ভানুসিংহের পত্রাবলী/৬
৬
কাল সন্ধ্যাবেলায় স্তরে স্তরে গাঢ় নীল মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল—তখন নীচের সেই পূবদিকের বারান্দায় সাহেবে আমাতে মিলে খাচ্ছিলুম—আমার আর-সব খাওয়া হ’য়ে গিয়ে যখন চিঁড়েভাজা খেতে আরম্ভ ক’রেচি এমন সময় পশ্চিম দিক থেকে সোঁ সোঁ করে হাওয়া এসে সমস্ত কালো মেঘ আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্য্যন্ত বিছিয়ে দিলে। কতদিন পরে ঐ সজল মেঘ দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। যদি আমি তোমাদের কাশীর হিন্দুস্থানী মেয়ে হ’তুম তাহ’লে কাজ্রী গাইতে গাইতে শিরীষগাছের দোলাটাতে দুল্তে যেতুম। কিন্তু এণ্ড্রুজ্ কিম্বা আমি, আমাদের দুজনের কারো হিন্দুস্থানী মেয়ের মতো আকৃতি প্রকৃতি কিম্বা চালচলন নয়, তা ছাড়া সে কাজ্রী গান জানে না, আমিও যা জানতুম ভুলে গেচি। তাই দু-জনে মিলে উপরে আমার ছাদের সাম্নেকার বারান্দায় এসে ব’স্লুম। দেখ্তে দেখ্তে ঘনবৃষ্টি নেমে এলো— জলে বাতাসে মিলে আকাশময় তোলপাড় ক’রে বেড়াতে লাগ্লো। আমার ছাদের সাম্নেকার পেঁপে গাছটার লম্বা পাতা গুলোকে ধ’রে ঠিক যেন কানমলা দিতে লাগ্লো। শেষকালে বৃষ্টি প্রবল হ’য়ে গায়ে যখন ছাঁট লাগ্তে আরম্ভ হ’লো, তখন আমার সেই কোণটাতে এসে আশ্রয় নিলুম। এমন সময় চোখ ধাঁদিয়ে কড়কড় শব্দে প্রকাণ্ড একটা বাজ প’ড়্লো। তামাদের মনে হ’লো বাগানের মধ্যেই কোথাও পড়েচে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে দেখি হরিচরণ পণ্ডিতের বাসার দিকে ছেলেরা ছুট্চে। সেই বাড়িতেই বাজ প’ড়েছিলো। তখন তাঁর বড়ো মেয়ে উনানে দুধ জ্বাল দিচ্ছিলেন, তিনি অজ্ঞান হ’য়ে প’ড়লেন। ছেলেরা দূর থেকে দেখ্তে পেলে চালের উপর থেকে ধোঁয়া উঠ্তে আরম্ভ হ’য়েছে। তারা তো সব চালের উপর চ’ড়ে ‘জল জল’ করে চীৎকার ক’র্তে লাগ্লো। ছেলেরা কুয়ো থেকে জল ভ’রে এনে চালের উপর আগুন নিবিয়ে ফেল্লে। ভাগ্যে, হরিচরণের বাড়ির কাউকে আঘাত লাগে নি। কেবল হরিচরণের মেয়ের হাত একটু পুড়ে ফোস্কা পড়েছিলো। কিন্তু সব চেয়ে ভালো লেগেছিলো আমার ছেলেদের উদ্যোগ দেখে। তাদের না আছে ভয়, না আছে ক্লান্তি। নির্ভয়ে হাতে ক’রে ক’রে চালের খড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিতে লাগ্লো। আর দূরের কুয়ো থেকে দৌড়ে দৌড়ে সার বেঁধে জলভরা ঘড়া এনে উপস্থিত ক’র্তে লাগলো। ওরা যদি না দেখ্তো এবং না এসে জুট্তো তাহলে মস্ত একটা অগ্নিকাণ্ড হ’তো। এমনি ক’রে কাল অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত ঝড়-বাদল হ’য়ে আজ অনেকটা ঠাণ্ডা আছে। আকাশ এখনো মেঘে লেপে আছে, হয়তো আজও বিকেলে একচোট বৃষ্টি শুরু হবে! ইতি—৫ই শ্রাবণ, ১৩২৫।