ভানুসিংহের পত্রাবলী/২৪
২৪
এতক্ষণ তুমি রেলগাড়িতে ধক্ ধক্ ক’র্তে ক’র্তে চ’লেচো, কত ষ্টেশন পার হ’য়ে চ’লে গিয়েচো— আমাদের এই লাল মাটির, এই তালগাছের দেশ হয় তো ছাড়িয়ে গেচো বা। আমার পূবদিকের দরজার সাম্নে সেই মাঠে রৌদ্র ধূ ধূ ক’র্চে এবং সেই রৌদ্রে নানা রঙের গোরুর পাল চ’রে বেড়াচ্চে। এক-একটা তালগাছ তাদের ঝাঁক্ড়া মাথা নিয়ে পাগ্লার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আজ দিনে আমার সেই বড়ো চৌকিতে বসা হ’লো না—খাওয়ার পর এণ্ড্রুজ্ সাহেব এসে আমার সঙ্গে বিদ্যালয়ের ভূত-ভবিষ্যৎ- বর্ত্তমানসম্বন্ধে বহুবিধ আলোচনা ক’র্লেন তাতে অনেকটা সময় চ’লে গেল। তা’রপরে নগেনবাবু নামক এখানকার একজন মাষ্টার তাঁর এক মস্ত তর্জ্জমা নিয়ে আমার কাছে সংশোধন কর্বার জন্যে আন্লেন, তাতেও অনেকটা সময় চলে গেল। সুতরাং বেলা তিনটে বেজে গেচে তবু আমি আমার সেই ডেস্কে ব’সে আছি। বই, কাগজ, খাতা, দোয়াত, কলম, ওষুধের শিশি এবং অন্য হাজার রকম জবড়ভঙ্গ্ জিনিসে আমার ডেস্ক পরিপূর্ণ। তা’র মধ্যে এমন অনেক আবর্জ্জনা আছে, যা এখনি টেনে ফেলে দিলেই চলে; কিন্তু কুঁড়ে মানুষের মুস্কিল এই-যে, আবশ্যকের জিনিস সে খুঁজে পায় না আর অনাবশ্যক জিনিস না খুঁজলেও তা’র সঙ্গে লেগেই থাকে। এমন অনেক ছেঁড়া লেফাফা কাগজ চাপা দিয়ে জমানো র’য়েছে যার ভিতরকার চিঠিরই কোনোও উদ্দেশ পাওয়া যায় না। মনে আছে, আমাকে তোমার রূপকথা পাঠিয়ে দিতে হবে সেই অলাবু-নন্দিনীর “কাহিনী” আর সেই “চম্কিলা” “সোনেকিতরহ” চুলওয়ালী রাজকুমারীর কথা। তা ছাড়া, আর একটি কথা মনে রাখ্তে হবে, মন খারাপ ক’রো না — লক্ষ্মী মেয়ে হ’য়ে প্রসন্ন হাসি হেসে ঘর উজ্জ্বল ক’রে থাক্বে। সকলেই ব’ল্বে, তুমি এমন সোনেকিতরহ হাসি পেয়েচো কোন্ পারিজাতের গন্ধ থেকে, কোন্ নন্দন-বীণার ঝঙ্কার থেকে, কোন প্রভাত-তাবার আলোক থেকে, কোন্ সুর-সুন্দরীর সুখস্বপ্ন থেকে, কোন্ মন্দাকিনীর চলোর্ম্মি-কল্লোল থেকে, কোন্—কিন্তু আর দরকার নেই, এখনকার মতো এই ক-টাতেই চ’লে যাবে—কেন না কাগজ ফুরিয়ে এসেচে, দিনও অবসন্ন-প্রায়, অপবাহ্ণের ক্লান্ত রবির আলোক ম্লান হ’য়ে এসেচে। ২ অগ্রহায়ণ, ১৩২৫।