ব্যঙ্গকৌতুক/অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি
অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি
৺গােকুলনাথ দত্ত। ইন্দ্রলােক।
গোকুলনাথ। (স্বগত) আমি দেখ্চি স্বর্গটি স্বাস্থ্যের পক্ষে দিব্য জায়গা হয়েছে। সে সম্বন্ধে প্রশংসা না ক’রে থাকা যায় না। অনেক উচ্চে থাকার দরুণ অক্সিজেন্ বাষ্পটি বেশ বিশুদ্ধ পাওয়া যায়, এবং রাত্রিকাল না থাকাতে নন্দনবনের তরুলতাগুলি কার্ব্বনিক অ্যাসিড্ গ্যাস পরিত্যাগ করবার সময় পায় না, হাওয়াটি বেশ পরিষ্কার। এদিকে ধূলো নেই, তা’তে ক’রে একেবারে রােগের বীজই নষ্ট হ’য়েছে। কিন্তু এখানে বিদ্যাচর্চার যে রকম অবহেলা দেখ্চি তা’তে আমি সন্দেহ করি ধূলােয় রােগের বীজ উড়ে বেড়ায় এ সংবাদ এখনো এঁদের কানে এসে পৌঁছেচে কি না। এঁরা সেই যে এক সামবেদের গাথা নিয়ে প’ড়েছেন এর বেশি আর ইণ্টেলেকচুয়াল মুভ্মেণ্ট্ অগ্রসর হলো না। পৃথিবী দ্রুতবেগে চ’ল্চে কিন্তু স্বর্গ যেমন ছিল তেমনিই র’য়েচে, কন্সার্ভেটিভ্ যতােদূর হ’তে হয়!
(বৃহস্পতির প্রতি) আচ্ছা, পণ্ডিত মশায়, ঐ যে সামবেদের গান হ’চ্চে, আপনারা তাে ব’সে ব’সে মুগ্ধ হ’য়ে শুন্চেন, কিন্তু কোন্ সময়ে ওর প্রথম রচনা হয় তা’র কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ সংগ্রহ ক’র্তে পেরেচেন কি?—কী ব’ল্লেন? স্বর্গে আপনাদের ইতিহাস নেই? আপনাদের সমস্তই নিত্য?—সুখের বিষয়! সুরবালকদের তারিখ মুখস্ত ক’র্তে হয় না—কিন্তু বিদ্যাচর্চা ওতে করে কি অনেকটা অসম্পূর্ণ থাকে না? ইতিহাস শিক্ষার উপযােগিতা চার প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে।— প্রথম, ক—
মনােযােগ দিচ্ছেন কি?— (স্বগত) গান শুন্তে মত্ত তা’র আর মন দেবে কী ক’রে? পৃথিবী ছেড়ে অবধি এঁদের কাউকে যদি একটা কথা শােনাতে পেরে থাকি! শুন্চে কি না শুন্চে মুখ দেখে কিছু বােঝ্বার জো নেই—একটা কথা ব’ল্লে কেউ তা’র প্রতিবাদ করে না, এবং কারাে কথার কোনো প্রতিবাদ ক’র্লে তা’র একটা জবাব পাওয়াই যায় না। শুনেচি এইখানেই আমাকে সাড়ে পাঁচ কোটি সাড়ে পনর লক্ষ বৎসর কাটাতে হবে। তা হ’লেই তো গেচি! আত্মহত্যা ক’রে যে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে সে সুবিধাও নেই—এখানকার সাপ্তাহিক মৃত্যু তালিকা অন্বেষণ কর্তে গিয়ে শুন্লুম এখানে মৃত্যু নেই। অশ্বিনীকুমার নামক দুই বৈদ্য যে পদটি পেয়েচেন ওঁদের যদি বাঁধা খােরাক বরাদ্দ না থাক্তো তা হ’লে সমস্ত স্বর্গ ঝেটিয়ে এক পয়সা ভিজিট জুট্তো না। তবে কী ক’র্তে যে ওঁরা এখানে আছেন তা আমাদের মানুষের বুদ্ধিতে বুঝ্তে পারিনে। কাউকে তাে খরচের হিসাব দিতে হয় না, যার যা খুসি তাই হ’চ্চে। থাক্তো একটা ম্যুনিসিপ্যালিটি,এবং নিয়মমত কাজ হ’তো তা হ’লে আমিই তো সর্ব্বাগ্রে ঐ দুইটি হেল্থ অফিসারের পদ উঠিয়ে দেবার জন্যে ল’ড়্তুম। এই যে রােজ সভার মধ্যে অমৃত ছড়াছড়ি যাচ্ছে, তা’র একটা হিসেব কোথাও আছে? সেদিন তাে শচীঠাক্রুণকে স্পষ্টই মুখের উপর জিজ্ঞাসা ক’র্লুম, স্বর্গের সমস্ত ভাঁড়ার তাে আপনার জিম্মায় আছে— পাকা খাতায় হােক খসড়ায় হোক তা’র কোনাে একটা হিসাব রাখেন কী —হাতচিঠা, কি রসিদ, কি কোনাে রকমের একটা নিদর্শন রাখা হয়? শচীঠাক্রুণ বােধ করি মনে মনে রাগ ক’র্লেন—স্বর্গ সৃষ্টি হ’য়ে অবধি এ রকম প্রশ্ন তাঁকে কেউ জিজ্ঞাসা করে নি। যা পাব্লিকের জিনিষ তা’র একটা রীতিমত জবাবদিহি থাকা চাই, সে বােধটা এদের কারো দেখ্তে পাইনে। অজস্র আছে ব’লেই কি অজস্র খরচ ক’র্তে হবে? যদি আমাকে বেশি দিন এখানে থাক্তেই হয় তা হলে স্বর্গের সমস্ত বন্দোবস্ত আগাগােড়া রিফর্ম্ম না ক’রে আমি ন’ড়চিনে। আমি দেখ্চি, গােড়ায় দরকার অ্যাজিটেশন্—ঐ জিনিষটা স্বর্গে একেবারেই নেই— সব, দেবতাই বেশ সন্তুষ্ট হ’য়ে ব’সে আছেন। এঁদের এই তেত্রিশকোটিকে একবার রীতিমত বিচলিত ক’রে তুল্তে পার্লে কিছু কাজ হয়। এখানকার লােকসংখ্যা দেখেই আমার মনে হ’য়েছিলাে এখানে একটি বড়ো রকমের দৈনিক কিম্বা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ বেশ চালানো যেতে পারে। আমি যদি সম্পাদক হই, তা হ’লে আর দুটি উপযুক্ত সাবএডিটার পেলেই কাজ আরম্ভ ক’রে দিতে পারি। প্রথমত নারদকে দিয়ে খুব এক চোট্ বিজ্ঞাপন বিলি ক’র্তে হয়। তা’র পরে বিষ্ণুলােক ব্রহ্মলােক চন্দ্রলােক সূর্য্যলােকে গুটিকতক নিয়মিত সংবাদদাতা নিযুক্ত ক’র্তে হয়—আহা, এই কাজটি যদি আমি ক’রে যেতে পারি তা হ’লে স্বর্গের এ চেহারা আর থাকে না। যাঁরা সব দেবতাদের ঘুষ দিয়ে দিয়ে স্বর্গে আসেন, প্রতি সংখ্যায় তাঁদের যদি একটি করে সংক্ষেপ মর্ত্যজীবনী বের ক’র্তে পারি তা হ’লে আমাদের স্বর্গীয় মহাত্মাদের মধ্যে একটা সেন্সেশন্ প’ড়ে যায়!—একবার ইন্দ্রের কাছে আমার প্রস্তাবগুলাে পেড়ে দেখ্তে হবে!
(ইন্দ্রের নিকট গিয়া) দেখুন মহেন্দ্র, আপনার সঙ্গে আমার গােপনে কিছু (অপ্সরাগণকে দেখিয়া) ও! আমি জান্তুম না এঁরা সব এখানে আছেন—মাপ ক’র্বেন—আমি যাচ্ছি!—এ কি, শচীঠাক্রুণও যে ব’সে আছেন! আর ঐ বুড়ো বুড়ো রাজষি দেবর্ষিগুলােই বা এখানে ব’সে কী দেখ্চে? দেখুন মহেন্দ্র, স্বর্গে স্বায়ত্ত শাসন প্রথা প্রচলিত করেন নি ব’লে এখানকার কাজকর্ম তেমন ভালো রকম ক’রে চ’ল্চে না। আপনি যদি কিছুকাল এই সমস্ত নাচ বাজনা বন্ধ ক’রে দিয়ে আমার সঙ্গে আসেন তা হ’লে আমি আপনাকে হাতে হাতে দেখিয়ে দিতে পারি এখানকার কোনো কাজেরই বিলি ব্যবস্থা নেই। কার ইচ্ছায় কী ক’রে যে কী হ’চ্চে কিছুই দন্তস্ফুট কর্বার জো নেই। কাজ এমনতর পরিষ্কার ভাবে হওয়া উচিত, যে, যন্ত্রের মতো চ’ল্বে এবং চোখ বুলিয়ে দেখ্বামাত্রই বােঝা যাবে। আমি সমস্ত নিয়ম নম্বরওয়ারি ক’রে লিখে নিয়ে এসেচি—আপনার সহস্র চক্ষুর মধ্যে একজোড়া চোখও যদি এদিকে ফেরান্ তা হ’লে—আচ্ছা তবে এখন থাক্, আপনাদের গান বাজ্নাগুলো না হয় হ’য়ে যাক্ তা’র পরে দেখা যাবে।
(ভরত ঋষির প্রতি) আচ্ছা অধিকারী মশায়, শুনেচি গান বাজনায় আপনি ওস্তাদ, একটি প্রশ্ন আপনার কাছে আছে। গানের সম্বন্ধে যে ক-টি প্রধান অঙ্গ আছে অর্থাৎ সপ্ত সুর, তিনগ্রাম, একুশ মূর্চ্ছনা—কী বল্লেন? আপনারা এ সমস্ত মানেন না—আপনারা কেবল আনন্দটুকু জানেন! তাইতো দেখ্চি—এবং যতাে দেখ্চি ততো অবাক হ’য়ে যাচ্চি। (কিয়ৎক্ষণ শুনিয়া) ভরতঠাকুর ঐ যে ভদ্র মহিলাটি—কী ওঁর নাম—রম্ভা? উপাধি কী বলুন? উপাধি বুঝ্চেন না? এই যেমন রম্ভা চাটুয্যে কি রম্ভা ভট্টাচার্য্য—কিম্বা ক্ষত্রিয় যদি হন তাে রম্ভা সিংহ —এখানে আপনাদের ও সব কিছু নেই বুঝি?—আচ্ছা বেশ কথা—তা শ্রীমতী রম্ভা যে গানটি গাইলেন আপনারা তো তা’র যথেষ্ট প্রশংসা কর্লেন—কিন্তু ওর রাগিণীটি আমাকে অনুগ্রহ ক’রে ব’লে দেবেন? একবার তাে দেখ্চি ধৈবত লাগ্চে আবার দেখি কোমল ধৈবতও লাগে —আবার গােড়ার দিকে-ওঃ, বুঝেচি আপনাদের কেবল ভালােই লাগে, কিন্তু ভালো লাগ্বার কোনো নিয়ম নেই। আমাদের ঠিক তা’র উল্টো, ভালাে না লাগ্তে পারে কিন্তু নিয়মটা থাক্বেই। আপনাদের স্বর্গে যেটি আবশ্যক সেটি নেই, যেটা না হ’লেও চলে তা’র অনেক বাহুল্য। সমস্ত সপ্তস্বর্গ খুঁজে কায়ক্লেশে যদি আধখানা নিয়ম পাওয়া যায় তো তখনি তা’র হাজারখানা ব্যতিক্রম বেরিয়ে পড়ে। সকল বিষয়েই তাই দেখ্চি। ঐ দেখুন না ষড়ানন ব’সে আছেন—ওঁর ছ-টার মধ্যে পাঁচটা মুণ্ডুর কোনােই অর্থ পাবার জো নেই। শরীরতত্ত্বের কখও যে জানে সে-ও ব’লে দিতে পারে একটা স্কন্ধের উপরে ছ-টা মুণ্ড নিতান্তই বাহুল্য!-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! ওঁর ছয় মাতার স্তন পান ক’র্তে ওঁকে ছ-টা মুণ্ড ধারণ ক’র্তে হ’য়েছিলো? ওটা হ’লো মাইথলজি আমি ফিজিয়লজির কথা ব’ল্ছিলুম। ছ-টা যেন মুণ্ডই ধারণ ক’র্লেন— পাকযন্ত্র তাে একটার বেশি ছিল না।—এই দেখুন না, আপনাদের স্বর্গের বন্দোবস্তটা। আপনার শরীর থেকে ছায়াটাকে বাদ দিয়ে দিয়েচেন—কিন্তু সেটা আপনাদের কী অপরাধ ক’রেছিলো? আপনারা স্বর্গের লােক—ব’ল্লে হয়তাে বিশ্বাস করেন না, আমি জন্মকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত ঐ ছায়াটাকে কখনো পশ্চাতে, কখনো সম্মুখে, কখনো দক্ষিণে, কখনো বামে সঙ্গে ক’রে নিয়ে কাটিয়েচি, ওটাকে পুষতে একদিনের জন্যে শিকিপয়সা খরচ ক’র্তে হয়নি এবং অত্যন্ত শ্রান্তির সময়ও বহন ক’র্তে এক তিল ভার বােধ করিনি—ওটাকে আপনারা ছেঁচে দিলেন, কিন্তু ছ-টা মুণ্ড, চারটে হাত, হাজারটা চোখ, এতে খরচও আছে, ভারও আছে—অথচ সেটা সম্বন্ধে একটু ইকনমি কর্বার দিকে নজর নেই। ছায়ার বেলাই টানাটানি কিন্তু কায়ার বেলা মুক্তহস্ত!— সাধুবাদ দিচ্চেন? দেবতাদের মধ্যে আপনিই তা হ’লে আমার কথাটা বুঝেচেন! সাধুবাদ আমাকে দিচ্চেন না? শ্রীমতী রম্ভাকে দিচ্চেন? ওঃ! তা হ’লে আপনি বসুন,আমি কার্তিকের সঙ্গে আলাপ ক’রে আসি।
(কার্ত্তিকের পার্শ্বে বসিয়া) গুহ, আপনি ভালো আছেন তো? আপনাদের এখানকার মিলিটারি ডিপার্টমেণ্ট সম্বন্ধে আমার দুটো একটা খবর নেবার আছে। আপনারা কী রকম নিয়মে—আচ্ছা তা হ’লে এখন থাক্ আগে আপনাদের অভিনয়টা হ’য়ে যাক্? কেবল একটা কথা জিজ্ঞাসা করি—এই যে নাটকটি অভিনয় হ’চ্চে এর নাম তো শুন্চি, চিত্রলেখার বিরহ— এর উদ্দেশ্যটা কী আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। উদ্দেশ্য দু-রকমের হ’তে পারে, এক জ্ঞানশিক্ষা, আর এক নীতিশিক্ষা। কবি, হয়, এই গ্রন্থের মধ্যে কোনো একটা জাগতিক নিয়ম আমাদের সহজে বুঝিয়ে দিয়েচেন, নয় স্পষ্ট ক’রে দেখিয়ে দিয়েচেন যে, ভালো ক’র্লে ভালো হয়, মন্দ ক’র্লে মন্দই হ’য়ে থাকে। ভেবে দেখুন, বিবর্ত্তনবাদের নিয়ম অনুসারে পরমাণুপুঞ্জ কী রকম ক’রে ক্রমে ক্রমে বিচিত্র জগতে পরিণত হ’লো—কিম্বা আমাদের ইচ্ছাশক্তি যে অংশে পূর্ব্ববর্তী কর্ম্মের ফল সেই অংশে বদ্ধ এবং যে অংশে পরবর্ত্তী কর্ম্মকে জন্ম দেয় সেই অংশে মুক্ত এই চিরস্থায়ী বিরোধের সামঞ্জস্য কোন্খানে —কাব্যে যখন সেই তত্ত্ব পরিস্ফুট হয় তখন কাব্যের উদ্দেশ্যটি হাতে হাতে পাওয়া যায়! চিত্রলেখার বিরহের মধ্যে এর কোন্টি আছে? আপনি তো বিগলিত প্রায় হ’য়ে এসেচেন; যে রকম দেখচি দেবলোকে যদি ফিজিয়লজির নিয়ম ব’লে একটা কিছু থাক্তো তা হ’লে এখনি আপনার দ্বাদশ চক্ষু থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হ’তো! যাই হোক কার্ত্তিক, এ বড়ো দুঃখের বিষয় স্বর্গে আপনাদের রাশি রাশি কাব্য নাটকের ছড়াছড়ি যাচ্চে কিন্তু যাতে গবেষণা কিম্বা চিন্তাশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় স্বর্গীয় গ্রন্থকারদের হাত থেকে এমন একটা কিছুই বেরোচ্চে না। (ঈষৎ হাস্যসহকারে) দেখচি “চিত্রলেখার বিরহ” নাটকখানা আপনার বড়োই ভালো লেগে গেচে, তা হলে অন্য প্রসঙ্গ থাক্ আপনি ঐটেই দেখুন!
(ইন্দ্রের নিকট গিয়া দেখুন দেবরাজ, স্বর্গে পরস্পরের মতামত আলােচনার একটা স্থান না থাকাতে বড়ােই অভাব বােধ করা যায়। আমার ইচ্ছা, নন্দনকাননের পারিজাতকুঞ্জের মধ্যে যেখানে আপনাদের নৃত্যশালা আছে সেইখানে একটা সভাস্থাপন করি, তা’র নাম দিই, শতক্রতু ডিবেটিংক্লব। তা’তে আপনারও একটা নাম থাক্বে আর স্বর্গেরও অনেক উপকার হবে! না, থাক্, মাপ ক’র্বেন— আমার অভ্যাস নেই—আমি অমৃত খাইনে—রাগ যদি না করেন তো বলি ও অভ্যাসটা আপনাদের ত্যাগ করা উচিত—আমি দেখেচি দেবতাদের মধ্যে পানদোযটা কিছু প্রবল হ’য়েছে। অবশ্য ওটাকে আপনারা সুরা বলেন না, কিন্তু ব’ল্লে কিছু অত্যুক্তি হয় না। পৃথিবীতেও দেখ্তুম অনেকে মদকে ওয়াইন্ বলে কিছু সন্তোষলাভ ক’র্তেন। সুরেন্দ্র, আপনি শ্রীমতী মেনকাকে এই মাত্র যে সম্বােধনটা ক’র্লেন ওটা কি ভালাে শুন্তে হ’লাে? সংস্কৃত কাব্যে নাটকে দেখেচি বটে ঐ সকল সম্বোধন প্রচলিত ছিল, কিন্তু আপনি যদি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর নেন তো জান্তে পার্বেন, ওগুলাে এখন নিন্দনীয় ব’লে গণ্য হ’য়েছে! আমরা কী রকম সম্বােধন করি জান্তে চাচ্চেন? আমরা কখনো মাতৃসম্বােধনও ক’রে থাকি কখনাে বা বাছাও বলি—আবার সময়রিশেষে ভালােমানুষের মেয়ে ব’লেও সম্ভাষণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে কোনােটিই আপনি এই সকল মহিলাদের প্রতি প্রয়ােগ ক’র্তে ইচ্ছা করেন না? তা না করুন এটা স্বীকার ক’র্তেই হবে আপনারা ওঁদের সম্বন্ধে যে বিশেষণগুলি উচ্চারণ ক’রে থাকেন, তা’তে রুচির পরিচয় পাওয়া যায় না। কী ব’ল্লেন? স্বর্গে সুরুচিও নেই কুরুচিও নেই? প্রথমটি যে নেই সে বিষয়ে সন্দেহ করিনে—দ্বিতীয়টি যে আছে তা এখনি প্রমাণ ক’রে দিতে পারি কিন্তু আপনারা তাে আমার কোনাে আলোচনাতেই কর্ণপাত করেন না।
(শচীর নিকট গিয়া) দেখুন শচি, আপনার কি মনে হয় না, স্বর্গসমাজের ভিতরে যে সমস্ত দোষ প্রবেশ ক’রেচে সেগুলাে দূর কর্বার জন্যে আমাদের বদ্ধপরিকর হওয়া উচিত। আপনারা স্বর্গাঙ্গনারাও যদি এ সকল বিষয়ে শৈথিল্য প্রকাশ ক’র্তে থাকেন তা হ’লে আপনাদের স্বামীদের চরিত্রের অবস্থা ক্রমশই শােচনীয় হ’তে থাক্বে। ওঁদের সম্বন্ধে যে সকল অপযশের কথা প্রচলিত আছে সে আপনাদের অবিদিত নেই— মধ্যে মধ্যে যদি সভা আহ্বান ক’রে এ সকল বিষয়ে আলােচনা হয়—আপনারা যদি সাহায্য করেন তা হ’লে— কোথায় যান? গৃহকর্ম্ম আছে বুঝি? (শচীকে উঠিতে দেখিয়া সকল দেবতার উত্থান এবং অকালে সভাভঙ্গ)। মহা মুস্কিলে পড়া গেল—কাউকে একটা কথা ব’ল্লে কেউ শােনেও না—বুঝ্তেও পারে না; (ইন্দ্রের নিকট গিয়া কাতর স্বরে) ভগবন্ সহস্রলােচন শতক্রতো, আমার সাড়ে পাঁচ কোটি সাড়ে পনর লক্ষ বৎসরের মধ্যে আর কতো দিন বাকি আছে?
ইন্দ্র। (কাতর স্বরে) সাড়ে পাঁচকোটি পনরলক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার নয় শ নিরেনব্বই বৎসর।
(গােকুলনাথ এবং তেত্রিশকোটি দেবতার এক সঙ্গে সুগভীর দীর্ঘ নিশ্বাস পতন)