দ্বাদশ সর্গ।

নলিনী। বিজয়, বিনােদ, প্রমোদ, অশােক, সুরেশ,

নীরদ, ও অনিল।

সুরেশ।—যাইতে বলিছ বালা, কোথা যাব আর? 
দিগ্বিদিক হারাইয়া, ও রূপ-অনলে গিয়া
এ পতঙ্গ পাখা দুটি পুড়ায়েছে তার!
রূপসী, ক্ষমতা আর নাই উড়িবার!

নলিনী।—রূপ কিছু মোর না যদি থাকিত 

বড় হইতাম সুখী,
দেখিতাম যত পতঙ্গ তোমরা
আসিতে কি লোভ দেখি!
রূপ—রূপ—রূপ—পোড়া রূপ ছাড়া
আর কিছু মোর নাই?
তোমাদের মত পতঙ্গের দল
চারিদিকে ঘিরে করে কোলাহল,
দিবস রজনী করে জ্বালাতন,
ঝাঁপায়ে পড়ে গো না মানে বারণ;
পোড়া রূপ থেকে এই যদি হোল
হেন রূপ নাহি চাই!
হেন কেহ নাই হায়—

শুধু ভালবাসে নলিনী বালারে
আর কিছু নাহি চায়!
(অশােকের প্রতি) 
এই যে অশোক! ওই দেখ সখা—
দিবে কি আমারে দিবে কি তুলে
বক্ষ হোতে মোর ফুল উড়ে গিয়ে
পোড়েছে তোমার চরণ-মূলে!
যদি সখা ওটি রাখিতে চাও
তোমারি কাছেতে রাখিয়া দাও;—
দুদণ্ডেই ওটি যাইবে শুকায়ে
শুকায়ে গেলেই দিওগো ফেলে,
যতখণ ওটি নাহি পড়ে ঝোরে
ততখণো যদি মনে রাখ মোরে,
ততখনো যদি না থাক’ ভুলে,
তা’হোলেও সখা বড় ভাগ্য মানি
চিরকাল মনে সে কথা রবে;—
যদি সখা নাহি লইতে চাও
এখনি ভূতলে ফেলিয়া দাও,
চরণে দলিয়া ফেল গো তবে!
কত শত হেন অভাগা কুসুম
আপনি পোড়েছে চরণে আসি,
কত শত লোক চেয়েও দেখেনি,
চরণে দলিয়া গিয়াছে হাসি,
তবে আর কেন, ফেলগো দলিয়া

কিসের সরম আমার কাছে?
যে কুসুম, সখা, শাখা হোতে ঝোরে
চরণের নীচে পড়ে সাধ কোরে,
কে না জানে বল তাহার কপালে
চরণে দলিয়া মরণ আছে!
(নীরদের প্রতি) 
এই যে নীরদ, এনেছ গাঁথিয়া
গোলাপ ফুলের হার!
ভূলে গেছ কেন বাছিয়া ফেলিতে
কাঁটা গুলি, সখা, তার?
তবে গো পরায়ে দাও—
না হয় কাঁটায় ছিঁড়িবে হৃদয়,
না হয় এ বুক হবে রক্তময়,
এনেছ গাঁথিয়া গোলাপ যখন
তবে গো পরায়ে দাও!
কতই না কাঁটা বিঁধিয়াছে হেথা
রাখিতে গোলাপ বুকের কাছে,
জ্বলুক হৃদয়—বহুক্ শোণিত,
তা’ বোলে গোলাপ ফেলিতে আছে?
(প্রমােদের প্রতি) 
চাইনে তোমার ফুল উপহার,
যাও—হেথা হোতে যাও!
দুটি ফুল দিয়ে, ফুল বিনিময়ে
হাসি কিনিবারে চাও!

নলিনি, নলিনি, কেনরে হলিনি
পাষাণ-কঠিন মন?
দুটো কথা শুনে—দুটো ফুল পেয়ে
ভাঙ্গে কেন তোর পণ?
পলকে পলকে ভাঙ্গিস্ গড়িস্,—
ভেঙ্গে যায় মৃদু শ্বাসে,
যার পরে তুই করিস্‌লো মান
সেই মনে মনে হাসে!
দেখি আজ তুই কেমন পারিস্
থাকিবারে অভিমানে?
কহিনে কথা-হাসিনে হাসি—
চাহিনে তার পানে!
বিনােদ।—একটি কথাও কহিল না মােরে, 
পাশ দিয়া গেল চলি!
গর্ব্ব-ভার-গুরু প্রতি পদক্ষেপে
মরমে মরমে দলি।
কেন গো—কেন গো কি আমি কোরেছি—
কিছুত না পড়ে মনে,
কহেছে ত কথা প্রমোদের সাথে
অশোক—নীরদ সনে!
গেল যে হৃদয়—কত দিন আর
রবে সে এমন করি।
কখনো উঠিয়া আকাশের পরে
কখনো পাতালে পড়ি!

অনিল।—(দূর হইতে দেখিয়া) 
না জানি কিসের জ্যোতি নয়নে আছে গো বালা!
যেদিকে চাহিয়া দেখ সেদিক করিছ আলা।
অন্ধকার-ভেদী এক হাসিময় তারা সম—
প্রাণের ভিতর পানে চাহিয়া রোয়েছ মম!
ফিরায়ে লইনু মুখ তবুও কেনগো দেখি
চাহিছে হৃদয় পানে দুটি হাসিমাখা আঁখি!
আঁখি মুদি, তবু কেন হেরিগো প্রাণের কাছে
দুটি আঁখি চেয়ে আছে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে!
হেথা না পাইবি ঠাঁই—দূর হ’ তুইরে তারা—
চন্দ্রমা জোছনা করি এ হৃদি রেখেছে ভরি,
তুই তারা সে আলোকে হইবি আপনা-হারা!
দূর হ’রে—দূর হ’রে-দূর হ’রে ক্ষুদ্র তারা!
কিন্তু কি মধুর মুখ ভাব ভরে ঢল ঢল!
কোমল কুসুম সম সমীরণে টল মল।
দেখিনি এহেন মুখ সুমধুর ভাব ময়,
কেন? ললিতার মুখ এ হোতে কি ভাল নয়?
আহা সে মধুর বড় ললিতার মুখ খানি,
আঁখি কত কথা কয়, মুখেতে নাইক বাণী;—
বাহির হইতে চায় তার সেই মৃদু হাসি,
অধরের চারিধারে কতবার উঁকি মারে,
লজ্জায় মরিয়া যায় কেবল দুই পা আসি!
তার মুখ পূর্ণ-রাকা সরমের মেঘে ঢাকা,
মধুর মুখানি তার আমি বড় ভালবাসি!

ললিতার চেয়ে কি গো মুখ খানি ভাল এর?
উভেরি মধুর মুখ-দুই ভাব দুজনের—
ললিতা সে লাজময়ী মুখেতে নাইক কথা
মাটি পানে চেয়ে আছে যেন লজ্জাবতী লতা।
নলিনী, নলিনী সম কেমন রোয়েছে ফুটি,
বরষার নদী জল করিতেছে টলমল
হেলি দুলি লহরীতে পড়িতেছে লুটি লুটি।—
উভেরি মধুর মুখ ললিতার, নলিনীর,
অধীর সৌন্দর্য্য-কারো, কারো বা প্রশান্ত স্থির!
কিন্তু নলিনীর মুখ ভাবের খেলার গেহ
সেথা ভাব-শিশু গুলি করিতেছে কোলাকুলি,
কেহবা অধরে হাসে, নয়নে নাচিছে কেহ,
এই যে অধরে ছিল এই সে নয়নে গেছে,
দুদণ্ড খেলায়ে কেহ ঘুমাইয়া পড়িয়াছে!
কভুবা দু’তিন জনে নাচিতেছে এক সনে,
পলক পড়িতে চোখ আরত তাহারা নাই;
নলিনীর মুখখানি ভাবের খেলার ঠাই!
নলিনীর মুখ পানে যতই চাহিয়া থাকি
নূতন নূতন শোভা দেখিতে পায়যে আঁখি;
কিন্তু ললিতার মুখ কখনো এমন নয়।
এত সে কয়না কথা, এত ভাব নাই সেথা,
নহেগো এমনতর অধীর মাধুর্য্য ময়!
নাইবা এমন হোল তাহাতে কি আছে হানি।
না হয় দেথিতে ভাল নলিনীর মুখখানি!

তবু ললিতারে মোর ভাল আমি বাসি ত রে!
তবু ত সৌন্দর্য্য তার এ হৃদি রোয়েছে ভোরে!
রূপেতে কি যায় আসে? রূপ কেবা ভাল বাসে?
ললিতা নলিনী কাছে না হয় রূপেতে হারে—
ভালবাসি—ভালবাসি—তবু আমি ললিতারে!
নলিনী।—(বিনােদের কাছে পুনর্ব্বার ফিরিয়া আসিয়া) 
কেন হেন আহা মলিন আনন,
আঁখি নত মাটি পানে!
তোমারে বিনোদ পাইনি দেখিতে
দাঁড়াইয়া এই খানে!
শিথিল হইয়া পড়েছে ঝুলিয়া
ফুলের বলয় মোর,
দাওনাগো সখা দাওনা তুলিয়া
বাঁধগো আঁটিয়া ডোর!




(নলিনীর গান)


এস মন, এস, তোমাতে আমাতে
মিটাই বিবাদ যত!
আপনার হোয়ে কেন মোরা দোঁহে
রহিগো পরের মত?
আমি যাই এক দিকে, মন মোর!
তুমি যাও আর দিকে,
যার কাছ হোতে ফিরাই নয়ন
তুমি চাও তার'দিকে!

তার চেয়ে এস দুজনে মিলিয়ে
হাত ধোরে যাই এক পথ দিয়ে,
আমারে ছাড়িয়ে অন্য কোন খানে
যেওনা কখনো আর!
পারিনা কি মোরা দুজনে থাকিতে,
দোঁহে হেসে খেলে কাল কাটাইতে?
তবে কেন তুই না শুনে বারণ
যাস্‌রে পরের দ্বার?
তুমি আমি মোর থাকিতে দুজন,
বল্ দেখি, হৃদি, কিবা প্রয়োজন
অন্য সহচরে আর?
এত কেন সাধ বল্ দেখি, মন,
পর ঘরে যেতে যখন তখন,
সেথা কিরে তুই আদর পা’স?
বল্‌ত কতনা সহিস্ যাতনা?
দিবানিশি কত সহিস্ লাঞ্ছনা?
তবু কিরে তোর মিটেনি আশ?
আয়, ফিরে আয়—মন, ফিরে আয়—
দোঁহে এক সাথে করিব বাস!
অনাদর আর হবেনা সহিতে,
দিবস রজনী পাষাণ বহিতে,
মরমে দহিতে, মুখে না কহিতে,
ফেলিতে দুখের শ্বাস!
শুনিলিনে কথা? আসিলিনে হেথা?

ফিরিলিনে একবার?
সখিলো, দুরন্ত হৃদয়ের সাথে
পেরে উঠিনেত আর!
“নয়রে সুখের খেলা ভালবাসা!”
কত বুঝালেম তায়,—
হেরিয়া চিকণ সোণার শিকল
খেলাইতে যায় হৃদয় পাগল—
খেলাতে খেলাতে না জেনে না শুনে
জড়ায় নিজের পায়!
বাহিরিতে চায় বাহিরিতে নারে,
করে শেষে হায় হায়!
শিকল ছিঁড়িয়ে এসেছে ক’বার
আবার কেন রে যায়?
চরণে শিকল বাঁধিয়া কঁদিতে
না জানি কি সুখ পায়!
তিলেক রহেনা আমার কাছেতে
যতই কাঁদিয়া মরি,
এমন দুরন্ত হৃদয় লইয়া
স্বজনি, বল্ কি করি?




অনিল।—ওঠ্ হেথা হােতে—চল্ চল্ যাই, 
কি কারণে হেথা আছিস্ আর!
মুদিয়া আসিছে মনের নয়ন,

মনের চরণে পড়িছে ভার!
ললিতা আমার! না থাকুক্ রূপ
নাইবা গাহিতে পারিলি গান,
ভাল বাসি তোরে, ভাল বাসিব রে
যত দিন দেহে রহিবে প্রাণ!
(নলিনী ব্যতীত আর সকলের প্রস্থান)
নলিনী।—পারিনে ত আর, বসি এই খানে, 
ওই যে এদিকে আসিছে কবি!
কথা আজ মোরে কহিতে হইবে,
র'বনা বসিয়া অচল ছবি!
কি কথা বলব? ভাবিতেছি মনে,
কিছুই ত ভেবে নাহিক পাই;
বলিব কি তারে—“তোমরা কবিগো,
তোমাদের ভাল বাসিতে নাই!
বুঝিতে পারনা আপনার মন,
দিবা নিশি বৃথা করগো শোক,
ভাল বাসা তরে আকুল হৃদয়
ভাল বাসিবার পাওনা লোক!
মনে তোমাদের সৌন্দর্য্য জাগিছে
ধরায় তেমন পাওনা খুঁজে,
তবুও ত'ভাল বাসিতেই হবে
নহিলে কিছুতে মন না বুঝে!
অবশেষে কারে পাও দেখিবারে
নেশায় আপনা ভুলি,

সাজাইয়া দেয় কলপনা তারে
নিজের গহনা খুলি।
আসি কলপনা কুহকিনী বালা
নয়নে কি দেয় মায়া,
কলপনা তারে ঢেকে রাখে নিজে
দিয়ে নিজ জ্যোতি ছায়া।
কল্পনা-কুহকে মায়া মুগ্ধ চোকে
কি দেখিতে দেখ কিবা,
অপরূপ সেই প্রতিমা তাহার
পূজ মনে নিশি দিবা!
যত যায় দিন, যত যায় দিন,
যত পাও তারে পাশে
দেবীর জ্যোতি সে হারায় তাহার
মানুষ হইয়া আসে!
ভাল বাসা যত দূরে চলি যায়
হাহাকার কর মনে,
কলপনা কাঁদে ব্যথিত হইয়া
আপনার প্রতারণে!
আমি গো অবলা-কবির প্রণয়
অত নাহি করি আশা,
আমি চাই নিজ মনের মানুষ
শাদাশিদে ভালবাসা!”
এমনি করিয়ে বাতাসের পরে
মিছে অভিমান বাঁধি

অকারণে তার করিব লাঞ্ছনা
অভিমানে কাঁদি কাঁদি।
কিছুতে সান্ত্বনা না আমি মানিব,
দূরেতে যাইব চোলে
কাছেতে আসিতে করিব বারণ
করুণ চোখের জলে।