ভগ্নহৃদয়/একাদশ সর্গ
একাদশ সর্গ।
অনিল।
অনিল।—কিছুইত হোল না!
সেই সব—সেই সব—সেই হাহাকার রব
সেই অশ্রু-বারিধারা, হৃদয়-বেদনা!
কিছুতে মনের মঝে শান্তি নাহি পাই,
কিছুই না পাইলাম যাহা কিছু চাই!
ভাল ত গো বাসিলাম—ভালবাসা পাইলাম,
এখনোত ভালবাসি—তবুও কি নাই!
তবুও কেনরে হৃদি শিশুর মতন
দিবানিশি নিরজনে করিছে রোদন!
মনোমত হয়নি বা যা’ কিছু পেয়েছে,
সকলেরি মাঝে বুঝি অভাব বোয়েছে!
আশ মিটাইয়া বুঝি ভালবাসি নাই,
ভালবাসা পাইনি বা যখন চাই!
যেন গো কাহার তরে মন ব্যগ্র আছে,
অশরীরী ছায়া তার দাঁড়াইয়া কাছে;
দুই বাহু বাড়াইয়া করি প্রাণপণ
তাড়াতাড়ি ছুট গিয়ে করি আলিঙ্গন—
ছায়া শুধু—ছায়া শুধু—হৃদয় না পুরে—
তা’ চেয়ে রহেনা কেন শত ক্রোশ দূরে?
আমার এ উৰ্দ্ধশ্বাস পিপাসিত মন
নাহি অনুভবে তার হৃদয়-স্পন্দন;
মন চায় হাতে তার রাখি মোর হাত
বুকে তার মাথা রাখি করি অশ্রুপাত;
সেই ত ধরিনু হাত বুকে মাথা রাখি,
দৃঢ় আলিঙ্গন তারে করি থাকি থাকি;
কিন্তু এ কি হোল দায়, এ কিসের মায়া?
কিছু না ছুঁইতে পাই, ছায়া সব ছায়া!
তাই ভাবি, মন মোর যা কিছু পেয়েছে
সকলেরি মাঝে বুঝি অভাব রোয়েছে!
তৃষিত হৃদয় চায় ভালবাসা যত
ললিতা ফিরায়ে বুঝি দেয়নাক’ তত!
আমি চাই এক সুরে দুই হৃদি বাজে,
আবরণ নাহি রয় দুজনার মাঝে!
সমুদ্র চাহিয়া থাকে আকাশের পানে,
আকাশ সমুদ্রে চায় অবাক নয়ানে,
তেমনি দোঁহার হৃদি হেরিবে দোঁহায়,
পড়িবে উভের ছায়া উভয়ের গায়!
কিন্তু কেন, ললিতার এত কেন লাজ!
এত কেন ব্যবধান দুজনার মাঝ?
মিলিবার তরে যাই হইয়া অধীর,
মাঝেতে কেনরে হেন লৌহের প্রাচীর?
আমি যাই তাড়াতাড়ি করিতে আদর,
তারে হেরে উল্লাসেতে নাচেগো অন্তর,
মিলিবারে অর্দ্ধপথে সে আসেনা ছুটে,
তার মুখে একটিও কথা নাহি ফুটে!
জানিগো ললিতা মোরে ভাল বাসে মনে,
যাতে আমি ভাল থাকি করে প্রাণপণে;
কিন্তু তাহে কিছুতেই তৃপ্ত নহে প্রাণ,
দুজনার মাঝে কেন এত ব্যবধান?
যেমন নিজের কাছে লাজ নাহি থাকে
তেমনিই মনে কেন করেনা আমাকে?
কিছুই গো হোল না!
সেই সব, সেই সব—সেই হাহাকার রব
সেই অশ্রুবারিধারা হৃদয় বেদনা!
ললিতার প্রবেশ।
ললিতা।—কেন গো বিষণ্ন হেরি নাথের বদন?
জেনে কি দোষ কিছু কোরেছি এমন?
একবার কাছে গিয়ে ধরি দুটি হাত
শুধাব কি—“হোয়েছে কি? অবোধ ললিতা সেকি
না বুঝে হৃদয়ে তব দিয়েছে আঘাত?”
সেদিন ত, শুধালেন নাথ যবে আসি—
“একবার বল্তরে—ভাল কি বাসিস মোরে?”
মুক্তকণ্ঠে বলেছিনু “নাথ, ভালবাসি!”
একেবারে সব লজ্জা দিনু বিসর্জন,
বুকে তাঁর মুখ রেখে কোরেছি রোদন—
কাঁদিয়ে কোহেছি কথা, জানায়েছি সব ব্যথা
যত কথা রুদ্ধ ছিল মরম তলেতে,
এত দিন বলি বলি পারিনি বলিতে!
সেদিন ত কোন লজ্জা ছিলনাকো আর;
কিন্তু গো আবার কেন উদিল আবার!
হেথায় দাঁড়ায়ে আমি রহি একধারে
এখনি দেখিতে নাথ পাবেন আমারে!
ডাকিলেই কাছে গিয়ে, সব লজ্জা বিসর্জ্জিয়ে
একেবারে পায়ে ধোরে কেঁদে গিয়ে কব’
“বল নাথ কি কোরেছি? কি হোয়েছে তব?”
অনিল।—এমন বিষন্ন হােয়ে বােসে আছি হেথা
তবুও সে দূরে আছে—তবু সে এলনা কাছে,
তবুও সে শুধালে না একটিও কথা!
পাষাণ বজ্রেতে গড়া এ লজ্জা তাহার,
প্রেম বরিষার নদী ভাঙ্গিতে নারিল যদি
দয়াতেও ভাঙ্গিবেনা হেরি অশ্রুধার?
লজ্জার একাধিপত্য যে নিষ্ঠুর মনে,
প্রেম দয়া যে হৃদয়ে বাস করে ভয়ে ভরে
চরণে শৃঙ্খল বাঁধা লজ্জার শাসনে—
অনিল কি করিবিরে লয়ে হেন মন?
তুই চাস মুখে তোর হেরিলে বিষাদ ঘোর
অশ্রুজলে অশ্রুজল করিবে বর্ষণ!
কতনা আদরে তোর মুছাবে নয়ন!
তুই কি চাস্রে হেন পাষাণ মুরতি
দূরে দাঁড়াইয়া রবে— একটি কথা না কবে,
সান্তনার তরে যবে তুই ব্যগ্র অতি?
হায়রে অদৃষ্ট মোর—কিছুই হোলনা—
সেই সব, সেই সব—সেই হাহাকার রব
সেই অশ্রুবারিধারা হৃদয় বেদনা!
অনিলের বেগে প্রস্থান।
ললিতা।—(স্বগত)
নয়নে আঁধার হেরি, ঘুরিছে সংসার,
মাগো মা—কোথায় মাগো—পারিনে মা আর!
(বৃক্ষতলে বসিয়া পড়িয়া)
গেলে তবে গেলে চলি নিষ্ঠুর—নিষ্ঠুর—
ললিতা যে এক ধারে দাঁড়ায়ে রোয়েছে হারে—
একটু আদর তরে হোয়ে তৃষাতুর!
কখন্ ডাকিবে বোলে আছে মুখ চেয়ে,
একটু ইঙ্গিতে পায়ে পড়িত গো ধেয়ে—
দেখেও, দেখেও তারে গেলে গো চলিয়া,
একবার ডাকিলে না ললিতা বলিয়া?
দোষ কি কোরেছি কিছু সখাগো আমায়?
তার লাগি কেন না করিলে তিরস্কার?
একবার চাহিলে না—ফিরেও গো দেখিলে না,
এমন কি অপরাধ পারি করিবারে?
তবে কেন, কেন নাথ, বলনি আমারে?
যদি সখা পায়ে ধোরে শত-শতবার কোরে
শুধাই গো, বলিবে কি, কি দোষ কোরেছি?
অভাগিনী যদি নাথ, যদি মোরে যাই,
মরণ শয্যায় শুয়ে শেষ ভিক্ষা চাই,
চরণ দুখানি ধুয়ে শেষ অশ্রুজলে,
দুখিনী ললিতা তব কেঁদে কেঁদে বলে,
তবুও কি ফিরিবে না? তবুও কি চাহিবে না?
তবুও কি বলিবে না কি দোষ কোরেছি!
তবুও কি সখা তুমি যাইবে চলিয়া?
একবার ডাকিবে না ললিতা বলিয়া?