ব্যঙ্গকৌতুক/বশীকরণ
বশীকরণ
প্রথম অঙ্ক
আশু ও অন্নদা
আশু। আচ্ছা অন্নদা, তুমি যেন ব্রাহ্মই হ’য়েছিলে, কিন্তু তাই ব’লে স্ত্রী-পরিত্যাগ ক’র্তে গেলে কেন? স্ত্রী তো তেত্রিশ কোটির মধ্যে একটিও নয়! ঐটুকু পৌত্তলিকতা—রাখলেও ক্ষতি ছিল না।
অন্নদা। সে তাে ঠিক কথা। স্ত্রী-পরিত্যাগ করা যায়, কিন্তু স্ত্রী- জাতি তো বিদায় হন না,―স্ত্রীকে ছাড়্লে স্ত্রীজাতি বিশ্বব্যাপী হ’য়ে দেখা দেন— স্ত্রীপূজার মাত্রা মনে মনে বেড়ে ওঠে।
আশু। তবে?
অন্নদা। তবে শােনাে। আমার শাশুড়ী ছিলেন না, শ্বশুর ভয়ঙ্কর হিন্দু ছিলেন। যখন শুনলেন আমি ব্রাহ্ম হ’য়েচি,আমার স্ত্রীকে বিধবার বেশ পরিয়ে ব্রহ্মচারিণী ক’রে কাশীতে গিয়ে বাস ক’র্লেন। তা’র পরে শুন্চি হিন্দুশাস্ত্রের সমস্ত দেবতাতেও তৃপ্তি হয় নি, তা’র উপরে অল্কট্, ব্লাভাট্স্কি, অ্যানি বেসাণ্ট্, সূক্ষ্মশরীর, মহাত্মা, প্লানচেট্, ভূতপ্রেত কিছুই বাদ যায় নি—
আশু। কেবল তুমি ছাড়া।
অন্নদা। আমাকে ব্রহ্মদৈত্য ব’লে বাদ দিলে।
আশু। তুমি তা’র আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েচো?
অন্নদা। আশার অপরাধ নেই—তা’র পশ্চাতে এতো বড়ো রেজিমেণ্ট্ লেগেচে, সে আর টিঁক্লো না! শুনেচি আমার শ্বশুর মারা গেচেন, এবং আমার স্ত্রী এখন পতিত উদ্ধার ক’রে বেড়াচ্চেন।
আশু। তুমি একবার চরণে পতিত হওগে না, যদি উদ্ধার করেন।
অন্নদা। ঠিকানাও জানিনে, প্রবৃত্তিও নেই।
আশু! তুমি কি এইরকম উড়ে উড়ে বেড়াবে?
অন্নদা। না হে, সােনার খাঁচার সন্ধানে আছি।
আশু। খাঁচাওয়ালার অভাব নেই,তবে সােনা জিনিষটা দুর্লভ বটে!
অন্নদা। আচ্ছা, আমার আলােচনা পরে হবে, কিন্তু তােমার কী বলাে দেখি? তােমার তাে আইবড়লােক প্রাপ্তির বিধান কোনাে শাস্ত্রেই লেখে না। তা’র বেলা চুপ! থিওসফিতে তােমাকে খেলে! মন্ত্রতন্ত্র, প্রাণায়াম, হঠযােগ, সুষুম্না-ইড়া-পিঙ্গলা এ সমস্তই তােমাকে ছাড়ে, যদি বিবাহ কর!
আশু। তুমি মনে কর, আমি সবই অন্ধভাবে বিশ্বাস করি―তা নয়। এ সমস্ত বিশ্বাসের যােগ্য কি না, তাই আমি পরীক্ষা ক’রে দেখ্তে চাই! অবিশ্বাসকেও তাে প্রমাণের উপর স্থাপন ক’র্তে হবে।
অন্নদা। ব’সে ব’সে তাই করো! মরীচিকা স্থাপনের জন্যে পাথরের ভিত্তি গাঁথো। আমি এখন চ’ল্লেম।
আশু। কোথায় যাচ্চো?
অন্নদা। শবসাধনায় নয়।
আশু। তা তাে জানি।
অন্নদা। একটি সজীবের সন্ধান পেয়েছি।
আশু। তবে যাও! শুভকার্য্যে বাধা দেবাে না!
দ্বিতীয় অঙ্ক
বাড়িওয়ালা ও তাহার স্ত্রী
স্ত্রী। মাতাজি যদি হবে, তবে অমন চেহারা কেন?
বাড়িওয়ালা। দেখ্তে শুন্তে তাড়কা-রাক্ষসীর মতাে না হ’লেই বুঝি আর মাতাজি হয় না!
স্ত্রী। হবে না কেন! কিন্তু তাহ’লে কি এই সমর্থবয়সে স্বামীর ঘরে না থেকে তােমার মতো বােকা ভােলাবার জন্যে মাতাজি-গিরি ক’র্তে বেরােতো? তাহলে কি পিতাজি তােমার মাতাজিকে ছাড়্তো? আর এতাে টাকাই বা পেলে কোথায়?
বাড়িওয়ালা। ওগাে, যারা যােগবিদ্যা জানে, তাদের যদি টাকা না হবে,—চেহারা না হবে, তবে কি তােমার হবে? রােসাে না,—ওঁর কাছে মন্তরটন্তরগুলো শিখে নেওয়া যাক্ না।
স্ত্রী। বুড়ােবয়সে মন্তর শিখে হবে কী শুনি? কা’কে বশ ক’র্বে?
বাড়িওয়ালা। যাঁকে কিছুতেই বশ মানাতে পার্লেম না!
স্ত্রী। তিনি কে?
বাড়িওয়ালা। আগে বশ মানাই, তা’র পরে সাহস ক’রে নাম ব’ল বো!
মাতাজির প্রবেশ
মাতাজি। এ বাড়িতে আমার থাকার সুবিধা হ’চ্চে না। এর চেয়ে বড়ো বাড়ি আমাকে দিতে হবে।
বাড়িওয়ালা। এ বাড়ি ছাড়া আমার আর একটিমাত্র বড়ো বাড়ি আছে। সেটা বড়ো বটে, কিন্তু—
মাতাজি। তা ভাড়া বেশি দেবো, কিন্তু সেই বাড়িতেই আমি কাল যেতে চাই।
বাড়িওয়ালা। সবে পর্শুদিন সেখানে একটি ভাড়াটে এসেচে। একটি কোন্ সদর্আলার বিধবা স্ত্রী,—পশ্চিম থেকে মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজ্তে এসে আমার সেই উনপঞ্চাশ নম্বরের বাড়িতে উঠেছে।
মাতাজি। উনপঞ্চাশ নম্বর! ঠিক আমি যা চাই! তোমার এ বাড়ির নম্বর ভালো নয়!
বাড়িওয়ালা। বাইশ নম্বর ভালো নয় মাতাজি? কারণটা কী বুঝিয়ে বলুন।
মাতাজি। বুঝ্তে পার্চো না—দুয়ের পিঠে দুই—
বাড়িওয়ালা। ঠিক ব’লেচেন মাতাজি, দুয়ের পিঠে দুইই তো বটে! এততদিন ওটা ভাবি নি!
মাতাজি। দুইয়েতে কিছু শেষ হয় না, তিন চাই। দেখো না, আমরা কথায় বলি, দু’ তিন জন—
বাড়িওয়ালা। ঠিক ঠিক, তা তো ব’লেই থাকি।
মাতাজি। যদি দুই ব’ল্লেই চুকে যেতো, তাহ’লে তা’র সঙ্গে আবার তিন ব’ল্বো কেন? বুঝে দেখো!
বাড়িওয়ালা। আমাদের কী বা বুদ্ধি, তাই বুঝ্বো! সবই তো জানতুম, তবু তো বুঝিনি।
মাতাজি। তাই, ঐ দুইয়ের পিঠে দুই ব’লেই আমার মন্ত্র কিছুই সফল হ’চ্চে না!
স্ত্রী। (আত্মগত) বেঁচে থাক্ আমার দুয়ের পিঠে দুই! মন্ত্র সফল হ’য়ে কাজ নেই।
মাতাজি। উনপঞ্চাশের মতো এমন সংখ্যা আর হয় না!
বাড়িওয়ালা। (জনান্তিকে) শুন্লে তো গিন্নি!
স্ত্রী। (জনান্তিকে) শুনে হবে কী! তোমার উনপঞ্চাশ যে অনেককাল হ’লো পেরিয়েচে।
বাড়িওয়ালা। কিন্তু মাতাজিকে কি কালই সে বাড়িতে যেতে হবে?
মাতাজি। কাল ঊনত্রিশ তারিখে মঙ্গলবার প’ড়েচে, এমন দিন আর পাওয়া যাবে না!
বাড়িওয়ালা। ঠিক কথা! কাল ঊনত্রিশেও বটে, আবার মঙ্গলবারও বটে! কী আশ্চর্য্য! তা হ’লে তো কালই যেতে হ’চ্চে বটে! তা-ই ঠিক ক’রে দেবো! (মাতাজির প্রস্থান) এখন আমার সেই নতুন ভাড়াটেদের ওঠাই কী ব’লে। বিদেশ থেকে এসেচে, হঠাৎ তা’রা এখন বাড়িই বা পায় কোথায়?
স্ত্রী। তাদের আপাতত এই বাড়িতে এনে রাখো না! আমরা না হয় কিছুদিন ঝামাপুকুরে জামাইবাড়ি গিয়েই থাক্বো! তোমার ঐ মন্তরজানা মেয়েমানুষকে এখানে রেখে কাজ নেই! বিদায় ক’রে দাও। ছেলেপিলের ঘর, কার্ কখন অপরাধ হয়, বলা যায় কি?
বাড়িওয়ালা। সেই ভালো। তাদের কোনোরকম ক’রে ভুলিয়েভালিয়ে আজকের মধ্যেই উনপঞ্চাশ নম্বর থেকে বাইশ নম্বরে এনে ফেলা যাক্! বলি গে, পাড়ায় প্লেগ্ দেখা দিয়েচে, ঊনপঞ্চাশ নম্বরে প্লেগ্হাসপাতাল ব’স্বে!
তৃতীয় অঙ্ক
আশু ও অন্নদা।
অন্নদা। তােমার ঐ টাট্কা লঙ্কার ধোঁয়ায় নাকের জলে চোখের জলে ক’র্লে যে হে! তােমার ঘরে আসা ছাড়্তে হ’লাে!
আশু। টাট্কা লঙ্কার ধোঁয়া তুমি কোথায় পেলে?
অন্নদা। ঐ যে তোমার তর্কালঙ্কারের বকুনি! লােকটা তো বিস্তর টিকি নাড়্লে, মাথামুণ্ডু কিছু পেলে কি?
আশু। মাথামুণ্ডু নইলে শুধু টিকি ন’ড়্বে কোথায়? কথাগুলাে যদি শ্রদ্ধা ক’রে শুন্তে, তবে বুঝ্তে।
অন্নদা। যদি বুঝ্তেম, তবে শ্রদ্ধা ক’র্তেম! তুমি আশু ফিজিকাল্ সায়ান্সে এম্, এ, দিয়ে এলে—তুমি যে এতো ঘন ঘন টিকিনাড়া বরদাস্ত ক’র্চো, এ যদি দেখ্তে পায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের চূমকাম-করা দেওয়ালগুলো বিনি খরচে লজ্জায় লাল হ’য়ে ওঠে। আজ কথাটা কী হ’লো বুঝিয়ে বলো দেখি।
আশু। পণ্ডিতমশায় পরিণয়তত্ত্ব ব্যাখ্যা ক’র্ছিলেন।
অন্নদা। তত্ত্বটা আমার জানা খুব দরকার হ’য়ে প’ড়েচে। তর্কালঙ্কার মশায় ব’ল্ছিলেন, বিবাহের পূর্ব্বে কন্যার সঙ্গে জানাশুনার চেষ্টা না করাই কর্ত্তব্য। যুক্তিটা কী দিচ্চিলেন, ভালাে বােঝা গেল না।
আশু। তিনি বলছিলেন, সকল জিনিষের আরম্ভের মধ্যে একটা গােপনতা আছে। বীজ মাটির নীচে অন্ধকারের মধ্যে থাকে, তা’র পরে অঙ্কুরিত হ’লে তখন সূর্য-চন্দ্র-জল-বাতাসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই কর্বার সময় আসে। বিবাহের পূর্ব্বে কন্যার হৃদয়কে বিলাতী অনুকরণে বাইরে টানাটানি না ক’রে তাকে আচ্ছন্ন আবৃত রাখাই কর্ত্তব্য। তখন তা’র উপরে তাড়াতাড়ি দৃষ্টিক্ষেপ ক’র্তে যেয়াে না। সে যখন স্বভাবতই নিজে অঙ্কুরিত হ’য়ে তা’র অর্দ্ধমুকুলিত সলজ্জ দৃষ্টিটুকু গােপনে তােমার দিকে অগ্রসর কর্তে থাক্বে, তখনি তােমার অবসর।
অন্নদা। আমার অদৃষ্টে সে পরীক্ষা তাে হ’য়ে গেছে। বিলাতী প্রথামতে, বিবাহের পূর্ব্বে কন্যার হৃদয় নিয়ে টানাহেঁচ্ড়া করিনি;—হৃদয়টা এতো অন্ধকারের মধ্যে ছিল যে, আমি তা’র কোনাে খোঁজ পাইনি, তা’র পরে অঙ্কুরিত হ’লো কি না হ’লো, তা’রো তো কোনো ঠিকানা পেলেম না। এবারে উল্টোরকম পরীক্ষা ক’র্তে চ’লেছি, এবার আগে হৃদয়, তা’র পরে অন্য কথা!
আশু। পরীক্ষার দিন কবে?
অন্নদা। কাল।
আশু। স্থান?
অন্নদা। উনপঞ্চাশ নম্বর রাম বৈরাগীর গলি।
আশু। নম্বরটা তো ভালাে শােনাচ্চে না!
অন্নদা। কেন? উনপঞ্চাশ বায়ুর কথা ভাব্চো? সে আমাকে টলাতে পার্বে না—তুমি হ’লে বিপদ ঘ’ট্তো।
আশু। পাত্র?
অন্নদা। কন্যার বিধবা মা তা’কে পশ্চিম থেকে সঙ্গে ক’রে এনেচে। আমি ঘটককে ব’লে রেখেচি যে ভালো ক’রে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় ক’রে নিয়ে তবে বিবাহের কথা হবে।
আশু। কিন্তু অন্নদা, শেষকালে বহুবিবাহে প্রবৃত্ত হ’লে।
অন্নদা। তােমাদের মতাে আমি নাম দেখে ভড়্কাই নে। যে বহুবিবাহের মধ্যে আর সমস্ত আছে, কেবল বহুটুকুই নেই, তাকে দেখে চমকাও কেন ভাই।
আশু। তবু একটা প্রিন্সিপল্ আছে তাে―বহুবিবাহকে বহুবিবাহ ব’ল্তেই হবে।
অন্নদা। আমার নামমাত্র স্ত্রী যেখানে আছে, প্রিন্সিপ্লও সেইখানে আছে। সে স্ত্রীও আস্চে না, প্রিন্সিপ্লও রইলো—অতএব এখন আমি ডঙ্কা মেরে বহুবিবাহ ক’র্বো, প্রিন্সিপ্ল্ জুজুকে ডরাবো না!
রাধাচরণের প্রবেশ
রাধা। আশুবাবু!
আশু। কী হে রাধে!
রাধা। সেদিন আপনি আমার সঙ্গে মন্ত্র নিয়ে তর্ক ক’র্লেন—এক একটা শব্দের যে একএক প্রকার বিশেষ ক্ষমতা আছে, আমার বােধ হ’লো আপনি যেন তা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন না।
অন্নদা। বলো কী রাধে—তা হলে আর অবিশ্বাস কর্বার ক্ষমতা এখনাে সম্পূর্ণ লােপ হয় নি— এখনাে দুটো একটা জায়গায় ঠেক্চে! শব্দের মধ্যে শক্তি আছে, এ কথা বাঙালীর ছেলে বিশ্বাস করো না।
রাধা। বলুন তাে অন্নদাবাবু! তা হ’লে মারণ, উচাটন, বশীকরণ, এগুলাে কি বেবাক্ গাঁজাখুরি!
অন্নদা। তাও কি কখনো হয়? সংসারে কি এতাে গাঁজার চাষ হ’তে পারে!
রাধা। পশ্চিম থেকে একজন যােগসিদ্ধ মাতাজি এসেচেন। শুনেচি তিনি মন্ত্রের বল একেবারে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিতে পারেন। দেখ্তে গিয়েছিলেম, কিন্তু সকলকে তিনি দেখা দেন না; ব’লেচেন, যােগ্য লােক পেলে তা’কে তিনি তাঁর সমস্ত বিদ্যে দেখিয়ে দেবেন। আশুবাবু, আপনি চেষ্টা ক’র্লে নিশ্চয় বিফল হবেন না।
আশু। তিনি থাকেন কোথায়?
রাধা। বাইশ নম্বর ভেড়াতলায়।
অন্নদা। বাইশ নম্বরটা উনপঞ্চাশের চেয়ে ভালাে হ’তে পারে, কিন্তু জায়গাটা ভালো ঠেক্চে না। একে বশীকরণ-বিদ্যে, তা’র উপরে ভেড়াতলা! মাতাজির কাছে মুণ্ডুজিটি খুইয়ে এসাে না!
আশু। আরে ছি! কী বকো, তা’র ঠিক নেই। তাঁরা হ’লেন সাধু স্ত্রীলােক, সেখানে মুণ্ডুর ভাবনা ভাব্তে হয় না। তুমি বুঝেসুঝে ঊনপঞ্চাশে পা বাড়িয়ো।
অন্নদা। তুমি ভাব্চো বাইশ একেবারেই নির্ব্বিষ! তা নয় হে! বিশের উপরেও দুইমাত্রা চড়িয়ে তবে বাইশ! আপাদমস্তক জর্জ্জর হ’য়ে ফিরবে।
চতুর্থ অঙ্ক
বাইশ নম্বরে কন্যার বিধবা মাতা শ্যামাসুন্দরী
শ্যামা। পেলেগ্ শুনে ভয়ে বাঁচিনে! তাড়াতাড়ি ক’রে পালিয়ে তাে এলুম! কিন্তু অন্নদা ব’লে ছেলেটির আজ যে সেই উনপঞ্চাশ নম্বরে আস্বার কথা আছে, সে কি সেখান থেকে চিনে ঠিক এখানে আস্তে পার্বে? এতে ক’রে খাওয়াদাওয়ার জোগাড় ক’র্লেম, সব মাটি হবে না তো? যে তাড়াটা লাগালে, একবার খবর দেবার সময় দিলে না! ঘটক ব’লেচে, ছেলেটি আমার নিরুপমাকে ভালো ক’রে দেখে-শুনে নিতে চায়, ওর পড়াশুনাে গানবাজ্না সব পরীক্ষা ক’র্বে— তা করুক! কর্ত্তা তো নিরুপমাকে সেই রকম ক’রেই শিখিয়েচেন! বরাবর পশ্চিমে ছিলেন, আমাদের কখনাে তো বন্ধ ক’রে রাখেন নি! তবু ক’ল্কাতার ছেলে কী রকম জানিনে! ভয় হয়! আমাদের ধরণ ধারণ দেখে হয় তাে অভদ্র মনে ক’র্বে! তা’রা মেয়ের সঙ্গে শেক্হ্যাণ্ড করে না কি, কে জানে! হয় তো ইংরাজিতে গুড্মর্ণিং বলে। শুনেচি তাদের নিজের হাতে চুরট জ্বালিয়ে দিতে হয়—এ সব তো পার্বো না! ঘটক ব’ল্লে, ছেলেটি হ্যাট্কোট্ পরে! আমার মেয়ে আবার ফিরিঙ্গির সাজ দু-চক্ষে দেখ্তে পারে না! কী রকম যে হবে, বুঝ্তে পার্চি নে? মন্ত্র পড়ে বিয়ে ক’র্তে রাজি হবে তো?
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য। মা ঠাক্রুণ, একটি বাবু এসেচেন; আমি তাঁকে ব’ল্লেম বাড়িতে পুরুষমানুষ কেউ নেই। তিনি ব’ল্লেন, তিনি মার সঙ্গেই দেখা ক’র্তে এসেচেন।
শ্যামা। তবে ঠিক হ’য়েচে। সেই ছেলেটি এসেচে। ডেকে নিয়ে আয়। (ভৃত্যের প্রস্থান) ভয় হ’চ্চে—ক’ল্কাতার ছেলে, তা’র সঙ্গে কী রকম করে চ’ল্তে হবে! কী জানোয়ারই মনে ক’র্বে।
আশুর প্রবেশ
(শ্যামাসুন্দরীর পায়ের কাছে একটি গিনি রাখিয়া
আশুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম।)
শ্যামা। (স্বগত) এ যে প্রণামী দিয়ে প্রণাম ক’র্লে গো! এ তো শেক্হ্যাণ্ড করে না! বাঁচালে! লক্ষ্মী ছেলে! কেমন ধুতিচাদর প’রে এসেচে!
আশু। মাতাজি, আমাকে যে আপনি দর্শন দেবেন, এ আমি আশা করিনি! বড়ো অনুগ্রহ ক’রেচেন।
শ্যামা। (সস্নেহে সপুলকে) কেন বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো, তোমাকে দেখা দিতে দোষ কী।
আশু। স্নেহ রাখ্বেন। আশীর্ব্বাদ ক’র্বেন, এই অনুগ্রহ থেকে কখনো বঞ্চিত না হই।
শ্যামা। বাবা, তোমার কথা শুনে আমার কান জুড়ালো—আমি নিশ্চয় অনেক তপস্যা ক’রেছিলেম, তাই—
আশু। মাতাজি, আপনি তপস্যার দ্বারা যে নিরুপম-সম্পদ্ লাভ ক’রেচেন, আমাকে তা’র—
শ্যামা। তোমাকে দেবার জন্যেই তো প্রস্তুত হ’য়ে এসেছি। অনেক সন্ধান ক’রে যোগ্যপাত্র পেয়েচি—এখন দিতে পার্লেই তো নিশ্চিন্ত হই।
আশু। (শ্যামার পদধূলি লইয়া) মাতাজি, আমাকে কৃতার্থ ক’র্লেন—এতো সহজেই যে ফললাভ ক’র্বো, এ আমি স্বপ্নেও জানতুম না।
শ্যামা। বলো কী বাবা, তোমার আগ্রহ যতো, আমার আগ্রহ তা’র চেয়ে বেশি।
আশু। তাহলে যে কামনা ক’রে এসেছিলেম, আজ কি তা’র কিছু পরিচয়—
শ্যামা। পরিচয় হবে বৈ কি বাবা, আমার তা’তে কোনো আপত্তি নেই—
আশু। আপত্তি নেই মাতাজি? শুনে বড়ো আরাম পেলেম—
শ্যামা। দেখাশুনা সমস্তই হবে বাবা, আগে কিছু খেয়ে নাও!
আশু। আবার খাওয়া! আপনি আমাকে যথার্থ জননীর মতোই স্নেহ দেখালেন।
শ্যামা। তুমিও আমাকে মার মতোই দেখ্বে, এই আমার প্রাণের ইচ্ছা—আমার তো ছেলে নেই, তুমিই আমার ছেলের মতো থাক্বে।
আহার্য্য লইয়া ভৃত্যের প্রবেশ
আশু। করেচেন কী? এতো আয়োজন?
শ্যামা। আয়োজন আর কী ক’র্লেম? আজই ঠিক আস্তে পার্বে কি না, মনে একটু সন্দেহ ছিল, তাই―
আশু। সন্দেহ ছিল? আপনি কি জান্তেন, আমি আস্বো?
শ্যামা। তা জান্তেম বৈ কি।
আশু। (আত্মগত) কী আশ্চর্য্য! আমাকে না জেনেই আমার জন্যে পূর্ব্ব হ’তেই অপেক্ষা ক’র্ছিলেন? তবু অন্নদা যােগবলে বিশ্বাস করে না! তাকে ব’ল্লে বােধ হয় ঠাট্টা ক’রেই উড়িয়ে দেবে! (আহারে প্রবৃত্ত)
শ্যামা। (আত্মগত) ছেলেটি সােনার টুক্রাে! যেমন কার্ত্তিকের মতাে দেখ্তে, তেম্নি মধুঢালা কথা! আমাকে প্রথম থেকেই মাতাজি ব’লে ডাক্চে। পশ্চিম থেকে এসেচি কি না, তাই বােধ হয় মা না ব’লে মাতাজি ব’ল্চে। (প্রকাশ্যে) কিছুই খেলে না যে বাবা?
আশু। আমার যা সাধ্য, তা’র চেয়ে বরঞ্চ বেশিই খেয়েচি মাতাজি।
শ্যামা। তা হ’লে একটু ব’সো—আমি ডেকে নিয়ে আসি। (প্রস্থান)
আশু। রাধে ব’লেছিলো বটে, মাতাজি কুমারী কন্যার দ্বারা মন্ত্রের ফল দেখিয়ে থাকেন। বশীকরণ-বিদ্যায় আমার একটু বিশ্বাস জন্মাচ্চে। এরি মধ্যে মাতাজির মাতৃস্নেহে আমার চিত্ত কেমন যেন আর্দ্র হ’য়ে এসেচে। আমার মা নেই, মনে হ’চ্চে যেন মাকে পেলেম! এ কোন্ মন্ত্রবলে কে জানে! মাতাজি স্নিগ্ধ দৃষ্টি দ্বারা আমার সমস্ত শরীর যেন অভিষিক্ত ক’রে দিয়েছেন। প্রথম দেখাতেই উনি যে আমাকে তাঁর পুত্রস্থানীয় ক’রে নিয়েছেন, এ যেন পূর্ব্বজন্মের একটা সম্বন্ধের স্মৃতি।
নিরুপমাকে লইয়া শ্যামার প্রবেশ
আশু। (স্বগত) আহা কী সুন্দর! মাতাজির বশীকরণ-বিদ্যা যেন মূর্ত্তিমতী। এঁর মুখে কোনো মন্ত্রই বিফল হ’তে পারে না।
শ্যামা। যাও, লজ্জা কোরো না মা! উনি যা জিজ্ঞাসা করেন, উত্তর দিয়াে।
আশু। লজ্জা ক’র বেন না! মাতাজি আমার প্রতি যে-রকম অনুগ্রহ প্রকাশ ক’রেচেন, আপনিও আমাকে আপনার লােকের মতােই দেখ বেন। (আত্মগত) মেয়েটি কী লাজুক! আমার কথা শুনে আরো যেন লাল হ’য়ে উঠ লাে।
শ্যামা। বাবা, তােমার ইচ্ছামত ওকে জিজ্ঞাসাপত্র করাে।
আশু। আপনার কোন্ কোন্ বিদ্যায় অধিকার আছে, জান তে উৎসুক হ’য়ে আছি।
শ্যামা। বয়স অল্প, বিদ্যা কতােই বা বেশি হবে—তবে—
আশু। যতো অল্পই হােক্ মাতাজি, আমাদের মতো লােকের পক্ষে যথেষ্ট হবে।
শামা। (আত্মগত) বিদ্যার কোনো পরিচয় না পেয়েই যখন এতো সন্তুষ্ট, তখন মেয়েকে পছন্দ ক’রেচে ব’লেই বােধ হ’চ্চে। বাঁচা গেল, আমার বড়াে ভাবনা ছিল। (প্রকাশ্যে) নিরু, একটি গান শুনিয়ে দাও তো মা!
আশু। গান! এ আমার আশার অতীত। আপনি বােধ হয় পূর্ব্বে থেকেই জানেন, গানের চেয়ে আমি কিছুই ভালােবাসিনে (স্বগত) অন্নদার মতো এতো বড়ো সন্দেহী, সে থাক লে আজ যােগের বল প্রত্যক্ষ ক’র তে পার তো! (প্রকাশ্যে নিরুপমার প্রতি) আপনারা আমাকে একদিনেই চিরঋণী ক’রেচেন-যদি গান করেন, তবে বিক্রীত হ’য়ে থাক বো!
(নিরুপমার গান)
কাফি-ঝাঁপতাল
(আমি) কি ব’লে করিব নিবেদন
আমার হৃদয় প্রাণমন?
চিত্তে এসে দয়া করি’ নিজে লহো অপহরি’
করাে তা’রে আপনার ধন―
আমার হৃদয় প্রাণমন।
শুধু ধূলি শুধু ছাই মূল্য যার কিছু নাই
মূল্য তা’রে করো সমর্পণ
তব স্পর্শে পরশরতন।
তােমার গৌরবে যবে আমার গৌরব হবে
একেবারে দিব বিসর্জ্জন
চরণে হৃদয় প্রাণমন।
আশু। (স্বগত) আর মন্ত্রের দরকার নেই। বশীকরণের আর কী বাকি রইলো! কন্যাটি দেবকন্যা! (প্রকাশ্যে) মাতাজি!
শ্যামা। কী বাবা!
আশু। আমাকে আপনার পুত্র ক’রেই রাখবেন, এমন সুবাসঙ্গীত শােন্বার অধিকার থেকে বঞ্চিত ক’র্বেন না। যা পাওয়া গেল, এই আমি পরম লাভ মনে ক’র্চি। মন্ত্রতন্ত্রের কথা ভুলেই গেচি। এখন বুঝতে পার্চি, মন্ত্রের কোনো দরকারই নেই!
শ্যামা। অমন কথা বােলাে না বাবা! মন্ত্রের দরকার আছে বৈ কি! নইলে শাস্ত্র—
আশু। সে তো ঠিক কথা! মন্ত্র আমি অগ্রাহ্য করি নে। আমি ব’ল্ছিলেম মন্ত্র প’ড়্লেই যে মন বশ হয়, তা নয়, গানের মােহিনী শক্তির কাছে কিছুই লাগে না। (স্বগত) মেয়েটি আবার লজ্জায় লাল হ’য়ে উঠ্লো! ভারি লাজুক!
শ্যামা। (আত্মগত) ছেলেটি খুব ভালো! কিন্তু একটু যেন লজ্জা কম ব’লে বােধ হয়! মন বশ করার কথাগুলাে শাশুড়ীর সাম্নে না ব’ল্লেই ভালাে হ’তো।
আশু। কিন্তু আপনি বিরক্ত হবেন না, আমার যা মনে উদয় হ’চ্চে আমি বলি, তা’র পরে―
শ্যামা। তা বাবা, সে-সব কথা এখন থাক্! আগে—
আশু। আমি ব’ল্ছিলেম, গানে যে মন বশ হয়, সে-ও তো শব্দমাত্র—মনের সঙ্গে তা’র যদি যোগ থাকে, তা হ’লে মন্ত্রের শব্দশক্তিকেই বা না মানি কী ব’লে?
শ্যামা। ঠিক কথা। মন্ত্রটা মানাই ভালো!
আশু। (সোৎসাহে) আপনার কাছে এ-সব কথা বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা,কিন্তু শাব্দী শক্তির সঙ্গে আত্মার যে একটি নিগূঢ় যোগ আছে তার স্বরূপ নিরূপণ করা কঠিন,—তর্কালঙ্কারমশায় বলেন,সে অনির্ব্বচনীয়। শাস্ত্রে যে বলে শব্দ ব্রহ্ম তা’র কারণ কী? ব্রহ্মই যে শব্দ বা শব্দই যে ব্রহ্ম, তা নয়—কিন্তু ব্রহ্মের ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে শব্দস্বরূপেই ব্রহ্মের প্রকাশ যেন নিকটতম। (নিরুপমার প্রতি) আপনি তো এ সকল বিষয় অনেক আলোচনা ক’রেচেন—আপনার কি মনে হয় না, রূপরসগন্ধ-স্পর্শের চেয়ে শব্দই যেন আমাদের আত্মার অব্যবহিত প্রত্যক্ষের বিষয়। সেই জন্যই এক আত্মার সঙ্গে আর এক আত্মার মিলন-সাধনের প্রধান উপায় শব্দ। আপনি কী বলেন? (স্বগত) মেয়েটি ভারি লাজুক।
শ্যামা। বলো না মা, যা জিজ্ঞাসা ক’র্চেন বলো! এতো বিদ্যে শিখ্লে, এই কথাটার উত্তর দিতে পার্চো না? বাবা, প্রথমদিন কি না, তাই লজ্জা ক’র্চে। ও যে কিছু শেখে নি, তা মনে কোরো না।
আশু। ওঁর বিদ্যার উজ্জ্বলতা মুখশ্রীতেই প্রকাশ পাচ্চে। আমি কিছুমাত্র সন্দেহ ক’র্চিনে।
শ্যামা। নিরু, মা, একবার ও-ঘরে যাও তো। (নিরুপমার প্রস্থান) দেখো বাবা, মেয়েটির বাপ নেই, সকল কথা আমাকেই কইতে হ’চ্চে— তুমি কিছু মনে কোরো না।
আশু। মনে ক’র্বো! বলেন কী? আপনার কথা শুন্তেই তো এসেছিলেম—বাচালের মতো কেবল নিজেই কতকগুলো ব’কে গেলেম। আমাকে মাপ ক’র্বেন।
শ্যামা। তোমার যদি মত থাকে, তাহ’লে একটা দিনস্থির ক’র্তে হ’চ্চে তো?
আশু। (স্বগত) আমি ভেবেছিলেম, আজই সমস্ত হ’য়ে যাবে। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার, তাই বোধ হয় হ’ল না। (প্রকাশ্যে) তা আস্চে রবিবারেই যদি স্থির করেন?
শ্যামা। বলো কী বাবা। আজ বৃহস্পতিবার, মাঝে তো কেবল দুটো দিন আছে!
আশু। এর জন্যে কি অনেক আয়োজনের দরকার হবে?
শ্যামা। তা হবে বৈ কি বাবা—যথাসাধ্য ক’র্তে হবে। ছাড়া, পাঁজি দেখে একটা শুভদিন স্থির ক’র্তে হবে তো।
আশু। তা বটে, শুভদিন দেখ্তে হবে বৈ কি! আসল কথা, যতো শীঘ্র হয়! আমার যে-রকম আগ্রহ, ইচ্ছে হ’চ্চে, এই মুহুর্ত্তেই—
শ্যামা। তা আমি অনর্থক দেরি কর্বো না বাবা। আস্চে অঘ্রাণমাসেই হ’য়ে যাবে। মেয়েটিরও বিবাহযোগ্য বয়স হ’য়ে এসেছে, ওকেও তো আর রাখা যাবে না।
আশু। ওঁর বিবাহ হ’য়ে গেলেই বুঝি—
শ্যামা। তাহ’লেই আবার আমি কাশীতে ফিরে যেতে পারি।
আশু। তাহ’লে তা’র আগেই আমাদের—
শ্যামা। সব ঠিক ক’রে নিতে হবে।
আশু। তবে দিনক্ষণ দেখুন!
শ্যামা। তুমি তো রাজি আছ বাবা!
আশু। বিলক্ষণ! রাজি যদি না থাক্বো তো এখানে এলেম কেন। আপনাকে নিয়ে কি আমি পরিহাস ক’র্চি! আমার সে-রকম স্বভাব নয়। আমি এখনকার ছেলেদের মতো এ সকল বিষয় নিয়ে তামাসা করিনে!
শ্যামা। তোমার আর মত বদ্লাবে না!
আশু। কিছুতেই না! আপনার পদস্পর্শ ক’রে আমি ব’ল্চি, আপনার কাছ থেকে যা গ্রহণ ক’র্তে এসেচি, তা আমি গ্রহণ ক’রে, তবে নিরস্ত হবো।
শ্যামা। দেওয়া থোওয়ার কথা কিছু হ’লো না যে!
আশু। আপনি কী চান্ বলুন্।
শ্যামা। আমি কী চাইবো বাবা! তুমি কী চাও, সেইটে বলো!
আশু। আমি কেবল বিদ্যে চাই, আর কিছু চাই নে!
শ্যামা। (স্বগত) ছেলেটি কিন্তু বেহায়া, তা ব’ল তেই হবে! ছি ছি ছি, বিদ্যেসুন্দরের কথা আমার কাছে পাড়্লে কী ক’রে? আমার নিরুকে বলে কি না বিদ্যে! (প্রকাশ্যে) তাহ’লে পানপাত্রটার কথা কী বলো বাবা!
আশু। (স্বগত) পানপাত্র! এঁর দেখ্চি সমস্তই শাক্তমতে। এদিকে কুমারী কন্যা, তা’র পরে আবার পানপাত্র! এইটে আমার ভালো ঠেক্চে না! (প্রকাশ্যে) তা মাতাজি, আপনি কিছু মনে, ক’র্বেন না—অবশ্য যে কাজের যা অঙ্গ তা ক’র্তেই হয়। কিন্তু ঐ যে পানপাত্রের কথা ব’ল্লেন, ওটা আমার দ্বারা হবে না।
শ্যামা। বাবা তোমরা এ কালের ছেলে, তোমরা ওটাকে অসভ্যতা মনে কর, কিন্তু আমি তো ওতে কোনো দোষ দেখিনে—
আশু। আপনি ওতে কোনো দোষই দেখেন না? বলেন কী মাতাজি?
শ্যামা। তা না হয় পানপাত্র রইলো, ওর জন্যে কিছু আট্কাবে না, এখন বিবাহের কথা তো পাকা?
আশু। কার বিবাহের কথা!
শ্যামা। তুমি আমাকে অবাক্ ক’র্লে বাপু! এতােক্ষণ কথাবার্ত্তার পর জিজ্ঞাসা ক’র্চো কার বিবাহের কথা! তােমারি তো বিবাহের কথা হ’চ্চিলো—কেবল পানপাত্রের কথা শুনে তুমি চম্কে উঠলে। তা পানপাত্র না হয় না-ই হ’লো।
আশু। (হতবুদ্ধিভাবে) ও, হাঁ, তা বুঝেচি, তাই হ’চ্চিলো বটে! (স্বগত) মস্ত একটা কী ভুল হ’য়ে গেচে। না বুঝে একেবারে জড়িয়ে প’ড়েচি। কী করা যায়! (প্রকাশ্যে) কিন্তু এতাে তাড়াতাড়ি কিসের, আর এক দিন এ সব কথা খােলসা ক’রে আলােচনা করা যাবে! কী বলেন?
শ্যামা। খােলসার আর কী বাকি রেখেচো বাবা! আর-এক-দিন এর চেয়ে আর কতাে খােলসা হবে। তাড়াতাড়ি তাে তুমিই ক’র্ছিলে। আস্চে রবিবারেই তুমি দিনস্থির ক’র্তে চেয়েছিলে!
আশু। তা চেয়েছিলুম বটে।
শ্যামা। তুমি দেখাশুনা ক’র্তে চাইলে ব’লেই আমি মেয়েকে তােমার সাক্ষাতে বের ক’র্লুম; তা’র গানও শুন্লে—এখন পানপাত্রের কথা শুনেই যদি বেঁকে দাঁড়াও, তা হ’লে তাে আমার আর মুখ দেখাবার জো থাক্বে না। তােমাকেই বা লােকে কী ব’ল্বে বাবা! ভদ্রলােকের মেয়ের সঙ্গে এমন ব্যবহার কি ভালো? আমার নিরু তােমার কাছে কী দোষ ক’রেছিলাে যে (ক্রন্দন)—
নিরুপমার দ্রুত প্রবেশ
নিরুপমা। মা, কী হয়েছে মা, অমন করে কাঁদ্চো কেন?
আশু। (স্বগত) কী সর্ব্বনাশ! আমাকে এঁরা সবাই কী মনে ক’র্বেন না জানি! (প্রকাশ্যে) কিছু হয় নি, আমি সমস্তই ঠিক ক’রে দিচ্চি। আপনারা কান্নাকাটি ক’র্বেন না। শুভকর্ম্মে ওতে অমঙ্গল হয়। (শ্যামার প্রতি) তা, আপনি একটা দিন স্থির ক’রে দিন্— আমার তা’তে কোনাে আপত্তি নেই।
শ্যামা। তা বাবা যদি ভালাে দিন হয়, তা হলে তুমি যা ব’লেছিলে, আস্চে রবিবারেই হয়ে যাক্। আমার আয়ােজনে কাজ নেই। এই ক-টা দিন তােমার মত স্থির থাক্লে বাঁচি।
আশু। অমন কথা ব’ল্বেন না—আমার মতের কখনাে নড় চড় হয় না।
শ্যামা। আমার পা ছুঁয়ে তো তাই ব’লেওছিলে, কিন্তু দশমিনিট্ না যেতেই এক পানপত্রের কথা শুনেই তােমার মত ব’দ্লে গেল।
আশু। তা বটে। পানপাত্রটা আমি আদবে পছন্দ করি না—
শ্যামা। কেন বলো তো বাবা?
আশু। তা ঠিক্ ব’ল্তে পার্চিনে—ওই আমার কেমন—বােধ হয়, ওটা—কী জানেন,পানপাত্রটা যেন-কে জানে ও কথাটাই কেমন—হঠাৎ শুন্লে কী যেন—তা এই বাড়িটার নম্বর কী বলুন দেখি।
শ্যামা। ওঃ, তাই বুঝি ভাব্চো? আমরা তােমাকে ভাঁড়াচ্চি নে বাবা! আমরাই উনপঞ্চাশ নম্বরে ছিলুম, কাল এই বাইশ নম্বরে উঠে এসেচি। যদি মনে কোনো সন্দেহ থাকে, উনপঞ্চাশ নম্বরে বরঞ্চ একবার খোঁজ করে আস্তে পারে।
আশু। (স্বগত) উঃ, কী ভুলই ক’রেচি! যা হােক্, এখন একটা পরিত্রাণের রাস্তা পাওয়া গেচে। অন্নদাকে এনে দিলেই সমস্ত গােল মিটে যাবে! যা হােক্, অন্নদার অদৃষ্ট ভালো। একএকবার মনে হ’চ্চে ভুলটা শেষ পর্য্যন্ত টেনে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না।
শ্যামা। কী বাবা! এতাে ভাবচো কেন? আমরা ভদ্রঘরের মেয়ে—তােমাকে ঠকাবার জন্যে পশ্চিম থেকে এখেনে আসিনি।
আশু। ও কথা ব’ল্বেন না, আমার মনে কোনাে সন্দেহ নেই। এখন আমি যাচ্চি―একঘণ্টার মধ্যে ফিরে আস্বো—আজকের দিনের মধ্যেই একটা সন্তোষজনক বন্দোবস্ত ক’র্বােই, এ আমি আপনার পা ছুঁয়ে শপথ ক’রে যাচ্চি।
শ্যামা। বাবা, ও শপথে কাজ নেই—পা ছুঁয়ে আরাে একবার শপথ ক’রেছিলে—
আশু। আচ্ছা, আমি আমার ইষ্টদেবতার শপথ ক’রে যাচ্চি, আজকের মধ্যেই সমস্ত পাকা ক’রে তবে অন্য কথা।
শ্যামা। (স্বগত) ছেলেটি কথাবার্ত্তায় বেশ, কিন্তু ওকে কিছুই বুঝবার জো নেই! কখনো বা তাড়া দেয়, কখনো বা ঢিল দেয়, অথচ মুখ দেখে ওর প্রতি অবিশ্বাসও হয় না।
আশু। তবে অনুমতি করেন তো এখন আসি!
শ্যামা। তা এসাে বাবা। (প্রণাম করিয়া আশুর প্রস্থান)।
পঞ্চম অঙ্ক
অন্নদা
অন্নদা। ব্যাপারখানা তো কিছুই বুঝতে পারলেম না। ঘটকের কথা শুনে এলেম কন্যা দেখতে। যিনি দেখা দিলেন, তাঁকে তো, বয়স দেখে কোনােমতেই কন্যার মা ব’লে মনে হয় না—চেহারা দেখে বােধ হলো অপ্সরী—যদিচ অপ্সরীর চেহারা কী রকম, পূর্ব্বে কখনাে দেখিনি। শেকহ্যাণ্ড ক’র্তে যেম্নি হাত বাড়িয়ে দিয়েচি, অমনি ফস ক’রে আমার হাতে কড়িবাঁধা একগাছি লাল সুতো বেঁধে দিলে। আর কেউ হ’লে গােলমাল ক’র্তেম—কিন্তু যে সুন্দর চেহারা, গােলমাল কর্বার জো কী। কিন্তু এ সমস্ত কোন্-দেশী দস্তুর, তা তত বুঝতে পার্চিনে।
মাতাজির প্রবেশ
মাতাজি। (স্বগত) অনেক সন্ধান ক’রে তবে পেয়েচি। আগে আমার গুরুদত্ত বশীকরণ মন্ত্রটা খাটাই, তা’র পরে পরিচয় দেবো। (অন্নদার কপালে নরকপাল ঠেকাইয়া) বলো, হুর্লিং।
অন্নদা। হুর্লিং।
মাতাজি। (অন্নদার গলায় জবার মালা পরাইয়া) বলল, কুড়বং কড়বং ক্ড়াং |
অন্নদা। (স্বগত) ছি ছি ভারি হাস্যকর হ’য়ে উঠ্চে। একে আমার কোটের উপর জবার মালা, তা’র উপরে আবার এই অদ্ভুত শব্দগুলো উচ্চারণ!
মাতাজি। চুপ করে রইলে যে!
অন্নদা। ব’ল্চি। কী ব’ল্ছিলেন বলুন!
মাতাজি। কুড়বং কড়বং ক্ড়াং!
অন্নদা। কুড়বং কড়বং ক্ড়াং (স্বগত) রিডিক্লাস।
মাতাজি। মাথাটা নীচু করাে। কপালে সিঁদুর দিতে হবে!
অন্নদা। সিঁদুর! সিঁদুর কি এই বেশে আমাকে ঠিক মানাবে।
মাতাজি। তা জানিনে, কিন্তু ওটা দিতে হবে। (অন্নদার কপালে সিঁদুর লেপন।)
অন্নদা। ইস্, সমস্ত কপালে যে একেবারে লেপে দিলেন!
মাতাজি। বলো বজ্রযােগিন্যৈ নমঃ। (অন্নদার অনুরূপ আবৃত্তি) প্রণাম করাে। (অন্নদাকর্ত্তৃক তথাকৃত) বলাে কুড়বে কড়বে নমঃ। প্রণাম করাে! বলে হুর্লিঙে ঘুর্লিঙে নমঃ! প্রণাম করাে!
অন্নদা। (স্বগত) প্রহসটা ক্রমেই জ’মে উঠচে!
মাতাজি। এইবার মাতা বজ্রযােগিনীর এই প্রসাদী বস্ত্রখণ্ড মাথায় বাঁধো!
অন্নদা। (স্বগত) এই শালুর টুক্রােটা মাথায় বাঁধতে হবে! ক্রমেই যে বাড়াবাড়ি হ’তে চ’ল্ল! (প্রকাশ্যে) দেখুন, এর চেয়ে বরঞ্চ আমি পাগ্ড়ি প’র্তেও রাজি আছি—এমন কি বাঙালিবাবুরা যে টুপি পরে তাও প’র্তে পারি—
মাতাজি। সে সমস্ত পরে হবে, আপাতত এইটে জড়িয়ে দিই!
অন্নদা। দিন!
মাতাজি। এইবারে এই পিঁড়িটাতে বসুন!
অন্নদা। (স্বগত) মুষ্কিলে ফেল্লে! আমি আবার ট্রাউজার প’রে এসেছি। যাই হােক্, কোনােমতে ব’স্তেই হবে! (উপবেশন)
মাতাজি। চোখ বােজো। বলো, খটকারিণী, হঠবারিণী, ঘটসারিণী, নটতারিণী ক্রং! প্রণাম করো। (অন্নদার তথাকরণ) কিছু দেখতে পাচ্চো?
অন্নদা। কিচ্ছু না।
মাতাজি। আচ্ছা, তা হ’লে পূবমুখাে হ’য়ে ব’সাে—ডান কানে হাত দাও। বলাে খটকারিণী, হঠবারিণী, ঘটসারিণী, নটতারিণী ক্রং। প্রণাম করো। এবার কিছু দেখ্তে পাচ্চো?
অন্নদা। কিছু না।
মাতাজি। আচ্ছ। তা হ’লে পিছন ফিরে বসো! দুই কানে দুই হাত দাও! বলো খটকারিণী হঠবারিণী ঘটমারিণী নটতারিণী ক্রং। কিছু দেখ্তে পাচ্চো?
অন্নদা। কী দেখতে পাওয়া উচিত, আগে আমাকে বলুন?
মাতাজি। একটা গর্দ্দভ দেখতে পাচ্চো তো?
অন্নদা। পাচ্চি বৈ কি! অত্যন্ত নিকটে দেখতে পাচ্চি।
মাতাজি। তবে মন্ত্র ফ’লেছে। তা’র পিঠের উপরে—
অন্নদা। হাঁ হাঁ তার পিঠের উপরে একজনকে দেখতে পাচ্চি বৈ কি।
মাতাজি। গর্দ্দভের দুই কান দুই হাতে চেপে ধ’রে—
অন্নদা। ঠিক ব’লেচেন, কোসে চেপে ধ’রেচে—
মাতাজি। একটি সুন্দরী কন্যা—
অন্নদা। পরমা সুন্দরী—
মাতাজি। ঈশানকোণের দিকে চ’লেচেন—
অন্নদা। দিক ভ্রম হয়ে গেচে—কোন্ কোণে যাচ্চেন তা ঠিক ব’ল্তে পার্চিনে! কিন্তু ছুটিয়ে চ’লেচেন বটে! গাধাটার হাঁফ ধ’রে গেল।
মাতাজি। ছুটিয়ে যাচ্চেন না কি? তবে তো আর একবার—
অন্নদা। না, না, ছুটিয়ে যাবেন কেন—কী-রকম যাওয়াটা আপনি স্থির ক’র্চেন বলুন দেখি?
মাতাজি। একবার এগিয়ে যাচ্চেন, আবার পিছু হ’টে পিছিয়ে আস্চেন।
অন্নদা। ঠিক তাই! এগােচ্চেন আর পিচোচ্চেন! গাধাটার জিভ বেরিয়ে প’ড়েছে।
মাতাজি। তা হলে ঠিক হয়েছে। এবার সময় হ’লাে। ওলো মাতঙ্গিনী তােরা সবাই আয়!
হুলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনি করিতে করিতে স্ত্রীদলের প্রবেশ
(অন্নদার বামে মাতাজির উপবেশন ও তাহার হস্তে হস্তস্থাপন)
অন্নদা। এটা বেশ লাগচে, কিন্তু ব্যাপারটা কী ঠিক্ বুঝতে পার্চিনে।
রমণীগণের গান
এবার সখি সােনার মৃগ
দেয় বুঝি দেয় ধরা!
আয় গো তােরা পুরাঙ্গনা
আয় সবে আয় ত্বরা!
ছুটেছিলাে পিয়াসভরে
মরীচিকা-বারির তরে,
ধ’রে তা’রে কোমল করে
কঠিন ফাসি পরা’!
দয়ামায়া করিস্নে গাে,
ওদের নয় সে ধারা!
দয়ার দোহাই মান্বে না যে
এক্টু পেলেই ছাড়া!
বাঁধন-কাটা বন্যটাকে
মায়ার ফাঁদে ফেলাও পাকে,
ভুলাও তা’কে বাঁশির ডাকে
বুদ্ধিবিচারহরা!
অন্নদা। বুদ্ধিবিচার একেবারেই যায় নি! অতি সামান্যই বাকি আছে। তা’র থেকে মনে হ’চ্চে, ঐ যে যাকে জন্তু-জানােয়ার বলা হ’লো, সে সৌভাগ্যশালী আমি ছাড়া, উপস্থিত ক্ষেত্রে, আর কেউ হ’তেই পারে না! গানটি ভালো, সুরটিও বেশ, কণ্ঠস্বরও নিন্দা করা যায় না— কিন্তু রূপক ভেঙে সাদাভাষায় একটু স্পষ্ট ক’রে সবটা খুলে বলুন দেখি, —আমার সম্বন্ধে আপনারা কী ক’র্তে চান্! পালাবো এমন আশঙ্কা ক’র্বেন না, আপনারা তাড়া দিলেও নয়। কিন্তু কোথায় এলুম, কেন এলুম, কোথায় যাবাে, এ সকল গুরুতর প্রশ্ন মানবমনে স্বভাবতই উদয় হ’য়ে থাকে।
মাতাজি। তােমার স্ত্রীকে কি মাঝে মাঝে স্মরণ করাে?
অন্নদা। ক’রে লাভ কী, কেবল সময় নষ্ট! তাঁকে স্মরণ ক’রে যেটুকু সুখ, আপনাদের দর্শন ক’রে তা’র চেয়ে ঢের বেশি আনন্দ!
মাতাজি। তােমার স্ত্রী যদি তােমাকে স্মরণ ক’রে সময় নষ্ট করেন?
অন্নদা। তা হ’লে তাঁর প্রতি আমার উপদেশ এই যে, আর অধিক নষ্ট করা উচিত হয় না—হয় বিস্মরণ ক’র্তে আরম্ভ করুন, নয় দর্শন দিন, সময়টা মূল্যবান জিনিষ!
মাতাজি। সেই উপদেশই শিরােধার্য্য। আমিই তােমার সেবিকা শ্রীমতী মহীমােহিনী দেবী।
অন্নদা। বাঁচালে! মনে যে-রকম ভাবােদ্রেক ক’রেছিলে, নিজের স্ত্রী না হ’লে গলায় দড়ি দিতে হ’তাে। কিন্তু নিজের স্বামীর জন্যে এ সমস্ত ব্যাপার কেন?
মাতাজি। গুরুর কাছে যে বশীকরণমন্ত্র শিখেছিলেম, আগে সেইটে প্রয়ােগ ক’রে তবে আত্মপরিচয় দিলেম, এখন আর তােমার নিষ্কৃতি নেই।
অন্নদা। আর কারাে উপর এ মন্ত্রের পরীক্ষা করা হ’য়েচে?
মাতাজি। না তােমার জন্যেই এতোদিন এ মন্ত্র ধারণ ক’রে রেখেছিলেম! আজ এর আশ্চর্য্য প্রত্যক্ষফল পেয়ে গুরুর চরণে মনে মনে শতবার প্রণাম ক’র্চি। অব্যর্থ মন্ত্র! মন্ত্রে তােমার কি বিশ্বাস হ’লাে না?
অন্নদা। বশীকরণের কথা অস্বীকার ক’র্তে পারি নে! এখন তােমাকে এক বার এই মন্ত্রগুলাে পড়িয়ে নিতে পার্লে আমি নিশ্চিন্ত হই।
(দাসীকর্ত্তৃক সম্মুখে আহার্য্য স্থাপন)
অন্নদা। এ-ও বশীকরণের অঙ্গ। বন্যমৃগই হােক্,আর সহুরে গাধাই হােক্, পােষ মানাবার পক্ষে এটা খুব দরকারী। (আহারে প্রবৃত্ত)
আশুর দ্রুত প্রবেশ। মাতাজি প্রভৃতির প্রস্থান
আশু। ওহে অন্নদা, ভারি গােলমাল বেধে গেচে। বাঃ, তুমি যে দিব্যি আহার ক’র্তে ব’সেচো! তােমার এ কী রকমের সাজ! (উচ্চহাস্য) ব্যাপারখানা কী! নরমুণ্ড, খাঁড়া, বাতি, জবার মালা? তােমার বলিদান হবে না কি?
অন্নদা। হ’য়ে গেচে।
আশু। হ’য়ে গেচে কী রকম?
অন্নদা। সে সকল ব্যাখ্যা পরে ক’র্বো। তােমার খবরটা আগে বলো।
আশু। তুমি বিবাহের জন্যে যে কন্যাটিকে দেখবে ব’লে স্থির ক’রেছিলে, তাঁরা হঠাৎ উনপঞ্চাশ নম্বর থেকে বাইশ নম্বরে উঠে গেচেন। আমি কন্যার বিধবা মাকে মাতাজি মনে ক’রে বরাবর এমন নির্ব্বোধের মতো কথাবার্ত্তা ক’য়ে গেচি যে, তাঁরা ঠিক ক’রে নিয়েচেন —আমি মেয়েটিকে বিবাহ ক’র্তে সম্মত হ’য়েচি। এখন তুমি না গেলে তো আর উদ্ধার নেই।
অন্নদা। মেয়েটি দেখতে কেমন?
আশু। দেবকন্যার মতো।
অন্নদা। তা হােক্, বহুবিবাহ আমার মতবিরুদ্ধ।
আশু। বলাে কী? সেদিন এতাে তর্ক ক’র্লে—
অন্নদা। সেদিনকার চেয়ে ঢের ভালো যুক্তি পাওয়া গেচে—
আশু। একেবারে অখণ্ডনীয়?
অন্নদা। অখণ্ডনীয়।
আশু। যুক্তিটা কীরকম দেখা যাক্!
অন্নদা। তবে একটু ব’সাে। (প্রস্থান ও মাতাজিকে লইয়া প্রবেশ) ইনি আমার স্ত্রী শ্রীমতী মহীমােহিনী দেবী।
আশু। অ্যাঁ! ইনি তােমার—আপনি আমাদের অন্নদার—কী আশ্চর্য্য তা হ’লে তাে হ’তে পারে না!
অন্নদা। হতে পারে না কী ব’ল্চো! হ’য়েচে, আবার হ’তে পারে না কি! একবার হ’য়েচে, এই আবার দু-বার হ’লো, তুমি ব’ল্চো হ’তে পারে না!
আশু। আমি তা ব’ল্চিনে। আমি ব’ল্চি, সেই বাইশ নম্বরের কী করা যায়।
অন্নদা। সে আর শক্ত কী! সহজ উপায় আছে।
আশু। কী বলো দেখি!
অন্নদা। বিয়ে করে ফেলো!
আশু। সমস্ত বিসর্জ্জন দেবো—আমার হঠযোগ, প্রাণায়াম, মন্ত্রসাধন—
অন্নদা। ভয় কী, তুমি যেগুলো ছাড়বে, আমি সেগুলো গ্রহণ ক’র্বো। সে যাই হোক, তোমার বশীকরণটা কীরকম হ’লো?
আশু। তা নিতান্ত কম হয় নি। তোমার এই একটা ঠাট্টা কর্বার বিষয় হ’লো!
অন্নদা। আর ঠাট্টা চ’ল্বে না।
আশু। কেন বলো দেখি?
অন্নদা। আমারো বশীকরণ হয়ে গেচে।
আশু। চ’ল্লেম। এক ঘণ্টার মধ্যেই যাবার কথা আছে। কথাটা পাকা ক’রে আসি গে!