ভগ্নহৃদয়/তৃতীয় সর্গ
তৃতীয় সর্গ।
মুরলা ও অনিল।
অনিল।—ও হাসি কোথায় তুই শিখেছিলি বোন?
বিষন্ন অধর দুটি অতি ধীরে ধীরে টুটি
অতি ধীরে ধীরে ফুটে হাসির কিরণ।
অতি ঘন মেঘমালা ভেদি স্তরে স্তরে, বালা,
সায়াহ্ন জলদ প্রান্তে দেয় যথা দেখা
ম্লান তপনের মৃদু কিরণের রেখা।
কত ভাবনার স্তর ভেদ করি পর পর
ওই হাসি টুকু আসি পঁহুছে অধরে!
ও হাসি কি অশ্রুজলে সিক্ত থরে থরে?
ও হাসি কি বিষাদের গোধূলির হাস?
ও হাসি কি বরষার সুকুমারী লতিকার
ধৌতরেণু ফুলটির অতি মৃদু বাস?
মুরলারে, কেন আহা, এমন তু’ হলি!
এত ভালবাসা কারে দিলি জলাঞ্জলি?
যে জন রেখেছে মন শূন্যের উপরে,
আপনারি ভাব নিয়া উলটিয়া পালটিয়া
দিনরাত যেই জন শূন্যে খেলা করে,
শূন্য বাতাসের পটে শত শত ছবি
মুছিতেছে, আঁকিতেছে—শতবার দেখিতেছে,
সেই এক মোহময় স্বপ্নময় কবি—
সদা যে বিহ্বল প্রাণে চাহিয়া আকাশ পানে,
আঁখি যার অনিমিষ আকাশের প্রায়,
মাটিতে চরণ তবু মাটিতে না চায়—
ভাবের আলোকে অন্ধ তারি পদতলে
অভাগিনী, লুটাইয়া পড়িলি কি বোলে?
সেকিরে, অবোধ মেয়ে, বারেক দেখিবে চেয়ে?
জানিতেও পারিবে না যাইবে সে চোলে,
যুঁথিকা-হৃদয় তোর ধূলি সাথে দোলে।
এত ভালবাসা তারে কেন দিলি হায়?
সাগর-উদ্দেশগামী তটিনীর পায়
ভাবিয়া না চিন্তিয়া যথা অবহেলে
ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী দেয় আপনারে ঢেলে।
নিশীথের উদাসীন পথিক সমীর
শূন্য হৃদয়ের তাপে হইয়া অধীর,
কুসুম-কানন দিয়া যায় যবে কোয়ে,
আকুলা রজনীগন্ধা কথাটি না কোয়ে,
প্রাণের সুরভি সব দিয়া তার পায়,
পর দিন বৃন্ত হোতে ঝোরে পোড়ে যায়।
মেঘের দুঃস্বপ্নে মগ্ন দিনের মতন
কাঁদিয়া কাটিবে কিরে সারাটি যৌবন?
কেঁদে কেঁদে শ্রান্ত হোয়ে দীন অতিশয়—
আপনার পানে তবে চাহিয়া দেখিবি যবে
দেখিবি জীবন দিন সন্ধ্যা হয় হয়!
যে মেঘ মাঝারে থাকি উদিলি প্রভাতে
সেই মেঘ মাঝে থাকি অস্ত গেলি রাতে।
মুরলা।—কি জানি কেমন!
মুরলার সুখের কি দুঃখের জীবন!
সুখ দুঃখ দিনরাত মিলিয়া উভয়ে
রেখেছে সায়াহ্ণ করি এ শান্ত হৃদয়ে।
হেন আলিঙ্গনে তারা রয়েছে সদাই
যেন তারা দুটি সখা, যেন দুটি ভাই।
জোছনা ও যামিনীতে প্রণয় যেমন
তেমনি মিলিয়া তারা রোয়েছে দুজন।
সুখের মুখেতে থাকে দুখের কালিমা,
দুখের হৃদয়ে জাগে সুখের প্রতিমা।
একা যবে বসে থাকি স্তব্ধ জোছনায়,
বহে বাতায়ন পানে নিশীথের বায়,
বড় সাধ যায় মনে যারে ভালবাসি
একবার মুহূর্ত সে বসে কাছে আসি,
দুটি শুধু কথা কহে—একটু আদর—
সেই স্তব্ধ জোছনায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া হায়
মরিয়া যাইগো তারি বুকের উপর।
যখনি কবিরে দেখি সব যাই ভূলে,
কিছুই চাহিনা আর—কিছুই ভাবি না আর—
শুধু সেই মুখে চাই দুটি আঁখি তুলে।
দেখি দেখি—কি যে দেখি, কি বলিব কি সে!
হৃদয় গলিয়া যায় জোছনায় মিশে।
জোছনার মত, সেই বিগলিত হিয়া
প্রাণের ভিতরে ধরি একবারে মগ্ন করি
কবিরে চৌদিকে যেন থাকে আবরিয়া।
মনে মনে মন যেন কাঁদিয়া দু’করে
কবির চরণ দুটি জড়াইয়া ধরে;
আঁখি মুদি “কবি—কবি” বলে শতবার,
শতবার কেঁদে বলে “আমার-আমার;”
“আমার আমার” যেন বলিতে বলিতে
চাহে মন একেবারে জীবন ত্যজিতে;
সুখেতে কি দুখে যেন ফেটে যায় বুক,
সুখ বলে দুখ আমি, দুখ বলে সুখ।
কোথা কবি কোথা আমি, সে যেগো দেবতা,
তারে কি কহিতে পারি প্রণয়ের কথা?
কবি যদি ভূলে কভু মোরে ভালবাসে
তা’ হোলে যে ম’রে যাব সঙ্কোচে উল্লাসে।
চাইনা, চাইনা আমি প্রণয় তাঁহার,
যাহা পাই তাই ভাল স্নেহ সুধা-ধার।
শুকতারা স্নেহ-মাখা করুণ নয়ানে
চেয়ে থাকে অস্তমান যামিনীর পানে,
তেমনি চাহেন যদি কবি স্নেহ ভরে
মুরলার ক্ষুদ্র এই হৃদয়ের পরে,
তাহা হোলে নয়নের সামনে তাঁহার
হাসিয়ে ফুরায়ে যাবে জীবন আমার।
অনিল।—স্বার্থপর, আপনারি ভাবভরে ভাের,
আজিও সে দেখিল না হৃদয়টি তোর?
সর্বস্ব তাহারি পদে দিয়া বিসর্জ্জন
কাঁদিয়া মরিছে এক দীন-হীন মন,
ইহাও কি পড়িল না নয়নে তাহার?
আপনারে ছাড়া কেহ নাহি দেখিবার?
নিশ্চয় দেখেছে, তবু দেখেও দেখেনি,
দেখেছে সে—নিরুপায়, নিতান্তই অসহায়
ভালবাসিয়াছে এক অভাগা রমণী,
দেখেছে—হৃদয় এক ফাটিয়া নীরবে,
একান্ত মরিবে তবু কথা নাহি কবে;
দেখেও দেখেনি তবু, পশু সে নির্দ্দয়!
ভাঙ্গিয়া দেখিতে চাহে রমণী হৃদয়।
শতধা করিতে চায় মন রমণীর,
দেখিবারে হৃদয়ের শির উপশির।
এমন সুন্দর মন মুরলা তোমার,
এমন কোমল, শান্ত, গভীর, উদার;
ও মহান্ হৃদয়েতে প্রেম জলধির
নাইরে দিগন্ত বুঝি, নাই তার তীর।
করিস্নে, করিস্নে ও হৃদি বিনাশ,
যৌবনেই প্রণয়েতে হোস্নে উদাস।
কহিগে প্রণয় তোর কবির সকাশে,
শুধাইগে ভাল তোরে বাসে কি না বাসে।
ভাল যদি নাই বাসে কেন সেই জন
মিছা স্নেহ দেখাইয়া বেঁধে রাখে মন?
না যদি করিতে পারে তোরে আপনার,
আপনার মত কেন করে ব্যবহার?
কথা নাহি কহে যেন, না করে আদর,
পরের মতন থাকে, দেখে তোরে পর!
নিরদয়-দয়া তোরে নাইবা করিল!
শত্রুতার ভালবাসা নাইবা বাসিল।
মুহূর্ত্ত সুখের তোরে দিয়া প্রলোভন
অসুখী করিবে কেন সারাটি জীবন?
দুদণ্ডের আদরেতে কভু ভুলিস্না!
আধেক সুখেতে কভু পূরে না বাসনা।
এখনি চলিনু তবে তার কাছে যাই,
ভাল বাসে কি না বাসে শুধাইতে চাই।
মুরলা।—মনে কোরেছিনু, ভাই, এ প্রাণের কথা
কাহারেও বলিব না যত পাই ব্যথা।
সেদিন সায়াহ্ণ কালে উচ্ছসি উঠিয়া
বড় নাকি কেঁদে মোর উঠেছিল হিয়া,
তাই আমি পাগলের মত একেবারে
ছুটিয়া তোমারি কাছে গেনু কাঁদিবারে।
উচ্ছ্বসি বলি যত কাহিনী আমার!
কেন রে বলিলি হা-রে, দুর্ব্বল, অসার?
ভালবাসিতেই যদি করিলি সাহস,
লুকাতে নারিস্ তাহা হা হৃদি অবশ?
পরের চোখের কাছে না ফেলিলে জল
আশ কি মেটেনা তোর রে আঁখি দুর্ব্বল?
মুরলারে, অভাগীরে,—কেন ভাল বাসিলিরে?
যদি বা বাসিলি ভাল কেন তোর মন
হোল হেন নীচ হীন, দুর্ব্বল এমন?
একটি মিনতি আজি রাখ গো আমার!
সহস্র যাতনা পাই আর কখনত ভাই
ফেলিব না তব কাছে অশ্রুবারি-ধার।
যেওনা কবির কাছে ধরি তব পায়,
ভূলে যাও যত কথা কহেছি তোমায়।
দয়া কোরে আরেকটি কথা মোর রাখ,’
যদি গো কবির পরে রোষ কোরে থাক’
মোর কাছে কভু আর কোরনাক’ নাম তাঁর
সে নাম ঘৃণার স্বরে কভু সহিব না,
জানালেম এই মোর প্রাণের প্রার্থনা!
অনিল।—তবে কি এমনি শুধু মিছে ভালবেসে
শূন্য এ জীবন তোর ফুরাইবে শেষে!
মুরলা।—যায় যদি যাক্ ভাই, ফুরায় ফুরাক্,
প্রভাতে তারার মত মিশায় মিশাক্;
মুরলার মত ছায়া কত আসে কত যায়,
কি হ’য়েছে তায়!
অবোধ বালিকা আমি, মিছে কষ্ট পাই,
এ জীবনে মুরলার কোন কষ্ট নাই।
স্নেহের সমুদ্র সেই কবি গো আমার,—
অনন্ত স্নেহের ছায়ে আমারে বেঁখেছে পায়ে,
তাই যেন চিরকাল থাকে মুরলার!
সে মেহের কোলে শুয়ে কাটায় জীবন!
সে স্নেহের কোলে প্রাণ করে বিসর্জ্জন!
কুসুমিত সে অনন্ত স্নেহ-রাজ্য পরে।
তিল স্থান থাকে যেন মুরলার তরে!
যত দিন থাকে প্রাণ-ব্যাপি সেই টুকু স্থান
মাটিতে মিশারে রবে হৃদয় আমার।
কোন-কোন-কোন সুখ নাহি চাহি আর।