শান্তিনিকেতন

 দিনগুলো আজকাল শরৎকালের মতো সুন্দর হ’য়ে উঠেচে। আকাশে ছিন্ন মেঘগুলো উদাসীন সন্ন্যাসীর মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্চে। আমলকীগাছের পাতাগুলিকে ঝর্‌ঝরিয়ে দিয়ে বাতাস ব’য়ে যাচ্চে, তা’র মধ্যে একটা আলস্যের সুর বাজ্‌চে, আর বৃষ্টিতে-ধোওয়া রোদ্দুরটি যেন সরস্বতীর বীণার তারগুলো থেকে বেজে-ওঠা গানের মতো সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলেচে। আমার ঠিক চোখের উপরেই সন্তোষবাবুর বাড়ির সাম্‌নেকার সবুজ ক্ষেত রৌদ্রে ঝল্‌মল্ ক’রে উঠেচে; আর তা’রই একপাশ দিয়ে বোলপুর যাবার রাঙা রাস্তাটা চ’লে গেচে—ঠিক যেন একটি সোনালী সবুজ সাড়ির রাঙা পাড়ের মতো। খুব ছেলেবেলা থেকেই এই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আমার গলাগলি ভাব— তাই আমার জীবনের কত কালই নদীর নির্জ্জন চরে কাটিয়েচি। তা’রপরে কতদিন গেচে এখানকার নির্জ্জন প্রান্তরে। তখন এখানে বিদ্যালয় ছিল না, তখন শান্তিনিকেতনের বাড়ির গাড়ি-বারান্দায় ব’সে খুব বৃহৎ একটি নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে যেতে পারতুম; —রাত্রে ঐ বারান্দায় যখন শুয়ে থাক্‌তুম তখন আকাশের সমস্ত তারা যেন আমার পাড়াপড়শির মতো তাদের জান্‌লা থেকে আমার মুখের দিকে চেয়ে কী ব’ল্‌তো, তাদের কথা শোনা যেতো না, কিন্তু তাদের মুখ-চোখের হাসি আমাকে এসে স্পর্শ ক’রতো। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে ভাব করার একটা মস্ত সুবিধা এই যে, সে আনন্দ দেয়, কিন্তু কিছু দাবী করে না; সে তা’র বন্ধুত্বকে ফাঁসের মতো বেঁধে ফেল্‌তে চেষ্টা করে না, সে মানুষকে মুক্তি দেয়, তাকে দখল ক’রে নিতে চায় না। ১৮ই শ্রাবণ, ১৩২৫।