কলিকাতা

 তুমি দেরি ক’রে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছিলে এতে আমার রাগ করাই উচিত ছিল, কিন্তু রাগ ক’র্‌তে সাহস হয় না—কেননা আমার স্বভবে অনেক দোষ আছে—দেরি ক’রে উত্তর দেওয়া তা’র মধ্যে একটি। আমি জানি তুমি লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি অনেক সহ্য ক’র্‌তে পারো; আমার কুঁড়েমি, আমার ভোলা-স্বভাব, আমার এই সাতান্ন বছর বয়সে যত রকম শৈথিল্য সব তোমাকে সহ্য ক’র্‌তে হবে। আমার মতো অন্যমনস্ক অকেজো মানুষের সঙ্গে ভাব রাখ্‌তে হ’লে খুব সহিষ্ণুতা থাকা চাই—চিঠির উত্তর যত পাবে তার চেয়ে বেশি চিঠি লেখ্‌বার মতো শক্তি যদি তোমার না থাকে, দেনাপাওনা সম্বন্ধে তোমাব হিসাব যদি খুব বেশি কড়াক্কড় হয় তা’হলে একদিন আমার সঙ্গে হয়তো ঝগড়া হ’তেও পারে, এই কথা মনে ক’রে ভয়ে ভয়ে আছি। কিন্তু এ কথা আমি জোর ক’রে বল্‌চি যে, ঝগড়া যদি কোনো দিন বাধে তা’র অপরাধটা আমার দিকে ঘটতে পারে, কিন্তু রাগটা তোমার দিকেই হবে। আর যা’হোক্ আমি রাগী নই। তার কারণ এ নয় যে, আমি খুব ভালোমানুষ, তার কারণ এই যে, আমার স্মরণশক্তি ভারি কম। রাগ কর্‌বার কারণ কী ঘটেছে সে আমি কিছুতেই মনে রাখ্‌তে পারিনে। তুমি মনে ক’রো না কেবল পরের সম্বন্ধেই আমার এই দশা, নিজের দোষের কথা আমি আরো বেশি ভুলি। চিঠির জবাব দিতে যখন ভুলে যাই তখন মনেও থাকে না যে ভুলে গেছি; কর্ত্তব্য ক’র্‌তে ভুলি, ভুল সংশোধন ক’র্‌তেও ভুলি, সংশোধন ক’র্‌তে ভুলেচি তাও ভুলি। এমন অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করো এবং সে বন্ধুত্ব যদি স্থায়ী রাখ্‌তে চাও তাহ’লে তোমাকেও অনেক ভুল্‌তে হবে, বিশেষত চিঠির হিসাবটা।

 পদ্মার ধারের হাঁসেদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হ’লো কী ক’রে জিজ্ঞাসা ক’রেচো। বোধ হয় তা’র কারণ এই যে, বোবার শত্রু নেই। ওরা যখন খুব দল বেঁধে চেঁচামেচি করে আমি চুপ ক’রে শুনি, একটিও জবাব দিইনে। আমি এত বেশি শান্ত হ’য়ে থাকি যে, ওরা আমাকে মানুষ ব’লেই গণ্যই করে না—আমাকে বোধ হয় পাখীর অধম ব’লেই জানে—কেননা আমার দুই পা আছে বটে কিন্তু ডানা নেই। আর যাই হোক্ ওদের সঙ্গে আমার চিঠিপত্র চলে না—যদি চ’ল্‌তো তাহ’লে আমাকেই হার মান্‌তে হ’তো—কেননা ওদের ডানা-ভরা কলম আছে, আর ওদের সময়ের টানাটানি খুব কম।

 তোমাকে-যে এত বড়ো চিঠি লিখ্‌লুম আমার ভয় হ’চ্চে পাছে বিশ্বাস না করো যে আমার সময় কম। অনেক কাজ প’ড়ে আছে—কাজ ফাঁকি দিয়েই তোমাকে চিঠি লিখ্‌চি-কাজ যদি না থাক্‌তো তাহ’লে কাজ ফাঁকি দেওয়াও চল্‌তো না।

 বেলা অনেক হ’য়ে গেছে— অনেক আগে স্নান ক’র্‌তে যাওয়া উচিত ছিল— হাঁসেদের কথায় হঠাৎ স্নানের কথাটা মনে প’ড়ে গেল— তা’হ’লে আজ চল্লুম। আজ রাত্রে বোলপুর যেতে হবে। ইতি—৬ই কার্ত্তিক, ১৩২৪।