ভানুসিংহের পত্রাবলী/১২
১২
তুমি বোধ হয় এই প্রথম হিমালয়ে যাচ্চো। আমিও প্রায় তোমার বয়সে আমার পিতৃদেবের সঙ্গে হিমালয়ে গিয়েছিলুম। তা’র আগে ভূগোলে প’ড়েছিলুম,পৃথিবীতে হিমালয়ের চেয়ে উঁচু জিনিষ আর কিছু নেই, তাই হিমালয় সম্বন্ধে মনে মনে কত কী-যে কল্পনা ক’রেছিলুম তা’র ঠিক নেই। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মনটা একেবারে তোলপাড় ক’রেছিলো। অমৃতসর হ’য়ে ডাকের গাড়ি চ’ড়ে প্রথমে পাঠানকোটে গিয়ে প’ড়লুম। সেখানে পাহাড়ের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ। তুমি কাঠগোদাম দিয়ে উপরে উঠেচো,—পাঠানকোট সেই রকম কাঠগোদামের মতো। সেখানকার ছোটো ছোটো পাহাড়গুলো, “কর, খল” “জল পড়ে, পাতা নড়ে”,—এর বেশি আর নয়। তা’রপরে ক্রমে ক্রমে যখন উপরে উঠ্তে লাগ্লুম, তখন কেবল এই কথাই মনে হ’তে লাগ্লো, হিমালয় যত বড়োই হোক্ না, আমার কল্পনা তা’র চেয়ে তাকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েচে; মানুষের প্রত্যাশার কাছে হিমালয় পাহাড়ই বা লাগে কোথায়? আসল কথা, পাহাড়টা থাকে-থাকে উপরে উঠেচে ব’লে, ডাণ্ডি ক’রে চ’ড়তে চ’ড়তে, পর্ব্বতরাজের রাজমহিমা ক্রমে ক্রমে মনের মধ্যে স’য়ে আসে। যে-জিনিষটা খুব বড়ো, আমরা একেবারে তা’র সমস্তটা তো দেখ্তে পাইনে—পর্ব্বত ক্রমে ক্রমে দেখি, সমুদ্র ক্রমে ক্রমে দেখি—এমন কি, যে-মানুষ আমার চেয়ে বয়সে অনেক বেশি তা’র সেই বড়ো বয়সের সুদীর্ঘ বিস্তারটা এক সঙ্গে দেখ্তে পাওয়া যায় না। এই জন্যে তফাৎ জিনিষটা কল্পনায় যত বড়ো, প্রত্যক্ষে তত বড়ো নয়। তার্থাৎ বড়ো হ’লেও বড়ো দেখা যায় না। আমাদের যে-ঠাকুরকে আমরা প্রণাম করি, তিনি যত বড়ো তা’র সমস্তটা যদি সম্পূর্ণ আমাদের সাম্নে আস্তো, তা-হ’লে সে আমরা সইতেই পারতুম না। কিন্তু হিমালয় পাহাড়ের মতো আমরা তাঁর বুকের উপর দিয়ে ক্রমে ক্রমে উঠি। যতই উঠি না কেন, তিনি আমাদের একেবারে ছাড়িয়ে যান না,—বরাবর আমাদের সঙ্গী হ’য়ে তিনি আমাদের আপনি উঠিয়ে নিতে থাকেন; বুদ্ধিতে বুঝ্তে পারি তিনি আমাদের ছাড়িয়ে আছেন, কিন্তু ব্যবহারে বরাবর তাঁ’র সঙ্গে আমাদের সহজ আনাগোনা চ’ল্তে থাকে। তাই তো তাঁকে বন্ধু ব’ল্তে আমাদের কিছু ঠেকে না— তিনিও তাঁর উপরের থেকে হেসে আমাদের বন্ধু বলেন। এত উপরে চ’ড়ে যান না-যে, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়া দায় হ’য়ে ওঠে। তুমি যত জোরের সঙ্গে আমাকে সাতাশ বছরের ক’রে নিয়েচো, আমরা তা’র চেয়ে ঢের বেশি জোরে তাঁকে সাতও ক’র্তে পারি সাতাশও ক’র্তে পারি—আবার সাতাশ কোটি ক’র্লে ও চলে; তিনি-যে আমাদের জন্য সবই হ’তে পারেন, তা নইলে তাঁকে দিয়ে আমাদের চ’ল্তোই না। তোমার পাহাড় কেমন লাগ্লো, আমাকে লিখো। হিমালয়ে আলমোড়া-পাহাড়ের চেয়ে ভালো পাহাড় ঢের আছে, আলমোড়া ভারি নেড়া পাহাড়; ওর গাছপালা নেই আর ওখানে থেকে হিমালয়ের তুষার-দৃশ্য তেমন ভালো ক’রে দেখা যায় না। ইতি ১লা ভাদ্র, ১৩২৫।