ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস/অষ্টম উপদেশ
অষ্টম উপদেশ।
স্বর্গ ও নরক।
স্বর্গ নরকের ভব কিছু না কিছু সকল ধর্ম্মেতেই পাওয়া যায়। যেখানে পাপ পুণ্যের কথা কিছু আছে—যে ধর্ম্মে কর্ত্তব্যের ভাব কিছু মাত্র পরিস্কুটিত হইয়াছে; সেখানে স্বর্গ নরকের কোন না কোন প্রকার প্রসঙ্গ অবশ্যই পাওয়া যায়। সকল ধর্ম্মেতেই পাপ-লোক দুঃখময় এবং পুণ্যলোক সুখের ধাম বলিয়া বর্ণনা আছে। সকল ধর্ম্মেরই এই উপদেশ যে পরম ন্যায়বান্ পরমেশ্বর পরলোকে পাপ পুণ্যের ফলাফল ন্যায্য রূপে বিধান করিবেন। আমরা সহজ জ্ঞানে যাহা পাইতেছি, ব্রাহ্মধর্ম্মে সংক্ষেপের মধ্যে তাহার সকলই আছে। “পূণ্যং কুর্ব্বন্ পুণ্যকীর্ত্তিঃ পুণ্যং স্থানং স্ম গচ্ছতি। পাপং কুর্ব্বন্ পাপকীর্ত্তিঃ পাপমেবাশ্মুতে ফলং।” কিন্তু সেই পুণ্যফল আর পাপফল বিশেষ করিয়া বলিতে গিয়াই নানা ভ্রমের উৎপত্তি হইয়াছে। ধর্ম্মেতেই মুখ এবং পাপেতেই দুঃখ, এই আমরা সহজ জ্ঞানে জনিয়েছি। কিন্তু যেখানে সেই সুখের ভাব ও দুঃখের ভাব সবিশেষ বর্ণন করা হইয়াছে, সেখানে সত্যের পরিবর্ত্তে কল্পনাই স্থান পাইতেছে। ধর্ম্মের সঙ্গে সুখের কি প্রকার আর পাপের সঙ্গেও দুঃখেরই বা কি প্রকার সম্বন্ধ, তাহা বিবেচনা করিয়া দেখিলেই স্বর্গ নরকের ভাব অনেক বুঝা যাইবে।
সুখ কি? আমাদের সমুদয় বৃত্তির চরিতার্থতাতেই সুখ। আমাদের কোন এক বৃত্তি নিদ্রিত থাকিলে সুখের একটি দ্বার রুদ্ধ হইল। মনুষ্যের ইন্দ্রিয়-প্রবৃত্তি-সকল বাহ্য বিষয়ের প্রতি উন্মুখ রহিয়াছে, তাঁহার মানস-রসনা সৌন্দর্য্য রসপান করিবার জন্য উৎসুক রহিয়াছে, তাঁহার বুদ্ধিবৃত্তি সকল জ্ঞান এবং সত্যের দিকেই প্রসারিত হইতেছে, তাঁহার হৃদয় প্রেম-ক্ষুধা শান্তির নিমিত্তে নিয়ত ব্যাকুলিত হইতেছে, তাঁহার ধর্ম্ম-প্রকৃতি শ্রেয়কে অবলম্বন করিয়াই চরিতার্থ হইতেছে এবং তজ্জনিত বিমল আত্ম-প্রসাদেই পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইতেছে, তাঁহার ঈশ্বর-স্পৃহা বিষয়ের স্থূল আবরণ ছেদ করিয়া অদৃশ্য অলক্ষ্য বিষয়া— তীত ঈশ্বরকে পাইয়া চরিতার্থ হইতেছে। মনুষ্য যদি সম্পূর্ণ রূপে সুখী হইতে চাহেন, তবে তাঁহার জন্য অর্থ, জ্ঞান, প্রেম, ধর্ম্ম, ঈশ্বর, এ সকলই আবশ্যক। আমাদের কোন এক বৃত্তি কোন এক ইচ্ছা অসম্পন্ন থাকিলে তজ্জনিত সুখ হইতে বঞ্চিত হইতে হয়। আমাদের সুখ যখন এমত বিভিন্ন প্রকার, তখন ইহা স্পষ্টই রহিয়াছে, যে এসমুদায় সুখ এক কালে উপভোগ করা আমাদের সাধ্য হয় না। ইন্দ্রিয় লোলুপ ব্যক্তি বুদ্ধি জনিত ও ধর্ম্ম-জনিত সুখভোগে সমর্থ হয় না। ধার্মিক ব্যক্তির অনেক সময় বিষয় সুখে বঞ্চিত হইতে হয়। আমাদের হৃদয়ে কোন দুঃসহ পরিতাপ উপস্থিত হইলে ইন্দ্রিয়-সুখ বিজ্ঞানসুখ ইহার কিছুই আস্বাদন করিতে পারি না এবং ইহাও দেখা গিয়াছে যে ধর্ম্ম-যোদ্ধাগণ ধর্ম্ম-বর্ম্মে আবৃত থাকিয়া বিপক্ষদিগের সহস্র প্রকার অত্যাচারকে তুচ্ছ করিয়াছে। তাহাদের আত্মার শান্তি কেহই হরণ করিতে পারে নাই। “প্রসাদে সর্ব্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে।” ইহা হইতে আমরা এক নিয়ম এই পাইতেছি, যে যহৎ এবং পবিত্র সুখ উপভোগ করিতে হইলে নিকৃষ্ট সুখকে অনেক সময় পরিত্যাগ করিতে হইবে। বিষয়ের সঙ্গে যেমন আমাদের বিষয়-সুখ, ধর্ম্মের সঙ্গে সেই রূপ আত্ম-প্রসাদ এবং ঈশ্বরের সঙ্গে ব্রহ্মানন্দের উপভোগ হয়। এই ধর্ম্ম-জনিত আত্ম-প্রসাদ এবং ঈশ্বরের সহবাস জনিত ব্রহ্মানন্দ আমাদের চিরজীবনের সম্বল। বিষয়ের যোগে যে সুখ, তাহা বিষয়ের বিচ্ছেদেই চলিয়া যাইবে; কিন্তু ধর্মের আনন্দ ও ব্রহ্মানন্দ আমাদের অক্ষয়ধন। মনুষ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার ধর্ম্ম-প্রকৃতি ক্রমিকই প্রশস্ত ও উন্নত হইতে থাকিবে এবং তজ্জনিত আনন্দ আরো অধিক হইতে থাকিবে। যৌবন কালে যেমন নূতন নূতন সুখের প্রস্রবণ প্রমুক্ত হইয়া শৈশব-কালের সুখ সমুদায়কে অতিক্রম করে; আত্মার উন্নতাবস্থাতেও সেই রূপ জ্ঞান, ধর্ম্ম, ঈশ্বরপ্রীতি, এই সকল হইতেই আনন্দ ধারা নিঃসৃত হইয়া নিকৃষ্ট সুখ সমুদয়কে অতিক্রম করিয়া উঠিবে।
ধর্ম্মের সঙ্গে আত্ম-প্রসাদের সঙ্গেই বিশেষ যোগ, বিষয়-সুখের সঙ্গে সে প্রকার নাই। আমাদের আস্বাদন না থাকিলে যেমন আহারের বিচার থাকিত না, সেই রূপ আত্ম-প্রসাদ না থাকিলে আমরা ধর্ম্মের মাধুর্য্য গ্রহণ করিতে পারিতাম না; সুতরাং অনেক স্থলে ধর্ম্মানুষ্ঠানের বিশেষ ব্যাঘাত জন্মিত। আমরা নিস্বার্থভাবে ধর্ম্ম-কার্য্য সাধন করিলেই ঈশ্বর আমাদের আত্মাতে আত্ম-প্রসাদ প্রেরণ করেন। বিষয়-সুখ যদিও অনেক সময় ধর্মের বিরোধী হয়; কিন্তু আত্ম-প্রসাদ বিশ্বাসী অনুচরের ন্যায় তাহার সঙ্গে থাকিয়া আমাদিগকে ধর্ম্ম-কার্য্যে আরো উৎসাহ দিতে থাকে, বিষয়-মুখ ধর্ম্মের নিয়ত সঙ্গী নহে! ধর্ম্মকেই সাধন করিতেই হইবে; তাহার আনুষঙ্গিক বিষয়-সুখ পাওয়া যার ভালই, না যায় তাহাতেই বা কি? আমাদের সকল বৃত্তির চরিতার্থতাতেই সুখ, তাহাদের মধ্যে ধর্ম্মের বিরোধী সুখকে পরিত্যাগ করতে ধর্ম্ম। ধর্ম্মকে রক্ষা করিতে হইলে বিষয়-সুখ অনেক সময় বিসর্জ্জন করিতে হইবে, কষ্টকে আদর পূর্ব্বক গ্রহণ করিতে হইবে। আমাদের যৌবন কালে সকল প্রবৃত্তিই সমুন্নত হয়। এই সময়ে আমাদের আমোদ-স্পৃহা, লোকানুরাগ, বিষয়-লালসা, সকলই প্রবল হইয়া উঠে। এই কলেই আমাদের ইচ্ছার সঙ্গে ধর্ম্মের সঙ্গে সর্ব্বদা বিরোধ উপস্থিত হয়। মনের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করিলেই তাহাতে আমাদের সুখ; ধর্ম্মের অদেশে সেই সুখকে বিসর্জ্জন করিলে আত্ম-প্রসাদ থাকে। ধর্ম্মকে রক্ষা করিতে গেলে অনেক সময় বিষয়-সুখকে পরিত্যাগ করিতে হইবে; কিন্তু তাহাতে ধর্ম্ম-জনিত আনন্দ আরো অধিক উজ্জ্বল হইতে থাকিবে। নিঃস্বার্থ ধর্ম্ম কার্য্যের ফল আত্ম-প্রসাদ; ইন্দ্রিয়-মুখ ধর্ম্মের নিকট হইতে প্রার্থনা করা বৃথা।
সুখ এবং আত্ম-প্রসাদ এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ নির্দ্দেশ করলে অনেক ভ্রম দূর হইতে পারে। কেহ কেহ বলেন, ঈশ্বরের রাজ্যে বিচার নাই; ধার্ম্মিকেরাই অধিক দুঃখী, পাপীরাই এ সংসারে সুখে আছে। হিতৈষণা, ন্যায়, সত্য অবলম্বন করিতে গেলেই ধনমান মর্য্যাদার হানি উপস্থিত হয়। অতএব সংসারে সুখে থাকিতে গেলে ধর্ম্ম রক্ষা কোন ক্রমেই হয় না।
আমরা ধার্ম্মিক হইলে সংসারের সকল সুখ সম্পদ ভোগ করতে পাইব, ঈশ্বর আমাদের মঙ্গলের জন্যই এ রূপ বিধান করেন নাই। তিনি আমাদের সুখ তত চাহেন না, যত আমাদের ধর্ম্ম চাহেন। যদি ধার্মিক হইবামাত্র আমাদের সমুদায় কামনা চরিতার্থ হইত, তবে ধর্ম্মের কোন মূল্য, কোন বলই থাকিত না। ধর্ম্মের এ প্রকার উদার ভাব যে আমরা যদি সুখ উদ্দেশ করিয়া ধর্ম্ম সাধন করি, তবে তাহার পবিত্রতার হানি হয়। ত্যাগই ধর্ম্মের প্রাণ-স্বরূপ: কিন্তু আমরা যদি ভাবি লাভের উদ্দেশে ত্যাগ আপাততঃ স্বীকার করি, তবে ধর্ম্মতঃ সে ত্যাগই নহে। ধর্ম্মের জন্য সম্যক ত্যাগ স্বীকার কৱিতে হইবে। ধর্ম্মকে ধর্মের জন্যই আলিঙ্গন করিতে হইবে। আমরা যদি ভাবি সুখের প্রত্যশায় বর্ত্তমান সুখ পরিত্যাগ করি, তবে তাহা ধর্ম্ম-সাধন হইল না, স্বার্থ সাধন মাত্র। ধর্ম্মের দেশ বলিয়াই কার্য্য করিতে হইবে; তাহাতে অন্য কোন গুপ্ত অভিসন্ধি থাকিলে হইবে না। এ স্থলে বিষয়-সুখের সঙ্গে ধর্ম্মের সঙ্গে কেমন বিরোধ; আমাদের সম্পর্ণ লোভ-শূন্য হইয়া ধর্ম্মানুষ্ঠান করিতে হইবে। তবে ঈশ্বর যদি তাহার পুরস্কার দেন; তিনি যদি আমাদের কষ্টের শতগুণ সুখ আমাদের জন্য সঞ্চিত করিয়া রাখেন; তবে ইহাতে তাঁহার কৃপা ভিন্ন আর কিছুই নাই, ইহাতে আমাদের নিঃস্বার্থ ভাবের কোন হানি হইল না।
বিষয়-সুখের সঙ্গে ধর্ম্মের বিরোধ থাকাতেই ধর্ম্মের যথার্থ মাহাত্ম্য প্রকাশ পাইতেছে। আমাদের যা ইচ্ছা, তাহাই যদি ধর্ম্ম হইত; আমাদের স্বেচ্ছাচার তার কর্ত্তব্যে যদি কোন প্রভেদ না থাকিত; তবে ধর্ম্ম-কার্য্যের মূল্য কি থাকিত? আমরা, আপনা হইতে ধর্ম্ম পথে যাই ঈশ্বরের ইচ্ছা এই; এবং এই হেতু তিনি আমাদিগকে স্বাধীন করিয়া দিয়াছেন। আমাদের সম্মুখে সৎপথ অসৎ পথ দুইই রহিয়াছে এবং এই দুয়ের মধ্যে যাহা ইচ্ছা আমরা বাছিয়া লইতে পারি, এই কর্ত্তৃত্ব ভারও রহিয়াছে। যখন ইচ্ছা পূর্ব্বক সৎকে অবলম্বন করাতেই ধর্ম্ম, তখন যদি ধর্ম্মের বিরোধী ইচ্ছা আমাদের কিছুই না থাকিত, তাহা হইলে আমাদের ধর্ম্মের উপার্জন কি হইত? সংসারের কোন প্রলোভনই যদি আমাদিগকে ধর্ম্ম-পথ হইতে আকর্ষণ করিবার জন্য আমাদের সম্মুখে না আসিত, তবে ধর্ম্ম রক্ষার গৌরব কি থাকিত? যাই ধর্ম্মের বিরোধী বিষয়সকল আমাদিগকে আকর্ষণ করিতেছে, খাই আমরা বল পুর্ব্বক সেই সকল বিষয়ের প্রতিশ্রোতে যাইতেছি; তাহাতেই আমরা ধর্ম্মের গুরুত্ব উপলব্ধি করিতেছি। ঈশ্বর যদি কেবল আমাদিগকে সুখী করিবার ইচ্ছা করিতেন, তবে ধর্ম্ম না দিয়াও সুখী করিতে পারিতেন। কিন্তু যখন তাঁহার শুভ অভিপ্রায় এই যে আমরা ধর্ম্ম-বল উপার্জ্জন করিয়া তাঁহার নিকটবর্ত্তী হইতে থাকি, তখন আমাদের লক্ষ্য কি বিষয়-সুখ হওয়া উচিত? না ধর্ম্মের জন্য বিষয়সুখের হানিকে হানি বোধ করা উচিত?
আমরা এখানে দুই প্রকার অবস্থা দেখিতে পাই। অনেক স্থলে ধর্ম্মের সঙ্গে আমাদের বিরোধ থাকে, অনেক হলে নির্ব্বিরোধ। এক আমাদের নির্দ্দোষাবস্থা; অন্য আমাদের উন্নতি কিম্বা দুর্গতির অবস্থা। আমাদের প্রবৃত্তির সঙ্গে অনেক স্থলে ধর্ম্মের ঐক্য দেখা যায়। শরীর রক্ষা তামাদের পরম ধর্ম্ম; কিন্তু আমরা প্রবৃত্তি বশতও শরীর সেবায় প্রবৃত্ত হইতেছি। অশন বসন সুখ-স্বাচ্ছন্দতা পাইবার নিমিত্তে লোকে যে এত কষ্ট সহ্য করিতেছে, ধর্ম্মতঃ বিবেচনা করিতে গেলে তাহাতে তাহাদের কিছু মাত্র গৌরব নাই। কিন্তু যদি আমাদের এমন এক সময় উপস্থিত হয়, যখন আমরা বিপদে একান্তু আক্রান্ত হই— শোকেতে ব্যাকুল মতি হই—আপনার প্রতি আর কিছু মাত্র আদর থাকে না; মৃত্যুই আমাদের প্রার্থনীয় হইয়া পড়ে। এমন অবস্থায় যদি আমরা আমাদের সমুদয় বল একত্র করিয়া কেবল ধর্ম্মের জন্য কর্তব্যের জন্য আত্ম রক্ষা করি; সেই স্থলেই আমাদের ধর্ম্ম-বল প্রকাশ পায়। এই প্রকার আমরা ধর্ম্ম হইতে হিতৈষণার আদেশ পাইতেছি এবং আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হইতেও অন্যের প্রতি প্রেম দয়া, করুণা বিস্তার করিতেছি। কিন্তু মাতা যে তাঁহার পুত্রকে স্নেহ করেন, স্বামী যে তাহার স্ত্রীকে প্রীতি করেন, দরিদ্রের দুঃখ দেখিয়া যে কোন ব্যক্তি দয়া অনুভব করেন; তাহাতে তাঁহারদিগের ধর্ম্ম-গৌরব কি? সংগ্রাম স্থলেই ধর্ম্মের মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। আমরা যখন আপনার সুখ স্বচ্ছন্দতা বিসর্জ্জন করিয়া নিরাহারী নিরাশ্রয়কে অন্ন বস্ত্র প্রদান করি—যখন আমরা সমুদয় কষ্ট সহ্য করিয়া সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা সহকারে আমাদের কোন চির পালিত মন্দ অভ্যাসকে পরিত্যাগ করি-যখন শত্রুকে প্রেম দ্বারা পরাজয় করি, অসাধুকে সাধুতাতে ক্রয় করি—যখন ধর্ম্মের জন্য প্রাণের আশঙ্কও পরিত্যাগ করি; তখনই আমাদের প্রকৃত মহত্ত্ব; তখনই আমাদের কর্ত্তৃত্ব প্রকাশ পায়; তখনই আত্মাতে আত্ম-প্রসাদ অবতীর্ণ হয়। আত্মার বল বীর্য্য এই প্রকারেই উপার্জ্জন হয়। এই সকল সংগ্রাম স্থলেই আমাদের পরীক্ষা ও শিক্ষা হয়। এই হেতু ঈশ্বর আমাদিগকে সংসারে চির দিন সুখের ক্রোড়ে শয়ান রাখেন নাই। তিনি আমাদিগকে নানা কঠোর অবস্থাতে নিক্ষেপ করিয়া আমাদিগকে শিক্ষা প্রদান করিতেছেন। দেব-ভাব, পশু-ভাব—কুপ্রবৃত্তি, সুপ্রবৃত্তির সংগ্রামে আমরা ধর্ম্মবল উপার্জ্জন করি।
যাহারা স্বর্গকে বিষয়-সুখের ধাম বলিয়া বর্ণনা করে, তাহাদের ভ্রম এস্থানে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। এখানে আত্মপ্রসাদই স্বর্গের পূর্ব্বাভাস; কিন্তু তাহারদিগের মতে সেই স্বর্গেতে বিষয়-সুখই রাশীকৃত সঞ্চিত হইয়াছে। যে সকল কামনা এই মর্ত্যলোকে দুর্লভ, তাহাই সেখানে পূর্ণ হইবে। “সরথা সতূর্য্যা অপ্সরা, মহদায়তন সুগন্ধ কানন, সুশীতল অবিরল ছায়া, বিস্তীর্ণ বিমলা নদী, এই সকল স্বর্গলোকে প্রচুর-রূপে পাওয়া যাইবে। এই সমুদয় প্রাপ্ত হওয়া আমাদের সমুদায় ধর্ম্ম-কার্য্যের শেষ ফল! এখানে কিঞ্চিৎ ত্যাগ স্বীকার করিতে পারিলে স্বর্গলোকে আমরা অশ্ব রথ গজে পরিবৃত হইব। এখানে কামোপভোগ হইতে বিরত হইলে স্বর্গলোকে উৎকৃষ্ট সুরা, অপ্সরা, মর্ত্যলোকের দুর্ল্লভ ভোগ-সকল লাভ হইবে। স্বর্গের এই প্রকার ভাব কি হীন ভাব! ইহাতে আমাদের তাাত্মা কখনই সায় দেয় না।
বিষয়-সুখই কি আমাদের পরম পুরুষার্থ? আমাদের সমুদায় ধর্ম্ম-কার্য্যের শেষ কল কি অকিঞ্চিৎকর বিষয়-সুখ? আমাদের সমুদায় আশা ভরশা কি এই প্রকার সুখেতে পর্য্যবসান হইতে পারে? ইহা অপেক্ষা উন্নত উদ্ধত পবিত্র ফল কি আর কিছুই নাই? হে ভদ্র! হে বিদ্ব্ন! তুমি কি মনে কর, তোমাকেই আমি জিজ্ঞাসা করি। মনে কর, এখানে তোমার সকল ইচ্ছা চরিতার্থ হইয়াছে, তুমি এখানকার সকল কামনার কামভাগী হইয়াছ, পার্থিব সুখের কোন অভাব নাই; ধন, মান, যশ, প্রভুত্ব, অপর্য্যাপ্ত রূপে ভোগ করিতেছ; এই কি তোমার পরম প্রার্থনীয় অবস্থা? এই অবস্থাতেই কি তুমি চিরকাল পরিতৃপ্ত থাকিতে পার? এই সুখ-প্রদর্শন যদি অনন্ত কাল পর্য্যন্ত তোমার সম্মুখে বিস্তৃত থাকে, তাহাতেই কি তুমি আপনাকে কৃতার্থ বোধ কর? না তোমার আত্মা ইহা অপেক্ষা মহত্ত্বর উচ্চতর বিষয় চায়? মনুষ্যের আত্মা এই সকল প্রশ্নে এই একই উদ্ভর দেয়, যে আত্মার যে স্পৃহা ও আশা, বিষয়-সুখে তাহার কিছুই পূর্ণ হয় না।
সহস্র সহস্র ইন্দ্রিয়-সুখ, সহস্র সহস্র কৃত্রিম শোভায়। অনুরঞ্জিত হইলেও আমাদের আত্মাকে পূর্ণ ও পরিতৃপ্ত করিতে পারে না। নির্দ্দোষ ইন্দ্রিয়-সুখ অবশ্য সেব্য, তাহার সন্দেহ নাই। শোভা সঙ্গীত সৌগন্ধে পরিবৃত মনোহর উদ্যান বা উন্নত প্রাসাদে বাস করা—যে সকল স্থানে কর্ণ কোন অশ্রাব্য সুর শুনিতে পায় না, চক্ষু কোন কুৎসিত রূপ দেখিতে পায় না, এমন সকল স্থানে কালক্ষেপ করা—নানাবিধ ভোগ্য সামগ্রীতে আমাদের পশুপ্রকৃতিকে চরিতার্থ করা; এ সকল সামান্য সুখ নহে। পণ্ডিতভিমানী ব্যক্তিরা যাহা বলুন না কেন, এ সকল সুখ কখনই হেয় নহে! জগদীশ্বর আমাদের জন্য এ প্রকার সুখ অপর্যাপ্ত রূপে বিস্তার করিয়া রাখিয়াছেন। আমাদের চক্ষু কর্ণ পবিত্র সুখের দুই বিস্তীর্ণ দ্বার। কিন্তু এই প্রকার ইন্দ্রিয়-সুখই আমাদের সর্বস্ব নহে। ইহাতেই আমাদের সমুদয় প্রকৃতি চরিতার্থ হয় না। আমরা ইহা অপেক্ষাও আরো অধিক কিছু চাই। ইন্দ্রিয়-লোলুপ ব্যক্তি এ প্রকার সুখে সম্যক্ পরিতৃপ্ত থাকিতে পারে না। যৌবন কাল অতিক্রম করিয়া ইহা বিলক্ষণ অনুভব করা যায়। আমরা যৌবন কালে যত অপর্য্যাপ্ত রূপে সুখভোগ করি, পরে তত শীঘ্র তাহাতে বিরক্তি জমে। যাহারা সে সময়ে পরিমিত রূপে সুখ ভোগ করে, পরে আর তাহাতে তেমন স্পৃহা থাকে না। আমাদের জীবনের এমন এক সময় উপস্থিত হয়, যখন আমাদের সাংসারিক সমুদয় ভাব শীতল হুইয়া যায় এবং সংসারকেই যাহারা সার্ব্বস্ব জানিয়া সেবা করিয়া আসিয়াছে, তাহারাও বুঝিতে পারে যে সেই সংসারও তাহাদের শূন্য হৃদয়কে পূর্ণ করিতে পারে নাই।
অতএব স্বর্গকে এই প্রকার বিষয়-সুখের আলয় বলিয়া বর্ণন করা কি মূঢ়ত্বের কর্ম্ম! বিষয়-সুখে আমাদের আত্মা তৃপ্ত হয় না, এই আমাদের পরম মঙ্গল। তবে সেই সুখই কি আমাদের জীবনের শেষ লক্ষ্য, সমুদায় কর্ম্মের শেষ ফল হইবে?
পুনঃ পুনঃ বলা হইয়াছে যে আমাদের নিঃস্বার্থ ভাবে লোভ-শূন্য হইয়া ধর্ম্মের তানুষ্ঠান করিতে হইবে। আমরা স্বর্গের লোভে ধর্ম্মেতে অনুরক্ত হই, নরকের ভয়ে পাপ হইতে বিরত হই, ধর্ম্ম-জীবি জীবের ভাব এ প্রকার হওয়া উচিত নহে। যে ঈশ্বর আমাদের নিষ্কাম প্রীতি চাহেন, তাঁহা হইতেই আমরা নিঃস্বার্থ ধর্ম্মের শিক্ষা পাইতেছি। ঈশ্বর ধর্ম্মকে ধর্ম্মের জন্য আলিঙ্গন করিতে আমারদিগকে শিক্ষা দিতেছেন। আমরা লাভ ক্ষতি ফলাফল বিবেচনা করিয়া ধর্ম্মে প্রবৃত্ত হই, তাঁহার শিক্ষা এ প্রকার নয়। আমাদের নিস্বার্থ ভাব দেখিলে তবে তিনি প্রসন্ন হইয়া আমাদিগকে পুরস্কার দেন এবং তিনি নিজেই তাহার পুরস্কার হয়েন।
মনুষ্যকে যাহার লোভ দেখাইয়া ধর্ম্মে আনিতে চাহে অথবা ভয় দেখাইয়া পাপ হইতে বিরত করিতে চাহে; তাহারা ধর্ম্মের প্রকৃত ভাব অবগত নহে।
ঈশ্বর আমারদিগকে ভবিষ্যতে দণ্ড পুরস্কার দিবার জন্যই এখানে প্রেরণ করেন নাই। তিনি আমাদিগের জন্য একদিকে স্বর্গ আর একদিকে নরক সৃষ্টি করিয়া আমারদিগকে তাহার মধ্য স্থল এই পৃথিবীতে নিক্ষেপ করিয়া রাখেন নাই, যে মৃত্যুর পরে হুয় অনন্ত স্বর্গ-ভোগ বা অনন্ত নরক-ভোগ হইবে। আত্মার উৎকর্ষ সাধনই তাঁহার উদ্দেশ্য। এ পৃথিবীতেই আমাদের শিক্ষার শেষ হইবে না। আমরা সহজ জ্ঞানে এই বুঝিতে পারি যে ঈশ্বর “ধর্ম্মাবহং পাপমুদং।” ধর্ম্মের আবহ এবং পাপের মোচয়িতা। পাপীর দণ্ড অবশ্যই হইবে। ন্যায়বান্ ঈশ্বর পাপের উপযুক্ত দণ্ড অবশ্যই বিধান করিবেন; দণ্ডের জন্যই তাঁহার দণ্ড দিবার তাৎপর্য্য নহে কিন্তু পাপীর পরিত্রাণের জন্য। সেই প্রকার ঈশ্বর অবশ্য ধর্ম্মের পুরস্কার দিবেন। কিন্তু পুরস্কারের জন্য আমাদের ধর্ম্ম নহে। আমরা কি প্রত্যাশাপন্ন হইয়া ধর্ম্ম সাধন করিব? কখনই না। ঈশ্বর সুখকে আমাদের পরম পুরস্কার করিয়া রাখেন নাই; কিন্তু সুখ আমাদের অন্ন স্বরূপ; সেই অম্নে আমরা বল পাইয়া আরো প্রকৃষ্ট রূপে ধর্ম্ম সাধন করিতে পারি, এই তাহার অভিপ্রায়। আমরা ধর্ম্ম সাধন করিয়া ধর্ম্ম-বল উপার্জ্জন করিলাম; ঈশ্বরের নিকটবর্ত্তী হইলাম; এই আমাদের পুরস্কার; ইহা অপেক্ষা আর অধিক কি চাই? আমরা পাপ-কলঙ্ক হইতে মুক্ত হইয়া, সত্যতা পবিত্রতা অর্জন করিয়া, পুণ্য সঞ্চয় করিয়া, স্বাধীনতা উপার্জ্জন করিয়া, পরিশেষে এক আমাদের লক্ষ্য এই হইল যে স্বর্গে গিয়া একটুকু সুখ ভোগ করিব? ধর্ম্ম উপার্জ্জন করিয়া আমাদের লক্ষ্য ঈশ্বরের দিকেই যায়। আমরা ধর্ম্ম সাধন করিয়া সেই পবিত্র-স্বরূপকে পাইবার অধিকারী হই।
সংসারিক সুখ-ভোগের জন্য ধর্ম্মাচরণ যে প্রকার, স্বর্গ লাভের জন্য ধর্ম্ম-সাধনও সেই প্রকার। স্বার্থপরতা কি পরলোক পর্যন্তু বিস্তৃত হইলেই তাহা ধর্ম্মের বেশ ধারণ করিল? যদি অল্প পুরস্কারের জন্য ধর্ম্ম-সাধন প্রকৃত ধর্ম্ম না হয়, তবে অধিক পুরস্কারের জন্য যে ধর্ম্ম সেই কি পবিত্র ধর্ম্ম? এক রজত মুদ্রাতে লুব্ধ হওয়াও যাহা, এক শত মুদ্রাতেও সেই প্রকার, বরং অধিক; এবং স্বর্গ সুখ-ভোগের প্রত্যাশায়ও সেই প্রকার। এক দিবস কারাবাসের ভয়ে পাপ হইতে নিবৃত্ত হওয়াও যাহা,চতুর্দ্দশ বৎসর নির্ব্বাসের ভয়ে বিরত হওয়াও সেই প্রকার; এবং অনন্ত নরকাগ্নি ভয়েও সেই প্রকার। যে ব্যক্তি প্রত্যাশাপন্ন হইয়া ধর্ম্ম সাধন করে, সে একেবারেই বহু সম্পত্তি পাইবার মানসে আপাততঃ কিঞ্চিৎ কষ্ট সহ্য করিতে পারে; কিন্তু যিনি ধর্ম্মের জন্যই ধর্ম্ম সাধন করেন, তিনি আর মূল্যের বিষয় বিবেচনা করেন না; তাঁহার পক্ষে অল্প মূল্যও যাহা, আধিক মূল্যও সেই প্রকার।
কিন্তু স্বর্গের লোভে যেমন ধর্ম্ম হয় না, নরকের ভয় পাপীর পক্ষে কি রূপ? পাপীকে নরকের ভয় কি দেখাইবে? সে এখানে নরকের জ্বালা সহ্য করিতেছে; অথচ তাহাতে তাহার চেতন হয় না। পাপীকে অনন্ত নরক, জ্বলন্ত অনল, দুঃসহ যাতনার ভয় দেখাও, তাহাতে তাহার কি হইবে? তাহার পাপের আসক্তি কি ক্ষীণ হইবে? না, কেবল ভয়েরই সঞ্চার হইবে। ভয়েতে চালিত হওয়া অপেক্ষা আর নীচ ভাব কিছুই নাই। যে ব্যক্তি পাপের মলিনত্ব দেখিতে পাইয়াছে, তাহা হইতে বিরত হইবার ক্ষমতা বুঝিয়াছে, ঈশ্বরের অপ্রসন্নতা অনুভব করিয়াছে; অথচ যাহার পাপের প্রতি কিছু মাত্র ঘৃণা উপস্থিত হয় নাই, ঈশ্বর-প্রীতির শাখা মাত্রও যাহার হৃদয়ে উদ্দীপ্ত হয় নাই কিন্তু সে ব্যক্তি নীচ হীন পশুবৎ ভয়েতেই কখন কখন পাপ প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে পারে নাই; তাহার অপরাধের কি তাহাতে কিছু মাত্র লাঘব হইল? মন্দকে ভাল বাসিয়া গ্রহণ করতেই পাপ; তাহার সহিত ভয় মিশ্রিত হইলেই কি তাহার মলিনত্ব দূর হইল?
পাপীর শাস্তি অবশ্যই ভোগ করিতে হইবে। যিনি ধর্ম্ম-রাজ্যের রাজা, তিনি পাপের দণ্ড অবশ্যই বিধান করিবেন। সকল ধর্ম্মই ইহা স্বীকার করিয়া থাকে, স্বয়ং পাপীর অন্তরেই এ ভয় রাজত্ব করে। কিন্তু পাপীর নরক ভোগ কি প্রকার? আত্ম-গ্লানিই পাপীর নরক ভোগ। তাহার দুঃসহ হৃদয়-জ্বালাই নরকাগ্নি সমান। পাপীকে শাস্তি দিবার জন্য অগ্নিময় দৈত্যময় কীট পূর্ণ নরককল্পনা করিবার ভাবশ্যক করে না। তাহার আত্ম-গ্লানির দ্বার খুলিয়া দিলেই সে নরকের সমুদয় যন্ত্রণা ভোগ করিবে। পাপী ব্যক্তি এখানে আমোদ প্রমোদে আপনার অবস্থা ভুলিয়া থাকে, চির অভ্যাস বশতঃ পাপ কর্ম্মে অকাতরে রত হয়—তাহাদের শাস্তি দিবার জন্য অধিক আর কিছু আবশ্যক করিবে না, তাহাদের মন বহির্ব্বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইলেই আপনার প্রতি দৃষ্টি করিবে; তখনই সে আপনার অবস্থা বুঝিতে পারিবে; তখন তাহার সেই আত্মগ্লানির সন্ত্রণাই নরকের যন্ত্রণা। এখানে পাপীদের স্ফীত ভাব দেখিয়াই তাহারদিগকে সুখী মনে করা অতীব ভ্রান্তি। পাপের ফলই এই যে পাপীরা “দুর্ভিক্ষাৎ যান্তি দুর্ভিক্ষং ক্লেশাৎ ক্লেশং ভয়াদ্ভয়ং।”
কিন্তু এক বিষয় আমরা জানিতেছি যে পাপীর অনন্ত শাস্তি নহে। তাহার পাপ ভার যতই হউক না কেন, তাহা অবশ্যই পরিমিত। পরিমিত জীব অনন্ত পাপে পাপী কখনই হইতে পারে না। কতটুকু পাপের কি রূপ দণ্ড, তাহা যদিও আমরা ঠিক বলিতে পারি না; কিন্তু ইহা বলিতে পারি যে একটী ক্রোধ-বাক্যের জন্য প্রাণ-দণ্ড করিলে তাহা অন্যায় দণ্ড হইল। ইহা যদি সত্য হয়, তবে আমরা ইহাও বলিতে পারি; পরিমিত পাপের জন্য অনন্ত নরক ভোগ কখনই তাহার উপযুক্ত দণ্ড হইতে পারে না।
ন্যায়বান্ ঈশ্বর যেমন পাপের দণ্ড অবশ্যই দিবেন, সেই রূপ তিনি পাপিকে পোধন করিবার উপায়ও অবশ্যই বিধান করিবেন। তিনি দণ্ডের জন্যই দণ্ড দেন না, কিন্তু মঙ্গলোদ্দেশেই দণ্ড বিধান করেন। তাঁহার সকল শাস্তি ঔষধ স্বরূপ। তিনি পাপীকে একেবারে পরিত্যাগ করেন না। যে পর্য্যন্ত না পাপাত্মা তাহার পাপের জন্য অনুতাপ করিবে, যে পর্য্যন্ত না সে আপনার যথার্থ ধাম অন্বেষণ করিবে, যে পর্য্যন্ত না সে সমস্ত চিত্তে আপনার পরম পিতার প্রতি দৃষ্টি করিবে, সে পর্য্যন্ত সে শাস্তি ভোগ করিবে; এবং পরিশেষে যখন সে ঈশ্বরের আহ্বান শ্রবণ করিয়া আপনা হইতে তাঁহার দিকে গমন করিবে,তখন তিনি স্বীয় হস্ত প্রসারিত করিয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিবেন এবং পুনর্ব্বার আপন রাজ্যের অধিকারী করিবেন।
পাপীর নরক ভোগ এই প্রকার, ধার্ম্মিকের স্বর্গ ভোগের আভাস আমরা এখানে কি পাইয়াছি? অন্তরেই তাহার আভাস পাইতেছি।
ব্রাহ্ম ধর্ম্মের স্বর্গ কেবল সুখের স্বর্গ নহে। ব্রাহ্ম ধর্ম্ম সুখের জন্য, ভোগের জন্য, এখানেই হউক বা পরত্রই ইউক, ধর্ম্ম সাধন করিবার শিক্ষা দেন না; কিন্তু সর্ব্বথা ইছামুত্রার্থলভোগ বিরাগেরই উপদেশ দেন। ব্রাহ্মধর্ম্ম এ প্রকার কোন ঔষধ দেন না যে তাহা সেবন করিয়া পাপী একেবারেই সুস্থ হইবে; কিন্তু তিনি এই উপদেশ দেন যে অনিবার্য্য যত্ন সহকারে আমাদের কুপ্রবৃত্তি-সকলকে দমন করিতে হইবে এবং আমাদের ইচ্ছাকে ঈশ্বরের ইচ্ছার সহিত মিলিত করিতে হইবে। ব্রাহ্ম ধর্ম্ম এমত কোন স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দেন না যে সেখানে গেলেই আমাদের সকল জ্ঞান, সকল ধর্ম্ম, সকল সুখ লাভ হইবে। কিন্তু কোন কালেই আমাদের আত্মার উন্নতির বিরাম হইবে না। আমরা এক লোক হইতে অন্য উচ্চতর লোকে গিয়া উৎকৃষ্টতর অবস্থা প্রাপ্ত হইতে থাকিব। “স্বর্গাৎ স্বর্গং সুখাৎ সুখং” স্বর্গ হইতে স্বর্গ, সুখ হইতে উৎকৃষ্টতর সুখ ভোগ করিতে থাকিব—বিষয়-সুখ নয়, কিন্তু ব্রহ্মানন্দ। আমরা অনন্ত উন্নতি লাভের অধিকারী, অনন্ত-স্বরূপকে আমরা কোন কালেই জানিয়া এবং তাঁহার আনন্দ ভোগ করিয়া শেষ করিতে পারিব না, সেই অনন্ত প্রস্রবণ হইতে আমরা সকল কালেই পূর্ণ হইতে থাকিব। আমাদের কোন ভয় নাই। আমরা যেখানে থাকি, যে অবস্থায় থাকি; ঈশ্বর হইতে কখনই বিচ্ছিন্ন হইব না। আমরা জগৎ-পিতার আশ্রয়ে চিরকালই থাকিব। ধর্ম্ম উন্নত ভাব ধারণ করিবে। প্রত্যেক পাপপ্রবৃত্তি বিমর্দ্দিত হইবে এবং আমাদের দেব-তাব-সকল সমুন্নত হইতে থাকিবে। আমরা পুণ্য পদবীতে এই প্রকারে আরোহণ করিতে করিতে আমাদের পাপ-মলা সকল বিধূত হইয়া যাইবে এবং আমাদের আত্মাতে পবিত্রতা, মঙ্গল ভাব, আত্ম-প্রসাদ বহমান হইতে থাকিবে। আমাদের দেবভাবসকল আসুরিক প্রবৃত্তির উপরে জয়ী হইয়া আপনার প্রকৃত আধিপত্য সংস্থাপন করিবে।
আমাদের জ্ঞান, ভাব, ও ইচ্ছা একত্রে উন্নত হইতে থাকিবে। সেই সত্য পুরুষ আমাদের জ্ঞানের স্বর্গীয় অন্ন হইবেন; আমাদের ভাব-সকল উন্নত হইয়া তাঁহাতেই সমর্পিত হইবে; আমরা নুতন ক্ষেত্রে পতিত হইয়া ঈশ্বরের নূতন নুতন কার্য্য সমাধা করিয়া জীবনকে সার্থক করিতে থাকিব। আমরা কেবল ধ্যানে থাকির না, ব্রহ্মেতে লয় হইয়াও যাইব না; কিন্তু ধর্ম্মের পুরস্কার তাঁহার সহচর অনুচর হইয়া তাঁহার সহবাস-জনিত আনন্দ ভোগ করিতে করতেই চিরজীবন যাপন করিব। আমাদের জ্ঞান, ভাব, ও ইচ্ছা, এ তিনের একটীও বিনাশ হইবে না। কিন্তু তাহাদের ক্রমিকই উন্নতি হইতে থাকিবে। আমাদের ইচ্ছা ঈশ্বরের মঙ্গলময়ী ইচ্ছার অনুগামিনী হইবে; আমাদের প্রীতি এক্ষণে এক পরিবার, এক গ্রাম, এক দেশের মধ্যে বন্ধ আছে, কিন্তু তখন তাহা ঈশ্বরের উদার প্রেমের রূপ ধারণ করিবে এবং আমাদের জ্ঞান বিকশিত হইয়া তাঁহাকে আরো উজ্জ্বল রূপে দেখিতে পাইবে।
আমাদের সদ্ভাব, হিতৈষণা, পবিত্রতা, উপার্জ্জন হইতে থাকিবে; আমাদের প্রত্যেক বাক্য প্রত্যেক কার্য্য হইতে ধর্ম্মামৃত নিস্যন্দিত হইবে। আমাদের প্রীতি বিস্তার হইয়া সহস্র সহস্র আত্মাকে সিক্ত করিবে। আমরা দেবতাদিগের সঙ্গে পরম পবিত্র প্রেম-ভাবে থাকিয়া ঈশ্বরের প্রিয় অভিপ্রায় সম্পাদন করিতে থাকিব। তখন আমাদের এখানকার অবস্থা স্মরণ হইলে ইহা আমাদের জীবনের শৈশবকাল মনে হইবে এবং আমাদের এখানকার সমুদায় শিক্ষা শিশুর পদ-চারণা শিক্ষার ন্যায় বোধ হইবে।
আমাদের ঈশ্বর আমাদের সমীপে জাজ্বল্যতর প্রকাশমান থাকিবেন। আমরা তাঁহার মহিমাকেই মহীয়ান করিব, তাঁহার উপাসনাতেই জীবন যাপন করিব, তাঁহার সহবাসেই পরিতৃপ্ত হইব, তাঁহার পবিত্র চরণে শ্রদ্ধা অর্পণ করিয়া আপনাকে কৃতার্থ করিব, তাঁহাতে গাঢ়তর প্রীতি স্থাপন করিব এবং তাঁহার অপার প্রেম আরো উজ্জ্বল রূপে অনুভব করিতে পারিব। তিনিই আমাদের, উপজীবিকা হইবেন। যদিও চন্দ্র, সূর্য্য কখন নির্ব্বাণ হইয়। যায়, তথাপি এমন দিন অবশ্যই উদিত হইবে। এদিন একবার উদয় হইলে আর কখন অস্ত যাইবে না কিন্তু ইহার আলোক ক্রমিকই উজ্জ্বল হইয়া আমাদের আত্মাকে অনুরঞ্জিত করতে থাকিবে। ইহাই স্বর্গ, ইহাই মুক্তি।
“এষাস্য পরমা গতিরেষাস্য পরমা সম্পৎ এষোস্য পরমোলোক এষোস্য পরমআনন্দঃ।”