বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ।

 সন্ধ্যার পর বসন্তরায় একাকী বহির্ব্বাটিতে বসিয়া আছেন। এমন সময়ে সীতারাম তাঁহাকে আসিয়া প্রণাম করিল।

 বসন্তরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“কি সীতারাম, কি খবর?”

 সীতারাম কহিলেন, “সে পরে বলিব, আপনাকে আমার সঙ্গে আসিতে হইবে।”

 বসন্তরায় কহিলেন, “কেন, কোথায় সীতারাম?”

 সীতারাম তখন কাছে আসিয়া বসিল। চুপি চুপি ফিস্ ফিস্ করিয়া কি বলিল। বসন্তরায় চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “সত্য নাকি?”

 সীতারাম কহিল, “আজ্ঞা হাঁ মহারাজ।”

 বসন্তরায় মনে মনে অনেক ইতস্তত করিতে লাগিলেন। কহিলেন— “এখনি যাইতে হইবে না কি!”

 সীতারাম—“আজ্ঞা হাঁ!”

 বসন্তরায়—“একবার বিভার সঙ্গে দেখা করিয়া আসিব না?”

 সীতারাম—“আজ্ঞা—না—আর সময় নাই!”

 বসন্তরায়—“কোথায় যাইতে হইবে?”

 সীতারাম—“আমার সঙ্গে আসুন, আমি লইয়া যাইতেছি।”

 বসন্তরায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন—“একবার বিভার সঙ্গে দেখা করিয়া আসি না কেন?”

 সীতারাম—“আজ্ঞা না, মহারাজ! দেরি হইলে সমস্ত নষ্ট হইয়া যাইবে!”

 বসন্তরায় তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তবে কাজ নাই—কাজ নাই!” উভয়ে চলিলেন।

 আবার কিছু দূর গিয়া কহিলেন, “একটু বিলম্ব করিলে কি চলে না?”

 সীতারাম —“না মহারাজ তাহা হইলে বিপদ হইবে!”

 “দুর্গা বল” বলিয়া বসন্তরায় প্রাসাদের বাহির হইয়া গেলেন।

 বসন্তরায় যে আসিয়াছেন, তাহা উদয়াদিত্য জানেন না। বিভা তাহাকে বলে নাই। কেন না যখন উভয়ের দেখা হইবার কোন সম্ভাবনা ছিল না, তখন এ সংবাদ তাঁহার কষ্টের কারণ হইত। সন্ধ্যার পর বিদায় লইয়া বিভা কারাগার হইতে চলিয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য একটি প্রদীপ লইয়া একখানি সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িতেছেন। জানালার ভিতর দিয়া বাতাস আসিতেছে, দীপের ক্ষীণ শিখা কাঁপিতেছে, অক্ষর ভাল দেখা যাইতেছে না। কীট পতঙ্গ আসিয়া দীপের উপর পড়িতেছে। এক একবার দীপ নিভ নিভ হইতেছে। একবার বাতাস বেগে আসিল—দীপ নিভিয়া গেল। উদয়াদিত্য পুঁথি ঝাঁপিয়া তাঁহার খাটে গিয়া বসিলেন। একে একে কত কি ভাবনা আসিয়া পড়িল। বিভার কথা মনে আসিল। আজ বিভা কিছু দেরী করিয়া আসিয়াছিল, কিছু সকাল সকাল চলিয়া গিয়াছিল। আজ বিভাকে কিছু বিশেষ স্নান দেখিয়াছিলেন;—তাহাই লইয়া মনে মনে আলােচনা করিতেছিলেন। পৃথিবীতে যেন তাঁহার আর কেহ নাই—সমস্ত দিন বিভাকে ছাড়া আর কাহাকেও দেখিতে পান না— বিভাই তাঁহার একমাত্র আলোচ্য। বিভার প্রত্যেক হাসিটি প্রত্যেক কথাটি তাঁহার মনে সঞ্চিত হইতে থাকে—তৃষিত ব্যক্তি তাহার পানীয়ের প্রত্যেক বিন্দুটি পর্য্যন্ত যেমন উপভােগ করে, তেমনি বিভার প্রীতির অতি সামান্য চিহ্নটুকু পর্য্যন্ত তিনি প্রাণ-মনে উপভােগ করেন। আজ তাই এই বিজন ক্ষুদ্র অন্ধকার ঘরের মধ্যে একলা শুইয়া স্নেহের প্রতিমা বিভার ম্লান মুখখানি ভাবিতে ছিলেন। সেই অন্ধকারে বসিয়া তাঁহার একবার মনে হইল—“বিভার কি ক্রমেই বিরক্তি ধরিতেছে? এই নিরানন্দ কারাগারের মধ্যে এক বিষণ্ণ অন্ধকার মুর্ত্তির সেবা করিতে আর কি তাহার ভাল লাগিতেছে না? আমাকে কি ক্রমেই সে তাহার সুখের বাধা— তাহার সংসার-পথের কণ্টক বলিয়া দেখিবে? আজ দেরি করিয়া আসিয়াছে—কাল হয় ত আরো দেরি করিয়া আসিবে—তাহার পরে এক দিন হয় ত সমস্ত দিন বসিয়া আছি কখন্ বিভা আসিবে—বিকাল হইল—সন্ধ্যা হইল—রাত্রি হইল, বিভা আর আসিল না!—তাহার পর হইতে আর হয় ত বিভা আসিবে না।” উদয়াদিত্যের মনে যতই এই কথা উদয় হইতে লাগিল, ততই তাঁহার মনটা হা-হা করিতে লাগিল— তাঁহার কল্পনা-রাজ্যের চারিদিক কি ভয়ানক শূন্যময় দেখিতে লাগিলেন। এক দিন আসিবে যে দিন বিভা তাঁহাকে স্নেহশূন্য নয়নে তাহার সুখের কণ্টক বলিয়া দেখিবে—সেই অতি দূর কল্পনার আভাস মাত্র লাগিয়া তাঁহার হৃদয় একবারে ব্যাকুল হইয়া উঠিল। একবার মনে করিতেছেন “আমি কি ভয়ানক স্বার্থপর! আমি বিভাকে ভালবাসি বলিয়া তাহার যে ঘােরতর শত্রুতা করিতেছি, কোন শত্রুও বােধ করি এমন পারে না।” বার বার করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছেন আর বিভার উপর নির্ভর করিবেন না—কিন্তু যখনি কল্পনা করিতেন তিনি বিভাকে হারাইয়াছেন, তখনি তাঁহার মনে সে বল চলিয়া যাইতেছে, তখনি তিনি অকুল পাথারে পড়িয়া যাইতেছেন—মরণাপন্ন মজ্জমান ব্যক্তির মত বিভার কাল্পনিক মূর্ত্তিকে আকুল ভাবে আঁকড়িয়া ধরিতেছেন।

 এমন সময় বহির্দ্দেশে সহসা “আগুন—আগুন” বলিয়া এক ঘােরতর কোলাহল উঠিল। উদয়াদিত্যের বুক কাঁপিয়া উঠিল—বাহিরে শত শত কণ্ঠরােল একত্রে উঠিল, সহসা নানা কষ্টের নানাবিধ চীৎকার সহিত আকাশে শত লােকের দ্রুত পদশব্দ শুনা গেল। উদয়াদিত্য বুঝিলেন, প্রাসাদের কাছাকাছি কোথাও আগুন লাগিয়াছে। অনেকক্ষণ ধরিয়া গােলমাল চলিতে লাগিল—তাঁহার মন অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠিল। সহসা দ্রুতবেগে তাঁহার কারাগারের দ্বার খুলিয়া গেল। কে একজন তাঁহার অন্ধকার গৃহে প্রবেশ করিল—তিনি চমকিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“কে ও?”

 সে উত্তর করিল, “আমি সীতারাম, আপনি বাহির হইয়া আসুন।”

 উদয়াদিত্য কহিলেন—“কেন?”

 সীতারাম কহিল—“যুবরাজ কারাগৃহে আগুন লাগিয়াছে, শীঘ্র বাহির হইয়া আসুন!” বলিয়া তাঁহাকে ধরিয়া প্রায় তাঁহাকে বহন করিয়া কারাগারের বাহিরে লইয়া গেল।

 অনেক দিনের পর উদয়াদিত্য আজ মুক্ত স্থানে আসিলেন—মাথার উপরে সহসা অনেকটা আকাশ দেখিতে পাইলেন, বাতাস যেন তাহার বিস্তৃত বক্ষ প্রসারিত করিয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিতে লাগিল। চোখের বাধা চারিদিক হইতে খুলিয়া গেল। সেই অন্ধকার রাত্রে, আকাশের অসংখ্য তারকার দৃষ্টির নিম্নে, বিস্তৃত মাঠের মধ্যে কোমল তৃণজালের উপর দাঁড়াইয়া সহসা তাঁহার মনের মধ্যে এক অপরিসীম অনির্ব্বচনীয় আনন্দের উদয় হইল। সেই আনন্দে কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া তাহার পর সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন —“কি করিব, কোথায় যাইব?” অনেক দিন সঙ্কীর্ণ স্থানে বদ্ধ ছিলেন, চলেন ফেরেন নাই—আজ এই বিস্তৃত মাঠের মধ্যে আসিয়া অসহায় ভাবে সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি করিব? কোথায় যাইব?” সীতারাম কহিল —“আসুন, আমার সঙ্গে আসুন!”

 এদিকে আগুন খুব জ্বলিতেছে। বৈকালে কতকগুলি প্রজা প্রধান কর্ম্মচারীদের নিকট কি-একটা নিবেদন করিবার জন্য আসিয়াছিল। তাহারা প্রাসাদের প্রাঙ্গণে একত্র বসিয়াছিল—তাহারাই প্রথমে আগুনের গােল তােলে। প্রহরীদের বাসের জন্য কারাগারের কাছে একটি দীর্ঘ কুটীরশ্রেণী ছিল—সেই খানেই তাহাদের চারপাই, বাসন, কাপড়চোপড় জিনিষপত্র, সমস্তই থাকে। অগ্নির সংবাদ পাইয়াই যত প্রহরী পারিল সকলেই ছুটিয়া গেল, যাহারা নিতান্তই পারিল না, তাহারা হাত পা আছড়াইতে লাগিল। উদয়াদিত্যের গৃহদ্বারেও দুই একজন প্রহরী ছিল বটে, কিন্তু সেখানে কড়াক্কড় পাহারা দিবার কোন প্রয়োজনই ছিল না। দস্তুর ছিল বলিয়া তাহারা পাহারা দিত মাত্র। কারণ উদয়াদিত্য এমন শান্ত ভাবে তাঁহার গৃহে বসিয়া থাকিতেন যে বোধ হইত না যে তিনি কখন পালাইবার চেষ্টা করিবেন বা তাঁহার পালাইবার ইচ্ছা আছে। এই জন্য তাঁহার দ্বারে প্রহরীরা সর্ব্বাগ্রে ছুটিয়া গিয়াছিল। রাত হইতে লাগিল, আগুন নেবে না—কেহ বা জিনিষ পত্র সরাইতে লাগিল, কেহ বা জল ঢালিতে লাগিল, কেহ বা কিছুই না করিয়া কেবল গোলমাল করিয়াই বেড়াইতে লাগিল; আগুন নিবিলে পর তাহারাই সকলের অপেক্ষা অধিক বাহবা পাইয়াছিল। এইরূপ সকলে ব্যস্ত আছে, এমন সময়ে একজন স্ত্রীলোক তাহাদের মধ্যে ছুটিয়া আসিল, সে কি-একটা বলিতে চায়—কিন্তু তাহার কথা শোনে কে? কেহ তাহাকে গালাগালি দিল, কেহ তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল— কেহই তাহার কথা শুনিল না। যে শুনিল সে কহিল, “যুবরাজ পালাইলেন তাতে আমার কি মাগি, তোরই বা কি? সে দয়াল সিং জানে—আমার ঘর ফেলিয়া এখন আমি কোথাও যাইতে পারি না।”

 বলিয়া সে ভিড়ের মধ্যে মিশিয়া গেল। এইরূপ বারবার প্রতিহত হইয়া সেই রমণী অতি প্রচণ্ডা হইয়া উঠিল। একজন যাহাকে সমুখে পাইল তাহাকেই সবলে ধরিয়া কহিল—“পোড়ারমুখো, তোমরা কি চোখের মাথা খাইয়াছ? রাজার চাকরী কর সে জ্ঞান কি নাই? কাল রাজাকে বলিয়া হেঁটোয় কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়া তোমাদের মাটিতে পুঁতিব তবে ছাড়িব। যুবরাজ যে পালাইয়া গেল!”

 “ভালই হইয়াছে—তাের তাহাতে কি?” বলিয়া সে তাহাকে উত্তমরূপে প্রহার করিল—যাহারা ঘরে আগুন লাগাইয়াছিল, এ ব্যক্তি তাহাদের মধ্যে একজন। প্রহার খাইয়া সেই রমণীর মূর্ত্তি অতি ভীষণ হইয়া উঠিল—ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মত তাহার চোখ দুটা জ্বলিতে লাগিল, তাহার চুলগুলা ফুলিয়া উঠিল; সে দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় করিতে লাগিল, তাহার সেই মুখের উপর বহ্ণিশিখার আভা পড়িয়া তাহার মুখ পিশাচীর মত দেখিতে হইল। সম্মুখে একটা কাষ্ঠখণ্ড জ্বলিতেছিল, সেইটি তুলিয়া লইল, হাত পুড়িয়া গেল, কিন্তু তাহা ফেলিল না, সেই জ্বলন্ত কাষ্ঠ লইয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল। কিছুতে ধরিতে না পারিয়া—সেই কাষ্ঠ তাহার প্রতি ছুঁড়িয়া মারিল।