১১

শান্তিনিকেতন

 আজ বুধবার। কদিন খুব বৃষ্টি-বাদলের পর আজ সকালের আকাশে সূর্য্যের আলো নির্ম্মল হ’য়ে ফুটে উঠেচে। শিশু যেমন দোলায় শুয়ে শুয়ে অকারণ আনন্দে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে কলহাস্য ক’র্‌তে থাকে, তেমনি ক’রে আশ্রমের গাছপালাগুলি আজ তাদের ডালপালা দুলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেবলি ঝিল্‌মিল্ ক’রে উঠ্‌চে। এখন সকাল বেলা—স্নিগ্ধ বাতাস বইচে, পাখীর ডাকে এখানকার শালবন এবং আমবাগান মুখরিত। আমাদের মন্দিরের উপাসনা হ’য়ে গেচে। তারপরে এতক্ষণ আমার জান্‌লার ধারের সেই কোণ্‌টিতে শুয়েছিলুম। প্রতি বুধবারে উপাসনার পরে এণ্ড্‌রুজ্ একবার এসে, আমি কী ব’লেচি, আমার কাছে ইংরেজিতে তাই বুঝিয়ে নেন। বুঝিয়ে নিয়ে খুসী হ’য়ে তিনি চ’লে গেচেন। আমি কী বলেছিলুম জানো? এই সৃষ্টির দিকে প্রথম তাকালে কী দেখ্‌তে পাই? এর আগাগোড়া সমস্ত নিয়মে বাঁধা, এর সমস্ত অণুপরমাণুর মধ্যে নিয়মের ফাঁক এতটুকুও নেই। কেমন জানো? যেমন একটি সহস্র-তারবাঁধা বীণাযন্ত্র। এই বীণার প্রত্যেক তারটি খুব খাঁটি হিসাব ক’রে বাঁধা, অর্থাৎ এই বীণাটির তুম্বী থেকে আরম্ভ ক’রে এর সূক্ষ্মতম তারটি পর্য্যন্ত সমস্তই সত্য। কিন্তু না-হয় সত্যই হ’লো, তাতে আমার কী! বীণার তার বাঁধার খাঁটি নিয়ম নিয়ে আমি কী ক’র্‌বো? তেমনি এই জগতে সূর্য্যচন্দ্রগ্রহ অণু-পরমাণু সমস্তই ঠিক সময় দেখে ঠিক নিয়ম রেখে চ’ল্‌চে—এই কথাটা যত বড়ো কথাই হোক্ না, কেবল তাতে আমাদের মন ভরে না। আমরা এই কথা বলি, শুধু বীণাব নিয়ম চাইনে, বীণার সঙ্গীত চাই। সঙ্গীত টি যখন শুন্‌তে পাই, তখনি ঐ বীণাযন্ত্রের শেষ অর্থটি পাই—তা নইলে ও কেবল খানিকটা কাঠ এবং পিতল। জগতের এই বীণাযন্ত্রে আমরা সঙ্গীতও শুনেচি; শুধু কেবল নিয়ম নয়। সকাল বেলার আলোতে আমরা শুধু কেবল মাটিজল, শুধু কেবল কতকগুলো জিনিষ দেখ্‌তে পাই, তা নয়। সকাল বেলার শান্তি, স্নিগ্ধতা, সৌন্দর্য্য, পবিত্রতা সে তো কেবল বস্তু নয়, সেই হ’চ্চে সকালের বীণাযন্ত্রের সঙ্গীত। তা’রই সুরে আমাদের হৃদয় পাখীর সঙ্গে মিলে গান গাইতে চায়। যেখানে বীণা শুধু বীণা, সেখানে সে বস্তুমাত্র—কিন্তু যেখানে বীণায় সঙ্গীত ওঠে, সেখানে বীণার পিছনে আমাদের ওস্তাদ্‌জি আছেন। সেই ওস্তাদ্‌জির আনন্দই গানের ভিতর দিয়ে আমাদের আনন্দ দেয়। সৃষ্টির বীণা তো ওস্তাদ্‌জি বাজিয়ে চ’লেচেন, কিন্তু আমাদের নিজের চিত্তের বীণাও যদি সুরে না বাজে তা’হলে আমাদের হৃদয়রীণার ওস্তাদজিকে চিন্‌বো কী ক’রে? তাঁব আনন্দরূপ দেখ্‌বো কী ক’রে? না যদি দেখি তাহ’লে কেবল বেসুর, কেবল ঝগড়া-বিবাদ, কেবল ঈর্ষা-বিদ্বেষ, কেবল কৃপণতা, স্বার্থপরতা, কেবল লোভ এবং ভোগের লালসা। আমাদের জীবনের মধ্যে যখন সঙ্গীত বাজে তখন নিজেকে ভুলে যাই। আমাদের জীবনযন্ত্রের ওস্তাদ্‌জিকেই দেখ্‌তে পাই। তখন দুঃখ আমাদের অভিভূত করে না, ক্ষতি আমাদের দরিদ্র ক’রে দেয় না, তখন ওস্তাদ্‌জির আনন্দের মধ্যে আমাদের জীবনের শেষ অর্থটি দেখ্‌তে পাই। সেইটি দেখ্‌তে পাওয়াই মুক্তি। সেইজন্যই তো চিত্তবীণায় সত্যসুরে তার বাঁধ্‌তে চাই, সেইজন্যে কঠিন চেষ্টায় মনকে বশ ক’র্‌তে চাই, চৈতন্যকে নির্ম্মল ক’রে তুল্‌তে চাই—সেইজন্যে নিজের স্বার্থ নিজের ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা ভুলে হৃদয়কে স্তব্ধ ক’র্‌তে চাই—তা হ’লেই আমার সুরবাঁধা যন্ত্র ওস্তাদের হাতে বেজে উঠ্‌বে; আমাদের প্রার্থনা হ’চ্চে এই:—“তব অমল পরশ রস অন্তরে দাও।” তাঁর সেই স্পর্শের রসই হ’চ্চে আমাদের অন্তরের সঙ্গীত। তুমিও জানো, আমি সন্ধ্যাবেলায় প্রায়ই গান করি—

বীণা বাজাও হে, মম অন্তরে।
সজনে বিজনে, বন্ধু, সুখে দুঃখে বিপদে
আনন্দিত তান শুনাও হে, মম অন্তরে।

 দুপুর বেলা খেতে গিয়ে দেখি, খাবার টেবিলে তোমার চিঠি আর সেই হিন্দী খবরের কাগজ র’য়েচে। তোমরা আলমোড়ায় যাচ্চো। ওখানে আমি অনেকদিন ছিলুম। তোমাদের ঠিকানা পেলে সেই ঠিকানায় লিখ্‌বো। আমি ভেবেছিলুম, তোমাদের স্কুলের ছুটির আগে তোমরা কোথাও যাবে না। কিন্তু দেখ্‌চি আমার ছেলেবেলাকার হাওয়া তোমাদের লেগেচে—তখন আমি কেবলি ইস্কুল পালিয়েচি। কিন্তু সাবধান আমার মতো মূর্খ হ’লে চ’ল্‌বে না—নাম্‌তা মনে থাকা চাই, আব সাইরীরিয়ার রাস্তা ভুল্‌লে কষ্ট পাবে।