ভানুসিংহের পত্রাবলী/২০
২০
প্রথম যখন তোমার চিঠি পেয়েছিলুম, তোমার চিঠিতে “প্রিয় রবিবাবু” প’ড়ে ভারি মজা লেগেছিলো। ভাব্লুম রবিবাবু আবার “প্রিয়” হবে কেমন ক’রে? যদি হ’তো “প্রিয় মিষ্টার ট্যাগোর”, তা হ’লে তেমন বেমানান হ’তো না; কেন না রবিবাবু প্রিয়ও হ’তে পারে, অপ্রিয়ও হ’তে পারে, এবং প্রিয় অপ্রিয় দুইয়ের বাহিরও হ’তে পারে। তুমি যখন চিঠি লিখেছিলে, তখন রবিবাবু প্রিয়ও ছিল না, অপ্রিয়ও ছিল না, নিতান্ত কেবলমাত্র রবিবাবুই ছিল। কিন্তু চিঠির ভাষায় মিষ্টার ট্যাগোরের ‘প্রিয়’ ছাড়া আর কিছু হবার জো নেই, তা আমার সঙ্গে তোমার ঝগ্ড়াই থাক্ আর ভাবই থাক্। আজকাল রবিবাবু পরীক্ষায় একেবারে দু-তিন ক্লাশ উঠে “রবিদাদা” হ’য়েছে, কিন্তু যদি “প্রিয় রবিদাদা” লেখো, তবে তোমার সঙ্গে আমার ঝগ্ড়া হবে। আর যদি বিশুদ্ধ বাংলামতে ‘প্রিয়’ লেখা হয়, তা হ’লে আপত্তি নেই বটে, তবু যখন আমি “রবিদাদা” তখন ওটা বাদ দিলেও চলে— ও যেন সকালবেলায় বাতি জ্বালানো, যেন, যার ফাঁসি হ’য়েচে, তাকে কুড়ি বৎসর দ্বীপান্তর দেওয়া। অতএব আমি যেন থানধুতি-পরা ঠাকুরদাদা, আমার কোনো পাড় নেই, আমি নিতান্তই যেন সাদা “রবিদাদা,” কী বলো?
তোমরা মুক্তেশ্বরে গেচো শুনে সুখী হ’লুম। আমি ভ্রমণ ক’র্তে ভালোবাসি, কিন্তু ভ্রমণের কল্পনা ক’র্তে আমার আরো ভালো লাগে। কেন না, কল্পনার বেলায় রেলগাড়ি ঘটর ঘটর করে না, বেরেলিতে তিন চার ঘণ্টা ব’সে থাক্তে হয় না, ডাণ্ডি অতি অনায়াসে এবং ঠিক সময়েই মেলে। তুমি তোমার নবীন দৃষ্টি নিয়ে নতুন নতুন দৃশ্য দেখ্চো, তোমার সেই আনন্দ আমি মনে মনে অনুভব ক’র্চি। আমি আমার এই খোলা ছাদে লম্বা কেদারায় শুয়ে শুয়ে, গিরিতটে তোমার দেবদারুবনে ভ্রমণের সুখ মনে মনে সঞ্চয় করি। আমিও প্রায় তোমার বয়সেই হিমালয়ে গিয়েছিলুম,— ড্যাল্হৌসীতে বক্রোটা শিখরের উপরে থাক্তুম। এক একদিন আমাদের বাড়ির খানিক নীচে এক দেবদারু বনে সকালে এক্লা বেড়াতে যেতুম। আমি ছিলুম ছোট্ট (তখন লম্বায় ছ-ফুট ছিলাম না), তাই গাছগুলোকে এত প্রকাণ্ড বড়ো মনে হ’তো—সে আর কী ব’ল্বো? সেই সব গাছের সুদীর্ঘ ছায়ার মধ্যে নিজেকে দৈত্যলোকের অতি ক্ষুদ্র এক অতিথি ব’লে মনে হ’তো। কিন্তু সেই আমার ছেলেবেলাকার পর্ব্বত, ছেলেবেলাকার বন এখন আর পাবো কোথায়? এখন আমার মনটা এই জগতের পথে এত নিজের সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে চলে-যে, নিজের চলার ধূলোয় এবং নিজের রথের ছায়ায় জগৎটা বারো আনা ঢাকা প’ড়ে যায়—বাজে ভাবনার ঝোঁকের মধ্য দিয়ে জগৎটাকে আর তেমন ক’রে দেখা যায় না। তাই আজ তুমি যে-পাহাড়ের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্চো, মনে হ’চ্চে সে আমার সেই অল্প বয়সের পৃথিবীর পাহাড়, আমার সেই ৪৫।৪৬ বৎসরের আগেকার। আমরা পুরাণো হ’য়ে উঠে নিজের হাজার রকম চিন্তায় এই পৃথিবীটাকে যতই জীর্ণ ক’রে দিই না কেন, মানুষ আবার ছেলেমানুষ হ’য়ে, নূতন হ’য়ে, চিরনূতন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। শুধু একদল মানুষ যদি চিরকালই বৃদ্ধ হ’তে হ’তে পৃথিবীতে বাস ক’র্তো, তা হ’লে বিধাতার এই পৃথিবী তাদের নস্যে, তামাকের ধোঁয়ায়, তাদের পাকা বুদ্ধির আওতায়, একেবারে আচ্ছন্ন হ’য়ে যেতো, স্বয়ং বিধাতা তাঁর নিজের সৃষ্টি ঐ পৃথিবীকে চিন্তে পার্তেন না। কিন্তু জগতে শিশুর ধারা কেবলি আস্চে। নবীন চোখ, নবীন স্পর্শ, নবীন আনন্দ ফিরে ফিরে মানুষের ঘরে অবতীর্ণ হ’চ্চে। তাই প্রাচীনদের অসাড়তার আবর্জ্জনা দিনে-দিনে, বারে-বারে, ধুয়ে-মুছে পৃথিবীর চিররহস্যময় নবীন রূপকে উজ্জ্বল ক’রে রাখ্চে। অন্য মানুষের সঙ্গে কবিদের তফাৎ কী, জানো? বিধাতার নিজের হাতে তৈরী শৈশব কবিদের মন থেকে কিছুতে ঘোচে না। কোনোদিন তাদের চোখ বুড়ো হয় না, মন বুড়ো হয় না। তাই চিরনবীন এই পৃথিবীর সঙ্গে তাদের চিরদিনের বন্ধুত্ব থেকে যায়, তাই চিরদিনই তা’রা ছোটোদের সমবয়সী হ’য়ে থাকে। সংসারে বিষয়ের মধ্যে যারা বুড়ো হ’য়ে গেচে, তা’রা চন্দ্রসূর্য্য গ্রহ-তারার চেয়ে বয়সে বড় হ’য়ে ওঠে, তা’রা হিমালয়ের চেয়ে বড়োবয়সের। কিন্তু কবিরা সূর্য্য, চন্দ্র, তারার ন্যায় চিরদিনই কাঁচাবয়সী—হিমালয়ের মতোই তা’রা সবুজ থাকে, ছেলেমানুষীর ঝরণাধারা কোনোদিনই তাদের শুকোয় না; লোকালয়ে বিশ্বজগতের নবীনতার বার্ত্তা এবং সঙ্গীত চিরদিন তাজা রাখ্বার জন্যেই কবিদের দরকার—নইলে তা’রা আর সকল বিষয়েই অদরকারী।
উচ্চ-হাসে সকৌতুকে চির-প্রাচীন গিরির বুকে
ঝ’রে পড়ে চির-নূতন ঝর্ণা;
নৃত্য করে তালে তালে প্রাচীন বটের ডালে ডালে
নবীন পাতা ঘন-শ্যামল-বর্ণা।
পুরাণো সেই শিবের প্রেমে নূতন হ’য়ে এলো নেমে
দক্ষসুতা ধরি’ উমার অঙ্গ,
এম্নি ক’রে সারাবেলা চ’ল্চে লুকোচুরি খেলা
নূতন পুরাতনের চিররঙ্গ।