শান্তিনিকেতন

 আজ সকাল থেকে ঘন ঘোর মেঘ ক’রে প্রবল বেগে বর্ষণ চল্‌চে, সকালে কোনো মাষ্টার তাই ক্লাশ নেন্‌নি। কিন্তু থার্ড ক্লাশের ছেলেদের আমি ছুটি দিতে পার্‌লুম না—তাদের পড়া খুব শক্ত, মাঝে মাঝে ফাঁক পড়্‌লে সমস্ত আল্‌গা হ’য়ে যাবে, তাই সেই বৃষ্টির মধ্যেও তাদের সংগ্রহ ক’রে আনা গেল। পড়াতে পড়াতে বৃষ্টির বেগ বেড়ে উঠ্‌লো, সঙ্গে সঙ্গে ঝড়। আমার শোবার ঘরে ক্লাশ হয়—ঘরে ছাঁট আস্‌তে লাগ্‌লো। সার্সি বন্ধ ক’রে দিলুম—পাঠ্য শেষ হ’য়ে গেল, কিন্তু বৃষ্টি শেষ হয় না—এই বৃষ্টিতে তাদের তো ছেড়ে দিতে পারিনে। শেষকালে ওরা আমাকে ধ’রে প’ড়্‌লো, মুখে মুখে একটা গল্প বানিয়ে ওদের শোনাতে। কিন্তু ভেবে দেখো আমার বয়স এখন সাতান্ন বছর হয়েছে, এখন কি ইচ্ছা ক’রলেই অনর্গল গল্প ব’ল্‌তে পারি? শেষকালে আমি কর্‌লুম কী, একটা গল্পের কেবল গোড়া ধরিয়ে দিয়ে ওদের বল্লুম সেইটে এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ ক’রে লিখে আনতে। ওরা তো উৎসাহের সঙ্গে রাজী হ’লো, কিন্তু ওদের গল্প যে কী রকম হবে তা কল্পনা ক’রে আমার মনে কিছুমাত্র উৎসাহ বোধ হ’চ্চে না। যাক্‌গে, ওরা তো সেই গল্প মাথায় নিয়ে ভিজ্‌তে ভিজ্‌তে চেঁচাতে চেঁচাতে ওদের ঘরে চ’লে গেল —আমি গেলুম স্নান ক’র্‌তে। স্নান ক’রে খেয়ে এসে আজ তাকিয়ায় একটু হেলান দিয়ে প’ড়েছিলুম। কিন্তু সমস্ত দিন তো কুঁড়েমি ক’রে কাটাতে পারিনে। অন্য দিন হ’লে উঠে আমার তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ক্লাশের জন্য পড়ার বই লিখ্‌তে ব’স্‌তুম, কিন্তু আজ বাদ্‌লার দিনে সেটা ভালো লাগ্‌লো না, তাই “বিদায়-অভিশাপ”টা ইংরেজিতে তর্জ্জমা ক’র্‌তে ব’সে গিয়েছিলুম। বেশ ভালোই লাগ্‌ছিলো; পাতা দুয়েক যখন শেষ হ’য়ে গেছে, এমন সময় চিঠি হাতে ক’রে এক হরকরার প্রবেশ। কাজেই এখন কিছুক্ষণের জন্য দেবযানীকে অপেক্ষা ক’র্‌তে হ’চ্চে। বৃষ্টি থেমে গেচে কিন্তু জলভারাবনত মেঘে আকাশ ভরা। এতদিন শ্রাবণের দেখা ছিল না, যেই বিশে একুশে হ’য়েচে অম্‌নি যেন কোনোমতে ছুট্‌তে ছুট্‌তে শেষ ট্রেণটা ধরে হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। কম হাঁপাচ্চে না,—তা’র হাঁপানির বেগে আমাদের শালবন বিচলিত, আম্‌লকিবন কম্পান্বিত, তালবন মর্ম্মরিত, বাঁধের জল কল্লোলিত, কচি ধানের ক্ষেত হিল্লোলিত, আর আমার এই জান্‌লার খড়খড়িগুলো ক্ষণে ক্ষণে খড়খড়ায়িত। ইতি—২১শে শ্রাবণ, ১৩২৫।