ব্রজবিলাস/প্রথম পরিশিষ্ট

প্রথম পরিশিষ্ট।

 জনমেজয় খুড় মহাশয় যখন উপাধি পান, সে সময়ে আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। এজন্য, তিনি কি উপাধি পাইলেন, শুনিতে পাই নাই। পার্শ্ববর্ত্তী লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করাতে, কেহ কেহ কহিলেন “কপিরত্ন”, কেহ কেহ কহিলেন, “কবিরত্ন। আমি বিষম সঙ্কটে পড়িলাম। উভয় পক্ষে লোকসংখ্যা সমান, সুতরাং, অধিকাংশের মতে কার্য্য শেষ করিবার পথ ছিল না। অবশেষে, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, আপাততঃ “কপিরত্ন” বলাই সাব্যস্ত করিলাম। কারণ, যদি উত্তর কালে কবিরত্ন বলিতে হয়, তাহায় পথ পরিষ্কার রহিল। কপ্-ই এই দুরের সন্ধি করিলে, কবি হইতে পারিবেক। কিন্তু, এখন কবিরত্ন বললে, যদি উত্তর কালে কপিরত্ন বলা আবশ্যক দাঁড়ায়, তাহার আর উপায় থাকিবেক না। ব্যাকরণের সূত্র অনুসারে, স্বরবর্ণ পরে থাকিলে, পদের অন্তস্থিত প স্থানে ব হয়; কিন্তু, ব স্থানে প হইবার বিধান নাই। যদি কেহ আপত্তি করেন, প স্থানে যে ব হয়, তাহা বর্গীয়; কিন্তু, কবি শব্দের ব আন্তঃস্থা; এমন স্থলে, ওরূপ সন্ধি দ্বারা, কি রূপে, কবিশব্দ সম্পন্ন করিবে। ইহার উত্তর এই, যখন এ দেশে উভয় বকারের, কি আকার, কি উচ্চারণ, কোনও অংশে কোনও প্রভেদ নাই, তখন বর্গীয় ও অন্তঃস্থা বকারের কথা ভুলিয়া, আপত্তি উত্থাপন করা খাটি বোকার কর্ম্ম।

 এক গ্রামে দুই বিদ্যাবাগীশ খুড় ছিলেন। ইঁহারা দুই সহোদর। জ্যেষ্ঠ নৈয়ায়িক, কনিষ্ঠ স্মার্ত্ত। এক দিন, এক ব্যক্তি ব্যবস্থা জানিতে গিয়াছিলেন। স্মার্ত্ত বিদ্যাবাগীশ বাটীতে নাই শুনিয়া, তিনি চলিয়া যাইতেছেন দেখিয়া, নৈয়ায়িক বিদ্যাবাগীশ জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি জন্যে আসিয়াছ। তিনি কহিলেন, আমার একটা তিন বৎসরের দৌহিত্র মরিয়াছে; তাহাকে পুতিব বা পোড়াইব, ইহার ব্যবস্থা জানিতে আসিয়াছি। নৈয়ায়িক অনেক ভারিয়া চিন্তিয়া কহিলেন, তাহাকে পুতিয়া ফেল। সে ব্যক্তি জানিতেন, তিন বৎসরের ছেলেকে পোড়াইতে হয়, পুভিতে হয় না; তথাপি, সন্দেহ করিয়া, জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছিলেন। এক্ষণে, পুতিতে হইবে, এই ব্যবস্থা শুনিয়া, তিনি সন্দিগ্ধ মনে ফিরিয়া যাইতেছেন; এমন সময়ে, পথিমধ্যে, স্মার্ত্তের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, জিজ্ঞাসিলেন, পুতিব না পোড়াইব। তিনি পোড়াইতে বলিলেন। তখন সে ব্যক্তি কহিলেন, তবে বড় মহাশয় পুতিতে বলিলেন, কেন। স্মার্ত্ত, জ্যেষ্ঠের মান রক্ষার জন্য, কহিলেন, তিনি পরিহাস করিয়াছেন। অনন্তর তিনি, বাটীতে গিয়া, জ্যেষ্ঠকে কহিলেন, কি বুঝিয়া আপনি এমন ব্যবস্থা দিলেন; পোড়াইবার স্থলে পুতিতে বলা, অতি অন্যায় হইয়াছে। নৈয়ায়িক কহিলেন, আমি অনেক বিবেচনা করিয়াই, পুতিতে বলিয়াছি। পুতিয়া রাখিলে, যদি পোড়াইবার দরকার হয়, ভুলিয়া পোড়াইতে পারিবেক; কিন্তু, যদি পোড়াইতে বলিতাম, তখন পোড়াইয়া ফেলিলে, যদি পুতিবার দরকার হইত, তখন কোথায় পাইত।

 যেমন পোড়াইবার দরকার হইলে, তুলিয়া পোড়াইতে পারিবেক, এই বিবেচনা করিয়া, নৈয়ায়িক পুতিবার ব্যবস্থা দিয়াছিলেন; সেইরূপ, কবিরত্ন বলা আবশ্যক হইলে, প স্থানে ব করিলেই চলিবেক, এই বিবেচনায়, উত্তর কালের পথ পরিষ্কার রাখিয়া, আমি কপিরত্ন উপাধিই সাব্যস্ত করিলাম; পরে যদি প্রমাণ প্রয়োগ দ্বারা প্রতিপন্ন হয়, খুড় মহাশয় কবিরত্ন উপাধি পাইয়াছেন; তখন, পুর্ব্বোক্ত প্রণালীতে, প স্থানে ব করিলেই, সর্বাংশে নিখিরকিচ হইবেক।

 কপিরত্ন উপাধি সাব্যস্ত রাখিবার জন্য, যে প্রবল যুক্তি ও উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখাইলাম, তাহা অকাট্য; কার বাপের সাধ্য, তাহাতে দন্তস্ফুট করে। এমন কি, “নবদ্বীপচন্দ্র, পণ্ডিতগণ্য, সুপ্রসিদ্ধ বাগ্মী,” নৈয়ায়িক পালের গোদা, শ্রীযুত ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন খুড় মহাশয়, সাহস করিয়া, ভাহার প্রতিবাদ করিতে অগ্রসর হইতে পারিবেন না।

 কিঞ্চ, শাস্ত্রকারেরাও ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন,

“প্রথমোপস্থিতপরিত্যাগে প্রমাণাভাবঃ”।

যাহা প্রথম উপস্থিত, তাহার পরিত্যাগ অপ্রামাণিক।

বর্ণমালা পাঠ করিতে আরম্ভ করিতে, প প্রথম উপস্থিত হয়, তৎপরে ব; এমন স্থলে, প পরিত্যাগ করিয়া ব ধরিতে গেলে, অর্থাৎ কপিরত্ন না বলিয়া কবিরত্ন বলিলে, উপরি দর্শিত প্রামাণিক ব্যবস্থার অপ্রামাণ্য ঘটে।

 অপিচ, প অক্ষরটি মোলায়েম, ব অক্ষরটি কড়া; জনমেজয় ধুড় যেরূপ রসিকের চূড়ামণি, তাঁহার উপাধিটি যত মোলায়ম অক্ষরে বানান যাইবেক, ততই মানানসই হইবে; এ বিবেচনাতেও, কপিরত্ন বলাই উচিত ও আবশ্যক। সভায় উপস্থিত বিদ্যাবাগীশ পালের মধ্যে, যদি কেহ বহুদর্শী আলঙ্কারিক থাকেন, তিনিই এই মীমাংসাটির প্রকৃত রূপ তাৎপর্য্য গ্রহণ করিতে পারিবেন। স্মার্ত্ত নৈয়ায়িক প্রভৃতি পালের গোদারা, ফেলফেল করিয়া চাহিয়া থাকিবেন, ভিতরে প্রবেশ করিতে পারিবেন না।

 অপরঞ্চ, প্রামাণিক লোকের মুখে শুনিতে পাওয়া যায়, ঘটকচূড়ামণি, প্রথম দশায়, “কচি পাঁঠা” এই অপুর্ব উপাধি পাইয়াছিলেন। বোকা পাঁঠা উপাধি হইলে, তিনি লোকালয়ে অধিকতর বলবিক্রমশালী বলিয়া প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিবেন, এই প্রবল যুক্তি দেখাইয়া, কেহ কেহ কচি শব্দ স্থলে বোকা শব্দ বসাইতে চাহিয়াছিলেন। এ বিষয়ে নানা তর্ক ও বিস্তর বাদানুবাদও হইয়াছিল। অবশেষে, “বোকা পাঁঠা” অপেক্ষা কচি পাঁঠা” মোলায়ম, নিরবচ্ছিন্ন এই বিবেচনায়, “কচি পাঁঠা উপাধিই সাব্যস্ত হয়। এ অনুসারে, কপিরত্ন উপাধি সাব্যস্ত হওয়াই, ঘটকচূড়ামণি খুড় মহাশয়ের পক্ষে, সর্ব্বতোভাবে বিধিসিদ্ধ হইতেছে।