ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস/সপ্তম উপদেশ

সপ্তম উপদেশ।


পরলোক।

 পরলোক এবং পরলোকের সাধন অবিবেকীর নিকটে প্রতিভাত হয় না। তাহারা পরলোকের বিষয় কি বুঝিবে? বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকিয়া তাহারা আপনাকেও বিস্মৃত হইয়া যায়। যদি বিষয়ই সার, বিষয়ই সত্য, এইরূপ জ্ঞান হয়—যদি গণনার সময়ে আপনাকে ছড়িয়াই গণনা করা যায়; তবে পরলোকের সাধন কোথা হইতে হইবে? বিষয়ই সর্ব্বস্ব, বিষয়ী যে আমি তাহা কিছুই নহে; এই প্রকার ভাবিয়া কার্য্য করিলে পরলোকের সাধন কখনই হইতে পারে না। পরলোকের সাধনের পূর্ব্বে আত্মদৃষ্টি আবশ্যক। বরং বস্তুর অস্তিত্বের প্রতি সংশয় উপস্থিত হইতে পারে; কিন্তু আমি আছি, ইহাতে আর কাহারও সংশয় হয় না। বাহিরের বস্তুর প্রতি সংশয় উপস্থিত হইলে গাঢ় প্রমাণ আবশ্যক—দর্শনেন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রমাণ না হইলে স্পর্শেন্দ্রিয়ের প্রমাণ চাই—বাধা ও প্রতিবন্ধক পাইলে সে প্রমাণ আরো দৃঢ়তর হয়; কিন্তু আপনাকে জানিবার জন্য আর প্রমাণের আবশ্যক করে না, অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্যতার তার প্রয়োজন হয় না; যেহেতু আপনার সাক্ষী আপনিই। আত্মজ্ঞান কেবল মনুয্যেরই আছে। মনুষ্য আত্মজ্ঞান বিহীন হুইলে সে নিশাগ্রন্তু ব্যক্তির ন্যায় কার্য্য করে। নিশাগ্রস্ত ব্যক্তি যেমন স্বপ্নেতে আপনাকে না জানিয়া কর্ম্ম করিতে থাকে এবং তাহাকে কেবল জাগ্রত করিয়া দিলেই সে সকল বুঝিতে পারে; সেই রূপ মনুষ্যও যখন আত্মজ্ঞান শূন্য হইয়া কার্য্য করে, তখন তাহাকে কেবল জাগ্রৎ করিয়া দিবার আবশ্যক। পশুদের আত্মজ্ঞান নাই—তাহারা কর্ত্তৃত্ব বুঝিয়া কার্য্য করে না, বিষয়াকর্ষণেই ধাবিত হয়। মনুয্যর আত্মজ্ঞান আছে, কিন্তু তাহারা কখন কখন আত্ম বিস্মৃত হয়, তাহার বিস্মৃতি ভঙ্গের নিমিত্তে তাহাকে জাগ্রৎ করিয়া দিলেই হয়। মনুষ্যের এক এক সময়ে এমন হীন অবস্থা হইয়া পড়ে, যে সে আর আপনার প্রতি দৃষ্টি করে না। যাহার দৈর্ঘ্য প্রস্থ আছে—যাহা দেখা যায় স্পর্শ করা যায়, তাহাই সে সত্য মনে করে, আর যাহা হ্রস্ব দীর্ঘ নহে, যাহা অদৃশ্য তাহাই তাহার নিকটে অসত্য রূপে প্রতীয়মাণ হয়। কিন্তু বস্তুতঃ ঠিক তার বিপরীত। বরং দৈর্ষ্য প্রস্থ বিশিষ্ট বস্তুর প্রতি সংশয় জন্মিতে পারে, কিন্তু আমাকে আমি কখনই সংশয় করিতে পারি না। সংশয় করে কে? না আমি; অতএব আমি আছি, নতুবা আমার সংশয়ও মিথ্যা; এসময়ে সংশয় আপনাকেই আপনি ছেদন করে। আমি আর প্রত্যক্ষের বিষয় নহি, কিন্তু আমি আপনাকেই আপনি বুঝিতে পারি। আমি একই বস্তু—আমার সমুদয় চিন্তা—সমুদয় ভাব—সমুদায় কামনা ইহাতে আশ্রিত রহিয়াছে। আমি বিভাগ যোগ্য নহি। শিশুকালে যে আমি ছিলাম; অদ্যও সেই আমি আছি। আমি স্থ‌ূল নহি, অণু নহি, হ্রস্ব নহি, দীর্ঘ নহি। আমি আকাশে নাই। আমার চিন্তা মস্তিষ্কে আছে—ভাবনা হৃদয়ে আছে—ব্যথা অঙ্গুলিতে আছে; এমত নহে। কিন্তু আমার যে কিছু চিন্তা যে কিছু ভাব, যে কিছু ক্লেশ, তাহা আমারই। সে সকল শরীরে আরোপ করা অতীব ভ্রান্তি। যে হেতু চিন্তা প্রভৃতি সমুদয় বৃত্তি কেবলই আত্মারই। এ সকল আত্মতত্ত্ব বুঝিবার জন্য প্রমাণের গাঢ়ত্ব আবশ্যক করে না।

 আমি এবং আমার শরীর, এ দুইকে পৃথক্ করিয়া বুঝিলে পরকালের প্রমাণ সহজেই হয়। আমি আমার শরীর হইতে ভিন্ন। আমি যখন দূরবীক্ষণ সহকারে গ্রহ উপগ্রহের গতিবিধি নিরূপণ করি; তখন সে দূরবীক্ষণও আমি নহি, এবং আমার চক্ষুও আমি নহি। আমার মস্তিষ্কও আমি নহি, আমার হৃদয়ও আমি নহি। অন্নপানে শরীরের পুষ্টি হইতেছে, রোগ দ্বারা শরীর ক্ষয় হইতেছে এবং কয়েক বৎসরের মধ্যে তাহার প্রত্যেক পরমাণু একেবারে পরিবর্ত্ত হইয়া যাইতেছে; কিন্তু আমি যে একই সে একই রহিয়াছে। বিষয় আর বিষয়ী অন্ধকার আর আলোকের ন্যায় পরস্পর বিভিন্ন স্বভাব। যাঁহারা ইহাদের মধ্যে সমুদয় প্রভেদ বিলীন করিতে চাহেন, তাঁহারা সহস্র সহস্র যুক্তিতেও তাহা অতি সামান্য লোককেও বুঝাইতে পারেন না। বিষয় আর বিষয়ী; ইহাদের মধ্যে কিছুতেই ঐক্য নাই—এ দুয়ের কোন এক গুণও সমান নহে। আকৃতি, বিস্তৃতি, বিষয়ের গুণ; আর স্মরণ, তুলনা, অনুমান; প্রীতি, দয়া; শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা; এবিষয়ীর গুণ; ইহার মধ্যে কিছুতেই সাদশ্য নাই। একজন দ্রষ্টা, স্প্রষ্টা, ঘ্রাতা, মন্তা, বোদ্ধা, কর্ত্তা; অপর আমাদের প্রত্যক্ষের বিষয়। আকাশ নাই আর জড় বস্তু আছে; এ আমরা মনেই করিতে পারি না। কিন্তু আকাশ বিষয়ীর অবলম্বন নহে।

 যখন শরীর আত্মা এত পৃথক্; তখন মৃত্যুর পরেই আত্মার কি প্রকারে বিনাশ হইতে পারে। আমরা কোন বস্তুরই বিনাশ কল্পনা করিতে পারি না। যাঁহার সৃজন শক্তিতে এ সমুদয় সৃষ্ট হইয়াছে, তাঁহারই সংহার—শক্তিতে এ সমুদয় ধ্বংস হইতে পারে। ঈশ্বরের পালনী ইচ্ছার বিরাম ব্যতীত সৃষ্টির কণামাত্রও ধংস হইতে পারে না। কিন্তু ঈশ্বরের সে ইচ্ছার বিরাম হইয়াছে কি না; এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জড় বস্তু হইতেই প্রাপ্ত হইতেছি। জড় বস্তু মধ্যে কোন বস্তুরই বিনাশ হইতেছে না। জল বাষ্প রূপে উত্থিত হইয়া শুষ্ক হইয়া যাইতেছে; কিন্তু সেই বাষ্প আবার জল মূর্ত্তি ধারণ করিতেছে। শুষ্ক বৃক্ষ-পত্র-সকল ভূমিতলে পতিত হইয়া অদৃশ্য হইতেছে; কিন্তু তাহাই আবার বাষ্পীয় পদার্থ বিশেষে পরিণত হইয়া উদ্ভিজ্জের বুদ্ধি বিষয়ে সাহায্য করিতেছে। মৃত দেহের প্রত্যেক অঙ্গ, প্রত্যেক অস্থি, প্রত্যেক পরমাণু বিচ্ছিন্ন হইতেছে; কিন্তু তাহার কিছুই বিনষ্ট হইতেছে। অতএব কোন্ উপমিতি দ্বারা ইহা সপ্রমাণ হয় যে মৃত্যুর পরে আত্মারই বিনাশ হইবে। যখন একটি জড়ীয় পরমাণু বিনষ্ট হইতে পারে না, তখন কি ঈশ্বর আত্মার বিনাশই ইচ্ছা করিবেন।

 কিন্তু মৃত্যুকালে শরীর যেমন ভঙ্গ হইয়া যায়, আত্মার কি সেই রূপে ভঙ্গও হইতে পারে? ইহার উত্তর না। শরীর পরমাণু বিশিষ্ট; জীবাত্মা একই বস্তু। শরীর অবয়ব বিশিষ্ট; জীবাত্মা অবয়ব বজ্জিত। জীবাত্মা আকাশে নাই; অতএব তাহা বিস্তৃতি শূন্য। জীবাত্মা একই বস্তু, ইহার জন্য বহু তর প্রমাণ ও যুক্তির অবশ্যক করে না। আমি একই; দুই নহি, তিন নহি; ইহা আমাদের আত্ম-প্রত্যয়-সিদ্ধ। যদি কাহাকেও জিজ্ঞাসা করা যায়, তুমি কয় জন? তাহা হইলে সে এই প্রশ্নে হাস্য করিবে। আমাদের শরীরের যদিও সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন হইতেছে, কিন্তু যে আমি পূর্ব্বেও ছিলাম, সেই আমি এখনও আছি; এই জ্ঞানটি প্রত্যেক মানসিক ক্রিয়ার মূলেই নিহিত রহিয়াছে। আমাদের বিচিত্র ভাব—বিচিত্র মনোবৃত্তি; এই একই বস্তুতে অনুভব করি। আমি একই, এই জ্ঞানটি না থাকিলে আমরা কোন বিষয়কেই বিষয় বলিয়া অবধারণ করিতে পারিতাম না; সকলই আমাদের নিকটে অসম্বদ্ধ বিচ্ছিন্ন হইত এবং আমাদের নিকটে তাহাদের থাকা আর না থাকা সমান হইত। আমি একই বস্তু, এই জন্যই আমার ভঙ্গ হইতে পারে না। শরীর পরমাণু বিশিষ্ট, অতএব সেই সকল পরমাণু পৃথক্ হইলে সে শরীর ভগ্ন হইতে পারে, কিন্তু আত্মা একই, তাহার বিনাশও নাই এবং ভঙ্গও নাই।

 এখানে আমাদের আত্মা শরীরে বদ্ধ রহিয়াছে। কেহ কেহ বলে যে শরীর হইতে মুক্ত হইলেই আত্মার বিনাশ হইবে। একি নিদারুণ উক্তি, একি নিদারুণ বিশ্বাস। কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে যদি এই প্রকার আশ্বাস দেওয়া যায় যে তুমি যতদিন বদ্ধ আছ, ততদিনই তোমার মঙ্গল; মুক্ত হইলেই তোমার মৃত্যু; তাহা হইলে তাহার কষ্ট কি দুর্ব্বিষহ হইয়া উঠে। আমাদের শরীরই কারাগৃহ। ইহাতে আত্মার স্বাভাবিক স্ফুর্ত্তি ও প্রভা নিরুদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। মনুষ্য আহার নিদ্রা ব্যতীত জীবন ধারণ করিতে পারে না; কিন্তু তিনি আহার নিদ্রার জন্যও জীবন ধারন করেন নাই। শরীরের সহিত আত্মার অস্থায়ী স্বম্বন্ধ; কিন্তু কেবল এই শরীরের লালন পালনেই হয়তো মনুষ্যের সমস্ত জীবন গত হয়। কাচ যেমন ভূমিতে পড়িলেই খণ্ড খণ্ড হয়, শরীরও সেই প্রকার। একবার মাত্র নিঃশ্বাস রুদ্ধ হইলে শরীরের প্রাণ বিয়োগ হয়। এখানে আত্মার স্বাভাবিক স্বাধীনত্ব কত সময়ে বিনাশ প্রাপ্ত হইতেছে এবং সে দাসের ন্যায় এই শরীরের উপরে কত বিষয়ে নির্ভর করিতেছে। এক এক সময়ে আমাদের মনের ভাব এত অধিক হয়, এত গাঢ় হয়, এ দ্রুত বেগে সঞ্চিত হয়, যে বাক্য তাহা বলিতে গিয়া স্তব্ধ হয়। দেখিবার জন্য আত্মার চক্ষু-রূপ দুই গবাক্ষ চাই; গমন করিবার জন্য পদ রূপ দুই ক্ষীণ যষ্টি আবশ্যক করে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর প্রতিকৃতি নিদ্রা প্রতি রজনীতে আত্মাকে মৃতবৎ করে। এখানে আত্ম মৃত্যু আর অমৃতের সন্ধি স্থানে রহিয়াছে। আমৃত ধামই তাহার যথার্থ ধাম; মুক্ত ভাবই তাহার স্বাভাবিক ভাব। যত দিন আমাদের আত্মা কারা-বদ্ধ, তত দিন জীবিত, মুক্ত হইলেই মৃত; এঅতি ভয়ানক কথা! ইহা সত্য হইলে পৃথিবীর সমুদয় ঘটনাই অসংলগ্ন হয়; মনুষ্যের জীবন সম্পূর্ণরূপে নিস্ফল হয়। ঈশ্বরের মঙ্গল-স্বরূপের উপরে নির্ভর করিয়া একথা কেহই বলিতে পারেন না। শরীর আমাদের সর্ব্বস্ব নয়, আত্মাই সার পদার্থ। শরীর এবং আত্মার যোগ হওয়াই আশ্চর্য ব্যাপার; আত্মা পৃথক্ থাকা কিছুই আশ্চর্য্য নহে। পরীর ব্যতীত যে জীবাত্মা থাকিতে পারে, ইহা মনে করা অতি সহজ; শরীরের সহিত তাহার কি রূপে সম্বন্ধ হইল, ইহাই বুঝা কঠিন।

 পরকালের প্রত্যয় চতুর্দ্দিক্ হইতেই দ্রঢ়ীভূত হইতেছে। বিশেষতঃ যখন আমরা আমাদের কর্ত্তৃত্ব বুঝিতে পারি, তখন পরকালের বিশ্বাস অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়। যখন আমরা বিষয়ের প্রতিকূলে গিয়া আপনাকে স্বতন্ত্র রূপে উপলব্ধি করিতে পারি—তখন পরকালের ছায়া এখানেই দেখিতে পাই। শত শত যুক্তি একত্র হইলেও আমারদিগকে এই কর্ত্তৃত্ব জ্ঞান হইতে বঞ্চিত করিতে পারে না। আমাদের কর্ত্তৃত্ব ভার আমরা আপনাপনিই বুঝিতে পারি —আমাদের অন্তরাত্মাই, ইহার প্রমাণ স্থল। প্রত্যেক ধর্ম্ম কালে আমাদের ত্যাগ যত অধিক হয়—আমাদের ধর্ম্ম-বল-যত প্রকাশ পায়; আমাদের স্বাধীনতা ও কর্ত্তৃত্ব আমরা ততই বুঝিতে পারি। বিবয়াকর্ষণের প্রতিকূলে আমাদের ইচ্ছাকে যে পরিমাণে নিয়োগ করি, সেই পরিমাণে বুঝিতে পারি যে আমি বিষয় ইইতে স্বতন্ত্র। এই প্রকার কর্ত্তৃত্ব জ্ঞান এবং কর্ত্তব্য জ্ঞান ধর্ম্মের এক প্রধান পুরস্কার এবং পরকালের প্রধান প্রমাণ স্থল। একবার কুপ্রবৃত্তির প্রতিস্রোতে গিয়া কে না আপনার স্বাধীনতা উপলব্ধি করিয়াছে? স্বার্থপরতাকে বিসর্জ্জন দিয়া কে না আপনাকে এ পৃথিবীর অনুপযুক্ত এবং শ্রেষ্ঠ লোকের উপযুক্ত বোধ করিয়াছে? একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র কার্য্য আপনার কর্ত্তৃত্ব ও স্বাধীনতাকে যেমন ব্যক্ত করে, শত শত যুক্তিতে তেমন করিতে পারে না। একটি কষ্টসাধ্য ধর্ম্ম-কার্য্য বিপক্ষবাদীদিগের যুক্তি খণ্ডনের অতি তীক্ষ্ণ, অস্ত্র। আমরা এখানে পরকালের আভাস কিছু মাত্র না পাইলে আর তাহাতে দৃঢ় বিশ্বাস হইত না। আমরা এখানেই মুক্ত ভাব উপলব্ধি না করিলে মুক্তির বিষয় কিছুই বুঝিতে পারিতাম না। এখানে আমরা বিষয়াকর্ষণকে যতবার নিরস্ত করিব; মুক্তভাব যত উপলব্ধি করিব; পরকাল ততই মনে জাগ্রহ হইয়া উঠিবে।

 যখন দেখিতে পাই—বিষয় স্রোতের প্রতিস্রোতেই অনেক সময় গমন করিতে হয়—ইন্দ্রিয় সুখকে বিসর্জ্জন দিতে হয়—ত্যাগ স্বীকার করিতে হয়; প্রবৃত্তির সহিত সংগ্রাম করিতে হয়; অথচ সেই সকল কার্য্যের পৃথিবীর সঙ্গে তাদৃশ যোগ নাই —তাহাতে সংসারেরও উন্নতি হয় না—ধন মানও উপার্জ্জন হয় না—স্বার্থপরতাও তৃপ্ত হয় না; তখন ইহাই প্রতীতি হয় যে আমি কেবল এই পৃথিবী লোকেরই জীব নহি, শ্রেষ্ঠ লোকের উপযুক্ত জ্ঞান ও ধর্ম্ম শিক্ষার জন্য এই পৃথিবীতে কিছুকাল অবস্থিতি করিতেছি। পশুদিগের তো এমন একটি অঙ্গ নাই, এমন একটি প্রবৃত্তি মাই, এমন কিছুই নাই, যাহা ইহকালের সম্যক্ উপযোগী না হইয়াছে মনুষ্যেরই এরূপ কেন? জন সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্তে আরো নানা উপায় হইতে পারিত—পরমেশ্বর মনুষ্যকে পশুদিগের ন্যায় কেবল প্রবৃত্তির বশীভূত করিতে পারিতেন; তিনি তাহার স্বার্থপরতাকে আরো দূরদর্শী করিয়া জনসমাজের মর্য্যাদা রক্ষা করিতে পারিতেন। কিন্তু মানুষ্য কেবল ইহকালের জীব নহে বলিয়া জগদীশ্বর এরূপ বিধান করেন নাই। ধর্ম্মের নিঃস্বার্থ ভাব পৃথিবীর ভাব হইতে অতি উচ্চ—সংসারের ক্ষুদ্র বিষয় সকলের একান্ত অনুপযোগী। মনুষ্য ধর্ম্মের সহিত নিষ্কাম মিত্রতা বন্ধন করিলে আপনার বৈষয়িক ক্ষতি বৃদ্ধির আশা ভয়ে বিশেষ ব্যাকুল হয়েন না, ধর্মানুষ্ঠানেই আপনাকে পবিত্র করিয়া পৃথিবী হইতেই উচ্চতর ধামের উপযুক্ত করেন। এখান হইতে আমরা পরকালের আভাস প্রাপ্ত হইতেছি। আমরা জীবদ্দশাতেই ধর্ম্মের অনুরোধে বিষয়ের প্রতিকূলে গিয়া মুক্তাবস্থা কতক উপলব্ধি করিতে পারিতেছি।  ঈশ্বরের সহিত এখানে আমাদের যোগ হইলে পরকালের বিশ্বাস আরো অটল হয়। ঈশ্বরের সঙ্গে এখানে একবার সম্বন্ধ নিবদ্ধ করিলে আর কেহই সে বিশ্বাসকে খণ্ডন করিতে পারে না। এই অখণ্ড বিশ্বাসের উপরে নির্ভর করিয়াই প্রাচীন ঋষিরা বলিয়া গিয়াছেন, ‘যএতদ্বিদুরমৃতান্তে ভবন্তি’ ‘যাঁহারা ইঁহাকে জানেন, তাঁহারা অমর হয়েন।’ ঈশ্বরের সহিত আমাদের চিরন্তন সম্বন্ধ—সে সম্বন্ধ একবার নিবদ্ধ হইলে আর কোন কালেই তাহা নিরাকৃত হইবার নহে। আমরা ঈশ্বরের আশ্রয়ে চিরকালই অবস্থিতি করিব; এই দৃঢ় বিশ্বাস তাপেক্ষা পরকালের দৃঢ়তর প্রমাণ আর কিছুই নাই। শুদ্ধ তর্ক-তরঙ্গের উপরে পরকালের বিশ্বাস নির্ম্মাণ করা কোন কার্য্যেরই নহে। বিপক্ষেরা তকের বলে ইহা কদাপি প্রমাণ করিতে পারেন না, যে জীবাত্মার বিনাশ বা ভঙ্গ হইবে। আমরা বরং উপমিতি দ্বারা প্রাপ্ত হইতেছি, যে জীবের বিনাশও নাই ভঙ্গও নাই। কিন্তু এই সকল তর্কের আড়ম্বরীতে আপনার বুদ্ধিকেই চরিতার্থ করা হয়। আত্ম-প্রত্যয়ে নির্ভর ব্যতীত কেবল বুদ্ধির সিদ্ধান্তে মনের নিষ্ঠা হয় না। আপনাকে ভুলিয়া বিষয়-স্রোতেই ভাসিতে থাকিলে সে প্রত্যয়টি উৎপন্ন হইতে পারে না; ধর্ম্ম ও ঈশ্বরের সহিত যোগ না হইলে সে প্রত্যয় দৃঢ়ীভূত হয় না। অস্থায়ী বিষয়-লালসাতে নিরন্তুর বিক্ষিপ্ত থাকিলে অনন্তু কালের প্রতি একবারও দৃষ্টিপাত হয় না। যাহার সহিত আমাদের চির সম্বন্ধ, যিনি আমাদের ইহকাল ও পরকালের একমাত্র উপজীব্য; তাঁহাকে এখানেই লাভ করিলে পরকালের বিষয়ে আর সংশয় থাকিতে পারে না। তাহা হইলে আমাদের এই অটল বিশ্বাস হয় যে তাঁহার আশ্রয় হইতে আমরা কোন কালেই বঞ্চিত হইব না—তাঁহার সহিত সম্বন্ধ কখনই ভঙ্গ হইবে না —তিনি আমাদের জ্ঞান-নেত্র হইতে আর কখনই অন্তরিত হইবেন না। তিনি অনন্ত কাল পর্যন্ত আমাদের স্পৃহাকে তৃপ্ত করিবেন-আশাকে পূর্ণ করিবেন—আত্মাকে শীতল করিবেন এবং স্বয়ং আপনাকে প্রদান করিয়া আমাদিগকে পরিপোষণ করিবেন। এই অটল বিশ্বাসই পরকালের দেদীপ্যমান প্রমাণ।