১৩

শান্তিনিকেতন

 আজ সকালে তোমার চিঠি পেলুম। তখন তো আমার সময় থাকে না, তাই এখন খাওয়ার পরে লিখ্‌তে ব’সেচি। আর খানিক পরে ম্যাট্রিক্‌-ক্লাসের ছেলেরা দল বেঁধে খাতাপত্র নিয়ে হাজির হবে। তুমি যে-নিয়ম ক’রে দিয়ে গিয়েছিলে, আজকাল সে আর পালন করা হ’য়ে ওঠে না; খাওয়ার পরে দুপুর বেলায় শোওয়া একে বারে ছেড়ে দিয়েচি—সেই ডেস্কের সাম্‌নে সেই চৌকি নিয়ে আমার দিন কাটে। সে জন্যে আমার নালিশ নেই, কাজের দরকার প’ড়লেই কাজ ক’র্‌তে হবে। পৃথিবীতে ঢের লোক আমার চেয়ে ঢের বেশি কাজ করে—সেও আবার অফিসের কাজ—অর্থাৎ সে-কাজ পেটের দায়ে, মনের আনন্দে নয়। আমি-যে ছেলেদের পড়াই, সে তো দায়ে প’ড়ে নয়, সে নিজের ইচ্ছায়—অতএব এ রকম কাজ ক’র্‌তে পারা তো সৌভাগ্য। কিন্তু তবু এক একবার দরজার ফাঁকের ভিতর দিয়ে এই সবুজ পৃথিবীর একটা আভাস যখন দেখ্‌তে পাই তখন মনটা উতলা হ’য়ে ওঠে। আমি যে জন্মকুঁড়ে। যেমন বাঁশির ফাঁকের ভিতর দিয়ে সুর বেরোয়, তেমনি আমার কুঁড়েমির ভিতর থেকেই আমার যেটি আসল কাজ সেইটি জেগে ওঠে। আমার সেই আসল কাজই হ’চ্চে বাণীর কাজ। সময়টাকে কর্ত্তব্য দিয়ে ভরাট ক’রে একেবারে নিরেট ক’রে দিলে বাণী চাপা প’ড়ে যায়। সেই জন্যই আমাকে কেবল কাজ থেকে নয়, সংসারের নানা জটিল বন্ধন থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থাক্‌তে হয়। কাজই হোক্, আর মানুষই হোক্, আমাকে একেবারে চাপা দিলে বা বেঁধে ফেল্লে আমার জীবন ব্যর্থ হ’তে থাকে। আমার মন ওড়্‌বার জন্যে শূন্যকে চায়। তাকে খাঁচায় বাঁধ্‌বার আয়োজন যতবার হ’য়েছে, সেই আয়োজনের শিকল ছিন্ন হ’য়ে প’ড়ে গেচে। হঠাৎ একদিন দেখ্‌তে পাবে আমার কাজকর্ম্মের দাঁড়খানা তা’র শিকল নিয়ে কোথায় প’ড়ে আছে, আর আমি অত্যুচ্চ অবকাশের আগ্‌ডালের উপর অসীম ফাঁকার মধ্যে এক্‌লা ব’সে গান জুড়ে দিয়েচি। তাই ব’ল্‌চি—দরজা-জান্‌লার আড়াল থেকে ঐ নীলে-সবুজে-সোনালিতে মেশানো ফাঁকার একটা অংশ যেম্‌নি দেখ্‌তে পাই, অম্‌নি আমার মন ডেস্কের ধার থেকে ব’লে ওঠে—ঐখানেই তো আমার জায়গা, ঐ ফাঁকাটাকে-যে আমার আনন্দ দিয়ে, গান দিয়ে ভ’রে তুল তে হবে। পুকুর আছে মাটির বাঁধ দিয়ে ঘেরা—সেইখানেই তা’র কাজ, কেউবা স্নান ক’র্‌চে, কেউবা জল তুল্‌চে, কেউবা বাসন মাজ্‌চে। কিন্তু আমি হ’চ্চি মেঘের মতো; আমাকে তো তটের ঘের দিলে চ’ল্‌বে না, আমাকে বাঁধ্‌তে গেলে তো বাঁধা প’ড়বো না—আমাকে-যে ঐ শূন্যের ভিতর দিয়ে বর্ষণ ক’র্‌তে হবে। সব সময়েই-যে বৃষ্টি ভ’রে আসে তা নয়, অনেক সময়ে অলস-স্বপ্নের মতো সূর্য্যের আলোতে রঙিয়ে উঠে কিছুই না ক’রে ঘুরে বেড়াই, কিন্তু এই কুঁড়েমিটুকু উপর থেকে আমার জন্যে বরাদ্দ হ’য়ে গেছে, এজন্যে আমি কারো কাছে দায়িক নই। সবই তো বুঝ্‌লুম, কিন্তু কুঁড়েমি করি কখন বলো তো? তুমি তো দেখেই গেচো কাজের আর অন্ত নেই। ঘোড়াকে বিধাতা বাতাসের মতো দ্রুতগামী এবং মুক্ত ক’রে সৃষ্টি ক’রেছিলেন, কিন্তু সেই ঘোড়াকেই মানুষ জিনে লাগামে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে ফেলে। আমারও সেই দশা। বিধাতার ইচ্ছা ছিল—আমি ভরপূর কুঁড়েমি ক’রে কাটাই, কিন্তু যে-গ্রহের হাতে প’ড়েচি, সে আমাকে ক’ষে খাটিয়ে নিচ্চে। বয়স যখন অল্প ছিল, তখন খাটুনি এড়িয়ে, ইস্কুল পালিয়ে পদ্মার নির্জ্জন চরে বোটের মধ্যে লুকিয়ে বেশ চালাচ্ছিলুম—কিন্তু যখন থেকে তোমার পঞ্জিকা অনুসারে আমার ‘সাতাশ’ বছর বয়স হ’য়েচে, তখন থেকেই কাজের টানে আপনি ধরা দিয়ে কেটে বেরোবার আর পথ পাইনে। নইলে আগেকার মতো হ’লে আমার পক্ষে আলমোড়ায় যেতে কতক্ষণ লাগ্‌তো বলো? তবু তোমরা সেই পাহাড়ের উপরে মুক্ত হাওয়ায় স্বাস্থ্য এবং আনন্দ ভোগ ক’র্‌চো এ কথা মনে ক’রে ভালো লাগ্‌চে; তোমার চিঠি সেখানকার লাল ফুলের পাপড়িতে রাগ-রক্ত হ’য়ে আমার হাতে এসে পৌঁচচ্চে। সেখানকার ফুলে যে-রক্তিমা দেখ্‌তে পাচ্চি, তোমার গালে সেই রক্তিমা সংগ্রহ ক’রে আন্‌বে—এই আশা ক’রে আছি। আজ আর সময় নেই—অতএব ইতি। ১১ই ভাদ্র, ১৩২৫।