ভগ্নহৃদয়/প্রথম সর্গ
ভগ্নহৃদয়।
প্রথম সর্গ।
দৃশ্য—বন। চপলা ও মুরলা।
চপলা।—সখি, তুই হলি কি আপনা-হারা?
এ ভীষণ বনে পশি, একেলা আছিস্ বসি
খুঁজে খুঁজে হোয়েছি যে সারা!
এমন আঁধার ঠাঁই—জনপ্রাণী কেহ নাই,
জটিল-মস্তক বট চারিদিকে ঝুঁকি!
দুয়েকটি রবি-কর সাহসে করিয়া ভর
অতি সন্তর্পণে যেন মারিতেছে উঁকি।
অন্ধকার, চারিদিক হ’তে, মুখ পানে
এমন তাকায়ে রয়, বুকে বড় লাগে ভয়,
কি সাহসে রোয়েছিস বসিয়া এখানে?
মুরলা।—সখি, বড় ভালবাসি এই ঠাঁই!
বায়ু বহে হুহু করি, পাতা কাঁপে ঝর ঝরি,
স্রোতস্বিনী কুলু কুলু করিছে সদাই!
বিছায়ে শুকানো পাতা, বট-মূলে রাখি মাথা,
দিনরাত্রি পারি সখি শুনিতে ও ধ্বনি।
বুকের ভিতরে গিয়া কি যে উঠে উথলিয়া
বুঝায়ে বলিতে তাহা পারিনা স্বজনী!
যা সখি, একটু মোরে রেখে দে একেলা,
এ বন আঁধার ঘোর, ভাল লাগিবেনা তোর,
তুই কুঞ্জ-বনে সখি কর গিয়ে খেলা!
চপলা।—মনে আছে, অনিলের ফুল-শয্যা আজ?
তুই হেথা বোসে র’বি, কত আছে কাজ!
কত ভোরে উঠে বনে গেছি ছুটে,
মাধবীরে লোয়ে ডাকি,
ডালে ডালে যত ফুল ছিল ফুটে
একটি রাখিনি বাকি!
শিশিরে ভিজিয়ে গিয়েছে আঁচল,
কুসুম-রেণুতে মাখা,
কাঁটা বিঁধে সখি হোয়েছিনু সারা
নোয়াতে গোলাপ-শাখা!
তুলেছি করবী, গোলাপ গরবী,
তুলেছি টগর গুলি,
যুঁই কুঁড়ি যত বিকেলে ফুটিবে
তখন আনিব তুলি।
আয়, সখি, আয়, ঘরে ফিরে আয়,
অনিলে দেখ্সে আজ;
হরষের হাসি অধরে ধরেনা,
কিছু যদি আছে লাজ!
মুরলা।—আহা সখি, বড় তারা ভালবাসে দুইজনে!
চপলা।—হ্যাঁ সখি, এমন আর দেখিনিত বর-কোনে!
জানিস্ত সখি, ললিতার মত
অমন লাজুক মেয়ে,
অনিলের সাথে দেখা করিবারে
প্রতি দিন যায় বিপাশার ধারে,
সরমের মাথা খেয়ে!
কবরীতে বাঁধি কুসুমের মালা,
নয়নে কাজল রেখা;
চুপি চুপি যায়, ফিরে ফিরে চায়,
বন-পথ দিয়ে একা!
দূর হোতে দেখি অনিলে, অমনি
সরমে চরণ সরে না যেন!
ফিরিবে ফিরিবে মনে মনে করি
চরণ ফিরিতে পারেনা যেন!
অনিল অমনি দূর হোতে আসি
ধরি তার হাত খানি,
কহে যে কত কি হৃদয়-গলানো
সোহাগে মাখানো বাণী
আমি ছিনু সখি লুকিয়ে তখন
গাছের আড়ালে আসি,
লুকিয়ে লুকিয়ে দেখিতেছিলেম
রাখিতে পারিনে হাসি!
কত কথা ক’য়ে, কত হাত ধরি,
কত শত বার সাধাসাধি করি,
বসাইল যুবা ললিতা বালারে
বকুল গাছের ছায়,
মাথার উপরে ঝরে শত ফুল;
যেন গো করুণ তরুণ বকুল,—
ফুল চাপা দিয়ে লাজুক মেয়েরে
ঢাকিয়া ফেলিতে চায়!
ললিতার হাত কাঁপে থর থর,
আঁখি দুটি নত মাটির উপর,
ভূমি হোতে এক কুসুম তুলিয়া
ছিঁড়িতেছে শত ভাগে।
লাজ-নত মুখ ধরিয়া তাহার
অনিল রাখিল বুকের মাঝার,
অনিমিষ আঁখি মেলিয়া যুবক
চাহি থাকে মুখ বাগে!
আদরে ভাসিয়া ললিতার চোখে
বাহিরে সলিল-ধার,
সোহাগে, সরমে, প্রণয়ে গলিয়া
আঁখি দুটি তার পড়িল ঢলিয়া,
হাসি ও নয়ন-সলিলে মিলিয়া
কি শোভা ধরিল মুখানি তার!
আমি সখি আর নারিনু থাকিতে
সুমুখে পড়িনু আসি,
করতালি দিয়ে উপহাস কত
করিলাম হাসি হাসি!
ললিতা অমনি চমকি উঠিল,
মুখেতে একটি কথা না ফুটিল,
আকুল ব্যাকুল হইয়া সরমে
লুকাতে ঠাঁই না পায়,
ছুটিয়ে পলায়ে এলেম অমনি
হেসে হেসে আর বাঁচিনে সজনি,
সে দিন হইতে আমারে হেরিলে
ললিতা সরমে মরিয়া যায়!
চপলা।—বাধা না পাইলে সখি সুখেতে কি সুখ আছে?
মুরলা।—সূর্য্যমুখী ফুল সখি আমি ভালবাসি বড়,
দু চারিটি তুলে এনে আজিকে করিস জড়!
মনে বড় সাধ তার দেখে রবি-মুখ পানে,
রবি যেথা, মাথা তার লোয়ে যায় সেইখানে;
তবু মনোআশা হায়, মনেই মিশায়ে যায়,
মুখানি তুলিতে নারে সরমেতে জড়সড়!
সে ফুলে সাজাবি দেহ লাজময়ী ললিতার,
লজ্জাবতী পাতা দিয়ে ঢাকিবি শয়ন তার;
কমল আনিয়া তুলি, লাজে-রাঙা পাপ্ড়ি গুলি
গাঁথি গাঁথি নিরমিয়া দিবি ঘোমটার ধার!
পাতা-ঢাকা আধ-ফুটো লাজুক গোলাপ দুটো
আনিস, দুলায়ে দিবি সুচারু অলকে তার!
সহসা রজনী-গন্ধা প্রভাতের আলো দেখে
ভাবিয়া না পায় ঠাঁই কোথা মুখ রাখে ঢেকে,
আকুল সে ফুল গুলি যতনে আনিস তুলি,
তাই দিয়ে গেঁথে গেঁথে বিরচিবি কণ্ঠহার।
ভাল নাহি লাগে বালা!
দুটি সখি মিলি হাসিতে হাসিতে,
গুণ গুণ গান গাহিতে গাহিতে
মনের মতন গাঁথিব মালা!
বল্ দেখি সখি হ’ল কি তোর?
হাসিয়া খেলিয়া কুসুম তুলিয়া
করিবি কোথায় ভাবনা ভুলিয়া
কুমারী-জীবন ভোর—
ত না, একি জ্বালা? মরমে মিশিয়া
আপনার মনে আপনি বসিয়া,
সাধ কোরে এত ভাল লাগে সখি
বিজনে ভাবনা-ঘোর!
তা’ হবেনা সখি, না যদি আসিস
এই কহিলাম তোরে—
যত ফুল আমি আনিয়াছি তুলি
আঁচল ভরিয়া ল’ব সব গুলি,
বিপাশার স্রোতে দিবলো ভাসায়ে
একটি একটি কোরে!
মুরলা।—মাথা খা, চপলা, মোরে জ্বালাসনে আর!
চপলা।—ভাল সই, জ্বালাবনা চলিনু এবার!
(গমনোদ্যম; পুনর্ব্বার ফিরিয়া আসিয়া)
না না সখি, এই আঁধার কাননে
একেলা রাখিয়া তোরে
কোথায় যাইব বল্ দিখি তুই,
যাইব কেমন কোরে?
তোরে ছেড়ে আমি পারি কি থাকিতে?
ভালবাসি তোরে কত!
আমি যদি সখি, হোতেম তোমার
পুরুষ মনের মত,
সারাদিন তোরে রাখিতাম ধোরে,
বেঁধে রাখিতাম হিয়ে,
একটুকু হাসি কিনিতাম তোর
শতেক চুম্বন দিয়ে!
অমিয়া-মাখানো মুখানি তোমার
দেখে দেখে সাধ মিটিতনা আর,
ও মুখানি লোয়ে কি যে করিতাম,
বুকের কোথায় ঢেকে রাখিতাম,
ভাবিয়া পেতাম তা’ কি?
সখি, কার তুমি ভালবাসা তরে
ভাবিছ অমন দিনরাত ধোরে,
পায়ে পড়ি তব খুলে বল তাহা
কি হবে রাখিয়া ঢাকি?
মুরলা।—ক্ষমা কর মোরে সখি, শুধায়োনা আর!
মরমে লুকানো থাক্ মরমের ভার!
যে গোপন কথা সখি, সতত লুকারে রাখি,
ইষ্ট-দেব-মন্ত্র সম পূজি অনিবার,
তাহা মানুষের কানে ঢালিতে যে লাগে প্রাণে,
লুকানো থাক্ তা সখি হৃদয়ে আমার!
ভালবাসি, শুধায়োনা কারে ভালবাসি!
সে নাম কেমনে সখি কহিব প্রকাশি!
আমি তুচ্ছ হোতে তুচ্ছ, সে নাম যে অতি উচ্চ,
সে নাম যে নহে যোগ্য এই রসনার!
ক্ষুদ্র ওই কুসুমটি পৃথিবী-কাননে,
আকাশের তারকারে পূজে মনে মনে—
দিন দিন পূজা করি শুকায়ে পড়ে সে ঝরি,
আজন্ম নীরব প্রেমে যায় প্রাণ তার—
তেমনি পূজিয়া তারে, এ প্রাণ যাইবে হা-রে
তবুও লুকানো রবে একথা আমার!
এ তোর কেমন কথা!
আজিও ত সখি না পেনু ভাবিয়া
এ কি প্রণয়ের প্রথা!
প্রণয়ীর নাম রসনার, সখি,
সাধের খেলেনা মত,
উলটি পালটি সে নাম লইয়া
রসনা খেলায় কত!
নাম যদি তার বলিস্, তা’হলে
তোরে আমি অবিরাম
শুনাব’ তাহারি নাম—
গানের মাঝারে সে নাম গাঁথিয়া
সদা গাব সেই গান!
রজনী হইলে সেই গান গেয়ে
ঘুম পাড়াইব তোরে,
প্রভাত হইলে সেই গান তুই
শুনিবি ঘুমের ঘোরে!
ফুলের মালায় কুসুম আখরে
লিখি দিব সেই নাম;
গলায় পরিবি—মাথায় পরিবি,
তাহারি বলয়, কাঁকন করিবি—
হৃদয়-উপরে যতনে ধরিবি
নামের কুসুম দাম!
যখনি গাহিবি তাহার গান,
যখনি কহিবি তাহার নাম,
সাথে সাথে সখি আমিও গাহিব,
সাথে সাথে সখি আমিও কহিব,
দিবারাতি অবিরাম—
সারা জগতের বিশাল আখরে
পড়িবি তাহারি নাম!
যখনি বলিবি তোর পাশে তারে
ধরিয়া অনিয়া দিব—
সুমুখ হইতে পলাইয়া গিয়া
আড়ালেতে লুকাইব।
দেখিব কেমন দুখ না ছুটে,
ওই মুখে তোর হাসি না ফুটে,—
ভূলিবি এ বন, ভূলিবি বেদন,
সখীরেও বুঝি ভূলিয়া যাবি!
বল্ সখি, প্রেমে পড়েছিস্ কার,
বল্ সখি বল্ কি নাম তাহার,
বলিবিনি কিলো? না যদি বলিস্
চপলার মাথা খাবি!
মুরলা।—(নেপথ্যে চাহিয়া) জীবন্ত স্বপ্নের মত, ওই দেখ্, কবি
একা একা ভ্রমিছেন আঁধার অটবী।
ওই যেন মূর্ত্তিমান ভাবনার মত,
নত করি দুনয়ন শুনিছেন একমন
স্তব্ধতার মুখ হোতে কথা কত শত!
(কবির প্রবেশ)
কবি।–বন-দেবীটির মত এইযে মুরলা,
প্রভাতে কাননে বসি ভাবনা-বিহ্বলা!
প্রকৃতি আপনি আসি লুকায়ে লুকায়ে,
আপনার ভাষা তোরে দেছে কি শিখায়ে?
দিনরাত কলস্বরে তটিনী কি গান করে
তাহা কি বুঝিতে তুই পেরেছিস্ বালা?
তাই হেতা প্রতিদিন আসিস্ একালা!
মুরলা! আজিকে তোরে বনবালা মত কোরে
চপলা সাজায়ে দিক্ দেখি একবার।
এলোখেলো কেশপাশে লতা দে বাঁধিয়া
অলক সাজায়ে দেলো তৃণফুল দিয়া—
ফুলসাথে পাতা গুলি, একটী একটী তুলি
অযতনে দেলো তাহা আঁচলে গাঁথিয়া!
হরিণ শাবক যত ভূলিবে তরাস,
পদতলে বসি তোর চিবাইবে ঘাস।
ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি মুখে তার দিবি তুলি,
সবিস্ময়ে সুকুমার গ্রীবাটী বাঁকায়ে
অবাক্ নয়নে তারা রহিবে তাকায়ে!
আমি হোয়ে ভাবে ভোর দেখিব মুখানি তোর,
কল্পনার ঘুমঘোর পশিবে পরাণে!
ভাবিব, সত্যই হবে, বনদেবী আসি তবে
অধিষ্ঠান হইলেন কবির নয়ানে!
তোমাদের দুজনার?
সখিরে আমার কি গুণ করেছ
বল দেখি একবার!
সখির আমার খেলাধূলা নেই
সারাদিন বসি থাকে বিজনেই,
জানিনা ত কবি এত দিন আছি
কিসের ভাবনা তার!
ছেলেবেলা হোতে তোমরা দুজনে
বাড়িয়াছ এক সাথে,
আপনার মনে ভ্রমিতে দুজনে
ধরি ধরি হাতে হাতে!
তখন না জানি কি মন্ত্র, কবি গো,
দিলে মুরলার কানে!
কি মায়া না জানি দিয়েছিলে পড়ি
সখীর তরুণ প্রাণে!
বেলা হোয়ে এল সজনি এখন,
করিয়াছে পান প্রভাত-কিরণ
ফুল-বধূটীর অধর হইতে
প্রতি শিশিরের কণা।
তুই থাক্ হেথা আমি যাই ফিরে,
অমনি ডাকিয়া লব মালতীরে,
একেলা ত বালা, অত ফুলমালা
গাঁথিবারে পারিবনা!
কবি।—মুরলা, তোমার কেন, ভাবনার ভাব হেন?
কতবার শুধায়েছি বলনি আমারে!
লুকায়োনা কোন কথা, যদি কোন থাকে ব্যথা
রুধিয়া রেখোনা তাহা হৃদয় মাঝারে!
হয়ত হৃদয়ে তব কিসের যাতনা
আপনি মুরলা তাহা জানিতে পারনা!
হয়ত গো যৌবনের বসন্ত সমীরে
মানস-কুসুম তব ফুটেছে সুধীরে,
প্রণয় বারির তরে তৃষায় আকুল
ম্ৰিয়মান হ’য়ে বুঝি পোড়েছে সে ফুল?
পেয়েছ কি যুবা কোন মনের মতন?
ভালবাসো, ভালবাসা করহ গ্রহণ;
তাহ’লে হৃদয় তব পাইবে জীবন নব,
উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বাসময় হেরিবে ভুবন।
মুরলা।—(স্বগত) বুঝিলেনা—বুঝিলেনা,—কবিগো এখনো
বুঝিলেনা এ প্রাণের কথা!
দেবতা গো বল দাও, এ হৃদয়ে বল দাও,
পারি যেন লুকাতে এ ব্যথা।
জানি, কবি, ভাল তুমি বাস’নাক মোরে,
তা’ হ’লে এ মন তুমি চিনিবে কি কোরে?
একটুকু ভাল যদি বাসিতে আমারে,
তা’ হ’লে কি কোন কথা, এ মনের কোন ব্যথা
তোমার কাছেতে কবি লুকায়ে থাকিতে পারে?
তাহা হ’লে প্রতি ভাবে, প্রতি ব্যবহারে,
মুখ দেখে, আঁখি দেখে, প্রত্যেক নিশ্বাস থেকে
বুঝিতে যা’ গুপ্ত আছে বুকের মাঝারে।
প্রেমের নয়ন থেকে প্রেম কি লুকানো থাকে?
তবে থাক্, থাক্ সব, বুকে থাক্ গাঁথা—
বুক যদি ফেটে যায়—ভেঙ্গে যায়—চূরে যায়—
তবু রবে লুকানো এ কথা,
দেবতাগো বল দাও—এ হৃদয়ে বল দাও
পারি যেন লুকাতে এ ব্যথা!
কবি।—বহুদিন হ’তে, সখি, আমার হৃদয়
হোয়েছে কেমন যেন অশান্তি-আলয়।
চরাচর-ব্যাপী এই ব্যোম-পারাবার
সহসা হারায় যদি আলোক তাহার,
আলোকের পিপাসায় আকুল হইয়া
কি দারুণ বিশৃঙ্খল হয় তা’র হিয়া!
তেমনি বিপ্লব ঘোর হৃদয় ভিতরে
হ’তেছে দিবস নিশা, জানিনা কি তরে!
নব-জাত উল্কা-নেত্র মহাপক্ষ গরুড় যেমন
বসিতে না পায় ঠাঁই চরাচর করিয়া ভ্রমণ,
উচ্চতম মহীরুহ পদভরে ভূমিতলে লুটে,
ভূধরের শিলাময় ভিত্তিমূল বিদারিয়া উঠে,
অবশেষে শূন্যে শূন্যে দিবারাত্রি ভ্রমিয়া বেড়ায়,
চন্দ্র সুর্য্য গ্রহ তারা ঢাকি ঘোর পাখার ছায়ায়;
তেমনি এ ক্লান্ত-হৃদি বিশ্রামের নাহি পায় ঠাঁই,
সমস্ত ধরায় তা’র বসিবার স্থান যেন নাই;
তাই এই মহারণ্যে অমারাত্রে আসিগো একাকী,
মহান্-ভাবের ভারে দুরন্ত এ ভাবনারে
কিছুক্ষণ তরে তবু দমন করিয়া যেন রাখি।
চন্দ্রশূন্য আঁধারের নিস্তরঙ্গ সমুদ্র মাঝারে
সমস্ত জগৎ যবে মগ্ন হ’য়ে গেছে একেবারে,
অসহায় ধরা এক মহামন্ত্রে হোয়ে অচেতন
নিশীথের পদতলে করিয়াছে আত্ম-সমৰ্পণ,
তখন অধীর হৃদি অভিভূত হোয়ে যেন পড়ে,
অতি ধীরে বহে শ্বাস, নয়নেতে পলক না নড়ে।
* * * *
প্রাণের সমুদ্র এক আছে যেন এ দেহ মাঝারে,
মহা উচ্ছ্বাসের সিন্ধু রুদ্ধ এই ক্ষুদ্র কারাগারে;
মনের এ রুদ্ধস্রোত দেহ খানা করি বিদারিত
সমস্ত জগৎ যেন চাহে সখি করিতে প্লাবিত!
অনন্ত আকাশ যদি হ’ত এ মনের ক্রীড়া-স্থল,
অগণ্য তারাকারাশি হ’ত তার খেলেনা কেবল,
চৌদিকে দিগন্ত আসি রুধিত না অনন্ত আকাশ,
প্রকৃতি জননী নিজে পড়াত কালের ইতিহাস,
দুরন্ত এ মন-শিশু প্রকৃতির স্তন্ত-পান করি
আনন্দ-সঙ্গীত স্রোতে ফেলিত গো শুন্যতল ভরি,
উষার কনক-স্রোতে প্রতিদিন করিত সে স্নান,
জ্যোছনা-মদিরা ধারা পূর্ণিমায় করিত সে পান,
ঘূর্ণ্যমান ঝটিকার মেঘমাঝে বসিয়া একেলা
কৌতুকে দেখিত যত বিদ্যুত-বালিকাদের খেলা,
দুরন্ত ঝটিকা হোথা এলোচুলে বেড়াত নাচিয়া
তরঙ্গের শিরে শিরে অধীর-চরণ বিক্ষেপিয়া।
হরষে বসিত গিয়া ধূমকেতু পাখার উপরে
তপনের চারিদিকে ভ্রমিত সে বর্ষ বর্ষ ধোরে |
চরাচর মুক্ত তার অবারিত বাসনার কাছে,
প্রকৃতি দেখাত তারে যেথা তার যত ধন আছে;
কুসুমের রেণুমাখা বসন্তের পাখায় চড়িয়া
পৃথিবীর ফুলবনে ভ্রমিত সে উড়িয়া উড়িয়া;
সমীরণ, কুসুমের লঘু পরিমল-ভার বহি
পথশ্রমে শ্রান্ত হোয়ে বিশ্রাম লভিছে রহি রহি,
সেই পরিমল সাথে আমনি সে যাইত মিলায়ে,
ভ্রমি কত বনে বনে, পরিমল রাশি সনে
অতি দূর দিগন্তের হৃদয়েতে যাইত মিশায়ে।
তটিনীর কলস্বর, পল্লবের মরমর,
শত শত বিহগের হৃদয়ের আনন্দ উচ্ছ্বাস,
সমস্ত বনের স্বর মিশে হ’ত একত্তর,
একপ্রাণ হোয়ে তারা পরশিত উন্নত আকাশ,
তখন সে সঙ্গীতের তরঙ্গে করিয়া আরোহন,
মেঘের সোপান দিয়া অতি উচ্চ শূন্যে গিয়া
উষার আরক্ত-ভাল পারিত গো করিতে চুম্বন!
কল্পনা, থাম গো থাম, কোথায়—কোথায় যাও নিয়ে?
ক্ষুদ্র এ পৃথিবী, দেবী, কোন্ খেনে রেখেছি ফেলিয়ে,
মাটীর শৃঙ্খল দিয়ে বাঁধা যে গো রোয়েছে চরণ,
যত উচে আরোহিব, তত হবে দারুণ পতন!
কল্পনার প্রলোভনে নিরাশার বিষ ঢাকা,
শূন্য অন্ধকার মেঘে সন্ধ্যার কিরণ মাখা;
সেই বিষ প্রাণ ভোরে সখিলো করিনু পান,
মন হ’য়ে গেল, সখি, অবসন্ন—ম্রিয়মান।
মুরলা।-কবিগো, ও সব কথা ভেবোনাকো আর,
শ্রান্ত মাথা রাখ’ এই কোলেতে আমার।
কবি –সখি, আর কত দিন সুখ হীন, শান্তি হীন,
হাহা কোরে বেড়াইব, নিরাশ্রয় মন লোয়ে!
পারিনে, পারিনে আর—পাষাণ মনের ভার
বহিয়া, পড়েছি সখি, অতি শ্রান্ত ক্লান্ত হোয়ে।
সম্মুখে জীবন মম হেরি মরুভূমি সম,
নিরাশা বুকেতে বসি ফেলিতেছে বিষশ্বাস।
উঠিতে শকতি নাই, যেদিকে ফিরিয়া চাই
শূন্য—শূন্য—মহাশূন্য নয়নেতে পরকাশ।
কে আছে, কে আছে, সখি, এ শ্রান্ত মস্তক মম
বুকেতে রাখিবে ঢাকি যতনে জননী সম!
কে আছে, অজস্র স্রোতে প্রণয় অমৃত ভরি
অবসন্ন এ হৃদয় তুলিবে সজীব করি!
মন, যতদিন যায়, মুদিয়া আসিছে হায়,
শুকায়ে শুকায়ে শেষে মাটীতে পড়িবে ঝরি।
মুরলা।—(স্বগত) হা কবি, ও হৃদয়ের শূন্য পূরাইতে
অভাগিনী মুরলাগো কি না পারে দিতে!
কি সুখী হোতেম, যদি মোর ভালবাসা
পূরাতে পারিত তব হৃদয় পিপাসা!
শৈশবে ফুটেনি যবে আমার এ মন,
তরুণ প্রভাত সম, কবিগো, তখন
প্রতিদিন ঢালি ঢালি দিয়েছ শিশির,
প্রতিদিন যোগায়েছ শীতল সমীর,
তোমারি চোখের পরে করুণ কিরণে
এ হৃদি উঠেছে ফুটি তোমারি যতনে;
তোমারি চরণে কবি দেছি উপহার,
যা কিছু সৌরভ এর তোমারি—তোমার।
(প্রকাশ্যে) তােল কবি, মাথা তােল, ভেবোনা এমন,
দুজনে সরসী তীরে করিগে ভ্রমণ।
ওই চেয়ে দেখ, কবি, তটিনীর ধারে
মধ্যাহ্ন কিরণ লোয়ে, বন-দেবী স্তব্ধ হোয়ে
দিতেছে বিবাহ দিয়া আলোকে আঁধারে।
সাধের সে গান তব শুনিবে এখন?
তবে গাই, মাথা তোেল, শোন দিয়ে মন।
গান।
কত দিন একসাথে ছিনু ঘুম ঘোরে,
তবু জানিতাম নাকো ভালবাসি তোরে।
মনে আছে ছেলেবেলা কত খেলিয়াছি খেলা,
ফুল তুলিয়াছি কত দুইটি আঁচল ভোরে!
ছিনু সুখে যত দিন দুজনে বিরহ হীন
তখন কি জানিতাম ভালবাসি তোরে?
অবশেষে এ কপাল ভাঙ্গিল যখন,
ছেলেবেলাকার যত ফুরাল’ স্বপন,
লইয়া দলিত মন হইনু প্রবাসী,
তখন জানিনু, সখি, কত ভালবাসি।