ভানুসিংহের পত্রাবলী/২১
২১
আচ্ছা বেশ, রাজি। ভানুদাদা নামই বহাল হ’লো। এ নামে আজ পর্য্যন্ত আমাকে কেউ ডাকেনি, আর কেউ যদি ডাকে তবে তা’র উত্তর দেবো না। সিণ্ডারেলার গল্প জানো তো? তা’র একপাটি জুতো নিয়ে রাজার ছেলে পা মেপে বেড়াতে লাগ্লো। আমার ভানু নামটা সেই রকম একপাটি; যদি কেউ ব্যবহার ক’র্তে যায়, আমি তখন ব’ল্তে পার্বো—আচ্ছা আগে নিজের নামের পাটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখো। যার নাম সুরবালা, সে ব’ল্বে সুরো সুরু সুরি—কিছুতেই ভানুর সঙ্গে মিল্বে না, যার নাম মাতঙ্গিনী সে ব’ল্বে মাতু, মাতি, মাতো—কিছুতেই মিল্বে না, তিনকড়িরও সেই দশা, কাত্যায়নীরও তাই; জগদম্বা, পীতাম্বরী, গুরুদাসী, শঙ্খেশ্বরী, নগেন্দ্রমোহিনী, কারোই কাছে ঘেঁষবার জো নেই। ভারি সুবিধে হ’য়েচে। কেবল আমার মনে ভারি ভয় র’য়ে গেল, পাছে কারো নাম থাকে “কানু বিলাসিনী”। তবে তাকে কী ব’লে ঠেকাবো? তুমি ভেবে রেখে দিয়ো।
ছুটির দিন এলো—পর্শু ছুটি, তারপরে কী ক’র্বো? তখন কেবল শিউলিবন, শিশির-ভেজা ঘাস, আর দিগন্ত-প্রসারিত মাঠ আমার মুখ তাকিয়ে থাক্বে। তা’রা তো আমার কাছে ইংরেজি শিখ্তে চায় না—তা’রা চায় আমার মনের মধ্যে যে আনন্দের সোনার কাটি আছে সেইটে ছুঁইয়ে দিয়ে তাদের জাগিয়ে তুল্বো এবং আমার চেতনার সঙ্গে তাদের সৌন্দর্য্যকে মিলিয়ে দেবো। আমার জাগরণের ছোঁয়াচ্ না লাগলে পরে প্রকৃতি জাগ্বে কী ক’রে? নীলাকাশের কিরণ-কমলের উপরে শারদলক্ষ্মী আসনগ্রহণ করেন, কিন্তু আমার আনন্দ-দৃষ্টি না প’ড়্লে পরে সে পদ্মই ফোটে না।
আজ বুধবার। আজ মন্দিরে ছুটির ঠাকুরের কথা ব’লেচি। যখন আমরা কাজ ক’র্তে থাকি, তখন শক্তির সমুদ্র থেকে আমাদের মধ্যে জোয়ার আসে, তখন আমরা মনে করি এ শক্তি আমারই এবং এই শক্তির জোরেই আমরা বিশ্বজয় ক’র্বো। কিন্তু শক্তিকে বরাবর খাটাতে তো পারিনে—সন্ধ্যা যখন আসে তখন তো কাজ বন্ধ হয়, তখন তো আর গাণ্ডীব তুল্তে পারিনে। তাই জোয়ার ভাঁটার ছন্দকে জীবের মেনে চলা চাই। একবার আমি, একবার তুমি। সেই তুমিকে বাদ দিয়ে যখন মনে করি আমিই কর্ত্তা, তখনই জগতে মারামারি বেধে যায়—রক্তে ধরণী পঙ্কিল হ’য়ে ওঠে। মা তাঁর মেয়েকে ডেকে বলেন, সংসারের কাজে তুমি আমার সঙ্গে লেগে যাও, মেয়ে তখন কোমর বেঁধে লাগে, কিন্তু সে যখন ভুলে যায়-যে, এই কাজ তা’র মায়ের সংসারেরই কাজ, যখন অহঙ্কার ক’রে ভাবে ‘আমি যেমন ইচ্ছা তাই ক’র্বো’, তখন সে সংসারের ব্যবস্থাকে উলট্ পালট্ ক’রে জঞ্জাল জমিয়ে তোলে—অবশেষে এমন হয়-যে, মা ঝাঁটা হাতে নিয়ে সমস্ত আবর্জ্জনা ঝেঁটিয়ে ফেলেন। মেয়ের সেই কাজটুকুর উপরে ঝাঁটা পড়ে না—যখন সে-কাজ মায়ের সংসার-ব্যবস্থার সঙ্গে মেলে। সংসার-স্থিতির সঙ্গে এই-যে মিলিয়ে কাজ করা, এতে আমাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে—অর্থাৎ মিল বেখেও আমরা তা’র মধ্যে নিজের স্বাতন্ত্র্য রাখ্তে পারি—তাতেই সৃষ্টির বৈচিত্র্য। মেয়ের হাতের কাজটুকু মায়ের অভিপ্রায়কে প্রকাশ ক’রেও নিজেকে বিশিষ্টভাবে প্রকাশ ক’রতে পারে। যখন তাই সে করে তখন তা’র সেই সৃষ্টি মায়ের সৃষ্টির সঙ্গে মিলে স্থিতি লাভ করে। বিশ্বকর্ম্মার কাজে আমরা যখন যোগ দিই তখন যে-পরিমাণে তাঁ’র সঙ্গে মিল রেখে, ছন্দ রেখে চলি সেই পরিমাণে আমদের কাজ অক্ষয়কীর্ত্তি হ’য়ে ওঠে,—যে-পরিমাণে বাধা দিই সেই পরিমাণে আমরা প্রলয়কে ডেকে আনি। নিজের জীবনকে এই প্রলয় থেকে যদি বাঁচাতে চাই তা হ’লে প্রতিদিনই আমি-তুমির ছন্দ মিলিয়ে চ’ল্তে হবে—সেই ছন্দেই মানুষের সৃষ্টি, মানুষের ইতিহাস অমরতা লাভ করে। দেখ্চো তো, মা আজ পশ্চিমের ঘরে কী রকম প্রলয়ের সম্মার্জ্জনী নিয়ে বেরিয়েচেন। পশ্চিমের সভ্যতা মনে ক’র্ছিলো, তা’র শক্তি তা’র নিজেরই ভোগ নিজেরই সমৃদ্ধির জন্যে। সে আমি-তুমির ছন্দকে একেবারে মানেনি। কিছুদূর পর্য্যন্ত সে বেড়ে উঠ্লো। মনে ক’র্লো সে বেড়েই চ’ল্বে— এমন সময়ে ছন্দের অমিল ঘোচাবার জন্যে হঠাৎ একমুহূর্ত্তেই মায়ের প্রলয় অনুচর এসে হাজির। এখন কান্না, আর বক্ষে করাঘাত। ইতি ১৬ই আশ্বিন, ১৩২৫।