ব্যঙ্গকৌতুক/স্বর্গীয় প্রহসন

স্বর্গীয় প্রহসন

ইন্দ্রসভা

 বৃহস্পতি। হে সৌম্য, তেত্রিশকোটি দেবতাতেও কি ইন্দ্রলােক পূর্ণ হয় নাই? আরাে কি নূতন দেবতা আমন্ত্রণের আবশ্যক আছে? হে প্রিয়দর্শন, স্মরণ রাখিয়ো, জন্ম মৃত্যুর দ্বারা মর্ত্ত্যলােকে লােকসংখ্যা নিয়মশাসনে থাকে, কিন্তু স্বর্গলােকে মৃত্যুর অভাবে দেবসংখ্যা হ্রাস করিবার কোনো উপায় নাই; অতএব সংখ্যা বৃদ্ধি করিবার পূর্ব্বে সবিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখা কর্ত্তব্য।

 ইন্দ্র। হে সুরগুরো, স্বর্গের পথ দুর্গম করিবার জন্য স্বর্গাধিপতির চেষ্টার ত্রুটি নাই এ কথা সর্ব্বজনবিদিত।

 বৃহস্পতি। পাকশাসন নাকপতে, তবে কেন অধুনা দেবলােকে মনসা শীতলা ঘেঁটু নামধারী অজ্ঞাতকুলশীল নব নব দেবতার অভিষেক হইতেছে?

 ইন্দ্র। দ্বিজোত্তম, আমরা দেবতাগণ ত্রিভুবনের কর্ত্তৃত্বভার প্রাপ্ত হইয়াছি বটে কিন্তু সে কেবল ত্রিভুবনের সম্মতিক্রমে। এ কথা গুরুদেবের অগােচর নাই, যে, মর্ত্ত্যলােকেই দেবতাদের নির্ব্বাচন হইয়া থাকে। এককালে আর্য্যাবর্তের সমস্ত ব্রাহ্মণ হােতাগণ আমাকেই স্বর্গের প্রধান পদ দিয়াছিলেন এবং তৎকালে সরস্বতী দৃষদ্বতী তীরের প্রত্যেক যজ্ঞ হুতাশনে আমার উদ্দেশে অহরহ যে হবি সমর্পিত হইত তাহার হােমধূমে আমার সহস্রলােচন হইতে নিরন্তর অশ্রু প্রবাহিত হইত। অদ্য নরলােকে হবি ঘৃত কেবল মাত্র জঠরযজ্ঞে ক্ষুধাসুরের উদ্দেশেই উপহৃত হইয়া থাকে এবং শুনিতে পাই সে ঘৃতও বিশুদ্ধ নহে।

 বৃহস্পতি। বৃত্রনিসূদন, সেই অপবিত্র বিমিশ্র ঘৃতপানে, শুনিতে পাই, ক্ষুধাসুর মৃতপ্রায় হইয়া আসিয়াছে। হে শক্র, দেবতাদের প্রতি দেবদেবের বিশেষ কৃপা আছে সেই জন্যই নরলােকে হােমাগ্নি নির্ব্বাপিত হইয়াছে, নতুবা নব্য গব্য পরিপাক করিতে হইলে, ভাে পাকশাসন, দেবজঠরের সমস্ত অমৃতরস সুতীব্র অম্লরসে পরিণত হইত, অগ্নিদেবের মন্দাগ্নি এবং বায়ুদেবের বায়ুপরিবর্ত্তন আবশ্যক হইত, এবং সমস্ত দেবতার অমরবক্ষে অসহ্য শূল বেদনা অমর হইয়া বাস করিত।

 ইন্দ্র। হে জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ, উক্তঘৃতের গুণাগুণ আমার অবিদিত নাই, যেহেতু যমরাজের নিকট সর্ব্বদাই তাহার বিবরণ শুনিতে পাই। অতএব হব্য পদার্থে আমার কিছুমাত্র লােভ নাই, এবং হােমাগ্নির তিরােধান সম্বন্ধেও আমি আক্ষেপ করিতেছি না। আমার বক্তব্য এই যে, যেমন পুষ্প হইতে সৌরভ উত্থিত হয় তেমনি মর্ত্ত্যের ভক্তি হইতেই স্বর্গ ঊর্দ্ধলােকে উদ্বাহিত হইতে থাকে; সেই ভক্তিপুষ্প যদি শুষ্ক হইয়া যায় তবে হে দ্বিজসত্তম, তেত্রিশ কোটি দেবতাও আমার এই পারিজাতমােদিত, নন্দনবনবেষ্টিত স্বর্গলােক রক্ষা করিতে পারিবে না। সেই কারণে, মর্ত্ত্যের সহিত যােগ প্রবাহ রক্ষা করিবার জন্য মাঝে মাঝে নরলােকের নবনির্ব্বাচিত দেবতাগুলিকে সাদরে স্বর্গে আবাহন করিয়া আনিতে হয়। হে ত্রিকালজ্ঞ, স্বর্গের ইতিহাসে এমন ঘটনা ইতিপূর্ব্বেও ঘটিয়াছে।

 বৃহস্পতি। মেঘবাহন, সে সমস্ত ইতিহাস আমার অগােচর নাই। কিন্তু ইতিপূর্ব্বে যে-সকল নূতন দেবতা মর্ত্ত্য হইতে স্বর্গলােকে উন্নীত হইয়াছিলেন তাঁহারা অভিজাত দেবগণের সহিত একাসনে বসিবার উপযুক্ত। সম্প্রতি ঘেঁটু প্রমুখ যে সমস্ত দেবতাগণ তােমার নিমন্ত্রণে স্বর্গে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছেন তাঁহারা সুরসভার দিব্যজ্যোতি ম্লান করিয়া দিয়াছেন। অদিতিনন্দন, আমার প্রস্তাব এই যে, তাঁহাদের জন্য একটি উপদেবলােক সৃজন করিবার জন্য বিশ্বকর্মার প্রতি বিশেষ ভারার্পণ করা হয়।

 ইন্দ্র। বুধপ্রবর, তাহা হইলে সেই উপস্বর্গই স্বর্গ হইয়া দাঁড়াইবে এবং স্বর্গ উপসর্গ হইবে মাত্র। একমাত্র বেদমন্ত্রের উপর আমাদের স্বর্গ প্রতিষ্ঠিত। জম্মনদেশীয় পণ্ডিতগণের বহুল চেষ্টা সত্ত্বেও সে মন্ত্র এবং তাহার অর্থ সকলে বিস্মৃত হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু আমাদের নূতন আমন্ত্রিত দেবদেবীগণ সায়নাচার্য্যের ভাষ্য, পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের পুরাতত্ত্ব অথবা তাঁহাদের প্রাচ্যশিষ্যবর্গের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিতেছেন না, তাঁহারা প্রতিদিনের সদ্য আহরিত পূজা প্রাপ্ত হইয়া উপবাসী পুরাতন দেবতাদের অপেক্ষা অনেক গুণে প্রবল হইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাদিগকে স্বপক্ষে পাইলে আমরা নূতন বললাভ করিতে পারিব। অতএব, গুরুদেব, প্রসন্নচিত্তে তাঁহাদের কণ্ঠে দেবমাল্য অর্পণ করিয়া তাঁহাদিগকে স্বর্গলােকে বরণ করিয়া লউন্!

 বৃহস্পতি। অহো দুর্বৃত্তা নিয়তি! মর্ত্ত্যলােকের প্রসাদলাভলালসায় কতাে পুরাতন দেবকুলপ্রদীপ ক্রমশ আপন দেবমর্য্যাদা বিসর্জ্জন দিয়াছেন। দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয় বীরবেশ পরিত্যাগ করিয়া সূক্ষ্মবসন লম্বকচ্ছে কামিনীমনােমােহন নির্লজ্জ নাগরমূর্ত্তি ধারণ করিয়াছেন। গম্ভীরপ্রকৃতি গণপতি কদলী তরুর সহিত গােপন পরিণয়পাশে বদ্ধ হইয়াছেন এবং মহাযােগী মহেশ্বর গঞ্জিকা ধুস্তূর সিদ্ধিপানে উন্মত্ত হইয়া মহাদেবীর সহিত অশ্রাব্য ভাষায় কলহ করিয়া নীচজাতীয় স্ত্রী-পল্লীর মধ্যে আপন বিহার ক্ষেত্র বিস্তার করিয়াছেন। সেই সমস্তই যখন একে একে সহ্য করিতে পারিয়াছি তখন, বােধ করি, দেবাসনে উপদেবতাগণের অধিরােহণ দৃশ্যও এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ধৈর্য্যকঠিন বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিতে পারিবে না!

চন্দ্রের প্রবেশ

 ইন্দ্র। ভগবন্ উড়ুপতে! স্বর্গলােকে তাে কৃষ্ণপক্ষের প্রভাব নাই, তবে অদ্য কেন তােমার সৌম্যসুন্দর প্রফুল্ল মুখচ্ছবি অন্ধকার দেখিতেছি?

 চন্দ্র। দেব সহস্রলােচন, স্বর্গে কৃষ্ণপক্ষ থাকিলে অমাবস্যার ছায়ায় আমি আনন্দে আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারিতাম। দেবরাজ, দেবী শীতলার প্রসন্নদৃষ্টি হইতে আমাকে নিষ্কৃতি দান করাে! তিনি স্বর্গে পদার্পণ করিয়া অবধি আমার প্রতি যে বিশেষ পক্ষপাত প্রকাশ করিতেছেন, আমি একাকী তাহার যােগ্য নহি। তাঁহার সেই প্রচুর অনুগ্রহ দেবসাধারণের মধ্যে সমভাগে বিভক্ত হইলে কাহারো প্রতি অন্যায় হয় না।

 ইন্দ্র। সুধাংশুমালিন্, সুহৃদগণের সহিত ভাগ করিয়া ভােগ করিলে অধিকাংশ আনন্দই বৃদ্ধি পাইয়া থাকে সন্দেহ নাই কিন্তু রমণীর অনুগ্রহ সে জাতীয় নহে।

 চন্দ্র। ভগবন্, তবে সে আনন্দ তুমিই সম্পূর্ণ গ্রহণ করো। তুমি সুরশ্রেষ্ঠ, এ সুখাবেগ তুমি ব্যতীত আর কেহ একাকী সম্বরণ করিতে পারিবে না।

 ইন্দ্র। প্রিয়সখে, অন্যের নিকট যাহা পাওয়া যায় তাহা বন্ধুকে দান করা কঠিন নহে; কিন্তু প্রেম সেরূপ সামগ্রী নহে; তুমি যাহা পাইয়াছ তাহা তুমি অনাদরে ফেলিয়া দিতে পার কিন্তু প্রিয়তম বন্ধুর অত্যাবশ্যক পূরণ করিবার জন্যও তাহা দান করিতে পার না।

 চন্দ্র। যদি ফেলিয়া দিতে পারিতাম, তবে, বিপন্নভাবে তােমার দ্বারস্থ হইতাম না। সুরপতে, অনেক সৌভাগ্য আছে যাহা দূরে নিক্ষেপ করিলেও নিকটে সংলগ্ন হইয়া থাকে।

 ইন্দ্র। শশলাঞ্ছন, তুমি কি অপযশের ভয় করিতেছ?

 চন্দ্র। সখে, সত্য বলিতেছি কলঙ্কের ভয় আমার নাই।

 ইন্দ্র। কলানাথ, তবে কি তুমি তােমার অন্তঃপুরলক্ষ্মী প্রিয়তমার অসূয়া আশঙ্কা করিতেছ?

 চন্দ্র। বন্ধো, তােমার অবিদিত নাই, সপ্তবিংশতি নক্ষত্রনারী লইয়া আমার অন্তঃপুর। তাহারা প্রত্যেকেই সমস্ত রাত্রি অনিমেষ নেত্রে জাগ্রত থাকিয়া আমার গতিবিধি নিরীক্ষণ করিয়া থাকে, তথাপি এপর্য্যন্ত নক্ষত্রলােকে কোনােরূপ অশান্তির কারণ ঘটে নাই। সপ্তবিংশতির উপর আর একটি যােগ করিতে আমি ভীত নহি।

 ইন্দ্র। সখে, ধন্য তােমার সাহস! তবে তােমার ভয় কিসের?

শশব্যস্ত হইয়া দেবদূতের প্রবেশ

 দূত। জয়ােস্তু। দেবরাজ, বাণী বীণাপাণি স্বর্গপরিত্যাগের কল্পনা করিতেছেন।

 ইন্দ্র। (সসম্ভ্রমে) কেন? দেবগণ তাঁহার নিকট কী কারণে অপরাধী হইয়াছে?

 দূত। মনসা শীতলা মঙ্গলচণ্ডী নাম্নী দেবীগণ সরস্বতীর কমলবনে চিঙ্গটি নামক কর্দ্দমচর ক্ষুদ্র মৎস্যের সন্ধানে গিয়াছিলেন। কৃতকার্য্য না হইয়া কমলকলিকায় অঞ্চলপূর্ণ করিয়া তিন্তিড়ি সংযােগে কটুতৈলে অম্লব্যঞ্জন রন্ধনপূর্ব্বক তীরে বসিয়া প্রচুরপরিমাণে আহার করিয়াছেন, এবং পিত্তলস্থালী সরােবরের জলে মার্জ্জনপূর্ব্বক স্ব স্ব স্থানে ফিরিয়া আসিয়াছেন। এপর্য্যন্ত মানসসরােবরের পদ্মকলিকা দেব দানব কেহই ভক্ষ্যরূপে ব্যবহার করে নাই। (দেবগণের পরস্পর মুখাবলােকন।)

ঘেঁটু মনসা প্রভৃতি দেবদেবীগণের প্রবেশ

ইন্দ্র। (আসন ছাড়িয়া উঠিয়া) দেবগণ, দেবীগণ, স্বাগত। আপনাদের কুশল? স্বর্গলােকে আপনাদের কোনােরূপ অভাব নাই? অনুচরগণ সমাহিত হইয়া সর্ব্বদা আপনাদের আদেশপালনের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকে? সিদ্ধগন্ধর্ব্বগণ নৃত্যশালায় নৃত্যগীতাদির দ্বারা আপনাদের মনােরঞ্জন করে? কামধেনুর দুগ্ধ এবং অমৃতরস যথাকালে আপনাদের সম্মুখে আহরিত হইয়া থাকে? নন্দনবনের সুগন্ধ সমীরণ আপনাদের ইচ্ছানুগামী হইয়া বাতায়নপথে প্রবাহিত হইতে থাকে? আপনাদের লতানিকুঞ্জে পারিজাত সর্ব্বদাই প্রস্ফুটিত থাকিয়া শােভাদান করে?

(দেবীগণের উচ্চহাস্য)

 মনসা। (ঘেঁটুর প্রতি) মিন্‌সে কী ব’ক্‌চে ভাই?

 ঘেঁটু। পুরুঠাকুরের মতো মন্তর প’ড়ে যাচ্ছে। (ইন্দ্রের প্রতি) ওহে, তুমি বুঝি কর্ত্তা! তােমার মন্তর পড়া হ’য়ে গিয়ে থাকে তো গােটাকতক কথা বলি।

 ইন্দ্র। হে ঘেঁটো। আপনকার—

 ঘেঁটু। ঘেঁটো কী! আমি তােমার বাগানের মালী? বাপের জন্মে এমন অভদ্দর মানুষ তো দেখিনি গা! ঘেঁটো! আমি যদি তােমাকে ইন্দির না ব’লে ইন্দিলে বলি!

 মনসা। তা হলেই চিত্তিরে হয়! (দেবীগণের উচ্চহস্য)

 ইন্দ্র। (হাস্যে যােগদান করিবার চেষ্টা করিয়া) কুন্দাভদন্তি, বহু তপস্যার দ্বারা স্বর্গলােক লাভ করিয়াছিলাম, কিন্তু কোন্ সুকৃতি ফলে আপনকার সকলের স্মিতদশনময়ূখে স্বর্গলােক অকস্মাৎ অতিমাত্র আলােকিত হইয়া উঠিল এখনো তাহা ধারণা করিতে পারিলাম না!

 ঘেঁটু। আরে রাখাে, ওসব বাজে কথা রাখো। তোমার পেয়াদাগুলাে আমাকে সােনার ভাঁড়ে করে কী সব এনে দেয় সে আমি ছুঁতে পারিনে। তােমার শচী গিন্নিকে ব’লে দিয়ো আমার জন্যে রােজ এক থাল গােবরের লাড়ু তৈরি ক’রে পঠিয়ে দেন!

 ইন্দ্র। তথাস্তু। স্বর্গে আমাদের কল্পধেনু আছেন। তিনি সকলের সকল কামনাই পূরণ করিয়া থাকেন। বােধ করি আপনার প্রার্থনা পূর্ণ করা তাঁহার পক্ষে দুঃসাধ্য না হইতে পারে?

 শীতলা। (চন্দ্রকে এক কোণে গুপ্তপ্রায় দেখিয়া নিকটে গিয়া) মাইরি! তুমি এতাে ছলও জানাে ভাই! আমাকে আচ্ছা ভােগ ভুগিয়েচো যাহােক্! আমি বলি, তুমি বুঝি অন্দর মহলে আছ। ঢুকে দেখি, অশ্লেষা আর মঘা নবাবপুত্রীর মতাে ব’সে আছেন—আমাকে দেখে অবাক্ হ’য়ে রইলেন। আমার সহ্য হ’লো না। আমি ব’ল্লুম, বলি, ও বড়ােমানুষের ঝি, তােমাদের গতর খাটিয়ে খেতে হয় না ব’লে বুঝি দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না! যা ব’ল্‌তে হয় তা ব’লেচি! ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিয়ে এসেছি।

 চন্দ্র। (জনান্তিকে ইন্দ্রের প্রতি) সপ্তবিংশতির উপর অষ্টবিংশতিতম যােগ হইলে কিরূপ দুর্য্যোগ উপস্থিত হইতে পারে তাহা, হে শচীপতে, সহজেই অনুভব করিতে পারিবেন। (শীতলার প্রতি) অয়ি অনবদ্যে,—  শীতলা। (হাসিয়া অস্থির হইয়া) মা গাে মা, তুমি এতাে হাসাতেও পারো! আদর ক’রে বেশ নামটি দিয়েচো যাহােক্! আনাে বদ্যি! কিন্তু বদ্যিতে ক’র্‌বে কী ভাই! কতো বদ্যির সাতপুরুষকে আমি সাতঘাটের জল খাইয়ে এসেচি—আমি কি তেম্‌নি মেয়ে!

 ঘেঁটু। (ইন্দ্রের গায়ের কাছে গিয়া তাঁহার পৃষ্ঠে হাত দিয়া) কী গো, ইন্দির দা! মুখে যে রা’টি নেই। রেতের বেলা গিন্নির সঙ্গে বকাবকি চুলােচুলি হ’য়ে গেচে না কি?

 ইন্দ্র। (সসঙ্কোচে সরিয়া গিয়া দূরস্থ আসন নির্দেশপূর্ব্বক) দেব, আসন গ্রহণে অনুমতি হৌক্‌।

 ঘেঁটু। এই যে এখানে ঢের জায়গা আছে। (ইন্দ্রের সহিত একাসনে উপবেশন) দাদা, আমার সঙ্গে তুমি নৌকোতা কোরাে না। আজ থেকে তুমি আমার দাদা, আমি তােমার ছােটো ভাই ঘেঁটু। (বাহুদ্বারা ইন্দ্রের গলবেষ্টন এবং ইন্দ্রকর্ত্তৃক অব্যক্ত কাতর ধ্বনি উচ্চারণ)

 শীতলা। (চন্দ্রের প্রতি) তুমি যাও কোথায়!

 চন্দ্র। মনােজ্ঞে, অন্য অন্তঃপুরে দেবীগণ ভর্ত্তৃপ্রসাদন ব্রতে তাঁহাদের এই সেবকাধমকে স্মরণ করিয়াছেন—অতএব যদি অনুমতি হয় তবে, হে হরিণশালীন নয়নে—

 শীতলা। কী ব’ল্লে? শালী? তা ভাই তাই সই! তােমার চাঁদমুখে সবই মিষ্টি লাগে। তা শালী যদি ব’ল্লে তবে কানমলাটিও খাও! (চন্দ্রের পার্শ্বে একাসনে বসিয়া চন্দ্রের কর্ণপীড়ন)

 ইন্দ্র। (চন্দ্রের প্রতি) ভগবন্ সিতকিরণমালিন্, তুমিই ধন্য। করুণস্পর্শে তরুণীকরকিসলয়ের অরুণরাগ এখনো তােমার কর্ণমূলে সংলগ্ন হইয়া আছে!

 শীতলা। (মনসার প্রতি লক্ষ্য করিয়া স্বগত) ম’লো। ম’লাে। আমাদের মন্‌সে হিংসেয় ফেটে’ ম’লো! আমি চাঁদের পাশে ব’সেচি এ আর ওঁর গায়ে সইলো না। ঘুর্ ঘুর্ করে বেড়াচ্চে দেখো না! এতোগুলো পুরুষ মানুষের সাম্‌নে লজ্জাও নেই! মাগী এবার পাড়ায় গিয়ে কতো কানাঘুষোই ক’র্‌বে! উনিও বড়ো কসুর করেন নি। কার্ত্তিক ঠাকুরটিকে নিয়ে যে রকম নিলজ্জপনা ক’রেচে আমি দেখে লজ্জায় ম’রে যাই আর কি! কাত্তিক কোথায় নুকোবে ভেবে পায় না। এই তো চেহারা—ওই নিয়ে এতো ভঙ্গীও করে! মাগো, মাগো, মাগো! (প্রকাশ্যে) আ মর্ মাগী। চাঁদের সাম্‌নে দিয়ে অমন বেহায়ার মতো আনাগোনা ক’র্‌চিস্ কেন? যেন সাপ খেলিয়ে বেড়াচ্চে! কার্ত্তিকের ওখানে ঠাঁই হ’লোনা না কি?

(সুরসভার মধ্যে মনসা ও শীতলার গ্রাম্য ভাষায় তুমুল কলহ)

 ইন্দ্র। (শশব্যস্ত হইয়া একবার মনসা ও একবার শীতলার প্রতি) ক্রোধ সম্বরণ করো! ক্রোধ সম্বরণ করো! অয়ি অসূয়তাম্রলোচনে, অয়ি গলদ্বেণীবন্ধে, অয়ি বিগলিতদুকূলবসনে! অয়ি কোকিলজিতকূজিতে, তারতর সপ্তম স্বরকে পঞ্চমস্বরে নম্র করিয়া আনো! অয়ি কোপনে—

 ঘেঁটু। (উত্তরীয় ধরিয়া ইন্দ্রকে আসনে বসাইয়া) তুমি এতো ব্যস্ত হও কেন দাদা! ওদের এমন রোজ হ’য়ে থাকে! থাক্‌তো ওলাবিবি, তাহ’লে আরো জ’ম্‌তো! তা’র কী খাবার গোল হ’য়েচে তাই সে শচীর সঙ্গে ঝগড়া ক’র্‌তে গেচে।

ইন্দ্র। (ব্যাকুলভাবে) হা সুরেন্দ্রবক্ষোবিহারিণী দেবী পৌলোমী।

(মনসার দ্রুতবেগে সভা ত্যাগ, এবং শীতলার পুনশ্চ চন্দ্রের পার্শ্বে

উপবেশন)

বীণাপাণির প্রবেশ

 বীণা। দেবরাজ, কর্কশ কোলাহলে আমার দেববীণার স্বরস্খলন হইতেছে, আমার কমলবন শূন্যপ্রায়, আমি দেবলোক হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। (প্রস্থান)

 বৃহস্পতি। আমিও জননী বীণার অনুগমন করি! (প্রস্থান)

অশ্লেষা ও মঘার সভাপ্রবেশ

 অশ্লেষা ও মঘা (চন্দ্রের একাসনে শীতলাকে দেখিয়া) আজ অপরূপ অভিনব সপ্তদশম কলায় দেব শশধরকে সমধিকতর শোভমান দেখিতেছি!

 চন্দ্র। দেবীগণ, এই হতভাগ্যকে অকরুণ পরিহাসে বিড়ম্বিত করিবেন না। পুরুষরাহু আমাকে কেবল ক্ষণমাত্রকাল পরাভব করিতে পারে সেই আক্রোশে ঈর্ষান্বিত ভগবান একটি স্ত্রীরাহু সৃজন করিয়াছেন ইঁহার পূর্ণগ্রাস হইতে আমি বহু চেষ্টায় আপনাকে মুক্ত করিতে পারিতেছি না!

 অশ্লেষা। আর্য্যপুত্র, এই ভদ্র ললনা অনতিপূর্ব্বে তোমার অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্ব্বক তোমার শ্বশুরকুলকে ঊর্দ্ধতন চতুর্দ্দশ পুরুষ পর্য্যন্ত অশ্রুতপূর্ব্ব কুৎসা দ্বারা লাঞ্ছিত করিয়া আসিয়াছেন। দেবীর সেই আশ্চর্য্য ব্যবহারকে আমরা অধিকারবহির্ভূত উপদ্রব জ্ঞান করিয়া বিস্ময়ান্বিত হইয়াছিলাম এক্ষণে স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি সৌভাগ্যবতী তোমারই হস্তে সেই অবমাননের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছেন। এখন, আর্য্যপুত্রকে তাঁহার নবতর শ্বশুরকুলে বরণ করিয়া আমরা নক্ষত্রলোক হইতে বিচ্যুতিলাভের জন্য চলিলাম! (শীতলার প্রতি) ভদ্রে, কল্যাণি, তোমার সৌভাগ্য অক্ষয় হৌক্‌। (প্রস্থান)

শচীর প্রবেশ

 ইন্দ্র। (সসম্ভ্রমে আসন ত্যাগ করিয়া) আর্য্যে, শুভ আগমন হৌক্‌!

 ঘেঁটু। (উত্তরীয় ধরিয়া ইন্দ্রকে সবলে আসনে উপবেশন করাইয়া) ঈস্! ভারি খাতির যে! মাইরি; দাদা ঢের ঢের পুরুষ মানুষ দেখেচি কিন্তু তোর মতো এমন স্ত্রৈণ আমি দেখিনি!

 (ঘেঁটুকে ইন্দ্রের বামপার্শ্বে শচীর নির্দ্দিষ্ট স্থানে বসিতে দেখিয়া দূরে এক কোণে শচীদেবী কর্ত্তৃক সামান্য এক আসন গ্রহণ।)

 ঘেঁটু। (শচীর অনতিদূরে গমন করিয়া সহাস্যে) বৌঠাক্‌রুণ, আমার দাদাকে কী মন্তর প’ড়ে দিয়েচো বলো দেখি! একেবারে শ্রীচরণের গোলাম ক’রে রেখেচো! তুমি উঠ্‌লে ওঠে, তুমি ব’স্‌লে বসে! বলি, একটা কথাই কও! (গান) “কথা কইতে দোষ কি আছে বিধুমুখী!”

 ইন্দ্র। দেব ঘেঁটো, কিঞ্চিৎ অবসর দিতে অনুমতি হৌক্‌! দেবীর নিকট কিছু নিবেদন আছে!

 ঘেঁটু। ঈস্ দেখো! দেখো! একটু কাছে এসে ব’সেচি তোমার যে আর গায়ে সইলো না—এতোটা বাড়াবাড়ি কিছু নয়—কথায় বলে অতিভক্তি চোরের লক্ষণ! কাজ নেই ভাই আবার শাপ দেবে। তোমরা দু-জনে বোসো, আমি যাই। (বলপূর্ব্বক ইন্দ্রকে শচীর আসনে বসাইবার চেষ্টা)

 ইন্দ্র। (ঘেঁটুকে দূরে অপসারণ করিয়া) দেব, তুমি আত্মবিস্মৃত হইতেছ!

ওলাবিবির প্রবেশ

 ওলা। (শচীর প্রতি) তাই বলি যায় কোথায়! অমনি বুঝি সোয়মির কাছে নাগাতে এসেচো! তা নাগাও না! তোমার সোয়ামিকে আমি ডরাইনে!

 শচী। (আসন হইতে উঠিয়া ইন্দ্রের প্রতি) দেবরাজ, আমি জয়ন্তকে সঙ্গে লইয়া বিষ্ণুলোকে কিছুকাল লক্ষ্মীদেবীর আলয়ে বাস করিবার সংকল্প করিয়াছি। বহুকাল দেবীদর্শন ঘটে নাই।

 ইন্দ্র। আর্য্যে, আমিও দেবীর অনুসরণ করিতেছি। বহুকাল পূজার অনবসরক্রমে চক্রপাণির নিকট অপরাধী হইয়া আছি।

(উভয়ের প্রস্থান)

 চন্দ্র। দেব সহস্রলােচন, বিষ্ণুলােকে আমারো বিশেষ আবশ্যক আছে—লক্ষ্মীদেবী।―হায়! বিপৎকালে বান্ধবেরাও ত্যাগ করিয়া যায়!

 শীতলা। অমন হাঁড়িপানা মুখ ক’রে আছ কেন? অমন ক’রে থাকো তাে ফের কানমলা খাবে!

 চন্দ্র। স্ফুরৎকনকপ্রভে, বিষ্ণুলােকে আমার বিস্তর বিলম্ব হইবে না। যদি অনুমতি করো তাে দাস—

 শীতলা। ফের কানমলা খাবে! (কান মলিতে উদ্যত)

(মনসার পুনঃপ্রবেশ। শীতলার সহিত পুনরায়

কলহারম্ভ, ঘেঁটু, ওলা, মঙ্গলচণ্ডী প্রভৃতি

সকলের তাহাতে যোগদান।)

 চন্দ্র। আপনারা তবে ততােক্ষণ মিষ্টালাপ করুন, দাস বিষ্ণুলােক অভিমুখে প্রয়াণ করিতে ইচ্ছা করে!

(দ্রুতপদে প্রস্থান।)