৪৫

 আমি নদীপথে কয়েকদিন কাটিয়ে এলুম—কাল রাত্রে ফিরে এসেচি। আজ সকালে দেখি, এখানে তোমার চিঠি আমার জন্যে অপেক্ষা ক’র্‌ছিলো। তুমি জানো—আমি নদী ভালোবাসি। কেন, ব’ল্‌বো? আমরা যে-ডাঙার উপরে বাস করি, সে-ডাঙা তো নড়ে না, স্তব্ধ হ’য়ে প’ড়ে থাকে, কিন্তু নদীর জল দিনরাত্রি চলে, তা’র একটা বাণী আছে। তা’র ছন্দের সঙ্গে আমাদের রক্ত-চলাচলের ছন্দ মেলে, আমাদের মনে নিরন্তর যে-চিন্তাস্রোত ব’য়ে যাচ্চে সেই স্রোতের সঙ্গে তা’র সাদৃশ্য আছে—এই জন্যে নদীর সঙ্গে আমার এত ভাব। বয়স যখন আরো কম ছিল, তখন কতকাল নৌকায় কাটিয়েচি, কোনো জনমানব আমার কাছেও থাক্‌তো না, পদ্মার চরের উপরকার আকাশে সন্ধ্যাতারা আমার জন্যে অপেক্ষা ক’রে থাক্‌তো; প্রতিবেশী ছিল চক্রবাকের দল; তাদের কলালাপ থেকে আর কিছু বুঝি বা না বুঝি, এটুকু জান্‌তুম আমার সম্বন্ধে কোনো জনরব তা’রা রটাতো না—এমন কি, আমার জয়-পরাজয় নামক গল্পের নায়ক-নায়িকার পরিণাম সম্বন্ধে তা’রা লেশমাত্র কৌতুহল প্রকাশ ক’র্‌তো না।

 যা হোক, তেহি নো দিবস গতাঃ, এখন বোলপুরের শুষ্ক ধূসর মাঠের মধ্যে ব’সে ইস্কুল-মাষ্টারি ক’র্‌চি; ছেলেগুলোর কলরব চক্রবাকের কল-কোলাহলকে ছাড়িয়ে গেছে। তুমি মনে ক’রো না, এখানে কোনো স্রোত নেই; এখানে অনেকগুলি জীবনের ধারা মিলে একটি সৃষ্টির স্রোত চ’লেচে; তা’র ঢেউ প্রতি মুহুর্ত্তে উঠ্‌চে, তা’র বাণীর অন্ত নেই। সেই স্রোতের দোলায় আমার জীবন অন্দোলিত হ’চ্চে, আপনার পথ সে কাট্‌চে, দুইতটকে গ’ড়ে তুল্‌চে। সে কোন্ এক অলক্ষ্য মহাসমুদ্রের দিকে চ’লেচে, দূর থেকে আমরা তা’র বার্ত্তার আভাস পাই মাত্র। ইতি ২২শে পৌষ, ১৩২৮।