছে পড়িয়া প্রণাম করিল, পায়ের ধূলা মাথায় লইল। বিভা উঠিয়া দাঁড়াইলে পর বসন্তরায় একবার নিতান্ত একাগ্র দৃষ্টে বিভার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা?” আর কিছু বলিলেন না, কেবল জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা?” যেন তাঁহার মনে একটি অতিক্ষীণ আশা জাগিয়াছিল যে, সীতারাম যাহা বলিয়াছিল, তাহা সত্য না হইতেও পারে। সমস্তটা স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করিতে ভয় হইতেছে পাছে বিভা তাহার উত্তর দিয়া ফেলে! তাঁহার ইচ্ছা নয় যে বিভা তৎক্ষণাৎ তাঁহার এ প্রশ্নের উত্তর দেয়। তাই তিনি অতি ভয়ে ভয়ে বিভার মুখখানিকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“বিভা?” তাই তিনি অতি একাগ্র দৃষ্টে তাহার মুখের দিকে একবার চাহিলেন। বিভা বুঝিল এবং বিভা উত্তর দিতেও পারিল না। তাহার প্রথম আনন্দ-উচ্ছ্বাস ফুরাইয়া গেছে। আগে যখন দাদা মহাশয় আসিতেন, সেই সব দিন তাহার মনে পড়িয়াছে! সে এক কি উৎসবের দিনই গিয়াছে! তিনি আসিলে কি একটা আনন্দই পড়িত! হাসিয়া তামাসা করিত, বিভা হাসিত কিন্তু তামাসা করিতে পারিত না, দাদা প্রশান্ত আনন্দ মূর্ত্তিতে দাদা মহাশয়ের গান শুনিতেন; আজ দাদা মহাশয় আসিলেন, কিন্তু আর কেহ তাঁহার কাছে আসিল না, কেবল এই আঁধার সংসারে একলা বিভা— সুখের সংসারের একমাত্র ভগ্নাবশেষের মত এক্লা—দাদা মহাশয়ের কাছে দাঁড়াইয়া আছে। দাদা মহাশয় আসিলে যে ঘরে আনন্দ-ধ্বনি উঠিত—সেই সুরমার ঘর আজ এমন কেন; সে আজ স্তব্ধ, অন্ধকার, শূন্যময়— দাদা মহাশয়কে দেখিলেই সে ঘরটা যেন এখনি কাঁদিয়া উঠিবে! বসন্তরায় একবার কি যেন কিসের আশ্বাসে সেই ঘরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন— দরজার কাছে দাঁড়াইয়া ঘরের মধ্যে মাথা লইয়া একবার চারিদিক দেখিলেন, তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরাইয়া বুকফাটা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন— “দিদি, ঘরে কি কেহই নাই?”
বিভা কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, “না দাদা মহাশয়, কেহই না।”
স্তব্ধ ঘরটা যেন হা-হা করিয়া বলিয়া উঠিল—“আগে যাহারা ছিল তাহারা কেহই নাই!”,
বসন্তরায় অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, অবশেষে বিভার হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে গাহিয়া উঠিলেন—
“আমি শুধু রৈনু বাকি!”
বসন্তরায় প্রতাপাদিত্যের কাছে গিয়া নিতান্ত মিনতি করিয়া কহিলেন —“বাবা প্রতাপ, উদয়কে আর কেন কষ্ট দাও—সে তােমাদের কি করিয়াছে? তাহাকে যদি তােমরা ভাল না বাস’ পদে পদেই যদি সে তােমাদের কাছে অপরাধ করে—তবে তাহাকে এই বুড়ার কাছে দাও না। আমি তাহাকে লইয়া যাই—আমি তাহাকে রাখিয়া দিই—তাহাকে আর তােমাদের দেখিতে হইবে না—সে আমার কাছে থাকিবে!”
প্রতাপাদিত্য অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত ধৈর্য্য ধরিয়া চুপ করিয়া বসন্তরায়ের কথা শুনিলেন, অবশেষে বলিলেন—“খুড়া মহাশয়, আমি যাহা করিয়াছি তাহা অনেক বিবেচনা করিয়াই করিয়াছি—এবিষয়ে আপনি অবশ্যই আমার অপেক্ষা অনেক অল্প জানেন—অথচ আপনি পরামর্শ দিতে আসিয়াছেন, আপনার এ সকল কথা আমি গ্রাহ্য করিতে পারি না।”
তখন বসন্তরায় উঠিয়া প্রতাপাদিত্যের কাছে আসিয়া প্রতাপাদিত্যের হাত ধরিয়া কহিলেন—“বাবা প্রতাপ, মনে কি নাই! তােকে যে আমি ছেলেবেলায় কোলে পিঠে করিয়া মানুষ করিলাম, সে কি আর মনে পড়ে না? স্বর্গীয় দাদা যে দিন তােকে আমার হাতে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন, সে দিন হইতে আমি কি এক মুহূর্ত্তের জন্য তােকে কষ্ট দিয়াছি? অসহায় অবস্থায় যখন তুই আমার হাতে ছিলি, এক দিনও কি তুই আপনাকে পিতৃহীন বলিয়া মনে করিতে পারিয়াছিলি? প্রতাপ, বল্ দেখি, আমি তাের কি অপরাধ করিয়াছিলাম যাহাতে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে তুই আমাকে এত কষ্ট দিতে পারিলি? এমন কথা আমি বলি না যে, তােকে পালন করিয়াছিলাম বলিয়া তুই আমার কাছে ঋণী—তোদের মানুষ করিয়া আমিই আমার দাদার স্নেহ-ঋণ শােধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। অতএব প্রতাপ, আমি প্রাপ্য বলিয়া তাের কাছে কিছুই চাহি না, কখনো চাহিও নাই, আমি কেবল তাের কাছে ভিক্ষা চাহিতেছি—তাও দিবি না?”
বসন্তরায়ের চোখে জল পড়িতে লাগিল, প্রতাপাদিত্য পাষাণ মূর্ত্তির ন্যায় বসিয়া রহিলেন।
বসন্তরায় আবার কহিলেন—“তবে আমার কথা শুনিবি না,—আমার ভিক্ষা রাখিবি না—? কথার উত্তর দিবিনে প্রতাপ?”—দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “ভাল—আমার আর একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা আছে, একবার আমি উদয়কে দেখিতে চাই—আমাকে তাহার সেই কারাগৃহে প্রবেশ করিতে কেহ যেন নিষেধ না করে—এই অনুমতি দাও!”
প্রতাপাদিত্য তাহাও দিলেন না। তাঁহার বিরুদ্ধে উদয়াদিত্যের প্রতি এতখানি স্নেহ প্রকাশ করাতে প্রতাপাদিত্য মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাঁহার যতই মনে হয় লােকে তাঁহাকেই অপরাধী করিয়া তুলিতেছে, ততই তিনি আরাে বাঁকিয়া দাঁড়ান।
বসন্তরায় নিতান্ত ম্লান মুখে অন্তঃপুরে ফিরিয়া গেলেন—তাঁহার মুখ দেখিয়া বিভার অত্যন্ত কষ্ট হইল। বিভা দাদা মহাশয়ের হাত ধরিয়া কহিল—“দাদা মহাশয় আমার ঘরে এস।” বসন্তরায় নীরবে বিভার সঙ্গে সঙ্গে বিভার ঘরে প্রবেশ করিলেন। তিনি ঘরে বসিলে পর বিভা তাহার কোমল অঙ্গুলি দিয়া তাঁহার পাকা চুলগুলি নাড়িয়া দিয়া কহিল—“দাদা মহাশয়, এস, তােমার পাকাচুল তুলিয়া দিই।” বসন্তরায় কহিলেন, “দিদি, সে পাকাচুল কি আর আছে? যখন বয়স হয় নাই তখন সে সব ছিল, তখন তােদের পাকাচুল তুলিতে বলিতাম—আজ আমি বুড়া হইয়া গিয়াছি—আজ আর আমার পাকাচুল নাই।”
বসন্তরায় দেখিলেন বিভার মুখখানি মলিন হইয়া আসিল, তাহার চোখ ছল্ছল্ করিয়া আসিল। অমনি তাড়াতাড়ি কহিলেন—“আয় বিভা, আয়। গােটাকতক চুল তুলিয়া দে। তােদের পাকাচুল সবরাহ করিয়া উঠিতে আর ত আমি পারি না ভাই। বয়স হইতে চলিল, ক্রমেই মাথায় টাক পড়িতে চলিল—এখন আর একটা মাথার অনুসন্ধান কর—আমি জবাব দিলাম।” বলিয়া বসন্তরায় হাসিতে লাগিলেন।
একজন দাসী আসিয়া বসন্তরায়কে কহিল—“রাণী মা আপনাকে একবার প্রণাম করিতে চান।”
বসন্তরায় মহিষীর ঘরে গেলেন, বিভা কারাগারে গেল।
মহিষী বসন্তরায়কে প্রণাম করিলেন। বসন্তরায় আশীর্ব্বাদ করিলেন —“মা, আয়ুষ্মতী হও।”
মহিষী কহিলেন, “কাকা মশায় ও আশীর্ব্বাদ আর করিবেন না। এখন আমার মরণ হইলেই আমি বাঁচি।”
বসন্তরায় ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “রাম, রাম! ও কথা মুখে আনিতে নাই।”
মহিষী কহিলেন, “আর কি বলিব কাকা মহাশয়, আমার ঘরকন্নায় যেন শনির দৃষ্টি পড়িয়াছে।”
বসন্তরায় অধিকতর ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন।
মহিষী কহিলেন, “বিভার মুখখানি দেখিয়া আমার মুখে আর অন্ন জল রুচে না। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কিছু বলে না, কেবল দিনে দিনে তাহার শরীর ক্ষয় হইয়া যাইতেছে। তাহাকে লইয়া যে আমি কি করিব কিছু ভাবিয়া পাই না!”
বসন্তরায় অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। “এই দেখুন কাকা মহাশয়, এক সর্ব্বনেশে চিঠি আসিয়াছে।” বলিয়া এক চিঠি বসন্তরায়ের হতে দিলেন।
বসন্তরায় সে চিঠি পড়িতে না পড়িতে মহিষী কাঁদিয়া বলিতে লাগিলেন—“আমার কিসের সুখ আছে? উদয়—বাছা আমার কিছু জানে না তাহাকে ত মহারাজ—সে যেন রাজার মতই হয় নাই, কিন্তু তাহাকে ত আমি গর্ভে ধারণ করিয়াছিলাম, সে ত আমার আপনার সন্তান বটে। জানি না, বাছা সেখানে কি করিয়া থাকে, একবার আমাকে দেখিতেও দেয় না!” মহিষী আজ কাল যে যে কথাই পাড়েন, উদয়াদিত্যের কথা তাহার মধ্যে একস্থলে আসিয়া পড়ে। ঐ কষ্টটাই তাঁহার প্রাণের মধ্যে যেন দিনরাত জাগিয়া আছে।
চিঠি পড়িয়া বসন্তরায় একেবারে অবাক্ হইয়া গেলেন—চুপ করিয়া বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বসন্তরায় মহিষীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “চিঠি ত কাহাকেও দেখাও নি মা?”
মহিষী কহিলেন, “মহারাজ এ চিঠির কথা শুনিলে কি আর রক্ষা রাখিবেন, বিভাও কি তাহা হইলে আর বাঁচিবে!”
বসন্তরায় কহিলেন, “ভাল করিয়াছ। এ চিঠি আর কাহাকেও দেখাইও না বউ মা। তুমি বিভাকে শীঘ্র তাহার শ্বশুর বাড়ি পাঠাইয়া দাও। মান অপমানের কথা ভাবিও না!”
মহিষী কহিলেন—“আমিও তাহাই মনে করিয়াছি। মান লইয়া আমার কাজ নাই, আমার বিভা সুখী হইলেই হইল। কেবল ভয় হয় পাছে বিভাকে তাহারা অযত্ন করে।”
বসন্তরায় কহিলেন,—“বিভাকে অযত্ন করিবে! বিভা কি অযত্নের ধন! বিভা যেখানে যাইবে সেই খানেই আদর পাইবে। অমন লক্ষ্মী অমন সােনার প্রতিমা আর কোথায় আছে! রামচন্দ্র কেবল তােমাদের উপর রাগ করিয়াই এই চিঠি লিখিয়াছে, আবার পাঠাইয়া দিলেই তাহার রাগ পড়িয়া যাইবে!” বসন্তরায় তাঁহার সরল হৃদয়ে সরল বুদ্ধিতে এই বুঝিলেন। মহিষীও তাহাই বুঝিলেন!
বসন্তরায় কহিলেন “বাড়িতে রাষ্ট্র করিয়া দাও যে বিভাকে চন্দ্রদ্বীপে পাঠাইতে অনুরােধ করিয়া রামচন্দ্র এক চিঠি লিখিয়াছে। তাহা হইলে বিভা নিশ্চয়ই সেখানে যাইতে আর অমত করিবে না।”