ভানুসিংহের পত্রাবলী/২৩
২৩
আমার ভ্রমণ শেষ হ’লো। যেখান থেকে যাত্রা আরম্ভ ক’রেছিলুম সেইখানেই আবার এসে ফিরেচি। সকলেই পরামর্শ দিয়ে থাকে, ছুটি পেলেই স্থান এবং বায়ু পরিবর্ত্তন করা দরকার কিন্তু দেখা গেল, সেটা যে অনাবশ্যক এবং ক্লেশকর—সেইটে ভালো ক’রে বুঝে দেখ্বার জন্যেই কেবল পরিবর্ত্তনের দরকার। আসল দরকার, যেখানে আছি সেইখানেই মনটাকে সম্পূর্ণ এবং সচেতন ভাবে ঢেলে দেওয়া। এই-যে মাঠ আমার চোখে প’ড়্চে এর কি দেখ্বার যোগ্য রস ফুরিয়ে গেচে? আর এই-যে শিশিরার্দ্র সকালবেলাটি তা’র কিরণ-দলের মাঝখানে আমার মনকে মধুপানরত স্তব্ধ ভ্রমরের মতো স্থান দিয়েচে, এ কি কোনোকালে এর বৃন্ত থেকে ঝ’রে প’ড়্বে? আসল কথা, মনটা অসাড় হ’লেই তাকে সাড়া দেবার জন্যে নাড়া দিতে হয়। তাই আমাদের সাধনা হওয়া উচিত, কী ক’র্লে আমাদের মন অসাড় না হয় তা হ’লেই নিজের মধ্যে নিজের সম্পদ লাভ ক’র্তে পারি, কেবলি বাইরের জন্যে ছট্ফট্ ক’র্তে হয় না। আমাদের যা কিছু সবচেয়ে বড়ো সম্পদ, সবচেয়ে বড়ো আনন্দ—তা’র ভাণ্ডার যদি বাইরে থাকে তা হ’লে আমাদের ভারি মুস্কিল, কেন না, বাইরের পথে বাধা ঘ’টবেই, বাইরের দরজা মাঝে মাঝে বন্ধ হবেই। বাইরের কাছ থেকে ভিক্ষা চাওয়ার অভ্যাস আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের ইচ্ছা বাইরের দিকে বাধা পেলেও আমরা যেন অন্তরের মধ্যে পূর্ণতা অনুভব ক’রে শান্তি পেতে পারি। নইলে, নিজেও অশান্ত হই—চারিদিককেও অশান্ত ক’রে তুলি। এই সংসার থেকে যে-প্রীতি, যে-কল্যাণ আমরা অন্তরের মধ্যে পেয়েচি সেই আমাদের অন্তরতম লাভের জন্যে যেন আমরা গভীর ভাবে কৃতজ্ঞ হই। বাইরের দিকে যে-কিছু জিনিষ পাইনি, সে-দিক থেকে যা-কিছু বাধা আস্চে, তা’রই ফর্দ্দটাকে লম্বা ক’রে তুলে যদি খুঁৎখুঁৎ করি, ছটফট ক’র্তে থাকি তা হ’লে অকৃতজ্ঞতা হয় এবং সেই চঞ্চলতা নিতান্তই বৃথা নিজের অন্তর-বাহিরকে আবৃত করে মাত্র। স্থির হবো, প্রশান্ত হবো, মনকে প্রসন্ন রাখবো তা হ’লেই আমাদের মন এমন একটি স্বচ্ছ আকাশে বাস ক’র্বে যাতে ক’রে অমৃতলোক থেকে আনন্দ-জ্যোতি আমাদের মনকে স্পর্শ ক’র্তে বাধা পাবে না। তোমার প্রতি তোমার ভানুদাদার এই আশীর্ব্বাদ-যে, তুমি আপনার ইচ্ছাকে একান্ত তীব্র ক’রে চিত্তকে কাঙাল-বৃত্তিতে দীক্ষিত ক’রো না—বিধাতার কাছ থেকে যা-কিছু দান পেয়েছো তাকে অন্তরের মধ্যে নম্র-ভাবে গ্রহণ এবং অবিচলিত ভাবে রক্ষা ক’রো! শান্তি হচ্ছে সত্য উপলব্ধি কর্বার সর্ব্বাপেক্ষা অনুকূল অবস্থা—সংসারের অনিবার্য্য আঘাতে ব্যাঘাতে, ইচ্ছার অনিবার্য্য নিষ্ফলতায় সেই সুস্নিগ্ধ শান্তি যেন তোমার মধ্যে বিক্ষুব্ধ না হয়। ইতি ১০ই কার্ত্তিক, ১৩২৫।