ভানুসিংহের পত্রাবলী/১০
১০
তোমার চিঠি আজ এইমাত্র পেলুম। এইমাত্র ব’ল্তে কী বোঝায় বলি। দুপুর বেলাকার খাওয়া হ’য়ে গেচে। সেই কোণটাতে তাকিয়া ঠেশান দিয়ে ব’সেছিলুম। আকাশ ঘন মেঘে অন্ধকার হ’য়ে গেছে —পশ্চিম দিক থেকে মাঝে মাঝে সোঁ সোঁ ক’রে ঝোড়ো বাতাস বইচে। ইন্দ্রের ঐরাবতের বাচ্চাগুলোর মতো মোটা মোটা কালো মেঘ আকাশময় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্চে। মাঝে মাঝে গুরু গুরু গর্জ্জন শোনা যায়। সাম্নে সবুজ মাঠের উপবে মেঘ্লা দিনের ছায়া, নিবিড় স্নিগ্ধতার মধ্যে চোখ ডুবে গেচে। তোমাকে লিখ্তে লিখ্তে বৃষ্টি নেমে এলো—বৃষ্টি একটুমাত্র দেখা দিলেই আমার এই বারান্দায় তা’র পায়ের শব্দ তখনি শোনা যায়। দূরে ভুবনডাঙার দিকে বাঁধের কাছে যে ঘন বনশ্রেণী দেখা যায়, বৃষ্টির ধারায় সেটা একটু ঝাপ্সা হ’য়ে এসেচে—বনলক্ষ্মী যেন তা’র পাত্লা ওড়্নাটাকে মুখের উপর ঘোম্টা টেনে দিয়েচে। ক-টা বেজেচে, ঠিক ব’ল্তে পারিনে। আমার সামনের দেয়ালে যেঘড়িটা ছিল তাকে নির্ব্বাসিত ক’রে দিয়েচি। ইদানীং তা’র ব্যবহারে এমন হয়ে এসেছিল-যে, তাকে বিশ্বাস কবার জো ছিল না—সে চ’ল্তোও ভুল ব’ল্তোও ভুল, তা’র পরামর্শমতো খেতে শুতে গিয়ে আমি অনেকবার ঠ’কেচি। তবু উপযুক্ত উপায়ে তাকে-যে সংশোধন করা যেতো না তা ব’লতে পারিনে—কিন্তু সময়ের জন্যই ঘড়ি, ঘড়ির জন্য সময় নষ্ট করা আমার পোষায় না। যাই হোক আন্দাজে মনে হ’চ্চে একটা দেড়টা হ’য়ে গেচে। আর একটু বাদেই আমাকে একটা ক্লাশ পড়াতে হবে। আজকাল প্রায় জন পনেরো গুজ্রাটি ছেলে এসেচে, কী ক’রে তাদের বাংলা পড়াতে হবে সেইটে আজ আমি দেখিয়ে দেবো—বৌমা আর শৈল ওদের দুপুর বেলায় একঘণ্টা ক’রে বাংলা পড়াতে রাজি হয়েছেন।
ইতিমধ্যে এণ্ড্রুজ্ সাহেবের খুব অসুখ ক’রেছিলো। আমাদের ভাবনা হ’য়েছিলো। একদিন তো রাত্রে তাঁর নিজের মনে হ’লো তাঁর ওলাউঠা হ’য়েচে। সেই রাত্রি এক্টার সময় বর্দ্ধমানে ডাক্তার ডাক্তে লোক পাঠিয়ে দিলুম। কিন্তু ইতিমধ্যে আমার ওষুধ খেয়ে এতটা ভালো হ’য়ে উঠ্লেন-যে, ভোরের বেলায় আবার টেলিগ্রাফ ক’রে ডাক্তার আনা বন্ধ করে দিলুম। তুমি তো জানোই আমার হাতের রেখায় লেখা আছে— আমি ডাক্তারি ক’র্তে পারি। যাই হোক্, এখন সাহেব আবার সেরে উঠে পূর্ব্বের মতোই চারিদিকে দৌড়ে দৌড়ে বেড়াচ্চেন। কিন্তু তিনি সেই-যে জাপানি ঝোলা কাপড়টা প’রতেন সেটা আজকাল আর দেখ্তে পাইনে।
বৃষ্টি একটুখানি হ’য়েই থেমে গেল। বাতাসটাও বন্ধ হ’য়েচে। কিন্তু পূবের দিকে খুব একটা ঘন নীল মেঘ ভ্রূকুটি ক’রে থ’ম্কে দাঁড়িয়ে র’য়েচে—এখনি বোধ হয় বরুণ-বাণ বর্ষণ ক’র্তে লেগে যাবে। আমরা আশ্রমে অনেক নতুন গাছ লাগিয়েচি, ভালো ক’রে বৃষ্টি হলে ভালোই হয়। কিন্তু আজকাল শরৎকালের মতো হ’য়েচে—রৌদ্রে বৃষ্টিতে মিলে ক্ষণে ক্ষণে খেলা শুরু হ’য়ে গেচে। তোমরা গান-বাজ্না শিখতে শুরু ক’রেচো শুনে খুব সুখী হলুম। আজ আমার আর সময়ও নেই, কাগজও ফুরোলো, পাড়া জুড়ালো, বর্গি এলো ক্লাসে।