৪৬

শিলাইদা

 তুমি আমাকে চিঠি লিখেচো শান্তিনিকেতনে, আমি সেটি পেলুম এখানে অর্থাৎ শিলাইদহে।

 তুমি কখনো এখানে আসোনি, সুতরাং জান্‌তে পারবে না—জায়গাটা কী রকম। বোলপুরের সঙ্গে এখানকার চেহারার কিছুমাত্র মিল নেই। সেখানকার রৌদ্র বিরহীর মতো, মাঠের মধ্যে একা ব’সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেল্‌চে, সেই তপ্ত নিশ্বাসে সেখানকার ঘাসগুলো শুকিয়ে হ’ল্‌দে হ’য়ে উঠেচে। এখানে সেই রৌদ্র তা’র সহচরী ছায়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলেচে; তাই চারিদিকে এত সরসতা। আমাদের বাড়ির সাম্‌নে সিসু-বীথিকায় তাই দিনরাত মর্ম্মরধ্বনি শুন্‌চি, আর কনকচাঁপার গন্ধে বাতাস বিহ্বল, কয়েৎবেলের শাখায় প্রশাখায় নতুন চিকণ পাতাগুলি ঝিল্‌মিল্ ক’র্‌চে, আর ঐ বেণুবনের মধ্যে চঞ্চলতার বিরাম নেই। সন্ধ্যার সময় টুকরো চাঁদ যখন ধীরে ধীরে আকাশে উঠ্‌তে থাকে তখন সুপুরিগাছের শাখাগুলি ঠিক যেন ছোটো ছেলের হাত নাড়ার মতো চাঁদমামাকে টী দিয়ে যাবার জন্যে ইসারা ক’রে ডাক্‌তে থাকে। এখন চৈত্রমাসের ফসল সমস্ত উঠে গিয়েচে, ছাদের থেকে দেখ্‌তে পাচ্চি, চষা মাঠ দিক-প্রান্ত ছড়িয়ে প’ড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কিছু বৃষ্টির জন্যে। মাঠের যে-অংশে বাবলাবনের নীচে চাষ পড়েনি সেখানে ঘাসে ঘাসে একটুখানি স্নিগ্ধ সবুজের প্রলেপ, আর সেইখানে গ্রামের গরুগুলো চ’র্‌চে। এই উদার-বিস্তৃত চষা মাঠের মাঝে মাঝে ছায়াবগুণ্ঠিত এক-একটি পল্লী—সেইখান থেকে আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথ বেয়ে গ্রামের মেয়েরা ঝকঝকে পিতলের কলসী নিয়ে দুটি তিনটি ক’রে সার বেঁধে প্রায় সমস্ত বেলাই জলাশয় থেকে জল নিতে চ’লেচে। আগে পদ্মা কাছে ছিল— এখন নদী বহুদূরে স’রে গেচে—আমার তেতালা ঘরের জানালা দিয়ে তা’র একটুখানি আভাস যেন আন্দাজ ক’রে বুঝ্‌তে পারি, অথচ একদিন এই নদীর সঙ্গে আমার কত ভাব ছিল। শিলাইদহে যখনই আস্‌তুম তখন দিনরাত্তির ঐ নদীর সঙ্গেই আমার আলাপ চ’ল্‌তো; রাত্রে আমার স্বপ্নের সঙ্গে ঐ নদীর কলধ্বনি মিশে যেতো আর নদীর কলস্বরে আমার জাগরণের প্রথম অভ্যর্থনা শুন্‌তে পেতেম। তারপরে কত বৎসর বোলপুরের মাঠে মাঠে কাট্‌লো, কতকাল সমুদ্রের এপারে ওপারে পাড়ি দিলুম—এখন এসে দেখি সে-নদী যেন আমাকে চেনে না। ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে দেখি, মাঝখানে কত মাঠ, কত গ্রামের আড়াল, সবশেষে উত্তর-দিগন্তে আকাশের নীলাঞ্চলের নীলতর পাড়ের মতো একটি বনরেখা দেখা যায়। সেই নীল রেখাটির কাছে ঐ যে একটি ঝাপ্‌সা বাষ্পলেখাটির মতো দেখ্‌তে পাচ্চি, জানি ঐ আমার সেই পদ্মা। আজ সে আমার কাছে অনুমানের বিষয় হ’য়েচে। এই তো মানুষের জীবন। ক্রমাগতই কাছের জিনিস দূরে চলে যায়, জানা জিনিস ঝাপ্‌সা হ’য়ে আসে, আর যে-স্রোত বন্যার মতো প্রাণমনকে প্লাবিত ক’রেচে, সেই স্রোত একদিন অশ্রুবাষ্পের একটি রেখার মতো জীবনের একান্তে অবশিষ্ট থাকে।

 এখন বেলা ফুরিয়ে এসেচে, অল্প একটুখানি মেঘেতে আকাশ ঢাকা, দিনাবসানেও বাগানে পাখীর ডাকে একটুও ক্লান্তি দেখ্‌চিনে। দুই কোকিলে কেবলি জবাব চ’লেচে, কেউ হার মান্‌তে চাচ্চে না—তা ছাড়া আরও অনেক পাখী ডাক্‌চে, তাদের ডাক স্পষ্ট ক’রে চেনা যায় না। সকলের ডাক মিশিয়ে জড়িয়ে গেচে, অন্য দিনের মতো বাতাস আজ দুরন্ত নয়, ঝাউগাছগুলি স্তব্ধ এবং নিঃশব্দ হ’য়ে গেচে। আজ অষ্টমীর চাঁদ দেখ্‌চি মেঘের পর্দ্দার আড়ালে রাত্রিযাপন ক’রবে।

 আমার ঘরের দক্ষিণদিকে ঐ ছাদে একটি কেদারা পাতা আছে—ঐখানে সন্ধ্যার সময় আমি গিয়ে বসি। এ কয়দিন দ্বিতীয়ার চাঁদ থেকে আরম্ভ ক’রে অষ্টমীর চাঁদ পর্য্যন্ত প্রত্যেকেই উদয়কালে এই কবির সঙ্গে মুকাবিলা ক’রেচে। ঐ চাদ হ’চ্চে আমার জন্মদিনের অধিপতি। আমি যখন ছাদে বসি তখন আমার বামে পূর্ব্ব আকাশ থেকে বৃহস্পতি আমার মুখের দিকে তাকায় আর পশ্চিম আকাশ থেকে চন্দ্রমা। —এইবার ক্রমে একটু অন্ধকার হ’য়ে আস্‌চে—ঘরের মধ্যকার এই ঘোলা আলোয় আর দৃষ্টি চ’ল্‌চে না, বাইরে গিয়ে বস্‌বার সময় হ’লো।

 তুমি আমার কাছে বড়ো চিঠি চেয়েছিলে, বড়ো চিঠিই লিখ্‌লুম। লিখ্‌তে পার্‌লুম, তা’র কারণ এখানে অবকাশ আছে। কিন্তু এই চিঠি যখন ডাকে দেবো, অর্থাৎ কাল বৃহস্পতিবারে,—ক’ল্‌কাতায় রওনা হবো। সেখানে ট্রাম আছে, মোটর আছে, ইলেক্‌ট্রিক্-পাখা আছে; সময় নেই। তা’রপরে বোলপুরে যাবো, —সেখানে শালের বনে ফুল ফুটেচে, আমবাগানে ফল ধ’রেচে; সেখানে মাঠ আছে বিস্তীর্ণ, আকাশ আছে অবারিত, কিন্তু সেখানেও অবকাশ নেই।

 চিঠি জিনিসটা ছোট্ট, মালতী-ফুলের মতো, কিন্তু সেই চিঠি যে-আকাশের মধ্যে ফুটে ওঠে সেই আকাশ মালতী-লতারই মতো বড়ো। আমাদের যত কেজো লোকের অবকাশ টবের গাছ, তা’র থেকে যে-সব পত্রোদ্গম হয় সে তো পোষ্টকার্ডের চেয়ে বড়ো হ’তে চায় না। ইতি ২২ চৈত্র, ১৩২৮।