২৫

শান্তিনিকেতন

 কাল তোমার চিঠি পেয়েচি, আমার চিঠিও নিশ্চয় তুমি পেয়েচো। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বেশ হাসিমুখে সেই বাংলা মহাভারত এবং চারুপাঠ প’ড়চো। যে তোমাকে দেখ্‌চে, সেই মনে ক’র্‌চে—চারুপাঠের মধ্যে খুব মনোহর গল্প এবং তোমার শিশু-মহাভারতের মধ্যে খুব মজার কথা কিছু বুঝি আছে। কিন্তু তা’রা জানে না, প্রায় দু-শো ক্রোশ তফাৎ থেকে ভানুদাদা তোমাকে খুসি পাঠিয়ে দিচ্চে—এত খুসি-যে, কার সাধ্য তোমাকে বিরক্ত করে, বা রাগায়, বা দুঃখ দেয়। আমি প্রায়সন্ধ্যাবেলায় সেই-যে গান গাই,—“বীণা বাজাও মম অন্তরে” সেই গানটি তোমার মনের মধ্যে বরাবরকার মতো স্বরলিপি ক’রে লিখে রেখে দেবার ইচ্ছা আছে—মনটি গানের সুরে এমনি বোঝাই হ’য়ে থাক্‌বে-যে, বাহিরের তুফানে তোমাকে নাড়া দিতে পার্‌বে না। শুধু তোমাকে ব’ল্‌চিনে, আমারও ভারি ইচ্ছে, নিজের ভরা মনটির মাঝখানে বেশ নিবিষ্ট হ’য়ে ব’সে বাইরের সমস্ত যাওয়া-আসা কাঁদা-হাসার অনেক উপরে স্থির হ’য়ে থাক্‌তে পারি। আপনার ভিতরে আপনার চেয়ে বড়ো কাউকে যদি ধ’রে রাখা যায় তা হ’লেই সেই ভিতরের গৌরবে বাহিরের ধাক্কাকে একটুও কেয়ার না কর্‌বার শক্তি আপনিই আসে। সেই ভিতরের ধনকে ভিতরে পেয়ে ভিতরে ধ’রে রাখ্‌বার জন্যেই আকাঙ্ক্ষা ক’র্‌চি। বাইরের কাছে যখনই কাঙালপনা ক’র্‌তে যাই তখনই সে পেয়ে বসে, তা’র আর দৌরাত্ম্যের অন্ত থাকে না— সে যতটুকু দেয় তা’র চেয়ে দাবী ঢের বেশি করে— সে এমন মহাজন-যে, শতকরা পাঁচশো টাকা সুদ আদায় ক’র্‌তে চায়। সে শাইলক্, সামান্য টাকা দেয় কিন্তু ছুরি বসিয়ে রক্তে মাংসে তা’র শোধ নেবার দাবী করে। তাই ইচ্ছে করি, বাহিরটাকে ধার দেবো কিন্তু ওর কাছ থেকে সিকি পয়সা ধার নেবো না। এই আমার মৎলবের কথাটা তোমার কাছে ব’লে রাখ্‌লুম। তোমার গণনামতে আমার যখন আটাশ বৎসর বয়স হবে ততদিনে যদি মৎলব সিদ্ধি হয় তা হ’লে বেশ মজা হবে। এখানকার খবর সব ভালো, সাহেব গেচে বাঁকিপুরে, দিনু, কমল এসেচে আমার ঘরের একতলায়, আমি সেই অনুবাদের কাজে ভূতের মতো খাট্‌চি; কিন্তু ভূত-যে খুব বেশি খাটে—এ অখ্যাতি তা’র কেন হ’লো বলো দেখি? কথাটা সত্য হ’লে তো ম’রেও শান্তি নেই।