শান্তিনিকেতন

 তুমি আজকাল খুব পড়ায় লেগে গেছো, কিন্তু আমি-যে চুপচাপ ক’রে ব’সে থাকি তা মনে ক’রো না। আমার কাজ চ’ল্‌চে। সকালে তুমি তো জানো সেই আমার তিন ক্লাশের পড়ানো আছে। তা’রপরে স্নান ক’রে খেয়ে, যেদিন চিঠি লেখ্‌বার থাকে চিঠি লিখি। তারপরে বিকেলে খাবার খবর দেবার আগে পর্য্যন্ত ছেলেদের যা পড়াতে হয় তাই তৈরি ক’রে রাখি। তারপরে সন্ধ্যার সময় ছাতে চুপচাপ ব’সে থাকি— কিন্তু এক-একদিন ছেলেরা আমার কাছে কবিতা শুন্‌তে আসে। তা’রপরে অন্ধকার হয়ে আসে—তারাগুলিতে আকাশ ছেয়ে যায়—দিনুর ঘর থেকে ছেলেদের গলা শুন্‌তে পাই— তা’রা গান শেখে—তা’রপরে গান বন্ধ হ’য়ে যায়। তখন আদ্যবিভাগের ছেলেদের ঘর থেকে হারমোনিয়ম্ এবং বাঁশির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গানের ধ্বনি উঠ্‌তে থাকে। ক্রমে রাত্রি আরো গভীর হয়, তখন ছেলেদের ঘরের গানও বন্ধ হ’য়ে যায়, আর দূরে গ্রামের রাস্তার ভিতর দিয়ে দুই একটা আলো চ’ল্‌চে দেখ্‌তে পাই। তা’রপরে সে আলোও থাকে না, কেবলমাত্র আকাশজোড়া তারার আলো। তা’রপরে ব’সে থাক্‌তে থাক্‌তে ঘুম পেয়ে আসে, তখন আস্তে আস্তে উঠে শুতে যাই। তা’রপরে কখন এক সময়ে আমার পূর্ব্বদিকের দরজার সম্মুখে আকাশের অন্ধকার অল্প অল্প ফিকে হ’য়ে আসে, দুটো একটা শালিকপাখী উস্‌খুস্ ক’রে ওঠে, মেঘের গায়ে গায়ে সোনালি আভা ফোটে, খানিক বাদেই সাড়ে চারটার সময় আদ্যবিভাগে ঢং ঢং ক’রে ঘণ্টা। বাজ্‌তে থাকে, অম্‌নি আমি উঠে পড়ি। মুখ ধুয়ে এসে আমার সেই পূর্ব্বদিকের বারান্দায় পাথরের চৌকির উপর আসন পেতে উপাসনায় বসি। সূর্য্য ধীরে ধীরে উঠে তা’র আলোকের স্পর্শে আমাকে আশীর্ব্বাদ করে। আজকাল সকাল সকাল খেতে যেতে হয়, কেননা সাড়ে ছটার সময় আশ্রমের সকল বালকবৃদ্ধ আমরা বিদ্যালয়ের সাম্‌নের মাঠে একত্র হই, একটি কোনো গান হ’য়ে তা’র পরে আমাদের স্কুলের কাজ আরম্ভ হয়। ঠিক প্রথম ঘণ্টায় আমার ক্লাশ নেই। কিন্তু সেই সময়ে আমি আমার কোণটাতে এসে একবার আমার পড়াবার বই ও খাতাপত্র দেখে শুনে ঠিক ক’রে নিই—তা’রপরে আমার কাজ। এই আমার দিনরাতের হিসাব তোমার কাছে দিলুম। কেমন শান্তিতে দিন চ’লে যায়। ঐ ছেলেদের কাজ ক’র্‌তে আমার খুব ভালো লাগে। কেননা ওরা জানে যে, আমরা ওদের জন্য যে-কাজ করি তা’র কোনো মূল্য আছে। ওরা যেমন অনায়াসে সূর্য্যের কাছ থেকে তা’র আলো নেয় আমাদের হাত থেকে তেমনি অনায়াসে সেবা নেয়। হাটে দোকানদারদের কাছ থেকে যেমন দরদস্তুর ক’রে জিনিষ কিন্‌তে হয় তেমন ক’রে নয়। এরা যখন বড়ো হবে, যখন সংসাবের কাজে প্রবেশ ক’র্‌বে, তখন হয়তো মনে প’ড়্‌বে— এই আশ্রমের প্রান্তর, এখানকার শালের বীথিকা, এখানকার আকাশের উদার আলো এবং উন্মুক্ত সমীরণ এবং প্রতিদিন সকালে বিকালে এখানে আকাশতলে নীরবে ব’সে ঠাকুরকে প্রণাম। ইতি—১২ই শ্রাবণ, ১৩২৫।